প্রিয় আইনমন্ত্রী! প্রধান বিচারপতি হতাশ কেন? by গোলাম মাওলা রনি
প্রধান
বিচারপতির সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আইনমন্ত্রীর
প্রতিক্রিয়াটি আমার মোটেও ভালো লাগেনি। ভালো লাগেনি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের
প্রতিক্রিয়াটিও। সরকারদলীয় উভয় নেতার বক্তব্যে মেধা-মননশীলতা ও রুচিবোধের
কোনো বালাই ছিল না। তারা উভয়েই বিচারাঙ্গনের সিনিয়র সদস্য এবং একই সাথে
রাজনীতিবিদও বটে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ-পদবি ও মর্যাদা
সম্পর্কে তারা আমজনতার চেয়ে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল হবেন, এমনটি ধারণা করাই
স্বাভাবিক। তারা আমাদের বিচারাঙ্গনের পবিত্রতা এবং সুউচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে
শিক্ষা দেবেন এবং সরকারদলীয় কর্তা হিসেবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির অতন্দ্র
প্রহরী হয়ে বেকুব ও নালায়েকদের বেবোধা কথাবার্তা, আচরণ ও কর্মকাণ্ড থেকে
সংশ্লিষ্টদের হেফাজত করবেন। কিন্তু তারা যদি ব্যক্তি-গোষ্ঠী বা দলের
স্বার্থ বিবেচনা করে উল্টো পথে চলেন, তবে আমজনতা হিসেবে দুয়েকটি প্রশ্ন
করার এখতিয়ার আপনা-আপনিই পয়দা হয়ে যায়।
প্রধান বিচারপতি বলেছেন- অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা সংবিধানসম্মত নয়। দুনিয়ার কোথাও এমন নজির নেই। আমাদের দেশে দীর্ঘকাল ধরে এটি প্রথা হিসেবে চলে এলেও, বর্তমান প্রধান বিচারপতি তার আমলে অতীতের সেই প্রথাটিকে চালু রাখতে নারাজ। অবসরে রায় লেখা কেন এবং কিভাবে অসাংবিধানিক, তা-ও তিনি চমৎকারভাবে অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন, যা সাধারণ মস্তিষ্কের অল্প বুদ্ধি এবং বোধসম্পন্ন মানুষের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ফলে দেশের সাধারণ মানুষ প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে এবং একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে টেনে আনার জন্য সুধীসমাজ তাকে সাধুবাদ জানিয়েছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে অতি চালাক, স্বার্থপর ও দলকানা শ্রেণীর মানুষজনের জন্য। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পর সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নড়েচড়ে বসে। তারা বক্তব্যটিতে রাজনৈতিক রঙ লাগান এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে থাকেন। অনেকে আবার প্রধান বিচারপতিকে টুকটাক খোঁচাও দিতে শুরু করেন।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে একটি বিচারিক রায়ের মর্যাদায় উন্নীত করে বলতে থাকেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে। সরকার অবৈধ হয়ে গেছে- প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অবৈধ হয়ে গেছে। কারণ, ওই মামলার চূড়ান্ত রায় লিখেছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক তার অবসরে যাওয়ার বহু দিন পর। কিছু অনলাইন পত্রিকা হাল আমলের টকশোজীবী এবং বড়গলায় কথা বলা বিতর্কিত লোকজন ঘটনার গভীরে না ঢুকেই উল্টাপাল্টা বক্তব্য দিয়ে পুরো বিষয়টিকে রাজনীতিকীকরণ করে ফেলেন এবং বক্তব্যদাতা প্রধান বিচারপতিকে বিব্রত করতে থাকেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যাতে সন্দেহপ্রবণ লোকজন প্রপাগান্ডা চালানোর সুযোগ পান এই বলে যে- দেশের আপাত শান্ত রাজনীতি প্রধান বিচারপতির কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ মন্তব্য শুরু করেন, তিনি কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এই সময়ে হঠাৎ করে এমন একটি উদ্ভট কথা বললেন? তিনি কি সরকারের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করেন? প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসে এস কে সিনহার সাক্ষ্য সব প্রগাগান্ডার সমুচিত জবাব দেয়া সম্ভব ছিল না। তিনি শুধু ইঙ্গিতে নিজের মনোভাব বোঝানোর জন্য কোনো একটি অনুষ্ঠানে বললেন- পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দশজন বুদ্ধিজীবীর মধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অন্যতম।
বিরোধী দলগুলো যখন প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে তাদের প্রয়োজনে রাজনৈতিক রঙ মাখিয়ে নিজ নিজ দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রচার করে যাচ্ছিল, তখন সরকারের উচিত ছিল বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করা। এটা করা মোটেও কঠিন ছিল না। আমার মতো স্বল্পজ্ঞানের একজন আইনের ছাত্রকে যদি দায়িত্ব দেয়া হতো তাহলে আমি বিষয়টিকে এমনভাবে মোকাবেলা করতাম, যাতে প্রধান বিচারপতির সম্মান অক্ষুণ্ন থাকত এবং বিরোধী দলগুলোও চুপ হয়ে যেত। সরকারি দল স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় না এগিয়ে উল্টো প্রধান বিচারপতিকে আক্রমণ করে বসে। অ্যাটর্নি জেনারেল প্রথমে বলেন- এটা প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিগত বক্তব্য। এর সাথে আইন-আদালত ও সুপ্রিম কোর্টের কোনো সম্পর্ক নেই। পরে তিনি আবার বলেন- অবসরে গিয়ে রায় লেখা অবশ্যই সংবিধানসম্মত। সরকারি মদদপুষ্ট উকিল নেতারা এলোমেলো পেঁচানো বক্তব্য দিতে আরম্ভ করেন অনেকটা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হিং টিং ছট্ কবিতার মতো করে। আইনমন্ত্রী বলেন- প্রধান বিচারপতি ব্যক্তিগত হতাশা থেকে এ কথা বলেছেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আরো একধাপ এগিয়ে প্রধান বিচারপতিকে নসিয়তের সুরে বলেন- মুখে লাগাম দিন!
আমি সেনগুপ্ত বাবুর বক্তব্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না। কারণ, মুখে লাগাম দেয়ার পরামর্শটি অত্যন্ত অবমাননাকর। লাগাম শব্দটি মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা মোটেও রুচিসম্মত এবং বিবেচনাপ্রসূত নয়। কাজেই ওদিকে না গিয়ে আমরা বরং আইনমন্ত্রীর বক্তব্যটি পর্যালোচনার চেষ্টা করি। এ ক্ষেত্রে আমার প্রথম প্রশ্ন- প্রধান বিচারপতি কেন হতাশ হবেন?
দ্বিতীয়ত, আইনমন্ত্রী কি দেশের প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন কিংবা দেয়ার এখতিয়ার রাখেন? আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি মতে, আইনমন্ত্রী সরকারকে খুশি করতে গিয়েই কথাগুলো বলেছেন, যা প্রকারান্তরে তার নিজের বিরুদ্ধে চলে গেছে। এ বিষয়ে প্রকৃত ঘটনা অনুধাবনের জন্য প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের কিয়ৎ আগেকার কিছু ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
