নজরদারি ও নজরহীনতার রাজনীতি by জোবাইদা নাসরীন
গত
কয়েক দিন আমাদের চোখ যখন আটকে ছিল টেলিভিশনে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর এবং
একটি আলোচিত রায়ের দিকে। অনেকে যখন ক্যালকুলেটর নিয়ে বসে গেছেন নির্বাচনের
বাকি দিন গুনতে এবং রাজনীতির অঙ্ক মেলাতে, ঠিক সেই সময়ে নিজের চোখের দৃষ্টি
ফিরিয়ে আনার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ
মুসলিম হলের ছাত্র এহসান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। প্রায় নিভে যাওয়া ফোলা চোখের আহত এহসানের
ছবি ঘুরেছে ফেসবুকে, কিন্তু ঘটনাটি আমাদের সংগঠিত করেনি। কারণ, আমরা তখন
ব্যস্ত ফেসবুকে অন্য কিছু পড়তে কিংবা রাজনীতির নগদ ভাজা খবর গিলতে। আমরা
অনেকেই জেনে গেছি যে ঘটনার সূত্রপাত একটি ক্যালকুলেটরকে ঘিরে। এহসানের কাছ
থেকে একটি ক্যালকুলেটর ধার নিয়েছিলেন বহিষ্কৃত ছাত্রলীগের নেতা ওমর ফারুক।
ঘটনার দিন গভীর রাতে ক্যালকুলেটর ফেরত চাওয়া নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রথমে
বাদানুবাদ, তারপর বেদম পেটানো। এটা কোনো মারামারি ছিল না, কারণ যখন অনেকজন
মিলে একজনকে মারে, তখন সেটি আর মারামারি হয় না, সেটি হয়ে যায় মার দেওয়া
কিংবা মার খাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নতুনদের ওস্তাদীয় ‘আদবকায়দা’
শেখানোর দায়িত্ব নেওয়া সিনিয়র ছাত্রদের হাতে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে মার এবং
নানা রকম শাস্তি পাওয়া এখন আর তেমন নতুন কোনো ঘটনা নয়। সেই সঙ্গে বাম
সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের জন্য দুই-চারটা চড়থাপ্পড়ও বরাদ্দ আছে। আর কোনো
নৈতিক আন্দোলনে হলে বসবাসকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তাঁদের জন্য
নিশ্চিতভাবেই ভয়ভীতি ডেকে আনে। এই ভয়ভীতি ও মারধরের আশঙ্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে
সাধারণ কিন্তু চিন্তা-চেতনায় অসাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের দাবিদাওয়ার
মিছিলে আনতে এখন ভীত থাকে। এভাবেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনকে, জীবনের
স্বপ্নগুলোকে প্রতিনিয়তই গলা টিপে হত্যা করার দিকে নিয়ে যাচ্ছি।
তবে এবারের
ঘটনাটি অন্য সব ছেলে শিক্ষার্থীদের হলে হরহামেশাই ঘটে যাওয়া ‘ছোটখাটো’ মার
খাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এহসানকে ওমর ফারুক এবং তাঁর বন্ধুরা রড
দিয়ে বেদম পিটিয়েছেন। এ সময় এহসান চোখে মারাত্মক আঘাত পান এবং অজ্ঞান হয়ে
যান। তাঁকে একজন নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেলে। আবারও নিয়ে আসা হয় নির্যাতকদের
রুমে। সেখান থেকে এহসান কোনোভাবে বের হয়ে আসেন। বর্তমান খবর অনুযায়ী, এহসান
রফিকের চোখের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিকিৎসকেরা চিন্তিত। তবে আমরা এ নিয়ে খুব
চিন্তিত বলে মনে হয় না। কারণ, সিদ্দিকুর বা এহসানরা নন; আসলে আমরাই সম্ভবত
আমাদের চোখ হারাচ্ছি। আমাদের চোখ কোনটা দেখবে আর কোনটা দেখবে না, সেটি আমরা
স্থির করে রাখি। দেখা-অদেখার এক জটিল রাজনীতিতেই আমরা অভ্যস্থ হয়ে পড়ছি।
এহসানকে মারধরের ঘটনায় এসএম হল ছাত্রলীগের তিন নেতাকে বহিষ্কার করেছে
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। এঁদের মধ্যে রুহুল আমিন ও ওমর ফারুক হল শাখা
ছাত্রলীগের সহসম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। আর মেহেদী হাসান হিমেল পালন
করছিলেন উপপ্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব। তবে এহসানের ওপর নির্যাতনের
ঘটনাকে ‘বৈধতা’ দিতে বলা হচ্ছে যে সে শিবির করত, যদিও কোনোভাবেই তার প্রমাণ
মেলেনি। আর কেউ শিবির করলেই তাঁকে পিটিয়ে প্রায় অন্ধ বানানোর দায়িত্ব কে
কাকে দিল? কবে থেকে ছাত্রলীগ এই দায়িত্ব নিল? তবে এই বিষয়ে প্রতিবাদও এসেছে
এ সংগঠনের সেই হলের সভাপতির কাছ থেকে। আর এর মধ্য দিয়েই প্রকাশ্য হয়ে
পড়েছে এসএম হলের ছাত্রলীগের দুই নেতার মধ্যকার বিরোধ।
দুই. সেই বিরোধ নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই, ক্ষমতাবানদের মধ্যে বিরোধ থাকবেই। ঢাকার মধ্যকার তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে রয়েছে এই র্যাগিংচর্চা। শিক্ষার্থীদের হল না থাকার কারণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে এখনো এই চর্চা তেমন করে রপ্ত করতে পারেনি বলা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭ তম ব্যাচের এক ছাত্রকে মানসিক নির্যাতন করেছেন ওই বিভাগের ৪৬ তম ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থী মো. মিজানুর রাহমান কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষে সদ্য ভর্তি হয়েছেন। মিজানুরের বন্ধুরা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, বিভাগের ৪৬ তম আবর্তনের শিক্ষার্থীরা তাঁদের (৪৭ তম আবর্তন) সঙ্গে পরিচিত হওয়ার নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন (সমকাল, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)। মানসিকভাবে ছেলেটি এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যে তিনি তাঁর পিতাকে দেখে চিনতে পারছেন না। যাঁরা ছেলেটিকে নির্যাতন করেছেন, তাঁরা বলছেন, ‘গণরুমে অসুস্থ হয়ে যাওয়া ছেলেটি আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন, তাঁর সঙ্গে এমন কিছুই করা হয়নি।’ কবে থেকে শিক্ষার্থীরা নিজেদের চিকিৎসক, বিভিন্ন দলীয় সনদ বিতরণকারী কিংবা ‘আদবকায়দা’ শেখানো কিংবা ‘বাপের নাম ভুলিয়ে’ দেওয়ার সামাজিক ‘মুরব্বি’র দায়িত্ব হাতে পেলেন? কারাই-বা তাঁদের এই ধরনের নির্যাতন করার বৈধতার স্বীকৃতি দিল?
