ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি : ট্রাম্পের গোমর ফাঁস
যুক্তরাষ্ট্রের
রাজনীতিতে ঝড় তুলেছে মাইকেল উলফের নতুন বই ‘ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি: ইনসাইড
দ্য ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ’। বইটি বাজারে আসার দিনই প্রকাশিত দেড় লাখ কপির সব
বিক্রি হয়ে গেছে। আগাম অর্ডার জমা পড়েছে ১০ লাখের বেশি। এ ছাড়া কয়েক লাখ
পিডিএফ ফাইল বিক্রি হয়েছে বলে নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা হেনরি
হল্ট অ্যান্ড কোম্পানি জানিয়েছে। অডিও বুক বিক্রি হয়েছে এক লাখের মতো।
বইটিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা মানুষ লুফে
নিয়েছে। বইটির প্রকাশনা ঠেকাতে ট্রাম্পের আইনি তৎপরতা বইয়ের কাটতি আরো
বাড়িয়ে দিয়েছে। বিবিসির উত্তর আমেরিকা বিষয়ক সম্পাদক জন সোপেল বলেছেন,
‘বইতে যা লেখা হয়েছে তার অর্ধেকও যদি সত্য হয় তাহলে বুঝতে হবে প্রেসিডেন্ট
মারাত্মক মতিভ্রমে আছেন আর হোয়াইট হাউজে চলছে বিশৃঙ্খলা’। শুরু থেকে একের
পর এক বিতর্কে বিপর্যস্ত ট্রাম্পকে নিয়ে নতুন করে যে আরো বিতর্ক চলবে সেটি
বোঝাই যাচ্ছে। বইয়ে আলোচিত কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো :
১. রুশ সংযোগ ও স্টিভ ব্যানন
ট্রাম্প প্রশাসনের সবচেয়ে প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন সাবেক রাজনৈতিক কৌশলবিদ স্টিভ ব্যানন। বইটিতে অনেক বক্তব্য আছে হোয়াইট হাউজের সাবেক এই কর্মকর্তার। ধারণা করা হচ্ছে মাইকেল ওলফ তার কাছ থেকেই প্রচুর তথ্য নিয়েছেন বইয়ের জন্য। তার উদ্বৃতি দিয়েই রুশ সংযোগ বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। ব্যানন বলেছেন, ট্রাম্পপুত্র নির্বাচনের আগে রুশ নাগরিকের সাথে বৈঠক করেছেন। তিনি নিজেই লেখকের কাছে ওই বৈঠক ‘রাষ্ট্রদ্রোহমূলক’ ও ‘দেশপ্রেমহীন’ ছিল বলে উক্তি করেছিলেন। এরপর ট্রাম্প বৈঠকে অংশ নেয়াদের তার বাবার অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন বলেও কথিত আছে। বইয়ে ফক্স নিউজের তৎকালীন প্রধান রজার এলিস ও স্টিভ ব্যাননের একটি নৈশ ভোজের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক মাইকেল উলফ। সেখানে ব্যানন বলেছেন, তিনি রাশিয়া সফর করেছিলেন পুতিনের সাক্ষাৎ পাওয়ার আশায়, তবে পুতিন তাকে সময় দেননি। তবু পুতিনের সাথে ঘনিষ্ঠতা অর্জন করতে তাকে চাপে রাখা হয়েছিলা। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ কর্মসূচির কারিগর ছিলেন এই ব্যানন।
২. অভিষেক অনুষ্ঠান নিয়ে অসন্তোষ
