এই সব লৌহমানব-মানবী by হাসান ফেরদৌস
বলা
হতো, তাঁর দলে খালেদা জিয়া একাই পুরুষ, বাকি সবাই মিনমিনে বিড়াল। সেই
খালেদা জিয়ার চোখে দেখলাম জল। এর আগে আরেকবার তাঁর চোখে জল দেখেছিলাম।
সেবার সরকার খালেদার একটি বাড়ি নিজের হেফাজতে ফিরিয়ে নিয়েছিল। বাড়ি হারিয়ে
তিনি হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন। এবার অবশ্য তাঁর প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি
লৌহমানবী-সুলভ, মাত্র কয়েক ফোঁটা জল। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় শেষ
পর্যন্ত তাঁকে জেলে যেতে হবে, এমন কথা হয়তো ভাবেননি। খালেদা জিয়াকে জেলে
পাঠালে আকাশ ভেঙে পড়বে, এমন আশঙ্কা কেউ কেউ ব্যক্ত করেছিলেন। হয়তো তিনি
নিজেও সে কথা বিশ্বাস করতেন। অথচ কিছুই হয়নি। বড় কোনো অঘটন না ঘটলে এই
লৌহমানবীর রাজনৈতিক জীবনের এটাই শেষ অধ্যায় কি না, সেই প্রশ্নও স্বাভাবিক।
এমন অনেকে আছেন যাঁরা মনে করেন, ফুটবল বা ক্রিকেট খেলায় যেমন পিছিয়ে থেকেও
কোনো কোনো দল ‘কামব্যাক’ করে থাকে, তিনিও করবেন। রাজনীতিতে নাকি শেষ কথা
বলে কিছু নেই। অতএব এ কথা সত্যি হলে হতেও পারে। তবে তাঁর বয়স তো বাড়ছে বৈ
কমছে না। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের
মতো দেশে ক্ষমতাবানেরা কখনোই অপরাধ করে শাস্তি পান না, এবার এর একটি
ব্যতিক্রম ঘটল।
এমন ঘটনা ঘটল, এর কারণ অবশ্য এই নয় যে বাংলাদেশে অবশেষে
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। খালেদার দল ক্ষমতায় থাকলে এমন ঘটনা কিছুতেই
ঘটত না, এ কথা মহামূর্খও জানে। এই কথা বলে অবশ্য ঘটনাটির রাজনৈতিক গুরুত্ব
খাটো করে দেখা ঠিক হবে না। একটি বিচার-প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এই মামলার রায়
হয়েছে, প্রায় ১০ বছর লেগে গেছে পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে। কোনো বিশেষ
আদালতে নয়, গোপন কোনো প্রক্রিয়ায় নয়, নিম্ন আদালতে সবার উপস্থিতিতে
সাক্ষী-সাবুদ নিয়েই পুরো কাজটি শেষ হয়েছে। ফলে অনেকের আশা, ক্ষমতাবানদের
আইনের শাসনের ভেতরে টেনে আনার একটি উদাহরণ সৃষ্টি হলো। এটি যে কোনো
ব্যতিক্রম নয়, এখন দরকার এই কথা প্রমাণ করা। অনেকে বলেছেন, মাত্র দুই কোটি
টাকার মামলা, চোখের ওপর দিয়ে যে হাজার হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, তার
বেলায় কী? খুব ন্যায্য কথা। আমরা আশা করি-আশা নয়, দাবি করি, সেসব মামলাও এক
এক করে মীমাংসা হবে। কিন্তু এই বাহানা দিয়ে দুই কোটি টাকা তছরুপের এই
মামলার ব্যাপারে চোখ বুজে থাকব, সে-ও কোনো কাজের কথা নয়। অনেকে বলেছেন,
আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। তাঁদের অভিযোগ, এই রায়
ওপর মহল থেকে কলকবজা নেড়ে আগেভাগেই ঠিক করে রাখা ছিল। ওপর মহল যদি কলকবজা
নাড়ার কথাই ভেবে থাকে, তাহলে এত লম্বা সময় ধরে এই প্রক্রিয়া চালু রাখল কেন?
