লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ টেলিটক
২০০৫ সালের মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের বাজারে যাত্রা শুরু করেছিল সরকারি মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটক। সে সময় টেলিটকের একটি সিম কেনার জন্য মানুষের দীর্ঘ লাইন ও অপেক্ষার ছবিও অনেকের মনে আছে। অনেক প্রত্যাশা নিয়ে পথচলা শুরু করা টেলিটক গত এক যুগে গ্রাহকের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে সরকারি নিরীক্ষা বলছে, গত এক যুগে টেলিটক তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। টেলিটকের ব্যর্থ হওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় ডাক, টেলিযোগাযোগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক (পিটিএসটি) নিরীক্ষা অধিদপ্তর বলছে, সম্ভাব্যতা যাচাই ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়াই বাংলাদেশের মুঠোফোন যোগাযোগ বাজারে অপারেটরটি প্রবেশ করে। এটি অপারেটরটির ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠার এক যুগ পরও লক্ষ্য অর্জনে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করতে না পারা এবং সর্বনিম্ন মানের গ্রাহক সন্তুষ্টির কারণে টেলিটক ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে টেলিটকের কার্যক্রম নিয়ে পিটিএসটির নিরীক্ষা অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, টেলিটক সরকারি কর্মচারীদের দিয়ে সর্বোচ্চ সরকারি সুবিধা নিয়ে এত দিন পরিচালিত হয়ে এসেছে। কিন্তু বাজারে প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার জন্য যে সক্ষমতা দরকার, সেটি অর্জনেই এটি ব্যর্থ হয়েছে।
এ অবস্থায় যত বিনিয়োগই করা হোক না কেন, টেলিটকের অবস্থার পরিবর্তন হবে না। ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এ নিরীক্ষা চালায় পিটিএসটি। নিরীক্ষায় বেশ কিছু বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়। এর মধ্যে প্রথমেই ছিল সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই বাজারে টেলিটকের প্রবেশ। এ বিষয়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়, যেকোনো ব্যবসা সফল করার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পথনকশা বা রোডম্যাপ থাকতে হয়। নির্দিষ্ট ফলাফল অর্জনের জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন, যা এক বছরের স্বল্পমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা দিয়ে বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু গত ১০ বছরে এমন কোনো পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেনি টেলিটক। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরির বিষয়ে নিরীক্ষা আপত্তিতে আরও বলা হয়েছে, তিন বছর চেষ্টা করেও ২০০৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে না পারা ছিল একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা। পরিকল্পনা প্রণয়নে চারটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আবেদন করলেও এরপর আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পিটিএসটির নিরীক্ষা আপত্তিতে বলা হয়েছে, গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় ৯৪ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন কর আদায় করে তা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি এই সরকারি কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির বাইরে থেকে আসা জনবলের পেছনে ৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা খরচ করেছে সংস্থাটি। দরপত্র না ডেকে বিভিন্ন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারে আরও ৮ কোটি টাকা খরচ করেছে তারা। গ্রাহক সন্তুষ্টির বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যাত্রা শুরুর পর থেকে টেলিটক এ বিষয়ে কোনো জরিপ করেনি। এটি ছাড়া গ্রাহকদের প্রকৃত সন্তুষ্টির মাত্রা পরিমাপ ও সেবার মান বাড়াতে করণীয় পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন। টেলিটকের গ্রাহক সন্তুষ্টি পরিমাপে পিটিএসটির নিরীক্ষা দল ১০টি জেলায় নিজেই একটি সমীক্ষা চালায়। এর মধ্যে ছয়টি বিভাগীয় শহর, দুটি পার্বত্য জেলা ও অন্য দুটি জেলা শহর থেকে মোট ১ হাজার ১৪৯ জন ব্যক্তির মতামত নেওয়া হয়। মতামত প্রদানকারীদের মধ্যে টেলিটকের ব্যবহারকারী ছিলেন ৪৩৬ জন আর ৭১৩ জন অন্য অপারেটরের গ্রাহক। নেটওয়ার্কের মান ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে টেলিটক ব্যবহারকারীদের কাছে করা প্রশ্নে ৭০ শতাংশ গ্রাহক তাঁদের অসন্তুষ্টির কথা জানান। বাকি ২২ শতাংশ তুলনামূলক সন্তুষ্টির কথা জানান। ৮ শতাংশ উত্তর েদননি। এ ছাড়া সেবাপ্রাপ্তির খরচ, গুণগত মান, সেবাকেন্দ্রের সুবিধা, কর্মীদের সহজলভ্যতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা-সংক্রান্ত মোট ১৪টি বিষয়ে টেলিটক ব্যবহারকারীরা তাঁদের মতামত দেন।
এসব বিষয়ের প্রতিটিতেই বেশির ভাগ ব্যবহারকারী অসন্তুষ্ট বলে মতামত দিয়েছেন। অন্য অপারেটরের সেবা ব্যবহারকারী ৭১৩ জন মতামত প্রদানকারী টেলিটক ব্যবহার না করার পেছনে নেটওয়ার্ক সমস্যাকে দায়ী করেন। ৫৫ শতাংশ গ্রাহক এটিকে এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ ছাড়া অন্য অপারেটরে কল করতে উচ্চ কলরেট, বিজ্ঞাপনের অভাব, অপারেটর পরিবর্তনের ঝামেলার মতো বিষয়ে মতামত দিয়েছেন অন্য অপারেটরের ব্যবহারকারীরা। পিটিএসটি এসব নিরীক্ষা আপত্তির বিষয়ে জানিয়ে গত বছর দুই দফায় টেলিটককে চিঠি দেয়। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেয়নি টেলিটক। টেলিযোগাযোগ-বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ গবেষক আবু সাইদ খান বলেন, টেলিটককে শুরু থেকেই একটি আমলানির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনা করা হয়েছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান চালানোর যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিবকেই এই ব্যর্থতার প্রধান দায় নিতে হবে। একে সরকার যদি সত্যিই চলতে দিতে চায়, তাহলে একে এর প্রতিযোগী বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মতোই বাজার সক্ষমতা ও পেশাদারি অর্জন করতে হবে। জানতে চাইলে টেলিটকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ছুটিতে ছিলাম, এখনো ছুটিতে আছি। এ বিষয়ে কাগজপত্র না দেখে কিছু বলতে পারব না।’ সরকারি নিরীক্ষার পাশাপাশি টেলিটকের কর্মকাণ্ড নিয়ে বেসরকারি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান এসিএনএবিআইএনের অনুসন্ধানে আরও বেশি দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে মোট ৩৩টি বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়। এর মধ্যে একটি হলো আর্থিক ও হিসাবরক্ষণের নির্দিষ্ট যেসব নীতিমালা রয়েছে, তার কোনোটাই প্রতিষ্ঠানটি অনুসরণ করেনি।
No comments