ট্রাম্প তার অভিষেক অনুষ্ঠান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। বন্ধু টম বারাক একটি জমজমাট অনুষ্ঠান আয়োজন করতে তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন; কিন্তু তিনি এমন কিছু করতে পারেননি যা নতুন প্রেসিডেন্টের মনঃপুত হয়েছে। ট্রাম্প চেয়েছিলেন তার প্রভাবশালী বন্ধুরা এমন কিছু তারকাকে হাজির করবে যাতে অনুষ্ঠানটি বেশি গ্রহণযোগ্য হয়, আর যারা আসতে চায়নি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু তারা রাজি হয়নি। তাই বিষয়টি ট্রাম্পের পছন্দ হয়নি। তিনি মনে করেন, তাকে বিব্রত করতে চেয়েছে বন্ধুরা। ট্রাম্প তার পরিবারের সদস্যদের রাখতে চাইতেন ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ক কমিটিতে। এ বিষয়টি আইন বহির্ভূত জেনেও এবং আশপাশের লোকদের অসন্তুষ্টি অগ্রাহ্য করেই ট্রাম্প এটি চাইতেন। ট্রাম্প অর্গানাইজেশন যেমন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চালাতেন, এখানেও তেমন মানসিকতা ছিল তার। তাকে থামানোর মতো কেউ ছিল না। তবে ট্রাম্পের সমর্থক হিসেবে পরিচিতি টিভি ব্যক্তিত্ব অ্যান কাল্টার তাকে বলেছেন, ‘কেউ স্পষ্ট করে বিষয়টি আপনাকে বলেনি কিন্তু তাই বলে আপনি আপনার সন্তানদের এখানে টানতে পারবেন না’। অভিষেক অনুষ্ঠানের চিত্রটা ছিল অন্য রকম। স্টিভ ব্যাননের লেখা আক্রমণাত্মক বক্তৃতা ট্রাম্প এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন নিজের কথা নয়, কোনো রায় পাঠ করছেন।
৩. কখনো ভাবেননি জিতবেন
নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই ভাবতে পারেননি যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। এজন্য তিনি একপর্যায়ে প্রচারণার কাজে আর অর্থও দিতে চাননি। ট্রাম্প মনে করতেন- তার আশপাশের সবাই বোকা, আর তার নির্বাচনী প্রচারণা পুরোটাই কোনো কাজের নয়। বিপরীতে হিলারি ক্লিনটনের প্রচারণায় নেতৃত্ব দিচ্ছে সেরা একদল লোক। এমনকি ট্রাম্প নিজেও এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন না যে, তিনি আসলে প্রেসিডেন্ট হতে চান কি না। সে সময়ও তার চিন্তা ছিল ট্রাম্প টিভি নেটওয়ার্ক দাঁড় করানোর বিষয়ে। নির্বাচনের ফলাফল তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এমন বক্তব্য দেয়ার জন্য তিনি প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যেও কেউ বিশ্বাস করতো না যে তিনি নির্বাচনে জিততে যাচ্ছেন। অভিষেক অনুষ্ঠানের কিছু দিন আগে একটি ডিনারের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক মাইকেল উলফ, যেখানে ফক্স নিউজের তৎকালীন প্রধান রজার এলিস বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, কিভাবে ট্রাম্প নির্বাচনে জিতলেন। ওই ডিনারে উপস্থিত ছিলেন স্টিভ ব্যাননও। স্টিভ ব্যানন ও ট্রাম্পের স্ত্রী মেলানিয়া বিশ্বাস করতেন যে ট্রাম্প নির্বাচনে জিতবেন। ট্রাম্প সেদিনও মেলানিয়াকে বলেছেন, তার জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যখনই জয়ের খবর এলো মেলানিয়া কেঁদে ফেলেন। ট্রাম্প টাওয়ারে নির্বাচনের দিনের সন্ধ্যাটি ছিল হতাশায় ভরা। এমনকি তার প্রচারণা দলের অনেকেই ভোটের পর কি কাজ করবেন তা ঠিক করেছিলেন।
৪. আইনি অজ্ঞতা
