রবার্ট মুগাবে: বিপ্লবী থেকে স্বৈরাচার, অতঃপর... by মাহমুদ ফেরদৌস
রবার্ট
গ্যাব্রিয়েল মুগাবে একবার বলেছিলেন তিনি শতবর্ষী হওয়া অবধি জিম্বাবুয়ের
শাসক থাকবেন। কিন্তু ৯৩ বছর বয়সে এসে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। গদিও
হারিয়েছেন তিনি। দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মঙ্গলবার পদত্যাগ করতে
বাধ্য হয়েছেন মুগাবে। এ খবরে রাজধানী হারারে এদিন রাতে ঘুমায়নি।
সব শ্রেণি, পেশার মানুষ নেমে পড়েন রাস্তায়। তারা ‘মুক্তি’ উদযাপন করতে থাকেন। এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয় রাজপথে। সুদীর্ঘ এক নায়কতন্ত্রের অবসান হওয়ার স্বস্তিতে উল্লাসে মাতোয়ারা জনগণের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। নেচে গেয়ে তারা মাতিয়ে রাখেন নগরের অলিগলি। মুগাবে শাসনের অবসান হওয়ায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে আসে সবাই। ওদিকে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার খবর বলা হয়েছে, শুক্রবার ক্ষমতা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন বরখাস্ত করা ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন এমনাংগাগওয়া। সেনাবাহিনী বলছে, মুগাবে নয়, তার আশপাশের লোকদের বিরুদ্ধেই তাদের অবস্থান। গৃহবন্দি অবস্থায় মুগাবে বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না। কিন্তু পরিস্থিতি তার অনুকূলে নেই ছিল না। বয়স তার ৯৩। স্ত্রী গ্রেস মুগাবে অভ্যুত্থানের খবর পেয়েই পালিয়েছেন। দুই সপ্তাহ আগে ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন এমনাংগাগওয়াকে বহিষ্কারের পরই সেনারা বিদ্রোহ করে।
বিশ্বে এ মুহূর্তে যত রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান আছেন, তাদের মধ্যে সম্ভবত মুগাবের চেহারাই পৃথিবীবাসী সবচেয়ে বেশি চেনেন। ৩৭ বছর ধরে ছিলেন ক্ষমতায়। তাই ব্যাপক ঘটনাবহুল তার জীবন।
প্রথম দিকে মুগাবেকে বলা হতো ‘মুক্তিদাতা’, যিনি সাবেক বৃটিশ উপনিবেশ রোডেশিয়াকে শ্বেতাঙ্গ শাসনমুক্ত করেছেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার খুব অল্প সময় পরই মুগাবে হয়ে যান স্বৈরাচার। তিনি রাজনৈতিক ভিন্ন মতালম্বীদের পিষে ফেলেছেন। বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন জাতীয় অর্থনীতির।
সত্তরের দশকের শেষ নাগাদ সহিংস বিদ্রোহ ও তীব্র অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে রোডেশিয়ার শ্বেতাঙ্গ সরকার আলোচনার টেবিলে আসে। ১৯৮০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় আসেন রাজনৈতিক বন্দি থেকে গেরিলা নেতা বনে যাওয়া মুগাবে।
ক্ষমতায় আসার পর তিনি শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ মেলবন্ধনের নীতি ঘোষণা করেন। সংখ্যাগুরু কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য উন্নততর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থা নেন। এসব উদ্যোগের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে তিনি ব্যাপক প্রশংসাও পেয়েছিলেন। কিন্তু তার এই দ্যুতি দ্রুতই মিইয়ে যেতে থাকে।
১৯৭৪ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান মুগাবে। তখন শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে গেরিলা সংগ্রাম চালাচ্ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের দুটি গ্রুপ। এর মধ্যে একটি ছিল জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়ন (জেডএএনইউ)। মুক্তি পেয়ে মুগাবে দলটির রাজনৈতিক ও সশস্ত্র শাখার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
শাসকবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে তার অপর অংশীদার ছিলেন জোসুয়া এনকোমো। তিনি ছিলেন জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান পিপল’স ইউনিয়নের (জেডএপিইউ) নেতা। ক্ষমতায় আসার পর ভিন্নমতালম্বীদের বিরুদ্ধে মুগাবে যে দমনপীড়ন শুরু করেন, তার প্রথম দিককার শিকার ছিলেন এনকোমা।
এনকোমাকে প্রথমে ঐক্যমতের সরকার থেকে বিদায় করা হয়। তিনি ছিলেন ওই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৯৮২ সালে তার দলের শক্ত ঘাঁটি মাতাবেলেল্যান্ড প্রদেশে অস্ত্রের বিরাট চালান আবিষ্কারের পর তাকে বহিষ্কার করা হয়।
মূলত, মুগাবের ক্ষমতার উৎস ছিল সংখ্যাগুরু শোনা সম্প্রদায়। তার নিয়ন্ত্রণে ছিল ফিফথ ব্রিগেড নামে এক কুখ্যাত বিশেষ বাহিনী। উত্তর কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ পেয়েছিল তারা। নিজের একসময়কার মিত্র এনকোমোকে মন্ত্রিসভা থেকে হঠানোর পর তার এনদেবেলে জনগোষ্ঠীর ওপর ফিফথ ব্রিগেডকে লেলিয়ে দেন মুগাবে। এই হত্যাযজ্ঞ গুকুরাহুন্দি নামে পরিচিত। এতে নিহত হয়েছিলেন আনুমানিক ২০ হাজার সন্দেহভাজন ভিন্নমতালম্বী।
দুই দশক পর শ্বেতাঙ্গ-মালিকানাধীন কৃষি খামার দখলে নেওয়ার পর, পশ্চিমাদের প্রিয়ভাজন থেকে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে যাওয়ার ষোলকলা পূরণ করেন মুগাবে। কিন্তু এখনও আফ্রিকার বহু জায়গায় তাকে মুক্তির নায়ক হিসেবেই স্মরণ করা হয়।
শ্বেতাঙ্গদের খামার দখলে নিতে তিনি প্রণয়ন করেছিলেন ভূমি সংস্কার নীতি। ওই সময় সাবেক অনেক স্বাধীনতাযোদ্ধা তার শাসন নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিল। তাদের সন্তুষ্ট করতেই শ্বেতাঙ্গদের জমি দখলে নিয়ে তাদের দেয়া হয়। এভাবে ধ্বংস হয়ে যায় জিম্বাবুয়ের গুরুত্বপূর্ণ কৃষিখাত। পালিয়ে যায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এক অর্থনৈতিক দুর্বিপাকে পড়ে দেশ। এই যখন অবস্থা, তখন মানুষের মানবাধিকার হরণ করে আর নির্বাচনে কারচুপি করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন মুগাবে।
দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্যাডর্যাক গুট্টো বলেন, ‘তিনি ছিলেন এক মহান নেতা। কিন্তু তার নেতৃত্বকে তিনি এমন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন যে জিম্বাবুয়েকে তিনি নিঃস্ব করে ফেলেছেন।’
বৃটেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ক্যারিংটন আবার মুগাবেকে বেশ ভালো করে জানতেন। তিনিই বিখ্যাত ল্যাঙ্ক্যাস্টার হাউজ আলোচনায় মধ্যস্থতা করেন। শ্বেতাঙ্গ সরকার ও কৃষ্ণাঙ্গ গেরিলাদের মধ্যে এই আলোচনার মাধ্যমেই জিম্বাবুয়ে স্বাধীনতা লাভ করে।
মুগাবেকে নিয়ে একটি আলোচিত বই লিখেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ নারী সাংবাদিক হেইদি হল্যান্ড। ‘ডিনার উইথ মুগাবে’ নামে সেই বইয়ে পিটার ক্যারিংটনের একটি আলোচিত মন্তব্য আছে মুগাবেকে নিয়ে। ক্যারিংটন বলেন, ‘মুগাবে আসলে মানুষই ছিল না। তার মধ্যে সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীদের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। আপনি তার দক্ষতা আর মেধার তারিফ করতে পারেন। কিন্তু লোকটা বড্ড পিচ্ছিল।’