পত্রিকায় দেখলাম- প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে বলেছেন, বিচারাঙ্গনে অস্থিরতা চলছে। মূলত বিচারকবৃন্দের বেতনভাতা, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও স্বাধীনতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এবং মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরেই বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য চলে আসছিল। সুপ্রিম কোর্ট চাচ্ছেন বিখ্যাত মাজদার হোসেন মামলার রায় মোতাবেক সব ক্ষমতা তাদের হাতে ন্যস্ত থাকুক। অন্য দিকে, সরকারের নির্বাহী বিভাগ, অর্থাৎ মন্ত্রণালয় কিছুতেই তাদের ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি নয়। এ দিকে অন্য একটি মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট জেলা জজদের বেতন ও পদবি নির্ধারণ করে দেন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়কে সেই রায় বাস্তবায়নের নির্দেশ পাঠান। গত কয়েক বছরে বহুবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্টের সেই রায় বাস্তবায়নে অর্থ মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সুপ্রিম কোর্টের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যয়, বেতনভাতা ও বিচারপতিগণের চিকিৎসা এবং আবাসন সঙ্কট নিয়ে অতীতে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার অফিস এবং আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বহু দেনদরবার হলেও কোনো ইতিবাচক সুরাহা হয়নি। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা বিরোধীয় বিষয়ের সাথে সাম্প্রতিককালে যুক্ত হয়েছে নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলিসংক্রান্ত জটিলতা, যা নিয়ে প্রধান বিচারপতি রীতিমতো বিব্রত অবস্থায় রয়েছেন।
উপরিউল্লিখিত বিষয়গুলোর বাইরে বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নানা কর্মকাণ্ড, কথাবার্তা এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা পুরো বিচারাঙ্গনকে অস্থির করে তুলেছে। বিচারপতি চৌধুরী নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত এবং কারো কারো কাছে অতীব বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। সরকারবিরুদ্ধ দল-গোষ্ঠী তাকে কট্টর সরকারপন্থী একজন রাগ চণ্ডাল মানুষ হিসেবে জানে। সরকারি দলে তাকে নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতারা প্রায়ই অভিযোগ করেন তার বিরুদ্ধে এবং একান্তে প্রশ্ন তোলেন- কে এই মানিক? সরকারের কার সাথে তার পরিচয়, তার ক্ষমতার উৎস কী ইত্যাদি। নবম সংসদের তৎকালীন স্পিকার এবং বর্তমানের রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে বিচারপতি মানিকের কিছু মন্তব্য সারা দেশে ঝড় তুলেছিল। স্পিকারসহ পুরো জাতীয় সংসদ এবং আওয়ামী ঘরানার তাবৎ রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক একসাথে সমস্বরে চিৎকার-চেঁচামেচি করার পরও বিচারপতি চৌধুরীর যখন কিছু হয়নি, তখন সারা দেশের সাধারণ মানুষের মতো বিচারপতি স্বয়ং হয়তো ভেবেছেন- তিনি সত্যিকার অর্থেই সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী একজন মহা ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
বিচারপতি মানিক যখন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে দায়িত্বরত ছিলেন, তখন বিভিন্ন মামলা রিট এবং আদালতের স্যুয়োমেটো রুলের ক্ষমতার প্রয়োগ দেখিয়ে তিনি কয়েক দিন পর পরই সারা দেশে হইচই ফেলে দিতেন। সচিব থেকে চাপরাশি, আইজি থেকে চৌকিদার- সবাই বিচারপতি মানিক আতঙ্কে দিনরাত দুঃস্বপ্ন দেখতেন। রাস্তায় কোনো বিচারপতির গাড়ি দেখামাত্র দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ-জনগণ সন্ত্রস্ত হয়ে ভাবত- ওই বুঝি মানিক এসে গেলেন। তিনি যে দিন আপিল বিভাগে পদোন্নতি পেলেন, সে দিন সাধারণ মানুষ ও সরকারি কর্তাদের ভীতু অংশটি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এবং পণ্ডিত প্রকৃতির লোকজন সমীকরণ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেল, কেন বিচারপতি মানিককে আপিল বিভাগে স্থান করে দেয়া হলো।