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পরও ট্রাম্পের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান জানতে বা পড়তে কোনো আগ্রহ ছিল না। এর আগেও সংবিধান সম্পর্কে খুব কমই জানতেন তিনি। প্রচারণা দলের সাবেক উপদেষ্টা স্যাম নানবার্গ বলেছেন, ‘আমি চতুর্থ সংশোধনী পর্যন্ত তার কাছ থেকে জেনেছিলাম। এরপর তিনি ঠোঁটে আঙুল চাপেন আর চারদিক তাকাতে থাকেন’। এ ছাড়া, ট্রাম্পের সাধারণ পাঠাভ্যাসও নেই মোটেও। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের যেসব বিষয় জানা উচিত, তিনি সেগুলোও পড়েন না। বইয়ের ভাষায় ‘প্রচলিত কোনো তথ্য প্রক্রিয়ার মধ্যেই তিনি নেই। তিনি পড়েন না, এমনকি চোখও বুলান না।
৫. কারো ওপর আস্থা নেই
ঘনিষ্ঠজনদের কারো ওপরেই আস্থা নেই ট্রাম্পের। তাদের সাথে টেলিফোনে আলাপ করা বিষয়গুলো ফাঁস হওয়ার কারণে তিনি এ বিষয়ে সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়েন। আশপাশের লোকদের বিষয়ে তার মনোভাব, ‘ব্যানন অনুগত ছিল না, রেন্স প্রিবাস ছিল দুর্বল, শন স্পাইসার ছিল বোকা, কনওয়ে শিশুর মতো কান্না করত, জ্যারেড ও ইভাঙ্কার ওয়াশিংটনে আশাই উচিত হয়নি’। খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে পারে এই ভয়ে ম্যাকডোনল্ডস থেকে চিজবার্গার কিনে খান ট্রাম্প। এটিও তার কারো ওপর আস্থা না থাকার আরেকটি প্রমাণ।
৬. ইভাঙ্কাকে প্রেসিডেন্ট করার লক্ষ্য
ট্রাম্পের কন্যা ইভাঙ্কা ও তার জামাই জ্যারেড কুশনারের মধ্যে এ সমঝোতা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে তাদের পরিবারের কেউ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলে সেটি হবেন ইভাঙ্কা। ট্রাম্পও ইভাঙ্কাকে পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করতে চান এমনটি উল্লেখ আাছে বইতে। উলফ লিখেছেন, ‘জ্যারেড ও ইভাঙ্কা হোয়াইট হাউজের অন্যতম অক্ষশক্তি। স্টিভ ব্যাননের সাথে টানাপড়েন ছিল ক্ষমতার চূড়ায় থাকা এ দম্পতির’। চাকরি যাওয়ার পর ব্যানন বলেছিলেন, ট্রাম্প যুগের সব ফালতু সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী তারা।
৭. শিশুসুলভ আচরণ
ট্রাম্পের আচরণকে শিশুসুলভ বলেই মনে করেন হোয়াইট হাউজের স্টাফরা। যে দুইশো জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে উলফ বইটি লিখেছেন তাদের বেশির ভাগই মনে করেন ট্রাম্পের আচরণে কোনো পরিপক্বতা নেই, তিনি এমন এক শিশুর মতো, যাকে সর্বদা সন্তুষ্ট রাখতে হয়। কর্মকর্তাদের সাথে তার আচরণও ছিল কখনো কখনো আপত্তিকর। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলে স্যালি ইয়েটসের সাথে বাজে ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে বইয়ে। এই আচরণগত ত্রুটির কারণে তার চারপাশের লোকেরাই নাকি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে থাকার যোগ্য কি না তিনি সে প্রশ্ন তোলেন।
৮. ভারসাম্যহীন জীবন