নিজের শাসনের শেষ দশকে এসে, মুগাবে পশ্চিমা-বিরোধী ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হন। নিজ দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য পশ্চিমা অবরোধকে দায়ী করতে তিনি খুব কঠোর শব্দ ও বাক্য চয়ন করতেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে, পশ্চিমাদের অবরোধ মুগাবে আর তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের ওপর আরোপ করা, জিম্বাবুয়ের অর্থনীতির ওপর নয়।
২০০৩ সালে এক প্রামাণ্যচিত্রে মুগাবেকে তার স্বৈরাচারী শাসন নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। জবাবে তিনি বলেন, ‘যখন মানুষ বলে যে আপনি একজন স্বৈরশাসক, আমি এটা পাত্তা দিই না। জানি যে, তারা এসব বলছে কেবল আমার মর্যাদা খাটো করার জন্য।’
তার দীর্ঘ শাসনামলে তার স্থলাভিষিক্ত কে হবেন এই আলোচনা ছিল অনেকটা নিষিদ্ধ। কিন্তু ২০১৪ সালে তার বয়স যখন ৯০ হয়, তখন তিনি দৃশ্যত বেশ দুর্বল হয়ে পড়েন। আর তখনই তার দলীয় নেতাদের মধ্যে তার স্থলাভিষিক্ত কে হবেন, এ নিয়ে তীব্র দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। বহু বছর ধরে গুজব আছে যে, তার প্রোস্টেট ক্যানসার আছে। কিন্তু সরকারিভাবে তা স্বীকার করা হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনি ঘন ঘন সিঙ্গাপুরে যান চোখের ছানির চিকিৎসা করাতে।
মুগাবের দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রেস একবার গর্ব করে বলেছিলেন আশি বছর বয়সেও মুগাবে সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠে হাঁটাহাঁটি করেন। গ্রেস ছিলেন মুগাবের এক সময়কার সেক্রেটারি। বয়সে ৪১ বছরের ছোট। কিন্তু তাকেই ভাবা হতো মুগাবের উত্তরাধিকারী।
২০১৬ সালে মুগাবে যখন বিদেশে তখন একবার গুজব উঠে তিনি মরে গেছেন। বিদেশ সফর থেকে ফিরে এসে তিনি রসিকতা করে বলেন, ‘এটা সত্য যে আমি মরেই গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি আবার পুনর্জন্ম লাভ করেছি। প্রতিবার আমি দেশে ফিরলেই পুনর্জন্ম লাভ করি।’
কিন্তু পরের কয়েক বছরে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তার দিন ঘনিয়ে এসেছে। একাধিকবার তিনি পড়ে গেছেন মাটিতে। ২০১৬ সালে একবার পার্লামেন্টের সূচনাকালে ভুল বক্তব্য দিয়ে ফেলেছিলেন।
১৯২৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে হারারের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে এক ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম হয় মুগাবের। তার বিভিন্ন জীবনীমূলক বইতে উঠে এসেছে যে, ছোটবেলায় তিনি ছিলেন একাকী ও পড়ুয়া ছেলে। গবাদিপশু চরাতে গিয়েও তিনি সঙ্গে বই রাখতেন। তার বয়স যখন দশ, হঠাৎ করে তার ছুতারমিস্ত্রি পিতা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু তখন মুগাবে নিজের পড়াশোনায় আরও বেশি মনোনিবেশ করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি স্কুলশিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন।