বিচারপতি মানিকের ইদানীংকালের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাপক ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এ কারণে তিনি কয়েকবার শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার পরও দমেননি, বরং দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। তার এই এগিয়ে যাওয়ার পেছনে কী ধরনের স্বার্থ বা ব্যক্তিগত ইচ্ছে-আকাক্সক্ষা ছিল, তা হয়তো তিনি নিজেই ভালো বলতে পারবেন। আমরা সাধারণ মানুষ সব সময়ই ভেবেছি- তিনি মহা ক্ষমতাধর ব্যক্তি, যার অঙ্গুলি হেলনে পুরো বিচারাঙ্গন কেঁপে ওঠে। কিন্তু তিনি যে তা নন এবং তিনিও যে ক্ষমতাহীন অবাঞ্ছিত হয়ে অপমানকর সময় পার করছেন, তা তিনি নিজেই লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে পুরো জাতিকে জানালেন। চিঠিতে তিনি নজিরবিহীনভাবে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কিছু গুরুতর অভিযোগ আনলেন এবং নিজের বক্তব্যের ব্যাপারে জনমত সৃষ্টির জন্য প্রধান বিচারপতির একটি একান্ত ব্যক্তিগত টেলিফোন সংলাপ সরকারপন্থী বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ৭১ টিভিতে বিরতিহীনভাবে কয়েক দিন ধরে ঢালাওভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করলেন। সারা দেশে শুরু হলো নতুন বিতর্ক, নবতর তোলপাড় এবং মহলবিশেষের তির্যক টিটকারি।
সুপ্রিম কোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে ৭১ টিভির কর্তৃপক্ষকে আদালতে তলব করলেন, কিন্তু শেষ অবধি দৃষ্টান্তমূলক কিছু না ঘটার কারণে আপাতদৃষ্টিতে বিচারপতি মানিকের সফলতা ফুটে উঠল। এরই মধ্যে তিনি অবসরে চলে গেলেন এবং প্রধান বিচারপতি তার অবসর সময়ের রায় লেখার ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। বিচারপতি মানিক প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তে বিক্ষুব্ধ হলেন এবং এ ব্যাপারে অতীতের প্রথা এবং নিজের অধিকার বর্ণনা করে প্রধান বিচারপতি বরাবরে পত্র লিখলেন। এই পত্রের অনুলিপি সব মিডিয়ায় প্রকাশিত হলো এবং জনাব মানিক নিজের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য কয়েকটি সরকারসমর্থক টিভির কট্টর সরকারি তাঁবেদার টকশো উপস্থাপকের মাধ্যমে রোজ রাতে টিভি টকশোতে অংশ নিতে শুরু করলেন। চার দিকে শুরু হলো নতুন কানাঘুষা, নতুন বিতর্ক এবং একই সাথে অস্থিরতা। এ অবস্থায় প্রধান বিচারপতি জনাব মানিকের অবসরকালীন সময়ে রায় লেখা নিয়ে মন্বব্য করতে বাধ্য হলেন। উপরিউল্লিখিত অবস্থায় সরকারের উচিত ছিল, গোপনে প্রধান বিচারপতির সাথে বসে একটি সম্মানজনক নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া। অন্য দিকে প্রধান বিচারপতির বক্তব্য নিয়ে সৃষ্টি হওয়া রাজনৈতিক বিতর্কগুলো রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার উদ্যোগ নেয়া। কিন্তু সরকার সে দিকে না গিয়ে যা করল তাতে এক দিকে যেমন সুপ্রিম কোর্টের মানমর্যাদা ক্ষুণ্ন হলো, অন্য দিকে নিজেদের দৈন্য প্রকাশ করে দিলো। আইনমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ার মোদ্দাকথা হলো- প্রধান বিচারপতি যা বলেছেন তা হয়তো ব্যক্তিগত হতাশা এবং বিচারপতি মানিকের সাথে পেরে না ওঠার ব্যর্থতার গ্লানি থেকে বলেছেন। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয়, বিচারপতি মানিক অবসরে গিয়েও রায় লিখতে পারবেন, যা প্রথা অনুযায়ী আইনগতভাবে বৈধ। অবসরে রায় লেখার বিষয়টি পৃথিবীর কোথাও নেই এবং এটি বাংলাদেশের সংবিধানের পরিপন্থী- প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যও আইনমন্ত্রীর কথায় পাল্টা চ্যালেঞ্জে পড়েছে, যা সার্বিক বিবেচনায় সরকারের বিপক্ষে যাবে।
