এক শয্যা থেকে একটি বটবৃক্ষ
চারদিকে
পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট শহর ভেলোর। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজধানী
চেন্নাইয়ের কাছেই। গেলে মনে হবে যেন বাংলাদেশেরই কোনো জায়গা। রংপুর থেকে
আসা কেউ থাকার হোটেল খুঁজছেন। নোয়াখালী থেকে আসা কেউ বাজারে মাছ কিনছেন।
ঢাকা থেকে গিয়ে কেউ আবার ট্যাক্সি থেকে মালপত্র নামাচ্ছেন। এ অন্য রকম
ব্যস্ততা। ভেলোর কোনো পর্যটন শহর নয়। বিপদে পড়েই মানুষ যায় সেখানে।
উদ্দেশ্য একটাই—চিকিৎসা। সীমিত আয় বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কাছে
ভেলোরের স্বনামধন্য খ্রিষ্টান মিশনারি হাসপাতালের (সিএমসি) চিকিৎসার খরচটা
নাগালের মধ্যেই। থাকা-খাওয়ার খরচও খুব বেশি নয়। সিএমসিতে বেশির ভাগ রোগীই
বাংলাদেশি। কলকাতার বাঙালির সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ভারতের ঝাড়খন্ড, ওডিশা,
কেরালা বা অন্যান্য রাজ্যের মানুষও চোখে পড়ে। আছে নেপাল, সিঙ্গাপুর থেকে
আসা মানুষও। আর স্থানীয় লোকজন তো রয়েছেই। ১১৮ বছরের পুরোনো এই সিএমসি
হাসপাতাল। হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. ইদা সোফিয়া স্কুডার। ১৯০০ সালে
প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতাল শুরুর ভাবনাটি আরও আগে। ১৮৯০ সালে ইদা সোফিয়া
স্কুডার যুক্তরাষ্ট্র থেকে দক্ষিণ ভারতে তাঁর ধর্মপ্রচারক মা-বাবার সঙ্গে
দেখা করতে যান। এক রাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা তিন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে
সন্তান জন্মদানে সহায়তা করতে বলা হয় ইদাকে। ইদার কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না।
তিনি বাবার সহায়তা চান। বাবা চিকিৎসকও ছিলেন। কিন্তু ওই তিন নারীর পরিবারের
কেউই পুরুষ চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসাসেবা নিতে রাজি হননি। পরদিন সকালে ওই
তিন নারীই মারা যান। ইদা মানসিকভাবে ভীষণ আঘাত পান। সামাজিক বাধার কারণে
তিন মায়ের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি তিনি। চিকিৎসক হবেন বলে শপথ নেন।
নারী ও শিশুদের সেবা করবেন বলে ব্রত নেন। ইদা এরপর আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে
যান। ১৮৯৯ সালে কর্নেল ইউনিভার্সিটি মেডিকেল কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হন।
সেখানে নারী শিক্ষার্থীদের সেটিই ছিল প্রথম ব্যাচ। ১৯০০ সালে আবার ভারতে
ফিরে যান ইদা। বাবার বাড়িতে একটিমাত্র বেড নিয়ে চালু করেন হাসপাতাল। এখন
সিএমসিতে অভ্যন্তরীণ রোগী দুই হাজারেরও বেশি। দৈনিক বহির্বিভাগীয় রোগী সাত
হাজার। হাসপাতালে ওয়ার্ড ৬৭টি। বিভিন্ন রোগের বিভাগ ১৪৪টি। হাসপাতাল শুরুর
পরই ইদা বুঝেছিলেন, নারীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য নারীদেরই চিকিৎসাসেবায়
প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। ১৯০৯ সালে তিনি চিকিৎসাসেবায় নারীদের
