তবু সব ক্লাসে প্রথম
জন্ম
থেকে দুটি হাত ও ডান পা নেই। যে একটি পা আছে, তা দিয়ে সে লেখে। সুন্দর করে
ছবি আঁকে। পা দিয়ে লিখেই সব পরীক্ষায় প্রথম সে। অদম্য ইচ্ছা আর নিরলস
প্রচেষ্টায় প্রতিবন্ধিতা জয় করে এগিয়ে চলেছে তামান্না আক্তার। তামান্না
আক্তার যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামের রওশন আলী ও খাদিজা
পারভীনের মেয়ে। তামান্না বাঁকড়া জনাব আলী খান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম
শ্রেণির ছাত্রী। রওশন আলী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। খাদিজা পারভীন গৃহিণী। তাঁদের
তিন ছেলেমেয়ে। তামান্না সবার বড়। ছোট বোন মুমতাহিনা রশ্মি দ্বিতীয় শ্রেণিতে
পড়ে। ভাই মুহিবুল্লা তাজের বয়স তিন বছর। তামান্না আক্তার গত বৃহস্পতিবার
প্রথম আলোকে বলে, ‘আমার ইচ্ছা মানুষের মতো মানুষ হওয়ার। এ জন্য আমি ডাক্তার
হতে চাই। মানুষের সেবা করতে চাই। মা-বাবা ছাড়াও স্কুলের স্যার ও বন্ধুরা
আমাকে খুব অনুপ্রেরণা দেন। সহযোগিতা করেন।’ তামান্নার মা খাদিজা পারভীন
বলেন, ‘২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর তামান্নার জন্ম। ওর জন্মের পর কষ্ট
পেয়েছিলাম। পরে ভেবেছি, ওকে কারও বোঝা হতে দেওয়া ঠিক হবে না। ছয় বছর বয়সে
ওর পায়ে কাঠি দিয়ে লেখানোর চেষ্টা করলাম। কলম দিলাম। কাজ হলো না। এরপর মুখে
কলম দিলাম। তাতেও কাজ হলো না। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, ওকে পা দিয়েই লেখাতে
হবে। এরপর ওকে বাড়ির কাছে একটি বেসরকারি সংস্থার স্কুলে নিয়ে গেলাম ভর্তি
করতে। কিন্তু প্রতিবন্ধী বলে তারা ভর্তি করল না। তাদের বললাম, শুধু দুই মাস
এখানে ও ক্লাস করবে। তাতেও তারা রাজি হলো না। এরপর স্কুলটির এক শিক্ষিকাকে
বলে দুই মাস ক্লাস করালাম। সেখান থেকে ওকে বাঁকড়া আজমাইন এডাস স্কুলে
ভর্তি করালাম। মাত্র দুই মাসের মাথায় ও পা দিয়ে লিখতে শুরু করল। এরপর ছবি
আঁকা শুরু করল। এ বিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা
সমাপনী পরীক্ষায় (পিইসি) জিপিএ-৫ পায় তামান্না। বৃত্তিও পায়।’
আজমাইন এডাস
স্কুলের তৎকালীন অধ্যক্ষ ফারহানা আফরোজ বলেন, তামান্না কারও কাছে প্রাইভেটও
পড়ত না। তারপরও ও সব ক্লাসে প্রথম হতো। খাদিজা পারভীন বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণি
পাসের পর তামান্নাকে বাঁকড়া জনাব আলী খান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা
হয়। সেখান থেকে অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় (জেএসসি) সে জিপিএ-৫ পায়।
বিজ্ঞান বিভাগে পড়ছে। কিন্তু ওকে পড়ানোর সামর্থ্য আমাদের নেই। টাকা থাকলে
ওকে ভালো করে মানুষ করতে পারতাম। গান শেখাতে পারতাম। ওর মধ্যে প্রতিভা আছে।
চর্চা করেই আজ এ পর্যন্ত এসেছে। ওকে নিয়ে আমি আশাবাদী।’ তামান্নার বাবা
রওশন আলী বলেন, ‘মেয়েটার জন্য কোনো কাজ করতে পারি না। সারাক্ষণ ওর দিকে
খেয়াল রাখতে হয়। শরীরে একটা মশা পড়লেও ও তাড়াতে পারে না। প্রতিদিন আমি আর
ওর মা ওকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে স্কুলে দিয়ে আসি। ছুটি হলে নিয়ে আসি। কিন্তু
ছেলেদের সাথে ক্লাস করতে ওর অসুবিধা হয়। পোশাক সরে গেলে ও ঠিক করতে পারে
না। একা শৌচাগারে যেতে পারে না। মেয়েদের সাথে নিচতলায় ওর ক্লাস হলে ভালো
হতো।’ বাঁকড়া জনাব আলী খান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হেলাল
উদ্দীন বলেন, ‘তামান্না প্রতি ক্লাসেই প্রথম হয়ে আসছে। ওর লেখা স্পষ্ট,
দৃষ্টিনন্দন। সুন্দর ছবি আঁকে। আশা করি, এসএসসি পরীক্ষায়ও তামান্না ভালো
করবে। বিদ্যালয় থেকে সব রকম সুবিধা ওকে দেওয়া হয়। সহপাঠীরা ওকে খুব
সহযোগিতা করে। এরপরও ওর সুবিধার্থে মেয়েদের ক্লাস নিচতলায় আনার ব্যাপারে
শনিবার মিটিং করব। তাহলে ও মেয়েদের সাথে ক্লাস করতে পারবে।’
No comments