ট্রাম্পের জীবন যাত্রা মোটেই প্রেসিডেন্টসুলভ নয়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিনি কয়েকটি চিজ বার্গার নিয়ে বেড রুমে প্রবেশ করেন। একসাথে তিনটি টিভি চালিয়ে দেন। অভিষেকের দিনই তিনি তার বেডরুমে দুটি বাড়তি টিভি দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। টিভি দেখতে দেখতেই ফোনে কথা বলা আর টুইটার চালান প্রেসিডেন্ট। শেষ রাতের দিকে ঘুমাতে যান। মাঝরাতে তার টুইটার পোস্ট নিয়ে অতীতেও সমালোচনা হয়েছে অনেক। এসব কারণেই স্ত্রী মেলানিয়া আলাদা রুমে থাকেন। যার যার রুম ভেতর থেকে তালাবদ্ধ থাকে।
৯. মেলানিয়ার সাথে সম্পর্ক
কখনো কখনো তাদের মধ্যে অনেক দিন ধরেও কথা বন্ধ থাকে। একসাথে ট্রাম্প টাওয়ারে থাকলেও মেলানিয়া হয়তো জানতেন না যে ট্রাম্প কোন রুমে আছেন, তাকে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতেও দেখা যেত না। ট্রাম্পের ব্যবসায় বা অন্য কাজকর্ম নিয়েও মেলানিয়ার কোনো মাথাব্যাথা ছিল না। তবে ট্রাম্প বিভিন্ন সময় মেলানিয়ার বিষয়ে কথা বলতেন। তাদের সম্পর্কটাকে নামমাত্র বিয়ে বললেও ভুল হবে না। ট্রাম্প কখনো কখনো দম্ভ করেই বলতেন, তার স্ত্রী একটি ‘ট্রফি মাত্র’। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনসহ যেকোনো কাজেই মেলানিয়ার সমর্থন ও অনুমতি চাইতেন ট্রাম্প। যে অল্প কয়েজন লোক ট্রাম্পের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন মেলানিয়া তাদের মধ্যে একজন। ট্রাম্পের সাথে ‘নিরাপদ আশ্রয়ের জীবন’ তিনি নষ্ট করতে চাইতেন না। যার কারণে শুধু সংবাদমাধ্যম নয়, ট্রাম্পের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়েও খুব একটা মাথা ঘামাতেন না। সন্তান ব্যারনের দিকে তার সব মনোযোগ।
১০. গোপনীয়তা রাখতে জানেন না
তার ভারসাম্যহীন জীবনের আরেকটি নজির এটি। প্রায়ই কাছের লোকদের কাছে নিজের গোপন কথা ফাঁস করে দেন, পরে আবার সেটি নিয়ে আফসোস করেন। বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবনের সব কিছু ফাঁস হয়ে গেলে তিনি ফাঁসকারীকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু সম্ভবত এসব গাল-গল্পের উৎস তিনি নিজেই’। টেলিফোনে আলাপ করার সময়ও তিনি নানা জনকে নানা কথা বলেন, যাদের সবাই বিশ্বস্ত নয়। যে কারণে প্রায়ই বিপদে পড়েন।
১. রুশ সংযোগ ও স্টিভ ব্যানন
ট্রাম্প প্রশাসনের সবচেয়ে প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন সাবেক রাজনৈতিক কৌশলবিদ স্টিভ ব্যানন। বইটিতে অনেক বক্তব্য আছে হোয়াইট হাউজের সাবেক এই কর্মকর্তার। ধারণা করা হচ্ছে মাইকেল ওলফ তার কাছ থেকেই প্রচুর তথ্য নিয়েছেন বইয়ের জন্য। তার উদ্বৃতি দিয়েই রুশ সংযোগ বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। ব্যানন বলেছেন, ট্রাম্পপুত্র নির্বাচনের আগে রুশ নাগরিকের সাথে বৈঠক করেছেন। তিনি নিজেই লেখকের কাছে ওই বৈঠক ‘রাষ্ট্রদ্রোহমূলক’ ও ‘দেশপ্রেমহীন’ ছিল বলে উক্তি করেছিলেন। এরপর ট্রাম্প বৈঠকে অংশ নেয়াদের তার বাবার অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন বলেও কথিত আছে। বইয়ে ফক্স নিউজের তৎকালীন প্রধান রজার এলিস ও স্টিভ ব্যাননের একটি নৈশ ভোজের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক মাইকেল উলফ। সেখানে ব্যানন বলেছেন, তিনি রাশিয়া সফর করেছিলেন পুতিনের সাক্ষাৎ পাওয়ার আশায়, তবে পুতিন তাকে সময় দেননি। তবু পুতিনের সাথে ঘনিষ্ঠতা অর্জন করতে তাকে চাপে রাখা হয়েছিলা। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ কর্মসূচির কারিগর ছিলেন এই ব্যানন।