তার বুদ্ধিবৃত্তিক দিক বেশ প্রখর ছিল। মার্ক্সবাদ লালন করতেন প্রথম দিকে। যৌবনে ভর্তি হয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকার বহু হবু কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী নেতার সঙ্গে তার উঠাবসা। ঘানায় শিক্ষকতাকালে তিনি দেশটির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট কোয়াম এনক্রুমাহর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। ঘানা থেকে দেশে (তখন রোডেশিয়া) ফেরার পর কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার দায়ে ১৯৬৪ সালে তাকে আটক করা হয়। তার জীবনের পরের ১০ বছর অতিবাহিত হয় বন্দিশিবির বা কারাগারে। কারাগারে থেকেই তিনি তিনটি ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু এই বন্দিজীবন ব্যাপক প্রভাব ফেলে তার ওপর।
তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন ঘানার বাসিন্দা। স্যালি ফ্রান্সেস্কা হেফ্রনের গর্ভে জন্ম নেওয়া তার চার বয়সী সন্তান যখন মারা যায়, তখনও তিনি ছিলেন কারান্তরীণ। নিজের ছেলের শেষকৃত্যানুষ্ঠানেও তাকে অংশগ্রহণ করতে দেননি রোডেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইয়ান স্মিথ। পরে অবশ্য কয়েক বছর পর দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রেসের গর্ভে তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে হয়।
কয়েক দশক ধরে ক্ষমতার ওপর বজ্রমুষ্ঠি ছিল মুগাবের। তিনি যখন দুর্বল হলেন শারীরিকভাবে তখন আস্তে আস্তে আলোচনা হতে থাকে কে হবেন তার উত্তরাধিকারী। ফার্স্টলেডি গ্রেসকে ভাবা হতো স্বামী মুগাবের উত্তরাধিকারী হওয়ার দৌড়ে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু এখন সময় বড্ড বেয়ারা।
মুগাবের অন্যতম জীবনীকার মার্টিন মেরেডিথের ভাষায়, ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তির চেয়েও মুগাবে ক্ষমতা নিয়ে মোহাচ্ছন্ন ছিলেন বেশি। বছরের পর বছর ধরে মুগাবে নিজের ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন সহিংসতা ও নির্যাতনের মাধ্যমে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা, আদালতকে লঙ্ঘন করা, সম্পত্তি অধিকার চূর্ণবিচূর্ণ করা, স্বাধীন গণমাধ্যমকে দমন ও নির্বাচনে কারচুপি করাই ছিল তার ক্ষমতায় থাকার কৌশল।’
(এএফপি অবলম্বনে)
সব শ্রেণি, পেশার মানুষ নেমে পড়েন রাস্তায়। তারা ‘মুক্তি’ উদযাপন করতে থাকেন। এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয় রাজপথে। সুদীর্ঘ এক নায়কতন্ত্রের অবসান হওয়ার স্বস্তিতে উল্লাসে মাতোয়ারা জনগণের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। নেচে গেয়ে তারা মাতিয়ে রাখেন নগরের অলিগলি। মুগাবে শাসনের অবসান হওয়ায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে আসে সবাই। ওদিকে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার খবর বলা হয়েছে, শুক্রবার ক্ষমতা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন বরখাস্ত করা ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন এমনাংগাগওয়া। সেনাবাহিনী বলছে, মুগাবে নয়, তার আশপাশের লোকদের বিরুদ্ধেই তাদের অবস্থান। গৃহবন্দি অবস্থায় মুগাবে বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না। কিন্তু পরিস্থিতি তার অনুকূলে নেই ছিল না। বয়স তার ৯৩। স্ত্রী গ্রেস মুগাবে অভ্যুত্থানের খবর পেয়েই পালিয়েছেন। দুই সপ্তাহ আগে ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন এমনাংগাগওয়াকে বহিষ্কারের পরই সেনারা বিদ্রোহ করে।
বিশ্বে এ মুহূর্তে যত রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান আছেন, তাদের মধ্যে সম্ভবত মুগাবের চেহারাই পৃথিবীবাসী সবচেয়ে বেশি চেনেন। ৩৭ বছর ধরে ছিলেন ক্ষমতায়। তাই ব্যাপক ঘটনাবহুল তার জীবন।
