ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ছবিতে
উঠানের গাছ আর দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে রাখা আছে ৭ ফুট লম্বা ও ৫ ফুট চওড়া ৪০টি বোর্ড। কালো পটভূমির প্রতিটি বোর্ডে সাদাকালোতে ফুটে আছে অগ্নিঝরা দিনের কথা। ধানমন্ডির ১০ নম্বর সড়কের এই বাড়িতে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস মূর্ত হয়ে আছে ছবিতে। ধানমন্ডি ১০ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়িটি ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের। এর আঙিনাতেই চলছে ভাষা আন্দোলনের ৪০টি দুর্লভ ছবি নিয়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনী। এই বাড়িতেই গড়ে ওঠা ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর মাসব্যাপী এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বাঙালির সংগ্রামের প্রসঙ্গ উঠলেই যে তারিখটা মনের মধ্যে জ্বল জ্বল করে,
সেটা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এই দিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনাই চেতনায় খেলে যায়। কিন্তু ভাষাসংগ্রামের ইতিহাসের প্রথম হামলা হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১২ ডিসেম্বর। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে একদল ভাড়াটে সন্ত্রাসী বাস ও ট্রাকে চড়ে দল বেঁধে এসে হামলা চালায় পলাশী ব্যারাকে। হামলার বর্ণনাসহ পলাশীর মোড়সংলগ্ন সেই হারিয়ে যাওয়া ব্যারাকের ছবি রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। আছে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মিছিল-সমাবেশের অনেক চেনা ও অচেনা ছবি। সব মিছিলের ছবিতেই মেয়েরা আছেন সামনের দিকে। ভাষা আন্দোলনে নারীদের অবদান নিয়ে ছাপার অক্ষরে পড়া ইতিহাস এই ছবিগুলোতে অনেক বেশি জীবন্ত বলে মনে হয়। ‘শিক্ষা ও কৃষ্টির গোড়ায় কুঠারাঘাত’, ‘রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম, আমাদের জীবনসংগ্রাম’—এমন সব প্রতিবাদী স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ডের ছবি যেন সেই সময়েই ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ছবি দেখতে দেখতে মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। উত্তর দিতে এগিয়ে আসেন যিনি, তাঁর নাম এম এ কামাল। কিছুদিন ধরে জাদুঘর দেখভালের দায়িত্ব পালন করছেন। পেশাগত জীবনে শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত। ‘১৯ আজিমপুর, ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার’ ক্যাপশনের একটি হলুদ দোতলা বড়ির ছবি সম্পর্কে জানতে চাইলে বুঝিয়ে বলেন, এই বাড়িতেই ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগঠন, তমুদ্দিন মজলিসের দপ্তর স্থাপন করা হয়েছিল। এই বাড়ি থেকেই আন্দোলনের সূচনা। তবে বাড়িটি এখন আর নেই। প্রদর্শনীতে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ব্যারাক এলাকায় স্থাপিত প্রথম শহীদ মিনারের ছবি। এই মিনার তৈরির দুই দিন পর,
১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, শাসকগোষ্ঠী তা ভেঙে ফেলে। ১৯৫৩ সালে তৎকালীন কলাভবন এলাকা (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ) এবং পুরোনো ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে স্থাপিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের ছবিও আছে এখানে। এগুলোও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলের শিকার হয়। ছাই রং করা দেয়ালে রঙিন বাংলা বর্ণমালা লেখা বাড়িটির চত্বরে আরও জায়গা পেয়েছে ভাষা আন্দোলনের ঘোষণাপত্র, তমুদ্দিন মজলিস প্রকাশিত পাকিস্তানের রাষ্ট্র-ভাষা বাংলা — না উর্দু? পুস্তিকার প্রচ্ছদের ছবি। আছে মাথায় গুলিবিদ্ধ ভাষাসৈনিক শহীদ রফিক উদ্দিনের ছবি। ১৯৫২ সালে রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিতর্কিত ঘোষণার মুহূর্তের ছবিও প্রদর্শিত হচ্ছে এখানে। ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরের পরিচালক এম আর মাহবুব বলেন, তরুণ প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানাতে তাঁদের এই আয়োজন। তিনি বলেন, শুধু বই পড়ার চাইতে ছবিতে দেখলে ছেলেমেয়েরা বিষয়গুলো অনেক ভালোভাবে বুঝতে পারে। ভাষাসংগ্রাম নিয়ে এই আলোকচিত্র প্রদর্শনীটি সবার জন্য উন্মুক্ত। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত (শুক্রবার বাদে) প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে কিলে ৫টা পর্যন্ত প্রদর্শনী চলবে।
No comments