বিশ্বসভায় মায়ের ভাষায় বক্তৃতা
সাদা টি-শার্ট। বুকে লেখা ‘ইমালোন নুংশিসি’। মণিপুরিদের মৈতৈ ভাষায় এ কথার বাংলা হচ্ছে, মাতৃভাষাকে ভালোবাসি। মৈতৈ অক্ষরের কারুকার্যে এ কথা জুড়ে দেওয়ার উপলক্ষ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সিলেট নগরের পশ্চিম শিবগঞ্জের ফরহাদখাঁ পুল-সংলগ্ন এলাকায় মণিপুরি তাঁতশিল্পজাত পণ্যের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘মোইরাং’-এর বিপণনকেন্দ্রে শোভা পাচ্ছে এ টি-শার্ট। খোঁজ নিয়ে জানা গেল এই টি-শার্ট করার পেছনে মায়ের ভাষাকে বিশ্বসভায় উপস্থাপন করার কাহিনি। ‘ও তো জাতিসংঘে গিয়ে বিশ্ব মাত করে দিয়ে এসেছে, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ছড়াতেই এ আয়োজন!’ পাশে থাকা একজনকে দেখিয়ে এভাবেই কাহিনির সূত্রটা বলছিলেন মোইরাংয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও বেসরকারি সংস্থা এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (একডো) নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ। ‘ও’ বলে অভিহিত করা হলো যাঁকে, তিনি নোংপকলৈ সিনহা। মণিপুরি এই তরুণী একডোর সমন্বয়ক পদে চাকরি করছেন। তিনি জাতিসংঘ সদর দপ্তরে পরপর তিনটি অধিবেশনে যোগ দিয়ে মণিপুরি ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এ কারণে তিনি মণিপুরিদের মধ্যে আলাদাভাবে সমাদৃত। একডোর সমন্বয়কের দাপ্তরিক কাজ সেরে মোইরাং বিপণনকেন্দ্র পরিচালনার কাজও দেখভাল করেন নোংপকলৈ। মণিপুরি ভাষায় জাতিসংঘে বক্তৃতা দেওয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ জুড়তেই তাঁর চোখমুখে ফুটে ওঠে খুশির ঝিলিক। মায়ের ভাষায় বলতে পারার সেই মুহূর্তকে জীবনে বড় সুখস্মৃতি বলে জানালেন তিনি। নোংপকলৈ পড়াশোনা করেছেন সিলেটের এমসি কলেজে। সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। কলেজে থাকার সময়ই একডোতে তাঁর পেশাজীবন শুরু। ২০০৪ সালে মাঠ সমন্বয়ক পদ থেকে এখন প্রধান কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ দায়িত্ব পাওয়ার পর বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি হিসেবে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ সদর দপ্তরে তাঁর যাওয়া।
নোংপকলৈর মণিপুরি ভাষায় দেওয়া প্রথম বক্তব্য জাতিসংঘের স্বীকৃত ছয়টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন একডোর নির্বাহী পরিচালক। ২০১১ সালের ১৪ মে জাতিসংঘের বিশেষায়িত অঙ্গ সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন’ (ডব্লিউআইপিও)-এর আমন্ত্রণে একডোর প্রথম প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন নোংপকলৈ। পরের বছর ২০১২ সালের ২১ জুলাই যোগ দেন জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের ‘সাবসিডিয়ারি বডি’র আমন্ত্রণে পঞ্চম সেশনে। আর ২০১৩ সালের ২৬ জুলাই জাতিসংঘে ‘সাইড ইভেন্ট ও আদিবাসী ককাস’ শীর্ষক অধিবেশনে অংশ নেন। ওই তিন অধিবেশনেই ‘অ্যাজেন্ডা আইটেম-৫’-এর অধীন বাংলাদেশে মণিপুরিসহ অন্য সব নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষা ও উন্নয়ন বিষয়ে নোংপকলৈ লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সেসব বক্তৃতায় তাঁর শুরুটা ছিল মণিপুরি ভাষায়। তিনি বলেছিলেন, ‘অমসুং বাংলাদেশকী ফুরুপচা ময়ামগী মাকৈদগী মায়ামবু মতিকচবগা লোয়ননা ইকায়খুৎবা উৎচরি’ (বাংলাদেশের মণিপুরি এবং অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে উপস্থিত সবাইকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শুরু করছি...)। এটুকু জানিয়েই আপ্লুত নোংপকলৈ। অনেকটা সুখস্মৃতিতাড়িত হয়ে তিনি বলেন, ‘আমি খুব ভয়ের মধ্যে ছিলাম। কারণ, পৃথিবীর একটি অতি ক্ষুদ্র জাতির ভাষা বিশ্বসভায় উপস্থাপন করছি। কিন্তু না, দেখলাম ওই সভার সঞ্চালক থেকে শুরু করে সবাই উৎফুল্ল!’ নোংপকলৈ একজন সংস্কৃতিকর্মীও। সিলেট সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের লালাদিঘিরপাড় মণিপুরি পাড়ায় তাঁদের বাড়ি। বাবা অনিল কিষণ সিংহ সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিত মুখ, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা সিলেট বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। মা শান্তি রাণী দেবী গৃহিণী। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে নোংপকলৈ বড়। বোন আওয়াংলৈ সিনহা একজন নারী উদ্যোক্তা, ভাই বুঙসানা সিংহ সরকারি চাকরিজীবী।
No comments