বাদীপক্ষ এই মামলা যতটা সম্ভব লম্বা করার চেষ্টা করেছে, নানা যুক্তিতে
কালক্ষেপণ করেছে। সরকারপক্ষ তাতে আপত্তি তোলেনি, বরং মনে হয়েছে দক্ষ
শিকারিরা মাছ ধরার সময় যেমন হুইল থেকে সুতো ছেড়ে মাছকে খেলিয়ে ক্লান্ত করে
তারপর ঘপাৎ করে তাকে ধরে বসেন, এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। রাজনৈতিক
পক্ষপাতদুষ্টতার কথা যদি ওঠে তাহলে বলতে হয়, পৃথিবীর কোনো আদালত নেই,
যেখানে রায় নিয়ে এই একই অভিযোগ ওঠে না। আমি যে দেশে থাকি, সেই আমেরিকায়
প্রতিটি মামলার ফলাফল ঘোষণার সময় সব প্রতিবেদনে অবধারিতভাবে উল্লেখ থাকে,
বিচারকদের কজন রিপাবলিকান, কজন ডেমোক্রেটিক। কিছুদিন আগে পেনসিলভানিয়া
অঙ্গরাজ্যের শীর্ষ আদালত রায় দিয়েছেন, রিপাবলিকান দল এই রাজ্যের আইন পরিষদ
নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহার করে বেআইনিভাবে নির্বাচনী এলাকা ভাগাভাগি
করেছে। রায় ঘোষণার পর জানা গেল, নয়জন বিচারকের সাতজন ডেমোক্রেটিক, দুজন
রিপাবলিকান। ডেমোক্রেটিক সাতজনই রায়ের পক্ষে, বাকি দুই রিপাবলিকান বিচারক
রায়ের বিপক্ষে। এই রায় নিয়ে তর্ক হয়েছে, মৃদু প্রতিবাদ হয়েছে, এমনকি আইনি
চ্যালেঞ্জও করা হয়েছে, কিন্তু তাতে রায়ের কার্যকারিতা বাতিল হয়নি। এ দেশের
আইনব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ, কাউকে এমন কথা বলতেও শুনিনি। বাংলাদেশের দলীয়
রাজনীতির দুই বৈশিষ্ট্য-পরিবারতন্ত্র ও গণতন্ত্রহীনতা। এই রায়ের ফলে তা আরও
নোংরাভাবে প্রকাশিত হলো। অনেকে আশা করেছিলেন, খালেদার হাজতবাসের ভেতর দিয়ে
তাঁর রাজনৈতিক দলে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে, আসেনি। কার নেতৃত্বে এখন দল
চলবে সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর এখনো মেলেনি। দলের এক নেতা অবশ্য খালেদা
জিয়ার অবর্তমানে তারেক রহমানের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। আমাদের
রাজনৈতিক স্মৃতি এমনিতে বড় ক্ষণস্থায়ী। খালেদা জিয়ার এই সুপুত্র ক্ষমতায়
থাকার সময় কী কাণ্ড করেছিলেন,
সে কথা হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন। এই জিয়া
অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার সূত্রে আমাদের আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো মাত্র
দুই কোটি টাকা, যা এঁদের জন্য হাতের ময়লা বৈ অন্য কিছু নয়, এই পরিবারের
সদস্যরা সেটার ভাগ ছাড়তেও রাজি নন। এই মামলার ফলে তারেকেরও শাস্তি হয়েছে।
বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ায় জেলের ঘানি হয়তো তাঁকে টানতে হবে না, কিন্তু
তাঁর ছবির ওপর যে ‘ধরিয়ে দিন’ ছাপখানা বসে গেল, তা মেটাবেন কী করে, সে
বুদ্ধি তো আমার মাথায় আসে না। তারপরও তিনি দলের অস্থায়ী প্রধান। এই মামলার
সূত্র ধরে বিএনপির জন্য একটা সুযোগ ছিল পরিবারতন্ত্র কাটিয়ে দলকে নতুনভাবে
গড়ে তোলার। বিএনপি যদি দলের নেতৃত্বে কিছুমাত্র গণতন্ত্রচর্চার অভ্যাস চালু
রাখত, তাহলে হয়তো দেশের এই প্রধান দলটি নতুন পথ ধরে চলার সুযোগ পেত। এই
দলে পরিবারতন্ত্রের অবসান হলে হয়তো অপর প্রধান দলেও সে চর্চা বন্ধ হতো।
কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। এই স্থবিরতা সত্ত্বেও এ রায়ের মাধ্যমে
পরিবর্তনের সম্ভাবনার একটি ইঙ্গিত মিলছে। না, দলগুলো নিজ থেকে কোনো কিছুই
বদলাবে না। যাঁরা ক্ষমতাসীন, শত অপরাধের পর আইনের হাত তাঁদের টিকিটিও ছুঁতে
পারবে না। কিন্তু এই রায়ের সূত্র ধরে আমরা ওপর মহল কীভাবে ক্ষমতার
অপব্যবহার করে নিজেদের পকেট ভারী করে, তার একটা স্পষ্ট চিত্র পেয়েছি। এই
মামলার সূত্র ধরেই আমরা তাদের অপব্যবহারের ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া শুরু
করেছি। দাবি উঠেছে হল-মার্ক বা বেসিক ব্যাংকের হাজার কোটি টাকার হাতবদল
তদন্তের। সামনে নির্বাচন আসছে। জনগণের হাতে তুরুপের তাস এখনো একটি আছে। এর
সঠিক ব্যবহার হলে পরিবর্তনের পথে প্রথম পাথরটি ছোড়া আমাদের পক্ষেও সম্ভব
হবে।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি
No comments