প্রশিক্ষণের জন্য একটি স্কুল গড়ে তোলেন। ১৯১৮ সালে নারীদের চিকিৎসাসেবার
জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেন। ১৯৪৬ সালে সেটি কলেজ অব নার্সিংয়ে
উন্নীত করা হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে পুরুষদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হতে থাকে এখানে।
সিএমসি এখন নারী-পুরুষদের স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসাক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে
স্বীকৃত ১৬৩-এরও বেশি প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করে। ওয়ার্ল্ড কনসালটিং
অ্যান্ড রিসার্চ করপোরেশন চিকিৎসাসেবায় এশিয়ার সবচেয়ে ভালো
ব্যক্তিমালিকানাধীন শিক্ষাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান (এশিয়াস বেস্ট প্রাইভেট
এডুকেশনাল ইনস্টিটিউট ইন মেডিকেল ক্যাটাগরি) হিসেবে সিএমসিকে পুরস্কৃত
করেছে। সিএমসি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অতিরিক্ত ভিড় ও নিয়ম-কানুনের
জটিলতায় অনেকেই হিমশিম খান। তবে নিয়মগুলো সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা থাকলে
ঝক্কিটা কমে যায়। যাঁরা সিএমসিতে যাবেন বলে ভাবছেন, তাঁদের প্রথমেই সংকটে
পড়তে হয় ভিসা নিয়ে। নিয়ম অনুসারে মেডিকেল ভিসা নিয়ে যাওয়ার কথা।
কিন্তু এ
জন্য সিএমসির চিকিৎসকদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেখাতে হয়। এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট
আবার অর্থ পরিশোধ করা ছাড়া নেওয়া যায় না। যাঁরা প্রথমবার যাচ্ছেন, তাঁদের
জন্য বিষয়টি জটিল। তবে পরিচিত কেউ ভারতে থাকলে তাঁদের মাধ্যমে অথবা
ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানিগ্রাম, ক্লাসিড, ফার্স্ট ট্র্যাকের মাধ্যমে এই অর্থ
পাঠাতে পারেন। মেডিকেল ভিসার জন্য বাংলাদেশ থেকে একজন চিকিৎসকের সুপারিশও
দরকার হয়। অনেকে এসব ঝক্কি এড়াতে ট্যুরিস্ট ভিসা নেন। কিন্তু এতে
ইমিগ্রেশনে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। কারণ ভেলোরে পর্যটকদের যাওয়ার খুব বেশি
কারণ নেই। চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্টের নির্ধারিত দিনের অন্তত দুই দিন আগে
সময় নিয়ে ভেলোরে যাওয়া ভালো। কারণ, অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলেও বাংলাদেশি রোগী
হিসেবে সিএমসিতে গিয়ে প্রথমেই আপনাকে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। নিতে হবে
হাসপাতাল নম্বর। তা না হলে সেখানে চিকিৎসা করাতে পারবেন না। পুরোনো রোগী
হিসেবে সিএমসির হাসপাতাল নম্বর থাকলেও বাংলাদেশ থেকে গেলে আবার
রেজিস্ট্রেশন করাতেই হবে। যতবারই যাবেন, ততবারই নতুন করে নিবন্ধন করতে হবে।
এটিই সিএমসির নিয়ম। সিএমসির মূল চত্বরের পাশে রয়েছে বাংলাদেশিদের জন্য এই
নিবন্ধনের ভবন। ভোরের দিকেই যাওয়া ভালো। তাহলে কাজটা আগে হবে। সিএমসি
হাসপাতালে ঢুকতেই চোখে পড়বে ক্রিস কার্ডের বিজ্ঞপ্তি। লম্বা লাইন এড়াতে