২. অভিষেক অনুষ্ঠান নিয়ে অসন্তোষ
ট্রাম্প তার অভিষেক অনুষ্ঠান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। বন্ধু টম বারাক একটি জমজমাট অনুষ্ঠান আয়োজন করতে তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন; কিন্তু তিনি এমন কিছু করতে পারেননি যা নতুন প্রেসিডেন্টের মনঃপুত হয়েছে। ট্রাম্প চেয়েছিলেন তার প্রভাবশালী বন্ধুরা এমন কিছু তারকাকে হাজির করবে যাতে অনুষ্ঠানটি বেশি গ্রহণযোগ্য হয়, আর যারা আসতে চায়নি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু তারা রাজি হয়নি। তাই বিষয়টি ট্রাম্পের পছন্দ হয়নি। তিনি মনে করেন, তাকে বিব্রত করতে চেয়েছে বন্ধুরা। ট্রাম্প তার পরিবারের সদস্যদের রাখতে চাইতেন ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ক কমিটিতে। এ বিষয়টি আইন বহির্ভূত জেনেও এবং আশপাশের লোকদের অসন্তুষ্টি অগ্রাহ্য করেই ট্রাম্প এটি চাইতেন। ট্রাম্প অর্গানাইজেশন যেমন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চালাতেন, এখানেও তেমন মানসিকতা ছিল তার। তাকে থামানোর মতো কেউ ছিল না। তবে ট্রাম্পের সমর্থক হিসেবে পরিচিতি টিভি ব্যক্তিত্ব অ্যান কাল্টার তাকে বলেছেন, ‘কেউ স্পষ্ট করে বিষয়টি আপনাকে বলেনি কিন্তু তাই বলে আপনি আপনার সন্তানদের এখানে টানতে পারবেন না’। অভিষেক অনুষ্ঠানের চিত্রটা ছিল অন্য রকম। স্টিভ ব্যাননের লেখা আক্রমণাত্মক বক্তৃতা ট্রাম্প এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন নিজের কথা নয়, কোনো রায় পাঠ করছেন।
৩. কখনো ভাবেননি জিতবেন
নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই ভাবতে পারেননি যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। এজন্য তিনি একপর্যায়ে প্রচারণার কাজে আর অর্থও দিতে চাননি। ট্রাম্প মনে করতেন- তার আশপাশের সবাই বোকা, আর তার নির্বাচনী প্রচারণা পুরোটাই কোনো কাজের নয়। বিপরীতে হিলারি ক্লিনটনের প্রচারণায় নেতৃত্ব দিচ্ছে সেরা একদল লোক। এমনকি ট্রাম্প নিজেও এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন না যে, তিনি আসলে প্রেসিডেন্ট হতে চান কি না। সে সময়ও তার চিন্তা ছিল ট্রাম্প টিভি নেটওয়ার্ক দাঁড় করানোর বিষয়ে। নির্বাচনের ফলাফল তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এমন বক্তব্য দেয়ার জন্য তিনি প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যেও কেউ বিশ্বাস করতো না যে তিনি নির্বাচনে জিততে যাচ্ছেন। অভিষেক অনুষ্ঠানের কিছু দিন আগে একটি