জনমনে নতুন প্রত্যাশা



বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘ভিশন-২০৩০’-এর দিকে আজ নজর থাকবে সবার। কী চমক থাকছে এ ভিশনে- এ নিয়ে অনেকের মাঝেই সৃষ্টি হয়েছে কৌতূহল ও আগ্রহ। বিগত কয়েক দিন ধরে বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলে আসছেন, রাজনীতিতে নতুন ধারা ও অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি থাকবে ‘ভিশন-২০৩০’-এ। তাদের এমন বক্তব্যে অনেকের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নতুন স্বপ্ন ও প্রত্যাশার।  অতীতমুখিতা বা লিখিত কিছু প্রতিশ্রুতি নয়, সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটবে এ ভিশনে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষক, সুশীল সমাজসহ দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর আলোচনায়ও স্থান পেয়েছে ভিশন-২০৩০। আজ বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টায় রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ভিশন উপস্থাপন করবেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, বিরোধী দল থেকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও ডেপুটি স্পিকার পদ, ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা, মাথাপিছু আয় পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার, প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কে নেয়া, দেশীয় বিনিয়োগে নানা সুযোগ-সুবিধাসহ আড়াই শতাধিক দফা থাকবে বলে জানা গেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, নতুন ধারার রাজনীতি ও অর্থনীতির যে স্বপ্ন বিএনপি দেখিয়ে আসছে, তাতে এ ভিশন নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণে দলটি ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে তাদের চরম মাশুল দিতে হবে। ভবিষ্যতে যতই স্বপ্ন দেখানো হউক, সাধারণ মানুষকে আস্থায় আনা কঠিন হবে বলে তাদের আশঙ্কা। তাদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।
কয়েক বছর ধরে আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়ায়, সংঘর্ষে সাধারণ মানুষ আরও বেশি ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে দেশি ও বিদেশি শুভাকাক্সিক্ষদের পরামর্শ এবং বর্তমান বাস্তবতায় নতুন কিছু করার চিন্তা করে দলটির হাইকমান্ড। হতাশ ও ক্ষুব্ধ মানুষকে নতুন কিছু স্বপ্ন দেখানোর দীর্ঘ কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্য নিয়ে ভিশন-২০৩০ তৈরি করা হয়েছে। জানা গেছে, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি কী কী করবে, তার একটি দলীয় কর্মপরিকল্পনা নিয়েই তৈরি করা হয়েছে এ ভিশন। সোমবার রাতে ও মঙ্গলবার দুপুরে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে খসড়া চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এ ভিশন চূড়ান্ত করা হয়। আগামী নির্বাচনে অংশ নিলে ‘ভিশন-২০৩০’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই প্রণয়ন করা হবে নির্বাচনী ইশতেহার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে গেলে কী কী কাজ করব, ২০৩০ সালে আমরা কেমন দেশ দেখতে চাই, সেই স্বপ্নটা কীভাবে জাতিকে দেখাতে চাই- এসব বিষয় তুলে ধরবেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া ও স্বপ্ন পূরণের মতো অনেক কিছু এতে থাকবে বলে জানান তিনি। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ওদের (বিএনপি) যে ঘুম ভেঙেছে এতেই আমি খুশি। আমার প্রত্যাশা, সবকিছু রাজধানীকেন্দ্রিক না হয়ে বিকেন্দ্রীকরণ হওয়ার ঘোষণা থাকবে। সবক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন দেখতে চাই। সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা থাকবে।
ভিশন-২০৩০ : সোমবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভিশন ২০৩০-এ প্রস্তাবিত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। নীতিনির্ধারকদের বেশিরভাগ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তাদের বিরোধিতায় পর এ বিধানটি বাদ রেখে বৈঠক স্থগিত করা হয়। মঙ্গলবার দুপুরে আবারও বৈঠকে বসেন তারা। সূত্র জানায়, শেষ পর্যন্ত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব পরীক্ষামূলকভাবে রাখা হতে পারে। তবে এর বাস্তবায়ন নিয়ে বিরোধী দলসহ বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ভিশন-২০৩০-এ দুর্নীতির সঙ্গে কোনো আপস নয়- এমন প্রতিশ্রুতির আলোকে তিনটি ‘গুড’ বা ‘সু’ অর্থাৎ থ্রিজির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। এ থ্রিজি হলো- গুড পলিসি, গুড গভর্ন্যান্স ও গুড গভর্নমেন্ট। অর্থাৎ সুনীতি, সুশাসন ও সু-সরকার। অর্থনীতি উন্নয়নে দেশীয় শিল্প বিকাশে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি থাকবে ভিশনে। এছাড়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বন্দি অবস্থায় অমানবিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো, আটক অবস্থায় মৃত্যুর তদন্ত, উচ্চআদালতে বিচারক নিয়োগে আইন, ন্যায়পাল গঠন, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা ও তদারকি বাড়ানো, বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা, প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানো, পুলিশের এএসআই ও কনস্টেবলদের ওভারটাইম ও রেশনের মাধ্যমে খাদ্যপণ্য দেয়ার পাশাপাশি সমমূল্যের অর্থ দেয়াসহ সার্বিক সুবিধা দেয়ার বিষয়টি ঘোষণায় থাকবে।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে জনগণের সম্মতি গ্রহণে ‘রেফারেন্ডাম’ বা ‘গণভোট’ ব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃপ্রবর্তন করার ঘোষণা দেবেন খালেদা জিয়া। গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সুশাসনের জন্য নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতো সাংবিধানিক ও আধা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি, অনিয়ম ও দলীয়করণমুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। প্রশাসনকে গতিশীল করার লক্ষ্যে ভিশনে উল্লেখ করা হয়েছে, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করে সততা, দক্ষতা, মেধা, যোগ্যতা, দেশপ্রেম ও বিচার ক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রশাসন, পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হবে। জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ন্যায়পালের পদ ও কার্যালয় সক্রিয় করবে দলটি। ভবিষ্যতে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনে কঠোরতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। এছাড়া পরিবেশদূষণ রোধ, জলবায়ু পরিবর্তন, দেশের অভ্যন্তরে প্রাপ্ত জ্বালানির সর্বোত্তম ব্যবহার, আবাসন খাতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিতকরণ, ওয়াকফ সম্পত্তির পরিচালনা ও ব্যবহারে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত, দেবোত্তর সম্পত্তিগুলো হিন্দু শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী পরিচালনার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করাসহ নতুন এক সামাজিক সমঝোতা বা চুক্তিতে উপনীত হতে বিএনপি উদ্যোগ নেবে।

No comments

Powered by Blogger.