আত্মত্যাগ বিফলে যাবে না by আবিদ আনোয়ার
একাত্তরের
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায়। অনেক
ত্যাগের বিনিময়ে হলেও সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছিল অল্পদিনেই। কিন্তু
‘মুক্তিযুদ্ধে’ ‘মুক্তি’ শব্দটির সংযোজনই বলে দেয় সেটি শুধু ভৌগোলিক
স্বাধীনতা অর্জনের প্রত্যাশায় শুরু হয়নি। যোদ্ধাদের এবং এদেশের জনগণের
প্রত্যাশা ছিল ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জিত হলে এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে
আর্থসামাজিক ‘মুক্তি’ যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি স্বাধীনতার পর জনগণের
ব্যক্তিগত অনেক প্রত্যাশাও পূরণ হবে। যুদ্ধজয়ের পর জনগণের প্রত্যাশা হয়ে
ওঠে আকাশচুম্বী। কোনো যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে যেমনটি হয়, বাংলাদেশেও তেমন
পরিস্থিতির উদ্ভব হল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও সেই সংকট সৃষ্টিতে
ভূমিকা রেখেছে, এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। অর্থনীতির ভিত নড়ে উঠল;
মুদ্রাস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হুহু করে বাড়তে শুরু
করল। সবশেষে চুয়াত্তর সালে দেশজুড়ে দেখা দিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। ফলে, জনগণের
প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির ফারাক ক্রমেই বাড়তে লাগল। সে অবস্থায় বঙ্গবন্ধু
ভাবলেন, একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় সমাজতন্ত্র কায়েম করাই এ সংকট উত্তরণের
একমাত্র পথ। ‘বাকশাল’ তৈরি হয়েছিল সমাজতন্ত্র কায়েমের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে।
আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী ইঙ্গ-মার্কিন শক্তিবলয়ের কেউ যেমন তা চায়নি,
বাংলাদেশের পরম বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়নও। সে সময়টায় সমাজতান্ত্রিক
রাষ্ট্রকাঠামোয় ভাঙন শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অন্য এক
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চীনও ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী। এমন পরিস্থিতিতে
সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাকশাল যেমন বিলুপ্ত হল, তেমনি বিলুপ্ত হল
তার সমাজতন্ত্র কায়েমের স্বপ্নও। প্রকৃতপক্ষে, কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থা নয়,
জাতীয় উন্নয়ন ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য চাই নেতানেত্রীদের সততা ও
একাগ্রতা- গণমুখী কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য তাদের নিজস্ব,
ব্যক্তিগত শিক্ষাদীক্ষা ও দক্ষতা। আমি বিশ্বাস করি, গণতান্ত্রিক দেশে
রাষ্ট্রপ্রধানগণ নিজেদের জনপ্রিয়তা টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই হোক আর
সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্য আত্মতৃপ্তির কারণেই হোক সততার সঙ্গে
দেশ পরিচালনার ইচ্ছা রাখেন এবং অধীনস্থদের ওপর এ বিষয়ে নজরদারি করেন।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশ শাসন করে আমলাতন্ত্র; নেতানেত্রীরা পরিচালিত
হন আমলাদের দ্বারা। অথচ বাঞ্ছনীয় ছিল উল্টোটা। রাষ্ট্রীয় তহবিল তছরুপ করে
ব্যক্তিগত উন্নয়নই যাদের মূল লক্ষ্য, তাদের দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন কতটা সম্ভব