ডিনারের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক মাইকেল উলফ, যেখানে ফক্স নিউজের তৎকালীন প্রধান রজার এলিস বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, কিভাবে ট্রাম্প নির্বাচনে জিতলেন। ওই ডিনারে উপস্থিত ছিলেন স্টিভ ব্যাননও। স্টিভ ব্যানন ও ট্রাম্পের স্ত্রী মেলানিয়া বিশ্বাস করতেন যে ট্রাম্প নির্বাচনে জিতবেন। ট্রাম্প সেদিনও মেলানিয়াকে বলেছেন, তার জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যখনই জয়ের খবর এলো মেলানিয়া কেঁদে ফেলেন। ট্রাম্প টাওয়ারে নির্বাচনের দিনের সন্ধ্যাটি ছিল হতাশায় ভরা। এমনকি তার প্রচারণা দলের অনেকেই ভোটের পর কি কাজ করবেন তা ঠিক করেছিলেন।
৪. আইনি অজ্ঞতা
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পরও ট্রাম্পের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান জানতে বা পড়তে কোনো আগ্রহ ছিল না। এর আগেও সংবিধান সম্পর্কে খুব কমই জানতেন তিনি। প্রচারণা দলের সাবেক উপদেষ্টা স্যাম নানবার্গ বলেছেন, ‘আমি চতুর্থ সংশোধনী পর্যন্ত তার কাছ থেকে জেনেছিলাম। এরপর তিনি ঠোঁটে আঙুল চাপেন আর চারদিক তাকাতে থাকেন’। এ ছাড়া, ট্রাম্পের সাধারণ পাঠাভ্যাসও নেই মোটেও। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের যেসব বিষয় জানা উচিত, তিনি সেগুলোও পড়েন না। বইয়ের ভাষায় ‘প্রচলিত কোনো তথ্য প্রক্রিয়ার মধ্যেই তিনি নেই। তিনি পড়েন না, এমনকি চোখও বুলান না।
৫. কারো ওপর আস্থা নেই
ঘনিষ্ঠজনদের কারো ওপরেই আস্থা নেই ট্রাম্পের। তাদের সাথে টেলিফোনে আলাপ করা বিষয়গুলো ফাঁস হওয়ার কারণে তিনি এ বিষয়ে সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়েন। আশপাশের লোকদের বিষয়ে তার মনোভাব, ‘ব্যানন অনুগত ছিল না, রেন্স প্রিবাস ছিল দুর্বল, শন স্পাইসার ছিল বোকা, কনওয়ে শিশুর মতো কান্না করত, জ্যারেড ও ইভাঙ্কার ওয়াশিংটনে আশাই উচিত হয়নি’। খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে পারে এই ভয়ে ম্যাকডোনল্ডস থেকে চিজবার্গার কিনে খান ট্রাম্প। এটিও তার কারো ওপর আস্থা না থাকার আরেকটি প্রমাণ।
৬. ইভাঙ্কাকে প্রেসিডেন্ট করার লক্ষ্য
ট্রাম্পের কন্যা ইভাঙ্কা ও তার জামাই জ্যারেড কুশনারের মধ্যে এ সমঝোতা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে তাদের পরিবারের কেউ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলে সেটি হবেন ইভাঙ্কা। ট্রাম্পও ইভাঙ্কাকে পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করতে চান এমনটি উল্লেখ আাছে বইতে। উলফ লিখেছেন, ‘জ্যারেড ও ইভাঙ্কা হোয়াইট হাউজের অন্যতম অক্ষশক্তি। স্টিভ ব্যাননের সাথে টানাপড়েন ছিল ক্ষমতার চূড়ায় থাকা এ দম্পতির’। চাকরি যাওয়ার পর ব্যানন বলেছিলেন, ট্রাম্প যুগের সব ফালতু সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী তারা।
৭. শিশুসুলভ আচরণ
