ডাকসু নির্বাচন না হলে নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি হবে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচন ইজ আ মাস্ট। নির্বাচন না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে।’ শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গতকাল শনিবার রাষ্ট্রপতি এসব কথা বলেন। হাজারো শিক্ষার্থীর মিলনমেলায় উৎসবমুখর পরিবেশে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ আড্ডার মঞ্চায়ন করতে তাঁরা হাজির হন কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে। এক সপ্তাহ ধরেই এ নিয়ে ক্যাম্পাসে উৎসাহ, উদ্দীপনা ছড়াচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে ছিল টুপি-গাউন ক্যামেরার ছড়াছড়ি। রাষ্ট্রপতি ছাত্ররাজনীতিতে নিয়মিত ছাত্রদের অংশগ্রহণের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ৫০ বছর বয়সে নেতৃত্ব দিলে যাঁদের বয়স ২০-২২ বা ২৫ বছর, তাঁদের সঙ্গে অ্যাডজাস্টমেন্ট কীভাবে হবে? লিখিত বক্তব্যে আচার্য বলেন, ছাত্ররাজনীতির বর্তমান হালচাল দেখে মনে হয়, এখানে আদর্শের চেয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের প্রাধান্য বেশি। গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করতে হলে দেশে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। আর সেই নেতৃত্ব তৈরি হবে ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমেই। তিনি বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে অছাত্ররাই ছাত্ররাজনীতির নেতৃত্ব দেয়, নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে ছাত্ররাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের এমনকি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা, সমর্থন ও সম্মান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। এটি দেশ ও জাতির জন্য শুভ নয়।’
গতকাল স্নাতকদের আনন্দকে দ্বিগুণ করে তোলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের প্রাণবন্ত বক্তৃতা। লিখিত বক্তব্যের একপর্যায়ে তিনি নিজের জীবনের কথা বলতে শুরু করেন, ‘আমার নিজের কাছেই অবাক লাগে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। ’৬১ সালে ম্যাট্রিক পাস করেছি, থার্ড ডিভিশন। ইন্টার পাস করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসলাম কিন্তু ভর্তি তো দূরের কথা, ভর্তির ফরমটাও আমাকে দেওয়া হয় নাই। বন্ধুবান্ধব অনেকে ভর্তি হলো, আমি ভর্তি হলাম গুরুদয়াল কলেজে।’ রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পুরো সময়জুড়ে হাসির রোল ওঠে সমাবর্তনস্থলে। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমাদের কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। তবে সমাবর্তনে আমাদের ডাকা হতো না। যারা অনার্স-মাস্টার্সে ছিল, তাদের ডাকা হতো। কনভোকেশনে ক্যাপ-গাউন পরার খায়েশ ছিল। কিন্তু আল্লাহর কী লীলাখেলা, বুঝলাম না, যেই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হইতে পারলাম না, সেইখানে আমি চ্যান্সেলর হইয়া আসছি। বাংলাদেশে যতগুলি পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সবগুলির আমি চ্যান্সেলর।’ রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ‘আমার নিজেরও ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি। কিন্তু সেই সময়ের রাজনীতি আর আজকের ছাত্ররাজনীতির তফাত অনেক। ষাটের দশকে আমরা যারা ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলাম, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল দেশ ও জাতির কল্যাণ। দেশের মানুষকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের কোনো স্থান ছিল না। সাধারণ মানুষ ছাত্রদের সম্মানের চোখে দেখত।’ রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘নিজের কথা কী বলব, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েই বিয়ে করে ফেলেছি। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রসংগঠনের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারির বয়স ৪৫-৫০ বছর। আমি একটু আর্লি করসি। তবে ২৫-২৬ বছর যদি বিয়ের বয়স ধরা হয়, তবে তো তার ৫০ বছর বয়সে এক সন্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কথা। বাপ-বেটা মিলে ইউনিভার্সিটিতে থাকার কথা।
বাপ নেতা আর ছেলে ছাত্র। এটা হতে পারে না।’ এবারের সমাবর্তন বক্তা ছিলেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিওর উপাচার্য অমিত চাকমা। তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের দশম প্রেসিডেন্ট। একজন রাসায়নিক প্রকৌশলী হিসেবে বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জন করেছেন। সমাবর্তনে তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি দেওয়া হয়। অমিত চাকমা বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমার কর্মজীবনে সফলতার কারণ, আমি মেধাবী না হলেও মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করেছি।’ তিনি বলেন, সর্বস্তরে সফল নেতাদের তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল। এগুলো হলো—যোগ্যতা, কর্মনিষ্ঠা ও চারিত্রিক গুণ। সমাবর্তনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অমিত চাকমা বলেন, এটা শিক্ষাযাত্রার সমাপ্তি নয়। একটি মাইলফলক মাত্র। শিক্ষার আলো দিয়ে অজ্ঞানতার অন্ধকার মুছে ফেলতে হবে। প্যারাস্যুট যেভাবে খুলতে হয়, মনের দরজা সেভাবে খুলে দিতে হবে। নিজের ক্ষমতাকে সৎ কাজে ব্যবহার করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সমাবর্তন পাওয়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘শুধু সার্টিফিকেট অর্জন বা পরীক্ষায় ভালো ফল করে দেশের কল্যাণ সাধন করা সম্ভব নয়। এ জন্য ভালো মানুষ হতে হবে।’ সমাবর্তন উপলক্ষে ক্যাম্পাসকে সাজানো হয় মনোরম সাজে। বিভিন্ন বিভাগ, ইনস্টিটিউট ও ভবন ছাত্রছাত্রীদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। মেডিকেল-ডেন্টাল থেকে অনেক শিক্ষার্থী সমাবর্তনে অংশ নেন। সন্ধ্যাকালীন কোর্স করা শিক্ষার্থীরাও দিনটিতে সবার সঙ্গে উৎসবে মেতে ওঠেন। সমাবর্তনে সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. এনামউজ্জামানের সঞ্চালনায় এ সময় সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দীনসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনের প্রধান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট-সিন্ডিকেট সদস্য এবং একাডেমিক পরিষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিনরা অনুষদভুক্ত বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের ডিগ্রিপ্রাপ্ত গ্র্যাজুয়েটদের নাম উপস্থাপন করেন। মোট ১৭ হাজার ৮৭৫ জন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীকে সনদ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ৮০ জনকে স্বর্ণপদক, ৬১ জনকে পিএইচডি ও ৪৩ জনকে এমফিল ডিগ্রি দেওয়া হয়।
No comments