ধলেশ্বরীতে ট্যানারি বর্জ্য দূষণ আরও বেড়েছে
সাভারে ধলেশ্বরী নদীতে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী ট্যানারি থেকে নির্গত বর্জ্যে দূষণ আরও বেড়েছে। ট্যানারির বর্জ্যের কারণে নদীটির নতুন নতুন এলাকা দূষণের শিকার হচ্ছে। চামড়াশিল্প নগরীর প্রধান বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র (সিইটিপি) থেকে নির্গত হওয়া পানি দ্বিতীয় দফায় পরীক্ষা করে এ তথ্য পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশবাদীরা বলছেন, সাভারের হেমায়েতপুরের পরিকল্পিত ওই চামড়াশিল্প নগরী নিয়ে অনেক বছর ধরে আলোচনা হয়েছে। দীর্ঘ সময় বেঁধে দিয়ে ট্যানারিগুলোকে সেখানে পর্যায়ক্রমে পাঠানো হচ্ছে। এরপরও সেখানে দূষণ হওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর গাফিলতিকে দায়ী করছেন পরিবেশবাদীরা। নিয়ম না মেনে সিইটিপি চালু করায় ট্যানারিগুলোর বর্জ্য সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে এসেছে। প্রথম দফার পরীক্ষার পর সিইটিপি নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা চীনা প্রতিষ্ঠান জিনসু লিংঝি এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন কোম্পানিকে শিল্প মন্ত্রণালয় ৫০ লাখ টাকা জরিমানাও করে।
কিন্তু দ্বিতীয় দফার পরীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, জরিমানার পর দূষণের মাত্রা আরও বেড়েছে। চামড়াশিল্প নগরীতে ১৫৪টি ট্যানারি প্লট পেয়েছে। চামড়াশিল্প নগরী কার্যালয়ের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৪৩টি ট্যানারি রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে ওয়েট ব্লু (চামড়া প্রক্রিয়াকরণ) স্থানান্তর করেছে। আর ওয়েট ব্লুর জন্য ড্রাম স্থাপন করেছে ৫২টি প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ সব ট্যানারি স্থানান্তরের আগেই ধলেশ্বরী যে পরিমাণ দূষণের শিকার হয়েছে, সব কটি সেখানে গেলে এর মাত্রা কয়েক গুণ বাড়বে বলে আশঙ্কা পরিবেশবাদী ও স্থানীয় মানুষের। পরিবেশ অধিদপ্তর গত ১২ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরী থেকে নির্গত পানি পরীক্ষা করে। এই পরীক্ষায় পানিতে মানব ও প্রাণিদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক উপাদান ক্রোমিয়ামের পরিমাণ নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে আড়াই গুণ বেশি পাওয়া গেছে। পানির তাপমাত্রা থেকে শুরু করে দ্রবীভূত অক্সিজেন, ক্ষার, বিদ্যুৎ পরিবাহন, ক্রোমিয়ামের পরিমাণ, লবণের পরিমাণ, রাসায়নিক উপাদান, জৈব রাসায়নিক উপাদানের পরিমাণ পরীক্ষা করা হয়েছে। অক্সিজেন ছাড়া বাকি সাতটি নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। আর অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, সিইটিপি থেকে নির্গত প্রতি লিটার পানিতে তাপমাত্রা পাওয়া গেছে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রা থাকার কথা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ক্ষারের পরিমাণ থাকার কথা ৬ মাইক্রোগ্রাম, পাওয়া গেছে প্রায় সাড়ে ৮ মাইক্রোগ্রাম।
রবীভূত অক্সিজেন থাকার কথা সাড়ে ৪ থেকে ৮ মাইক্রোগ্রাম, পাওয়া গেছে শূন্য দশমিক ২ গ্রাম। জৈব রাসায়নিকের পরিমাণ স্বাভাবিক পানিতে থাকার কথা ১ গ্রাম, কিন্তু ধলেশ্বরীর ওই অংশে পাওয়া গেছে ২৭৫ গ্রাম। রাসায়নিকের পরিমাণ থাকার কথা ২ গ্রাম, পাওয়া গেছে ৭ গ্রাম। এই দুটি উপাদানই আগেরবারের পরীক্ষায় অর্ধেকেরও কম পাওয়া গিয়েছিল। পানিতে দ্রবীভূত রাসায়নিক উপাদান থাকার কথা ২১ গ্রাম, রয়েছে প্রায় ৭৮ গ্রাম। অক্সিজেন ছাড়া অন্য সাতটি উপাদান নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি থাকা পানি পান করলে এবং ওই পানি প্রাণিদেহের সংস্পর্শে এলে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। ওই পানিতে প্রাণী ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকাও কঠিন হয়ে যাবে। আর যেগুলো বেঁচে থাকবে, সেগুলো বিষাক্ত হয়ে উঠবে। যা ওই নদীর তো বটেই, এর তীরবর্তী এলাকায় বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশবাদীরা। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ধলেশ্বরী দূষণের নতুন উৎস চামড়াশিল্প নগরীর ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয়কে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছেন। গত ২৯ ডিসেম্বর ওই পানি পরীক্ষা করে যে মাত্রায় দূষণ পাওয়া গিয়েছিল, ১২ জানুয়ারির পরীক্ষায় তার চেয়ে বেশি দূষণ পাওয়া গেছে; যা নদীটিকে বুড়িগঙ্গা-বালু ও শীতলক্ষ্যার মতো মারাত্মক দূষণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার গুডস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন,
ওই চীনা কোম্পানি শুরু থেকেই দুই নম্বরি করছে। তাই তাদের কোনো বিশ্বাস নেই। জরিমানার পরও তারা যেহেতু দূষণ চালিয়ে যাচ্ছে, তার মানে তাদের আরও কঠোর শাস্তি দিতে হবে। ২৯ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে প্রথমবারের মতো চামড়াশিল্প নগরী-সংলগ্ন এলাকার ধলেশ্বরীর পানি পরীক্ষা করে তাতে দূষণের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ৯ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘ট্যানারির বর্জ্যে আক্রান্ত ধলেশ্বরী’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ১১ জানুয়ারি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান আতাহারুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ধলেশ্বরীর ওই এলাকা পরিদর্শনে যায়। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে চামড়াশিল্প নগরী কর্তৃপক্ষ ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে দূষণের বিষয়টি অবহিত করে বেশ কিছু সুপারিশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত এক মাসেও এর কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি বলে জানা গেছে। উল্টো পরিবেশ অধিদপ্তরের দ্বিতীয় দফা পরীক্ষায় দূষণ আগের চেয়ে বেড়েছে। জানতে চাইলে আতাহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ধলেশ্বরীর দূষণ রোধে চামড়াশিল্প নগরীর জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়কে বেশ কিছু সুপারিশ করেছি। তারা বলেছিল, সেই সুপারিশ তারা মেনে চলবে। দূষণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আমরা সরকারের আরও শীর্ষ মহলে তুলে ধরব।’ ধলেশ্বরীর দূষণ নিয়ে ৩ ফেব্রুয়ারি সাভার উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে গণশুনানি হয়। এই গণশুনানির আয়োজন করে অ্যাসোসিয়েশন ফর রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা),
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), নিজেরা করি এবং নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদ। সহযোগিতা করে কমিউনিটি লিগ্যাল সার্ভিসেস (সিএলএস)। গণশুনানিতে ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের কথা শোনেন সাভারের সাংসদ এনামুর রহমান, উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফখরুল আলম, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সভাপতিত্ব করেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। গণশুনানিতে স্থানীয় লোকজন বলেন, দূষণের কারণে নদীর মাছ মরে ভেসে উঠছে। জমিতে ফসল হয় না। দুর্গন্ধে থাকা যায় না। বুড়িগঙ্গার মতো পরিণতির দিকে যাচ্ছে ধলেশ্বরী। গণশুনানিতে সিইটিপিকে শতভাগ কার্যকর করে সব বর্জ্য শোধন করে বের করার কথা বলা হয়। জানতে চাইলে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, চামড়াশিল্পসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দূষণের কারণে ঢাকার চারপাশের বেশির ভাগ নদী মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। ধলেশ্বরীর অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল। এখন সেটাও দূষিত করে ফেলা হচ্ছে। দেশের পরিবেশ আইন ও সংবিধান অনুযায়ী নদীদূষণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আশা করি সরকার দূষণরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।
No comments