শিথিল আওয়ামী লীগের চেইন অব কমান্ড
আওয়ামী লীগের তৃণমূল বেসামাল হয়ে পড়েছে। সঙ্ঘাত, মারামারি, সংঘর্ষ ও খুনোখুনি লেগেই আছে তৃণমূলে। এই পরিস্থিতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না হাইকমান্ড, বরং এতে দলের চেইন অব কমান্ড ক্রমেই শিথিল হয়ে পড়ছে। ঢাকায় ডেকে এনে অনুনয়-বিনয় কিংবা ধমক দিয়েও তৃণমূল নেতাকর্মীদের বাগে আনতে পারছে না দলটি। সোমবারও নরসিংদীর রায়পুরায় প্রতিপক্ষের হাতে আওয়ামী লীগের দুই কর্মী নিহত হয়েছেন। একই এলাকায় গত ১৯ এপ্রিল ওই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের দুই কর্মী নিহত হন। এতে গত এক মাসে ক্ষমতাসীন এই দলের ১০ জন নেতাকর্মী নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। রোববার রাতে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে এক নেতার রক্তাক্ত লাশ পাওয়া গেছে। দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়েছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের শ্রীপুরে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রেরÑ আসকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ হয়েছে ৩৫টি। ওই সংঘর্ষে ছয়জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৫৭৬ জন। আওয়ামী লীগ-যুবলীগের মধ্যে একটি সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও ২২ জন আহত হয়েছেন। এ সময়ে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে তিনটি। এতে আহত হয়েছেন ৩১ জন। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে গত তিন মাসে সারা দেশে চারটি সংঘর্ষে দু’জন নেতাকর্মীকে হারিয়েছে ছাত্রলীগ। গত ২০১৬ সালে রাজনৈতিক সঙ্ঘাতে দেশে ১৭৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগেরই ৮৩ জন। আর ২০১৫ সালে রাজনৈতিক সঙ্ঘাতে প্রাণহানি হয়েছে ১৫৩ জনের। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের মধ্যে সঙ্ঘাতে নিহত হয়েছেন ৩৩ জন।
২০১৪ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল ১৪৭। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ৩৪ জন। সূত্রে জানা গেছে, সোমবার নরসিংদীর রায়পুরায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বাঁশবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল হক এবং সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রাজনগর গ্রামের জয়নাল মিয়া ও সোবহানপুর গ্রামের আরশ আলী নিহত হন। এর আগে গত ১৯ এপ্রিল একই এলাকায় উভয়ের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে দু’জন নিহত হন। সোমবার ঝুট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় যুবলীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে কমপক্ষে পাঁচ নেতাকর্মী আহত হন। একই দিনে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ১২ জন আহত হন। রোববার রাতে কক্সবাজারের উখিয়া গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলাকালে কিশোর মজিবুর রহমান জাবু নিহত হয়। সে পালংখালী উচ্চবিদ্যালয় স্কুল কমিটি ছাত্রলীগের সভাপতি ছিল। একই দিন রাতে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে নিজ বাড়ির সামনে করেরহাট ইউনিয়ন যুবলীগের সহসভাপতি গোলাম মোস্তফার রক্তাক্ত লাশ পাওয়া গেছে। গত ৭ মে পিরোজপুর সদর উপজেলার কদমতলা গ্রামে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন সাকিব হাওলাদার। গত ২ মে মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়। এতে ১০ জন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। গত ৩০ এপ্রিল ফরিদপুরের সালথায় আটঘর ইউনিয়নের গোয়ালপাড়া গ্রামে ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শহিদুল হাসান খান সোহাগের বাড়িতে হামলা চালায় প্রতিপক্ষ। এতে উপর্যুপরি ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হন প্রবাসী জিয়াউর রহমান জিয়া। ১৮ এপ্রিল রাতে কুমিল্লার মুরাদনগরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি সদস্য আলী আশ্রাফ এবং আলাউদ্দিন আনিস গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আওয়ামী লীগ কর্মী ফারুক ও সাইদুর নিহত হন। একই দিনে ফরিদপুরের সালথায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপে দফায় দফায় সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। ১৬ এপ্রিল শরীয়তপুরের নড়িয়ায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হন। এর আগে গত বছর ২০ জুলাই শরীয়তপুরের নড়িয়ার জবসা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান শওকত আলীর সমর্থকেরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেন হাওলাদারকে কুপিয়ে হত্যা করে। গত ১৭ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় একটি জলমহাল দখলকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপে রক্তয়ী সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন নিহত হন।
এ ঘটনায় আহত হন আরো ২০ জন। এর আগের রাতে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিরোধের জের ধরে বড়মাছুয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কাইয়ুম হোসেনকে কুপিয়ে জখম করে প্রতিপরে নেতাকর্মীরা। এর আগে গত ১২ জানুয়ারি রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে সিট ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এর আগে ১০ জানুয়ারি আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজ সিকদার এবং সাবেক চেয়ারম্যান শফিউদ্দিনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হোসেন খাঁ নিহত হন। গত ৩ জানুয়ারি বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক কাজী মজিবুর রহমানের বাসভবনে হামলা চালায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এর আগের দিন কক্সবাজারের চকরিয়ায় ইয়াবার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ইটের আঘাতে আহত হন এক প্রবীণ শিক্ষক। নতুন বছরের শুরুতেই গণমাধ্যমের শিরোনামে আসে খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ। মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জেড এ মাহমুদকে ল্য করে প্রতিপক্ষ গুলি করলে ল্যভ্রষ্ট হয়ে এক পথচারী নারী নিহত হন। এ ঘটনায় জেড এ মাহমুদ অভিযোগ করেন, মাদক ব্যবসার বিরোধিতা করায় তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এর আগে ৩১ জুলাই খুলনায় ছাত্রলীগ নেতা সৈকতকে খুন করে প্রতিপরে নেতাকর্মীরা। এ দিকে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে আনুষ্ঠানিকভাবে যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা ও নীলফামারীর নেতাদের সাথে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। প্রতিটি বৈঠকে তিনি কোন্দল নিরসনের জন্য সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের তাগিদ দেন। এ ছাড়াও দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকেরা আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডি কার্যালয়ে তৃণমূল নেতাদের ডেকে এনে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করছেন। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম মুখপাত্র ড. হাছান মাহমুদ এমপি নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। এত বড় দলের তৃণমূল পর্যায়ে ছোটখাটো কিছু মতদ্বৈধতা থাকতেই পারে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যেহেতু টানা দুইবার ক্ষমতায় আছে, সেহেতু আমাদের দলে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল অনুপ্রবেশ করেছে বলে আমরা মনে করি। ওই মহলই এসব কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে এখন এক ধরনের সুবিধাবাদিতা কাজ করছে। সিনিয়রদের পাশাপাশি জুনিয়ররাও আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, আর্থিক সংশ্লিষ্টতার ক্ষেত্রে একে অপরের ওপর ভাগ বসাতে চায়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় আছে। নেতাকর্মীরা ক্ষমতার দাপট দেখাতে গিয়েও অনেক ক্ষেত্রে সংঘর্ষ ও মারামারি করছে। প্রকৃতপক্ষে ধীরে ধীরে দলের চেইন অব কমান্ড ভেঙে যাচ্ছে। বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক গোলাম মওলা রনি বলেন, এটা সুযোগসন্ধানীদের কাজ। যারা এসব করছে তারা হলো দলীয় সুবিধাভোগী অথবা সুবিধা ভোগপ্রত্যাশী। কেউ ভোগ করছে। আবার এসব ভোগ প্রত্যাশীরা ভাগ বসাতে গিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না।
No comments