প্রথম দিকে মুগাবেকে বলা হতো ‘মুক্তিদাতা’, যিনি সাবেক বৃটিশ উপনিবেশ রোডেশিয়াকে শ্বেতাঙ্গ শাসনমুক্ত করেছেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার খুব অল্প সময় পরই মুগাবে হয়ে যান স্বৈরাচার। তিনি রাজনৈতিক ভিন্ন মতালম্বীদের পিষে ফেলেছেন। বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন জাতীয় অর্থনীতির।
সত্তরের দশকের শেষ নাগাদ সহিংস বিদ্রোহ ও তীব্র অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে রোডেশিয়ার শ্বেতাঙ্গ সরকার আলোচনার টেবিলে আসে। ১৯৮০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় আসেন রাজনৈতিক বন্দি থেকে গেরিলা নেতা বনে যাওয়া মুগাবে।
ক্ষমতায় আসার পর তিনি শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ মেলবন্ধনের নীতি ঘোষণা করেন। সংখ্যাগুরু কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য উন্নততর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থা নেন। এসব উদ্যোগের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে তিনি ব্যাপক প্রশংসাও পেয়েছিলেন। কিন্তু তার এই দ্যুতি দ্রুতই মিইয়ে যেতে থাকে।
১৯৭৪ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান মুগাবে। তখন শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে গেরিলা সংগ্রাম চালাচ্ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের দুটি গ্রুপ। এর মধ্যে একটি ছিল জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়ন (জেডএএনইউ)। মুক্তি পেয়ে মুগাবে দলটির রাজনৈতিক ও সশস্ত্র শাখার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
শাসকবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে তার অপর অংশীদার ছিলেন জোসুয়া এনকোমো। তিনি ছিলেন জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান পিপল’স ইউনিয়নের (জেডএপিইউ) নেতা। ক্ষমতায় আসার পর ভিন্নমতালম্বীদের বিরুদ্ধে মুগাবে যে দমনপীড়ন শুরু করেন, তার প্রথম দিককার শিকার ছিলেন এনকোমা।
এনকোমাকে প্রথমে ঐক্যমতের সরকার থেকে বিদায় করা হয়। তিনি ছিলেন ওই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৯৮২ সালে তার দলের শক্ত ঘাঁটি মাতাবেলেল্যান্ড প্রদেশে অস্ত্রের বিরাট চালান আবিষ্কারের পর তাকে বহিষ্কার করা হয়।
মূলত, মুগাবের ক্ষমতার উৎস ছিল সংখ্যাগুরু শোনা সম্প্রদায়। তার নিয়ন্ত্রণে ছিল ফিফথ ব্রিগেড নামে এক কুখ্যাত বিশেষ বাহিনী। উত্তর কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ পেয়েছিল তারা। নিজের একসময়কার মিত্র এনকোমোকে মন্ত্রিসভা থেকে হঠানোর পর তার এনদেবেলে জনগোষ্ঠীর ওপর ফিফথ ব্রিগেডকে লেলিয়ে দেন মুগাবে। এই হত্যাযজ্ঞ গুকুরাহুন্দি নামে পরিচিত। এতে নিহত হয়েছিলেন আনুমানিক ২০ হাজার সন্দেহভাজন ভিন্নমতালম্বী।
দুই দশক পর শ্বেতাঙ্গ-মালিকানাধীন কৃষি খামার দখলে নেওয়ার পর, পশ্চিমাদের প্রিয়ভাজন থেকে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে যাওয়ার ষোলকলা পূরণ করেন মুগাবে। কিন্তু এখনও আফ্রিকার বহু জায়গায় তাকে মুক্তির নায়ক হিসেবেই স্মরণ করা হয়।