এবং যুদ্ধজয়ী জনগণের প্রত্যাশা পূরণই বা কতটা সম্ভব! প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও
অব্যবস্থা কী করে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে, সে সম্পর্কে
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এ লেখা শেষ
করছি- মুক্তিযুদ্ধের পরপর আমি কিশোরগঞ্জ মহকুমা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের
কমানড্যান্ট ছিলাম। ভারতের চাকুলিয়া বিশেষ ক্যাম্প থেকে কমান্ডো হিসেবে
প্রশিক্ষণ নিয়ে আমি ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে কিশোরগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধ করি।
১৯৭২ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি দফতরের ঠিকানায় ডাকযোগে একটি
প্যাকেট পাই। খুলে দেখলাম- জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর মুদ্রিত স্বাক্ষর
দেয়া কয়েক হাজার সার্টিফিকেট পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে শ’দুয়েক সার্টিফিকেটে
আঞ্চলিক অধিনায়ক হিসেবে তিন নম্বর সেক্টরের মেজর এজাজ আহমদ চৌধুরীর
স্বাক্ষর রয়েছে। বাকিগুলোয় আঞ্চলিক অধিনায়ক হিসেবে কারও স্বাক্ষর নেই। কোনো
সার্টিফিকেটেই কোনো মুক্তিযোদ্ধার নাম-ঠিকানা লেখা নেই। প্যাকেটের ভেতর
একটি চিঠিতে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেসব মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র জমা
দিয়েছেন তাদের মধ্যে যেন এগুলো বিতরণ করা হয়। আমাদের ক্যাম্পের সব
মুক্তিযোদ্ধা (প্রায় এগারো হাজার) তিন নম্বর সেক্টরের ছিলেন না; ২ নম্বর ও
১২ নম্বর সেক্টরেরও অনেকেই ছিলেন। মেজর এজাজ আহমদ চৌধুরীর স্বাক্ষর দেয়া
সার্টিফিকেট মাত্র শ’দুয়েক। যেসব সার্টিফিকেটে আঞ্চলিক অধিনায়কের স্বাক্ষর
নেই সেগুলো বিতরণ করব কী করে- এই দ্বন্দ্বে বিক্ষত হয়ে আমি চিঠি প্রেরকের
সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি জানান, এতসব ভাবনার সময় নেই; মুক্তিযোদ্ধা
ক্যাম্পগুলো দ্রুত বন্ধ করার নির্দেশ আছে; আপনি নিজেই আঞ্চলিক অধিনায়ক
হিসেবে স্বাক্ষর দিয়ে তাড়াতাড়ি ক্যাম্পের দায়িত্ব কিশোরগঞ্জের মুজিব বাহিনী
প্রধান অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদকে বুঝিয়ে দিন এবং দাফতরিক মালপত্র মহকুমা
প্রশাসকের নেজারতে জমা দিয়ে ২৫ তারিখের মধ্যে ক্যাম্প বন্ধ করে দিন। আমাকে
তা-ই করতে হল। নেজারতে জমা দেয়া মালপত্রের মধ্যে ছিল কয়েক হাজার
সার্টিফিকেটও। যেগুলোয় কোনো যোদ্ধার নাম-ঠিকানা ছিল না। ১৯৭১-এর ১৬
ডিসেম্বরের পর জন্ম নিয়েছেন এমন ‘মুক্তিযোদ্ধাদের’ ব্যঙ্গ করে বলা হতো
‘ষোড়শ বাহিনী’। ক্যাম্পে ক্যাম্পে সেইসব অবিতারিত সার্টিফিকেটের বদৌলতেই
অবৈধ ‘ষোড়শ বাহিনী’ও বৈধতা পেয়েছিল, পরে জেনেছি। যারা এমন অনৈতিক কাজটি
করতে পেরেছিলেন তারা আরও অনেক অনৈতিক কাজে জড়িত হবেন সেটাই স্বাভাবিক।
খোঁজ নিলে জানা যাবে, রাজনীতিতে, প্রশাসনে তাদেরই আধিপত্য বেশি। তাই,
প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ান লিখে আর কী হবে! তবুও, আশায় আছি একদিন
পরিস্থিতি বদলে যাবে। যুদ্ধজয়ী জনগণ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করবে; আজ হোক, কাল
হোক আত্মত্যাগ বিফলে যাবে না।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও গীতিকার
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও গীতিকার
No comments