আইনের একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে আমার মনে হচ্ছে, প্রধান বিচারপতির বক্তব্যই সঠিক এবং বিরুদ্ধবাদীরা জেনে-শুনে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করছেন। প্রথা অনুসরণের ধারণাটি এসেছে ব্রিটিশ কমন ল থেকে। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রথা অনুসরণ করা যাবে এবং কোন ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ আইনের কারণে প্রথা অনুসরণ করা যাবে না, তাবৎ দুনিয়ায় মোটামুটি সেটেলড হয়ে গেছে। কোনো প্রথা অনুসরণ করতে গিয়ে যদি বিধিবদ্ধ কোনো আইনের ব্যত্যয় হয়, তাহলে অবশ্যই সেই প্রথাটির আইনগত অগ্রাধিকার সৃষ্টি হয় না। বিচারপতিগণের শপথ, অবসরে যাওয়ার পর শপথের বাধ্যবাধকতা না থাকা এবং রাষ্ট্রীয় নথির গোপনীয়তাসংক্রান্ত আইনের কারণে অবসর সময়ে রায় লেখা বিধিসম্মত নয়। অন্য দিকে বিষয়টি একেবারেই সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধানের কোথাও লেখা নেই যে- অবসরে গিয়ে রায় লেখা যাবে না, এই যুক্তিতে বিষয়টিকে সংবিধানসম্মত বলা যাবে না, কারণ সংবিধানে এ কথাও লেখা নেই যে, অবসরে বসে রায় লেখা যাবে। সংবিধানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা এবং বিচারপতিগণের কার্যকাল সম্পর্কিত ধারাগুলো বিশ্লেষণ করলে অবসরে রায় না লেখার ব্যাপারে একাধিক নির্দেশনা বের করা যাবে। কিন্তু পুরো সংবিধান তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একটি অন্তর্নিহিত নির্দেশনা বের করা যাবে না, সেটার বলে বলীয়ান হয়ে বলা যাবে যে, অবসরে বসে যত দিন ইচ্ছে তত দিন সময় নিয়ে আদালতের পুরো নথি নিজগৃহে এনে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি তার কার্যকালীন মামলার রায় লিখতে পারবেন এবং আদালতের এজলাসের পরিবর্তে আদালতের সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে পুরো জাতির উদ্দেশ্যে রায়সংক্রান্ত বয়ান পেশ করতে পারবেন।
প্রধান বিচারপতি বলেছেন- অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা সংবিধানসম্মত নয়। দুনিয়ার কোথাও এমন নজির নেই। আমাদের দেশে দীর্ঘকাল ধরে এটি প্রথা হিসেবে চলে এলেও, বর্তমান প্রধান বিচারপতি তার আমলে অতীতের সেই প্রথাটিকে চালু রাখতে নারাজ। অবসরে রায় লেখা কেন এবং কিভাবে অসাংবিধানিক, তা-ও তিনি চমৎকারভাবে অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন, যা সাধারণ মস্তিষ্কের অল্প বুদ্ধি এবং বোধসম্পন্ন মানুষের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ফলে দেশের সাধারণ মানুষ প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে এবং একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে টেনে আনার জন্য সুধীসমাজ তাকে সাধুবাদ জানিয়েছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে অতি চালাক, স্বার্থপর ও দলকানা শ্রেণীর মানুষজনের জন্য। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পর সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নড়েচড়ে বসে। তারা বক্তব্যটিতে রাজনৈতিক রঙ লাগান এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে থাকেন। অনেকে আবার প্রধান বিচারপতিকে টুকটাক খোঁচাও দিতে শুরু করেন।