রোহিঙ্গা নির্যাতন জাতিগত নিধনের শামিল
রোহিঙ্গাদের
ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো নির্যাতনকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে চিহ্নিত
করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের একটি প্রতিবেদনে। গতকাল সোমবার
প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এই নির্যাতনের ঘটনা মানবতাবিরোধী অপরাধের
পর্যায়ে পড়ে এবং এটি গণহত্যারও শামিল। এ ইস্যুতে যুক্তরাজ্য এর নিজস্ব
মানদণ্ড অনুযায়ী যথার্থ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাজ্যের
পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় কমিটি
(ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি) এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘রাখাইন রাজ্যে সংঘাত
এবং যুক্তরাজ্যের ভূমিকা’ (ভায়োলেন্স ইন রাখাইন স্টেট অ্যান্ড ইউকে’স
রেসপন্স) শীর্ষক এ প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্য সরকারের কড়া সমালোচনা করে বলা হয়,
রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাজ্য এর নিজস্ব মানদণ্ড অনুযায়ী যথার্থ ভূমিকা
পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এ সংঘাতকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য সরকারের
বক্তব্যগুলো চরমভাবে বিভ্রান্তিকর ছিল বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এতে
বলা হয়, ‘যেকোনো সংঘাতের যথাযথ সংজ্ঞা নির্ধারণ জরুরি। কেননা, এটি সুরক্ষার
দায়দায়িত্বকে সামনে নিয়ে আসে এবং রাষ্ট্রগুলোকে ভূমিকা পালনে বাধ্য করে।’
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর পরিস্থিতির নিজস্ব মূল্যায়ন না করায় গভীর
উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনে। এতে দ্রুত বিশেষজ্ঞ দল প্রেরণ করে ধর্ষণ ও
সংঘাতের অভিযোগগুলোর তদন্ত এবং পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র উদ্ঘাটন করে
কমিটির কাছে প্রতিবেদন দাখিলে পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক
আদালতে বিষয়টি উত্থাপন করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখার সুপারিশ করা হয়েছে।
রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি এবং যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র বিভাগ এ নিয়ে কী
ভূমিকা পালন করেছে, তার মূল্যায়ন করতেই এই প্রতিবেদন তৈরি করে দেশটির
পররাষ্ট্র দপ্তর। ৩৭ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে দেশটির একক ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায়ের সঙ্গে যৌথ ভূমিকার বিষয়গুলো আলাদা আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয়।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতির মূল্যায়নে দ্রুত সরকারকে নিজস্ব তদন্তের পরামর্শ
দেওয়া হয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকাকে অপর্যাপ্ত
আখ্যায়িত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব
উত্থাপক হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার দায়
যুক্তরাজ্যেরও আছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চীনের হস্তক্ষেপে প্রস্তাব
পাস না হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এতে বলা হয়, আঞ্চলিক মিত্র ও জোটের সঙ্গে
মিলে যুক্তরাজ্যের উচিত সমাধান খোঁজা। প্রতিবেদনে বলা হয়, অবরোধ আরোপ যদিও
কোনো উপযুক্ত পন্থা নয়; কিন্তু মিয়ানমারের কোনো সমালোচনা না করে একতরফা
সম্পর্ক অব্যাহত রাখাটা যুক্তরাজ্যের জন্য সমীচীন নয়। পরিস্থিতির দ্রুত
উন্নতি না ঘটলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও ব্যবসার ওপর
অবরোধ আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। রোহিঙ্গা নির্যাতনের পুরো দায়
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হেইংয়ের ওপর বর্তায় বলে উল্লেখ
করা হয় প্রতিবেদনে। বেসামরিক সরকারের প্রধান স্টেট কাউন্সেলর অং সাং সু
চির নীরবতা সমালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, যদিও দেশটির গণতন্ত্রে
উত্তরণের পথে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সু চির বিকল্প নেই, কিন্তু তিনি
ইতিমধ্যে নিজেকে নীতিভ্রষ্ট হিসেবে প্রমাণ করেছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের
আশ্রয় দিয়ে মানবিক উদাহরণ তৈরির জন্য বাংলাদেশের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়
প্রতিবেদনে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে বলা হয়, বাস্তুহারা মানুষদের
ভবিষ্যৎ নির্ধারণের কাজটি বেশ চ্যালেঞ্জের। নিরাপদ ও স্বেচ্ছায়
প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দেওয়া হয় প্রতিবেদনে। এতে জাতিসংঘের আস্থা অর্জন
ব্যতীত কোনো চুক্তিতে সমর্থন না দিতে যুক্তরাজ্য সরকারকে পরামর্শ দেওয়া
হয়। এ ছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য স্থায়ী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার বিষয়টি
বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এটা লোকগুলোকে
আশাহীন ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবে এবং উগ্রবাদে দীক্ষিত হওয়ার ঝুঁকিতে
ফেলবে।
No comments