শ্বেতাঙ্গদের খামার দখলে নিতে তিনি প্রণয়ন করেছিলেন ভূমি সংস্কার নীতি। ওই সময় সাবেক অনেক স্বাধীনতাযোদ্ধা তার শাসন নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিল। তাদের সন্তুষ্ট করতেই শ্বেতাঙ্গদের জমি দখলে নিয়ে তাদের দেয়া হয়। এভাবে ধ্বংস হয়ে যায় জিম্বাবুয়ের গুরুত্বপূর্ণ কৃষিখাত। পালিয়ে যায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এক অর্থনৈতিক দুর্বিপাকে পড়ে দেশ। এই যখন অবস্থা, তখন মানুষের মানবাধিকার হরণ করে আর নির্বাচনে কারচুপি করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন মুগাবে।
দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্যাডর্যাক গুট্টো বলেন, ‘তিনি ছিলেন এক মহান নেতা। কিন্তু তার নেতৃত্বকে তিনি এমন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন যে জিম্বাবুয়েকে তিনি নিঃস্ব করে ফেলেছেন।’
বৃটেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ক্যারিংটন আবার মুগাবেকে বেশ ভালো করে জানতেন। তিনিই বিখ্যাত ল্যাঙ্ক্যাস্টার হাউজ আলোচনায় মধ্যস্থতা করেন। শ্বেতাঙ্গ সরকার ও কৃষ্ণাঙ্গ গেরিলাদের মধ্যে এই আলোচনার মাধ্যমেই জিম্বাবুয়ে স্বাধীনতা লাভ করে।
মুগাবেকে নিয়ে একটি আলোচিত বই লিখেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ নারী সাংবাদিক হেইদি হল্যান্ড। ‘ডিনার উইথ মুগাবে’ নামে সেই বইয়ে পিটার ক্যারিংটনের একটি আলোচিত মন্তব্য আছে মুগাবেকে নিয়ে। ক্যারিংটন বলেন, ‘মুগাবে আসলে মানুষই ছিল না। তার মধ্যে সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীদের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। আপনি তার দক্ষতা আর মেধার তারিফ করতে পারেন। কিন্তু লোকটা বড্ড পিচ্ছিল।’
নিজের শাসনের শেষ দশকে এসে, মুগাবে পশ্চিমা-বিরোধী ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হন। নিজ দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য পশ্চিমা অবরোধকে দায়ী করতে তিনি খুব কঠোর শব্দ ও বাক্য চয়ন করতেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে, পশ্চিমাদের অবরোধ মুগাবে আর তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের ওপর আরোপ করা, জিম্বাবুয়ের অর্থনীতির ওপর নয়।
২০০৩ সালে এক প্রামাণ্যচিত্রে মুগাবেকে তার স্বৈরাচারী শাসন নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। জবাবে তিনি বলেন, ‘যখন মানুষ বলে যে আপনি একজন স্বৈরশাসক, আমি এটা পাত্তা দিই না। জানি যে, তারা এসব বলছে কেবল আমার মর্যাদা খাটো করার জন্য।’
তার দীর্ঘ শাসনামলে তার স্থলাভিষিক্ত কে হবেন এই আলোচনা ছিল অনেকটা নিষিদ্ধ। কিন্তু ২০১৪ সালে তার বয়স যখন ৯০ হয়, তখন তিনি দৃশ্যত বেশ দুর্বল হয়ে পড়েন। আর তখনই তার দলীয় নেতাদের মধ্যে তার স্থলাভিষিক্ত কে হবেন, এ নিয়ে তীব্র দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। বহু বছর ধরে গুজব আছে যে, তার প্রোস্টেট ক্যানসার আছে। কিন্তু সরকারিভাবে তা স্বীকার করা হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনি ঘন ঘন সিঙ্গাপুরে যান চোখের ছানির চিকিৎসা করাতে।
মুগাবের দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রেস একবার গর্ব করে বলেছিলেন আশি বছর বয়সেও মুগাবে সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠে হাঁটাহাঁটি করেন। গ্রেস ছিলেন মুগাবের এক সময়কার সেক্রেটারি। বয়সে ৪১ বছরের ছোট। কিন্তু তাকেই ভাবা হতো মুগাবের উত্তরাধিকারী।
২০১৬ সালে মুগাবে যখন বিদেশে তখন একবার গুজব উঠে তিনি মরে গেছেন। বিদেশ সফর থেকে ফিরে এসে তিনি রসিকতা করে বলেন, ‘এটা সত্য যে আমি মরেই গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি আবার পুনর্জন্ম লাভ করেছি। প্রতিবার আমি দেশে ফিরলেই পুনর্জন্ম লাভ করি।’
