‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ হয়ে উঠল প্রভাতফেরির গান
প্রথম শহীদ দিবস (১৯৫৩) পালনের আবেগ পরবর্তী শহীদ দিবসেও বিন্দুমাত্র কমে যায়নি। শুরুর দিকে শহীদ দিবসের প্রভাতফেরিতে মূল অনুঘটক স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। বাসন্তী ফুলের সময়। তাই ফুলের সমারোহ। পুষ্পবিলাসী নাগরিকদের বাগান থেকে ফুল তোলায় ক্বচিৎ বাধা পেয়েছে ছাত্রছাত্রীরা। একুশের আবেগ তখন যথেষ্ট বহমান ঢাকাই নাগরিকদের হৃদয়ে। সেই টানে হৃদয়ের একূল-ওকূল দুকূল ভেসে গেছে। প্রভাতফেরিতে চোঙা মুখে নিয়ে স্লোগান: ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’ ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু করো’। অবশ্য সেই সঙ্গে অন্যান্য স্লোগানও ছিল—যেমন ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ ‘আরবি হরফে বাংলা চালু বন্ধ করো’, কখনো ‘নুরুল আমিন গদি ছাড়’ ইত্যাদি। তবে প্রভাতফেরির মূল আকর্ষণ ছিল গান। সেই গানের সমবেত সুরের মায়ায় শহর ঢাকায় মানুষের ঘুম ভেঙেছে। কেউ ঘুম ভেঙে উঠেছেন, বারান্দায় বা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রভাতফেরির আবেগমথিত দৃশ্য দেখেছেন, উৎসাহী কেউ কেউ পাঞ্জাবি বা শার্ট-পাজামা পরিহিত অবস্থাতেই প্রভাতফেরির মিছিলে শামিল হয়েছেন।
হয়তো কেউ বিছানায় পাশ ফিরে শুয়েছেন। তবে তাঁদের অনেকে দুপুরের বিশাল মিছিলে বা আর্মানিটোলা বা পল্টন ময়দানের বাঁধভাঙা জনসভায় যোগ দিয়েছেন। শুরুর প্রভাতফেরির মিছিলে যোগ দিয়েছে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। বাদ যায়নি কারিগরি কলেজগুলো। যেমন মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ড স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ইত্যাদি। প্রথম প্রভাতফেরির গান ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে/ আজিকে স্মরিও তারে’। সুরটিতে ছিল করুণ অনুভূতির প্রকাশ। আর প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মিছিলে শোনা গেছে ছাত্রনেতা গাজীউল হকের লেখা গান, ‘ভুলবো না, ভুলবো না, ভুলবো না এ ফেব্রুয়ারি ভুলবো না’। এখানে ছিল প্রতিবাদী বলিষ্ঠতার প্রকাশ। ঢাকা কলেজের ছাত্র বান্ধবকুটির মেসনিবাসী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কবিতা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ১৯৫৩ সালে রচিত হলেও সুরারোপিত হয়ে এ গান গাওয়া হয়েছে ১৯৫৪ সালের প্রভাতফেরিতে এবং এরপর থেকে নিয়মিত। এ ছাড়া একাধিক কবি লিখেছেন একুশের গান, যদিও সেগুলো প্রভাতফেরিতে গাওয়া হয়নি। আমার বিশ্বাস, ১৯৫৪ সালের শহীদ দিবস পালনে ছিল তেপ্পান্নর তুলনায় আরও ব্যাপককতা, আরও আবেগ। এর বড় কারণ ক্রমবর্ধমান ভাষিক চেতনা ও সংশ্লিষ্ট জাতীয়তাবাদীদের আবেগ। মুসলিম লীগের দুঃশাসনের প্রতিক্রিয়াও এতে জ্বালানি যোগ করেছে। আর সেই ধারায় ছাত্রসংগঠনগুলো মতাদর্শগত পার্থক্য ভুলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার অধিকার আদায়ে এক যাত্রায় শরিক হয়েছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এমনটাই বলে। এই অবস্থায় ছাত্রমহলের ঐক্যবদ্ধ চেতনার সুবাতাস বুকে ভরে ১৯৫৪ ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবস পালিত হয় অপেক্ষাকৃত অধিক আবেগে, ব্যাপক উদ্দীপনায়। বিলুপ্ত শহীদ মিনারের স্থান থেকে খালি পায়ে গান গেয়ে স্লোগান দিয়ে শহীদদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আজিমপুর করবরস্থানে যাওয়া ছিল গোটা কর্মসূচির প্রভাতি অংশ। সেবারের গান ছিল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা কবিতা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। আলতাফ মাহমুদের হৃদয় স্পর্শ করা সুরে এ গানটিই শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে একুশের গান,
যা আজও শহীদ দিবস উপলক্ষে গাওয়া হয়। শুধু শহর ঢাকাতেই নয়, প্রদেশজুড়ে সর্বত্র প্রবল আবেগে পালিত হয়েছে শহীদ দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি। এই সাংস্কৃতিক আবেগের সঙ্গে যুক্ত হয় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সচেতনতা, যা যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে সহায়তা করে। অন্যদিকে এই বিজয়কে নস্যাৎ করার পর ইস্কান্দার মির্জার গভর্নরি শাসনের দমননীতির মধ্যেও ১৯৫৫ ফেব্রুয়ারিতে সীমিত আকারে হলেও ছাত্রদের চেষ্টা চলেছে একুশে পালনের। ইতিমধ্যে ঘটনার চাপে গভর্নর শাসন বাতিল হওয়ার পর যুক্তফ্রন্টের দুই প্রধান দলের আত্মঘাতী দ্বন্দ্বের মধ্যে গঠিত আবুল হোসেন সরকার মন্ত্রিসভার আমলে শহীদ দিবস (১৯৫৬) পালনে ছাত্রসমাজে আবেগের কমতি ছিল না। ফুল হাতে গানে-স্লোগানে তারা শহীদ দিবসটিকে স্মরণ করেছে। যথারীতি ভোরে প্রভাতফেরির মিছিল, শহীদদের কবরে ফুলের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন—সবই ঠিকঠাকমতো চলেছে। এ বছরের (১৯৫৬) গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রভাতফেরির মিছিলে গাওয়া তফাজ্জল হোসেনের লেখা গান ‘শহীদি খুন ডাক দিয়েছে আজকে ঘুমের ঘোরে’। এ বছরের জুনে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি মেলে, তবে তা নামকাওয়াস্তে। আহমদ রফিক: ভাষাসংগ্রামী, কবি ও রবীন্দ্র-গবেষক
No comments