চাইলে ক্রিস কার্ড খুবই উপকারী একটি জিনিস। হাসপাতাল নম্বর দেওয়ার সঙ্গে
সঙ্গেই আপনি ক্রিস কার্ড পেয়ে যেতে পারেন। না পেলে সেটি চেয়ে নিতে ভুলবেন
না। ক্রিস কার্ড পাওয়ার পরই আপনি আন্দাজমতো রুপি সেটিতে ভরে নেবেন। আইএসএস
বিল্ডিংয়ের ১ ও ৩ নম্বর কাউন্টার থেকে আপনি ক্রিস কার্ডে রিচার্জ করতে
পারবেন। এমআরও, টেস্টের জন্য বা ওষুধ কেনার জন্য যেটাই হোক না কেন, আপনি
দেখবেন ক্রিস কার্ডের কাউন্টার আলাদা থাকে। অনেক সময় আইএসএস বিল্ডিংয়ের
কাউন্টার থেকেই আপনি সব জায়গায় ক্রিস কার্ডের মাধ্যমে রুপি পরিশোধ করতে
পারবেন। এটি করলে ভোগান্তি অনেকাংশেই কমে আসবে। আরও একটি সুবিধা হলো, একবার
ক্রিস কার্ড পেয়ে গেলে সেটি ব্যবহার করে পরে আবার আসতে হলে আপনি সহজেই
অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে পারবেন বাংলাদেশ থেকে। চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার সময়
অবশ্যই ক্রিস কার্ডে রুপি ভরে নেবেন। সেই রুপি দিয়েই আপনি পরবর্তী চেকআপের
জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসতে পারবেন। নিবন্ধন ও ক্রিস কার্ড তো হলো।
নির্ধারিত দিনে আপনাকে অ্যাপয়েন্টমেন্টে উল্লেখ করা সময়ের অন্তত দুই থেকে
তিন ঘণ্টা আগে গিয়ে এমআরও কাউন্টারে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে আপনি আপনার
অ্যাপয়েন্টমেন্টের রসিদটি জমা দেবেন। এরপর চিকিৎসকের ডাকের জন্য অপেক্ষা
করতে হবে। টেস্টের জন্যও সংশ্লিষ্ট কাউন্টারে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে রসিদ জমা
দিতে হবে। এরপর স্ক্রিনে আপনার সিরিয়াল নম্বর এলে পরীক্ষা করাতে পারবেন।
অনেক ক্ষেত্রে টেস্টের সিরিয়াল পেতে বেশ কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হয়। বিশেষ
করে এমআরআই বা সিটি স্ক্যানের জন্য। কারণ, সিএমসিতে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা
রোগীর প্রচুর ভিড় থাকে। বিভিন্ন কাউন্টার থেকে দেওয়া রসিদটি ভালো করে পড়ে
নেবেন। সেখানেই লেখা থাকে পরবর্তী সময়ে আপনাকে কত নম্বর কাউন্টারে যেতে
হবে। এ তো গেল চিকিৎসক দেখানো ও সংশ্লিষ্ট শারীরিক পরীক্ষার বিষয়। ওষুধ
কেনার জন্যও আলাদা কাউন্টারে রুপি জমা দেবেন। সিএমসির ওষুধ কেবল এই
হাসপাতালেই পাওয়া যায়। এগুলো সরকার অনুমোদিত। বাইরে কোথাও আপনি ঠিক ওই ওষুধ
পাবেন না। তবে এর বিকল্প পাবেন। আর একটি কথা, সিএমসিতে পুরো
চিকিৎসা-প্রক্রিয়ার সময় কোনো চিকিৎসক আপনাকে কোনো প্রেসক্রিপশন বা
ব্যবস্থাপত্র দেবেন না। এখানে পুরো প্রক্রিয়াটিই চলে কমপিউটার সিস্টেমে।
চিকিৎসক আপনাকে দেখার পর ব্যবস্থাপত্র পাঠিয়ে দেন ওষুধপত্রের বিভাগে।
তাঁরাই সেটি দেখে আপনাকে ওষুধ দিয়ে দেবেন। আপনার হাতে পৌঁছাবে কেবল ওষুধের
ফাইল। কোনো ব্যবস্থাপত্র নয়। আবার কোনো টেস্ট দিলে সেটিও কমপিউটার সিস্টেমে
চলে যায় সংশ্লিষ্ট বিভাগে। তবে প্রয়োজন মনে করলে আপনি সেটার সিডি সংগ্রহ
করতে পারবেন। সিএমসিতে রোগীরা জেনারেল অথবা প্রাইভেটে চিকিৎসকদের দেখাতে
