অবশেষে মারা গেল মহম্মদপুরের সেই আলেচিত ‘বৃদ্ধ শিশু’
দীর্ঘদিন
ধরে অসুস্থ থাকার পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার
বিনোদপুর ইউনিয়নের খালিয়া গ্রামের সেই ‘বৃদ্ধ শিশু’ বায়েজিদ শিকদার (৬)
অবশেষে মারা গেছে। সোমবার সন্ধ্যায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। বায়েজিদ বিশ্বাস বিরল প্রজেরিয়া রোগে
আক্রান্ত হয়। দেখতে অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষের চেহারা নিয়ে তার জন্ম হয়। আজ
মঙ্গলবার সকাল ১১টায় খালিয়া মাদ্রাসা-গোরস্থান ময়দানে নামাজে জানাজা শেষে
তাকে দাফন করা হয়। ২০১৬ সালের ২৩ মে ‘মায়ের কোলে বৃদ্ধ শিশু’ শিরোনামে
সর্বপ্রথম বায়েজিদকে নিয়ে দৈনিক নয়া দিগন্তে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এরপর দেশ-বিদেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বিষয়টি
ব্যাপক আলোচিত হলে সরকার বায়েজিদের চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গত এক বছর
ধরে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন হাসপাতালে
চিকিৎসা চলে। বেশ কিছু দিন সুস্থ থাকার পর বায়েজিদ সম্প্রতি আবার গুরুতর
অসুস্থ হয়ে পড়ে। পেশায় একজন রাজমিস্ত্রী বায়েজিদের বাবা লাভলু শিকদার
জানান, বায়েজিদ প্র¯্রাবের বাধাগ্রস্ততাসহ সর্দি, কাশি এবং প্রচন্ড
শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরণের জটিলতায় ভুগছিল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরে নানা
পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিল। সাথে ছিল অসুখের প্রকোপ। ফলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে
পড়েছিল সে। রোববার রাতে বায়েজিদ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে মাগুরা সদর হাসপাতালে
আনা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে
আজ সোমবার সন্ধ্যা পৌনে সাতটারদিকে বায়েজিদ মারা যায়। লাভলু শিকদার কথা
প্রসঙ্গে জানালেন, ২০১২ সালের মে মাসে মাগুরার মাতৃসদন হাসপাতালে তার
স্ত্রী তৃপ্তি খাতুন বৃদ্ধ মানুষের চেহারা সম্বলিত বায়েজিদের জন্ম দেন।
দিনে দিনে বায়েজিদের শরীরে বার্ধক্যের ছাপ আরো প্রকট হতে থাকে। জন্মের তিন
মাসের মধ্যেই তার দাঁত ওঠে। জন্মের পর বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসকদের
স্মরণাপন্ন হলেও স্বাভাবিক চেহারায় ফিরে আসেনি শিশুটির। লাভলু বললেন, এ
পর্যন্ত ছেলের সুস্থতার জন্য অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। ছেলের জন্য আর অর্থ
ব্যয় করা আমার সামর্থের বাইরে। তবুও ছেলের মুখের দিকে তাকালে কষ্ট হতো তার।
সুস্থতার জন্য ধারদেনা করে চিকিৎসার খরচ যুগিয়েছেন। বায়েজিদের মা তৃপ্তি
খাতুন বায়েজিদ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে জানালেন, অন্য শিশুরা সাধারণত ১০ মাস
থেকে এক বছরের মধ্যে হাঁটা শিখলেও বায়েজিদ হাঁটা শিখেছে সাড়ে তিন বছর
বয়সে। অথচ বায়েজিদের দাঁত ওঠে জন্মের মাত্র তিন মাসের মধ্যেই। গত বছর ২৯ মে
মাগুরা সদর হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত ৫ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড
জানায়, বায়োজিদ বিরল প্রজেরিয়া রোগে আক্রান্ত। মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত
অনুযায়ী সে সময় তাকে তারা উন্নত চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও দেড় মাস
ধরে চিকিৎসা করানো পর কোনো ফল না পেয়ে দরিদ্র লাবলু শিকদার শিশুপুত্র
বায়োজিদকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। মাগুরা সদর হাসপাতালের মেডিসিন রোগ
বিশেষজ্ঞ দেবাশিষ বিশ্বাস বলেন, প্রজেরিয়া রোগটি একটি বিরল জেনেটিক
অসঙ্গতি। এক কোটি শিশুর মধ্যে একজনের এই রোগে আক্রান্ত একজন শিশুর অস্তিত্ব
পাওয়া যেতে পারে। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত প্রজেরিয়া রোগে আক্রান্ত ১০০টির মতো
রোগী শনাক্ত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নানাবিধ শারীরিক সমস্যার সাথে সাথে বিরল
রোগ প্রজেরিয়ায় আক্রান্ত বায়েজিদের পুরুষাঙ্গের চামড়া নিচের দিকে ঝুলে
যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এ ধরনের শারীরিক জটিলতাকে ‘প্রিরিপিউস’ বলা
হয়। দৈহিক বৃদ্ধি এবং দৃষ্টিশক্তিসহ অন্যান্য বিষয় স্বাভাবিক থাকলেও এ রোগে
আক্রান্ত শিশুদের শরীরের চামড়া বৃদ্ধ মানুষদের মত কুচকানো হয়। তবে, এ রোগে
আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত ১৩/১৪ বছরের বেশিদিন বাঁচে না বলে জানালেন তিনি।
No comments