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে একটি বিচারিক রায়ের মর্যাদায় উন্নীত করে বলতে থাকেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে। সরকার অবৈধ হয়ে গেছে- প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অবৈধ হয়ে গেছে। কারণ, ওই মামলার চূড়ান্ত রায় লিখেছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক তার অবসরে যাওয়ার বহু দিন পর। কিছু অনলাইন পত্রিকা হাল আমলের টকশোজীবী এবং বড়গলায় কথা বলা বিতর্কিত লোকজন ঘটনার গভীরে না ঢুকেই উল্টাপাল্টা বক্তব্য দিয়ে পুরো বিষয়টিকে রাজনীতিকীকরণ করে ফেলেন এবং বক্তব্যদাতা প্রধান বিচারপতিকে বিব্রত করতে থাকেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যাতে সন্দেহপ্রবণ লোকজন প্রপাগান্ডা চালানোর সুযোগ পান এই বলে যে- দেশের আপাত শান্ত রাজনীতি প্রধান বিচারপতির কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ মন্তব্য শুরু করেন, তিনি কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এই সময়ে হঠাৎ করে এমন একটি উদ্ভট কথা বললেন? তিনি কি সরকারের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করেন? প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসে এস কে সিনহার সাক্ষ্য সব প্রগাগান্ডার সমুচিত জবাব দেয়া সম্ভব ছিল না। তিনি শুধু ইঙ্গিতে নিজের মনোভাব বোঝানোর জন্য কোনো একটি অনুষ্ঠানে বললেন- পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দশজন বুদ্ধিজীবীর মধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অন্যতম।
বিরোধী দলগুলো যখন প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে তাদের প্রয়োজনে রাজনৈতিক রঙ মাখিয়ে নিজ নিজ দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রচার করে যাচ্ছিল, তখন সরকারের উচিত ছিল বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করা। এটা করা মোটেও কঠিন ছিল না। আমার মতো স্বল্পজ্ঞানের একজন আইনের ছাত্রকে যদি দায়িত্ব দেয়া হতো তাহলে আমি বিষয়টিকে এমনভাবে মোকাবেলা করতাম, যাতে প্রধান বিচারপতির সম্মান অক্ষুণ্ন থাকত এবং বিরোধী দলগুলোও চুপ হয়ে যেত। সরকারি দল স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় না এগিয়ে উল্টো প্রধান বিচারপতিকে আক্রমণ করে বসে। অ্যাটর্নি জেনারেল প্রথমে বলেন- এটা প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিগত বক্তব্য। এর সাথে আইন-আদালত ও সুপ্রিম কোর্টের কোনো সম্পর্ক নেই। পরে তিনি আবার বলেন- অবসরে গিয়ে রায় লেখা অবশ্যই সংবিধানসম্মত। সরকারি মদদপুষ্ট উকিল নেতারা এলোমেলো পেঁচানো বক্তব্য দিতে আরম্ভ করেন অনেকটা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হিং টিং ছট্ কবিতার মতো করে। আইনমন্ত্রী বলেন- প্রধান বিচারপতি ব্যক্তিগত হতাশা থেকে এ কথা বলেছেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আরো একধাপ এগিয়ে প্রধান বিচারপতিকে নসিয়তের সুরে বলেন- মুখে লাগাম দিন!
আমি সেনগুপ্ত বাবুর বক্তব্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না। কারণ, মুখে লাগাম দেয়ার পরামর্শটি অত্যন্ত অবমাননাকর। লাগাম শব্দটি মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা মোটেও রুচিসম্মত এবং বিবেচনাপ্রসূত নয়। কাজেই ওদিকে না গিয়ে আমরা বরং আইনমন্ত্রীর বক্তব্যটি পর্যালোচনার চেষ্টা করি। এ ক্ষেত্রে আমার প্রথম প্রশ্ন- প্রধান বিচারপতি কেন হতাশ হবেন?