পারবেন। জেনারেলে সাধারণত জুনিয়র চিকিৎসকেরা চিকিৎসা দেন। প্রয়োজন মনে করলে
তাঁরা সিনিয়রদের কাছে পাঠান। আর প্রাইভেটে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা চিকিৎসা
দেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ, বাইরের দেশ বা অন্য কোনো দেশ থেকে আসা রোগীদের জন্য
চালু রয়েছে আলফা ক্লিনিক। এখানে সহজেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায়। ভিড়ও
অনেকটা কম। তবে সব বিভাগ এই আলফা ক্লিনিকে নেই। আলফা ক্লিনিকে খরচটাও
কিছুটা বেশি। এ ছাড়া তদকাল নামে আরেকটি পদ্ধতিতে কিছুটা বেশি খরচে তাড়াতাড়ি
অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায়। এ তো গেল চিকিৎসার কথা। যাঁরা প্রথমবার
যাচ্ছেন, তাঁরা থাকবেন কোথায়? খাবেন কী? সিএমসি হাসপাতালের গেটের উল্টো
পাশে অসংখ্য থাকার হোটেল রয়েছে। স্থানীয়ভাবে এগুলো লজ নামে পরিচিত। একটু
ঘুরে-ফিরে পছন্দমতো লজ পাবেন। ভাড়া ২০০ থেকে ৪০০ রুপির মধ্যে। ৫০০ বা ১০০০
রুপির মধ্যে বেশ ভালো থাকার লজ পাবেন। এসব লজে নিজেদের রান্না করে খাওয়ার
বন্দোবস্ত রয়েছে। ভেলোরের এই এলাকার বাজারও বেশ মজার। বাইরে থেকে চিকিৎসা
করাতে আসা রোগীদের কথা ভেবে তিন দিন বা সাত দিন চলার মতো ছোট ছোট প্যাকেট
করে মসলার গুঁড়ো, মুড়ি বা চাল কিনতে পারবেন। লজগুলোর নিয়ম সাধারণত একবার
উঠলে আপনাকে প্রথম তিন দিন সেখানে থাকতে হবে। এর কম থাকলেও তিন দিনের ভাড়া
দিতে হবে। তাই একটু বুঝেশুনে ওঠা ভালো। যদি হাতে সময় না থাকে তাহলে এ রকম
ব্যবস্থা নেই (অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা থাকা যায়) এমন কোনো লজে একটু বেশি রুপি দিয়ে
থাকবেন। পরে দেখেশুনে ভালো লজে যাবেন। না হলে আপনাদের তিন দিনের খরচ জলে
যাবে। বাংলাদেশের অনেককেই অনেক লজে রাখার ব্যাপারে আপত্তি থাকে। আপনি
পাসপোর্ট দেওয়ার পরও তাঁরা আপত্তি করতে পারেন। সেটি জেনে নেবেন। এ ছাড়া
নতুন কোনো লজে উঠলে বাইরের দেশের নাগরিক হিসেবে আপনাকে পুলিশ স্টেশনে যেতে
হবে। সেখান থেকে একটি অনুমোদনপত্র নিয়ে আসতে হবে। ভেলোরে বেশ কয়েকটি বাঙালি
হোটেল আছে। সেগুলোয় খেতে পারেন। আবার রান্না করেও খেতে পারেন। ডাক্তারের
অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা টেস্টের ফাঁকে দুই দিন বা তিন দিন সময় বেড়ানোর জন্য
পেতে পারেন। ভেলোরে বেড়ানোর জায়গা খুব বেশি নেই। বেশির ভাগই মন্দির। সেগুলো
পাহাড়ের ওপর। যেতে পারেন পালামোদি। ভেলোর থেকে পাহাড়ি পথ দিয়ে এক ঘণ্টার
পথ। প্রায় দেড়-দুই হাজার ফুট উঁচু থেকে পুরো শহর দেখতে দারুণ লাগে।
যাতায়াতের পথের সৌন্দর্যও দারুণ। এ ছাড়া যেতে পারেন টিপু সুলতানের ফোর্টে।
এর ভেতরে মন্দির রয়েছে। কাছাকাছি বিশাল একটি মাঠ আছে। খেলতে পারবে শিশুরা।
যেতে পারেন স্বর্ণমন্দির, রত্নগিরি মন্দির। চাইলে নিউমার্কেট অথবা
পাচ্চিপাই নামে সিল্কের কাপড়ের বাজারে কেনাকাটা করতে পারেন। এ ছাড়া রাস্তার
পাশেই বিভিন্ন ধরনের শৌখিন জিনিস পাবেন।
No comments