ট্রাম্পের আচরণকে শিশুসুলভ বলেই মনে করেন হোয়াইট হাউজের স্টাফরা। যে দুইশো জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে উলফ বইটি লিখেছেন তাদের বেশির ভাগই মনে করেন ট্রাম্পের আচরণে কোনো পরিপক্বতা নেই, তিনি এমন এক শিশুর মতো, যাকে সর্বদা সন্তুষ্ট রাখতে হয়। কর্মকর্তাদের সাথে তার আচরণও ছিল কখনো কখনো আপত্তিকর। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলে স্যালি ইয়েটসের সাথে বাজে ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে বইয়ে। এই আচরণগত ত্রুটির কারণে তার চারপাশের লোকেরাই নাকি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে থাকার যোগ্য কি না তিনি সে প্রশ্ন তোলেন।
৮. ভারসাম্যহীন জীবন
ট্রাম্পের জীবন যাত্রা মোটেই প্রেসিডেন্টসুলভ নয়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিনি কয়েকটি চিজ বার্গার নিয়ে বেড রুমে প্রবেশ করেন। একসাথে তিনটি টিভি চালিয়ে দেন। অভিষেকের দিনই তিনি তার বেডরুমে দুটি বাড়তি টিভি দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। টিভি দেখতে দেখতেই ফোনে কথা বলা আর টুইটার চালান প্রেসিডেন্ট। শেষ রাতের দিকে ঘুমাতে যান। মাঝরাতে তার টুইটার পোস্ট নিয়ে অতীতেও সমালোচনা হয়েছে অনেক। এসব কারণেই স্ত্রী মেলানিয়া আলাদা রুমে থাকেন। যার যার রুম ভেতর থেকে তালাবদ্ধ থাকে।
৯. মেলানিয়ার সাথে সম্পর্ক
কখনো কখনো তাদের মধ্যে অনেক দিন ধরেও কথা বন্ধ থাকে। একসাথে ট্রাম্প টাওয়ারে থাকলেও মেলানিয়া হয়তো জানতেন না যে ট্রাম্প কোন রুমে আছেন, তাকে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতেও দেখা যেত না। ট্রাম্পের ব্যবসায় বা অন্য কাজকর্ম নিয়েও মেলানিয়ার কোনো মাথাব্যাথা ছিল না। তবে ট্রাম্প বিভিন্ন সময় মেলানিয়ার বিষয়ে কথা বলতেন। তাদের সম্পর্কটাকে নামমাত্র বিয়ে বললেও ভুল হবে না। ট্রাম্প কখনো কখনো দম্ভ করেই বলতেন, তার স্ত্রী একটি ‘ট্রফি মাত্র’। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনসহ যেকোনো কাজেই মেলানিয়ার সমর্থন ও অনুমতি চাইতেন ট্রাম্প। যে অল্প কয়েজন লোক ট্রাম্পের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন মেলানিয়া তাদের মধ্যে একজন। ট্রাম্পের সাথে ‘নিরাপদ আশ্রয়ের জীবন’ তিনি নষ্ট করতে চাইতেন না। যার কারণে শুধু সংবাদমাধ্যম নয়, ট্রাম্পের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়েও খুব একটা মাথা ঘামাতেন না। সন্তান ব্যারনের দিকে তার সব মনোযোগ।
১০. গোপনীয়তা রাখতে জানেন না
তার ভারসাম্যহীন জীবনের আরেকটি নজির এটি। প্রায়ই কাছের লোকদের কাছে নিজের গোপন কথা ফাঁস করে দেন, পরে আবার সেটি নিয়ে আফসোস করেন। বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবনের সব কিছু ফাঁস হয়ে গেলে তিনি ফাঁসকারীকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু সম্ভবত এসব গাল-গল্পের উৎস তিনি নিজেই’। টেলিফোনে আলাপ করার সময়ও তিনি নানা জনকে নানা কথা বলেন, যাদের সবাই বিশ্বস্ত নয়। যে কারণে প্রায়ই বিপদে পড়েন।
No comments