দ্বিতীয়ত, আইনমন্ত্রী কি দেশের প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন কিংবা দেয়ার এখতিয়ার রাখেন? আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি মতে, আইনমন্ত্রী সরকারকে খুশি করতে গিয়েই কথাগুলো বলেছেন, যা প্রকারান্তরে তার নিজের বিরুদ্ধে চলে গেছে। এ বিষয়ে প্রকৃত ঘটনা অনুধাবনের জন্য প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের কিয়ৎ আগেকার কিছু ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
পত্রিকায় দেখলাম- প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে বলেছেন, বিচারাঙ্গনে অস্থিরতা চলছে। মূলত বিচারকবৃন্দের বেতনভাতা, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও স্বাধীনতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এবং মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরেই বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য চলে আসছিল। সুপ্রিম কোর্ট চাচ্ছেন বিখ্যাত মাজদার হোসেন মামলার রায় মোতাবেক সব ক্ষমতা তাদের হাতে ন্যস্ত থাকুক। অন্য দিকে, সরকারের নির্বাহী বিভাগ, অর্থাৎ মন্ত্রণালয় কিছুতেই তাদের ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি নয়। এ দিকে অন্য একটি মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট জেলা জজদের বেতন ও পদবি নির্ধারণ করে দেন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়কে সেই রায় বাস্তবায়নের নির্দেশ পাঠান। গত কয়েক বছরে বহুবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্টের সেই রায় বাস্তবায়নে অর্থ মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সুপ্রিম কোর্টের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যয়, বেতনভাতা ও বিচারপতিগণের চিকিৎসা এবং আবাসন সঙ্কট নিয়ে অতীতে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার অফিস এবং আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বহু দেনদরবার হলেও কোনো ইতিবাচক সুরাহা হয়নি। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা বিরোধীয় বিষয়ের সাথে সাম্প্রতিককালে যুক্ত হয়েছে নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলিসংক্রান্ত জটিলতা, যা নিয়ে প্রধান বিচারপতি রীতিমতো বিব্রত অবস্থায় রয়েছেন।
উপরিউল্লিখিত বিষয়গুলোর বাইরে বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নানা কর্মকাণ্ড, কথাবার্তা এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা পুরো বিচারাঙ্গনকে অস্থির করে তুলেছে। বিচারপতি চৌধুরী নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত এবং কারো কারো কাছে অতীব বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। সরকারবিরুদ্ধ দল-গোষ্ঠী তাকে কট্টর সরকারপন্থী একজন রাগ চণ্ডাল মানুষ হিসেবে জানে। সরকারি দলে তাকে নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতারা প্রায়ই অভিযোগ করেন তার বিরুদ্ধে এবং একান্তে প্রশ্ন তোলেন- কে এই মানিক? সরকারের কার সাথে তার পরিচয়, তার ক্ষমতার উৎস কী ইত্যাদি। নবম সংসদের তৎকালীন স্পিকার এবং বর্তমানের রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে বিচারপতি মানিকের কিছু মন্তব্য সারা দেশে ঝড় তুলেছিল। স্পিকারসহ পুরো জাতীয় সংসদ এবং আওয়ামী ঘরানার তাবৎ রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক একসাথে সমস্বরে চিৎকার-চেঁচামেচি করার পরও বিচারপতি চৌধুরীর যখন কিছু হয়নি, তখন সারা দেশের সাধারণ মানুষের মতো বিচারপতি স্বয়ং হয়তো ভেবেছেন- তিনি সত্যিকার অর্থেই সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী একজন মহা ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
