পশ্চিমের হাত গুটিয়ে থাকলে চলবে না
মিয়ানমারের
সেনাবাহিনী দেশটির মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যে জাতিগত নিধন অভিযান
চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া এই গত সপ্তাহে
গতি পেয়েছে। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল ‘খুব সম্ভবত
মানবাতাবিরোধী অপরাধের’ জন্য এক প্রস্তাব পাস করে মিয়ানমারের সমালোচনা
করেছে। আর তার পরদিন যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ উৎসাহ নিয়ে এক
প্রস্তাব পাস করে সামরিক বাহিনীর হামলার অবসান চেয়েছে। একই সঙ্গে তারা
রাখাইন প্রদেশে মানবিক সহায়তা দেওয়ার সুযোগের দাবি জানিয়েছে। এই রাখাইন
প্রদেশ থেকে গত আগস্টের শেষ ভাগ থেকে সোয়া ছয় লাখের বেশি মানুষকে তাড়ানো
হয়েছে। কংগ্রেস ও ট্রাম্প প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা জারি করতে যাচ্ছে, এর আওতায়
সামরিক নেতৃত্বও আছে। অন্যদিকে যারা দেশটির সামরিক বাহিনীকে সরঞ্জামাদি
সরবরাহ করে, কংগ্রেস তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেলায়ও
একই কথা প্রযোজ্য। এই মাসের শুরুর দিকে পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশে অবস্থানরত
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে দেখা করেছেন, এর আগে তিনি মিয়ানমারও সফর
করেছেন। এর সঙ্গে তিনি ‘মানুষের ব্যাপক দুঃখ-কষ্টের’ ব্যাপারে মুখ খুলেছেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এমন কোনো লক্ষণ দেখছি না যে এতে মিয়ানমারের জেনারেল
ও নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকারের ওপর
প্রভাব পড়েছে। অধিকাংশ বিবরণেই দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ঘৃণার ব্যাপারে
মিয়ানমার সমাজ দারুণভাবে একতাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা নাকচ
করার ক্ষেত্রেও তারা এককাট্টা।
আর রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের ঘৃণা
দীর্ঘদিনের। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রণালিবদ্ধ বর্বরতার—শিশু
হত্যা, গণধর্ষণ, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া—তদন্ত তো দূরের কথা, সামরিক বাহিনী
উল্টো বলছে, সেনাবাহিনী নিরপরাধ। অন্যদিকে অং সান সু চি জেনারেলদের
বিরুদ্ধে কথা বলা বা তাদের চাপ দেওয়া দূরে থাক, তিনি বলছেন, জাতিসংঘের
মানবাধিকারপ্রধান এটার মধ্যে ‘গণহত্যার উপাদান’ আছে বলে যে বিবৃতি দিয়েছেন,
তাতে মিয়ানমারের উদীয়মান গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ডিসেম্বরের ১ তারিখে
মিয়ানমারের সেনাপ্রধানকে নিয়ে তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে
দেখা করার জন্য বেইজিং সফর করেছেন। বলা বাহুল্য, সি চিন পিংয়ের সরকার
মিয়ানমারের ব্যাপারে জাতিসংঘের যেকোনো বক্তব্য ও কাজের সমালোচনা করেছে।
আবার মিয়ানমারের প্রতি চীনের সমর্থনও কিন্তু একদম নিঃশর্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্র
ও জাতিসংঘের মতো চীনও বাংলাদেশের জীর্ণ শিবিরে আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের
প্রত্যাবাসনের আহ্বান জানিয়েছে। মিয়ানমার তত্ত্বগতভাবে এই প্রত্যাবাসন মেনে
নিয়েছে। তারা গত মাসে বাংলাদেশের সঙ্গে এক চুক্তি সই করেছে। তারা বলেছে,
আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। কিন্তু জাতিসংঘের
শরণার্থীবিষয়ক কর্মকর্তারা গত সপ্তাহে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের টেকসই ও
স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। অনেক রোহিঙ্গাই এখন
পর্যন্ত ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেখানে আন্তর্জাতিক নজরদারি, মানবিক
সহায়তা ও বাঁচার মতো নিরাপদ জায়গা নেই; এমনকি নাগরিকত্বের মতো মৌলিক অধিকার
লাভেরও নিশ্চয়তা নেই। এই কঠিন বাস্তবতার অর্থ হলো জাতিসংঘ ও পশ্চিমা
সরকারগুলোর উচিত বাংলাদেশে অবস্থানরত লাখ লাখ রোহিঙ্গার জীবনমান উন্নয়নে
নজর দেওয়া। নিকট ভবিষ্যতে তাদের তো সেখানেই থাকার কথা। সেখানে তাদের গুরুতর
মানবিক ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা আছে, যেমন ডিপথেরিয়ার মতো প্রাথমিক
পর্যায়ের মহামারি ঘটে যেতে পারে। তাদের এই ক্ষণস্থায়ী নিবাসগুলো দ্রুতই
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে। এগুলো যদি ঠিকঠাক
ব্যবস্থাপনা বা দেখভাল করা না হয়, তাহলে তা চরমপন্থীদের দলভুক্তকরণের উর্বর
ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। একই সঙ্গে পশ্চিমা সরকারগুলোর অবশ্যই মিয়ানমারের
শাসকগোষ্ঠীর অনমনীয়তাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। তারা যে রোহিঙ্গাদের
ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে দূরে রাখতে চাইছে, সেটা হতে দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ
জাতিগত নিধনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ছাড় দেওয়ার যে চেষ্টা তারা করছে, তা
বন্ধ করতে হবে। ব্যাপারটা হলো মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তি না হওয়ার মানে
কিন্তু আরও ভয়ংকর নৃশংসতা ডেকে আনা।
No comments