কিন্তু পরের কয়েক বছরে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তার দিন ঘনিয়ে এসেছে। একাধিকবার তিনি পড়ে গেছেন মাটিতে। ২০১৬ সালে একবার পার্লামেন্টের সূচনাকালে ভুল বক্তব্য দিয়ে ফেলেছিলেন।
১৯২৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে হারারের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে এক ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম হয় মুগাবের। তার বিভিন্ন জীবনীমূলক বইতে উঠে এসেছে যে, ছোটবেলায় তিনি ছিলেন একাকী ও পড়ুয়া ছেলে। গবাদিপশু চরাতে গিয়েও তিনি সঙ্গে বই রাখতেন। তার বয়স যখন দশ, হঠাৎ করে তার ছুতারমিস্ত্রি পিতা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু তখন মুগাবে নিজের পড়াশোনায় আরও বেশি মনোনিবেশ করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি স্কুলশিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন।
তার বুদ্ধিবৃত্তিক দিক বেশ প্রখর ছিল। মার্ক্সবাদ লালন করতেন প্রথম দিকে। যৌবনে ভর্তি হয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকার বহু হবু কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী নেতার সঙ্গে তার উঠাবসা। ঘানায় শিক্ষকতাকালে তিনি দেশটির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট কোয়াম এনক্রুমাহর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। ঘানা থেকে দেশে (তখন রোডেশিয়া) ফেরার পর কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার দায়ে ১৯৬৪ সালে তাকে আটক করা হয়। তার জীবনের পরের ১০ বছর অতিবাহিত হয় বন্দিশিবির বা কারাগারে। কারাগারে থেকেই তিনি তিনটি ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু এই বন্দিজীবন ব্যাপক প্রভাব ফেলে তার ওপর।
তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন ঘানার বাসিন্দা। স্যালি ফ্রান্সেস্কা হেফ্রনের গর্ভে জন্ম নেওয়া তার চার বয়সী সন্তান যখন মারা যায়, তখনও তিনি ছিলেন কারান্তরীণ। নিজের ছেলের শেষকৃত্যানুষ্ঠানেও তাকে অংশগ্রহণ করতে দেননি রোডেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইয়ান স্মিথ। পরে অবশ্য কয়েক বছর পর দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রেসের গর্ভে তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে হয়।
কয়েক দশক ধরে ক্ষমতার ওপর বজ্রমুষ্ঠি ছিল মুগাবের। তিনি যখন দুর্বল হলেন শারীরিকভাবে তখন আস্তে আস্তে আলোচনা হতে থাকে কে হবেন তার উত্তরাধিকারী। ফার্স্টলেডি গ্রেসকে ভাবা হতো স্বামী মুগাবের উত্তরাধিকারী হওয়ার দৌড়ে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু এখন সময় বড্ড বেয়ারা।
মুগাবের অন্যতম জীবনীকার মার্টিন মেরেডিথের ভাষায়, ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তির চেয়েও মুগাবে ক্ষমতা নিয়ে মোহাচ্ছন্ন ছিলেন বেশি। বছরের পর বছর ধরে মুগাবে নিজের ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন সহিংসতা ও নির্যাতনের মাধ্যমে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা, আদালতকে লঙ্ঘন করা, সম্পত্তি অধিকার চূর্ণবিচূর্ণ করা, স্বাধীন গণমাধ্যমকে দমন ও নির্বাচনে কারচুপি করাই ছিল তার ক্ষমতায় থাকার কৌশল।’
(এএফপি অবলম্বনে)
No comments