তিন. বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন এহসান দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে, এখন সেই চোখই ক্ষতবিক্ষত বন্ধ। ঠিক একইভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে আসা ছেলেটির জীবনও হয়তো হারিয়ে যাবে র্যাগিং নামের এক যন্ত্রণার অংশ হয়ে। শুধু মিজানুরই নন, এই রকম হয়তো আরও অনেকেই এর মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, ভয়ে মুখ খোলেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বিনীত অনুরোধ করছি, আপনারা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর দেখভাল করার দায়িত্বে আছেন, তাঁদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনারা যদি এই ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতনের ব্যাপারে অন্যমনস্ক থাকেন, তাহলে আমাদের আসলেই বুঝে নিতে হবে প্রশাসনের আশকারাতেই র্যাগিং হচ্ছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর স্বীয় মর্যাদার ওপর ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব জায়গায় পা ফেলার অধিকার আছে, আছে নিরাপদে শিক্ষাজীবন পার করার দৃঢ় স্বপ্ন। সে স্বপ্নই ফিকে হয়, বর্ণহীন হয় নানা ঘূর্ণিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তবে কী দুঃস্বপ্নই হয়ে যাচ্ছে...জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়টি তবে কী ভয়ের প্রাচীরেই ঢাকা থাকবে?
জোবাইদা নাসরীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
zobaidanasreen@gmail.com
দুই. সেই বিরোধ নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই, ক্ষমতাবানদের মধ্যে বিরোধ থাকবেই। ঢাকার মধ্যকার তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে রয়েছে এই র্যাগিংচর্চা। শিক্ষার্থীদের হল না থাকার কারণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে এখনো এই চর্চা তেমন করে রপ্ত করতে পারেনি বলা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭ তম ব্যাচের এক ছাত্রকে মানসিক নির্যাতন করেছেন ওই বিভাগের ৪৬ তম ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থী মো. মিজানুর রাহমান কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষে সদ্য ভর্তি হয়েছেন। মিজানুরের বন্ধুরা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, বিভাগের ৪৬ তম আবর্তনের শিক্ষার্থীরা তাঁদের (৪৭ তম আবর্তন) সঙ্গে পরিচিত হওয়ার নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন (সমকাল, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)। মানসিকভাবে ছেলেটি এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যে তিনি তাঁর পিতাকে দেখে চিনতে পারছেন না। যাঁরা ছেলেটিকে নির্যাতন করেছেন, তাঁরা বলছেন, ‘গণরুমে অসুস্থ হয়ে যাওয়া ছেলেটি আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন, তাঁর সঙ্গে এমন কিছুই করা হয়নি।’ কবে থেকে শিক্ষার্থীরা নিজেদের চিকিৎসক, বিভিন্ন দলীয় সনদ বিতরণকারী কিংবা ‘আদবকায়দা’ শেখানো কিংবা ‘বাপের নাম ভুলিয়ে’ দেওয়ার সামাজিক ‘মুরব্বি’র দায়িত্ব হাতে পেলেন? কারাই-বা তাঁদের এই ধরনের নির্যাতন করার বৈধতার স্বীকৃতি দিল?
তিন. বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন এহসান দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে, এখন সেই চোখই ক্ষতবিক্ষত বন্ধ। ঠিক একইভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে আসা ছেলেটির জীবনও হয়তো হারিয়ে যাবে র্যাগিং নামের এক যন্ত্রণার অংশ হয়ে। শুধু মিজানুরই নন, এই রকম হয়তো আরও অনেকেই এর মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, ভয়ে মুখ খোলেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বিনীত অনুরোধ করছি, আপনারা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর দেখভাল করার দায়িত্বে আছেন, তাঁদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনারা যদি এই ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতনের ব্যাপারে অন্যমনস্ক থাকেন, তাহলে আমাদের আসলেই বুঝে নিতে হবে প্রশাসনের আশকারাতেই র্যাগিং হচ্ছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর স্বীয় মর্যাদার ওপর ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব জায়গায় পা ফেলার অধিকার আছে, আছে নিরাপদে শিক্ষাজীবন পার করার দৃঢ় স্বপ্ন। সে স্বপ্নই ফিকে হয়, বর্ণহীন হয় নানা ঘূর্ণিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তবে কী দুঃস্বপ্নই হয়ে যাচ্ছে...জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়টি তবে কী ভয়ের প্রাচীরেই ঢাকা থাকবে?
জোবাইদা নাসরীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
zobaidanasreen@gmail.com
No comments