বিচারপতি মানিক যখন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে দায়িত্বরত ছিলেন, তখন বিভিন্ন মামলা রিট এবং আদালতের স্যুয়োমেটো রুলের ক্ষমতার প্রয়োগ দেখিয়ে তিনি কয়েক দিন পর পরই সারা দেশে হইচই ফেলে দিতেন। সচিব থেকে চাপরাশি, আইজি থেকে চৌকিদার- সবাই বিচারপতি মানিক আতঙ্কে দিনরাত দুঃস্বপ্ন দেখতেন। রাস্তায় কোনো বিচারপতির গাড়ি দেখামাত্র দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ-জনগণ সন্ত্রস্ত হয়ে ভাবত- ওই বুঝি মানিক এসে গেলেন। তিনি যে দিন আপিল বিভাগে পদোন্নতি পেলেন, সে দিন সাধারণ মানুষ ও সরকারি কর্তাদের ভীতু অংশটি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এবং পণ্ডিত প্রকৃতির লোকজন সমীকরণ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেল, কেন বিচারপতি মানিককে আপিল বিভাগে স্থান করে দেয়া হলো।
বিচারপতি মানিকের ইদানীংকালের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাপক ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এ কারণে তিনি কয়েকবার শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার পরও দমেননি, বরং দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। তার এই এগিয়ে যাওয়ার পেছনে কী ধরনের স্বার্থ বা ব্যক্তিগত ইচ্ছে-আকাক্সক্ষা ছিল, তা হয়তো তিনি নিজেই ভালো বলতে পারবেন। আমরা সাধারণ মানুষ সব সময়ই ভেবেছি- তিনি মহা ক্ষমতাধর ব্যক্তি, যার অঙ্গুলি হেলনে পুরো বিচারাঙ্গন কেঁপে ওঠে। কিন্তু তিনি যে তা নন এবং তিনিও যে ক্ষমতাহীন অবাঞ্ছিত হয়ে অপমানকর সময় পার করছেন, তা তিনি নিজেই লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে পুরো জাতিকে জানালেন। চিঠিতে তিনি নজিরবিহীনভাবে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কিছু গুরুতর অভিযোগ আনলেন এবং নিজের বক্তব্যের ব্যাপারে জনমত সৃষ্টির জন্য প্রধান বিচারপতির একটি একান্ত ব্যক্তিগত টেলিফোন সংলাপ সরকারপন্থী বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ৭১ টিভিতে বিরতিহীনভাবে কয়েক দিন ধরে ঢালাওভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করলেন। সারা দেশে শুরু হলো নতুন বিতর্ক, নবতর তোলপাড় এবং মহলবিশেষের তির্যক টিটকারি।
সুপ্রিম কোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে ৭১ টিভির কর্তৃপক্ষকে আদালতে তলব করলেন, কিন্তু শেষ অবধি দৃষ্টান্তমূলক কিছু না ঘটার কারণে আপাতদৃষ্টিতে বিচারপতি মানিকের সফলতা ফুটে উঠল। এরই মধ্যে তিনি অবসরে চলে গেলেন এবং প্রধান বিচারপতি তার অবসর সময়ের রায় লেখার ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। বিচারপতি মানিক প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তে বিক্ষুব্ধ হলেন এবং এ ব্যাপারে অতীতের প্রথা এবং নিজের অধিকার বর্ণনা করে প্রধান বিচারপতি বরাবরে পত্র লিখলেন। এই পত্রের অনুলিপি সব মিডিয়ায় প্রকাশিত হলো এবং জনাব মানিক নিজের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য কয়েকটি সরকারসমর্থক টিভির কট্টর সরকারি তাঁবেদার টকশো উপস্থাপকের মাধ্যমে রোজ রাতে টিভি টকশোতে অংশ নিতে শুরু করলেন। চার দিকে শুরু হলো নতুন কানাঘুষা, নতুন বিতর্ক এবং একই সাথে অস্থিরতা। এ অবস্থায় প্রধান বিচারপতি জনাব মানিকের অবসরকালীন সময়ে রায় লেখা নিয়ে মন্বব্য করতে বাধ্য হলেন। উপরিউল্লিখিত অবস্থায় সরকারের উচিত ছিল, গোপনে প্রধান বিচারপতির সাথে বসে একটি সম্মানজনক নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া। অন্য দিকে প্রধান বিচারপতির বক্তব্য নিয়ে সৃষ্টি হওয়া রাজনৈতিক বিতর্কগুলো রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার উদ্যোগ নেয়া। কিন্তু সরকার সে দিকে না গিয়ে যা করল তাতে এক দিকে যেমন সুপ্রিম কোর্টের মানমর্যাদা ক্ষুণ্ন হলো, অন্য দিকে নিজেদের দৈন্য প্রকাশ করে দিলো। আইনমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ার মোদ্দাকথা হলো- প্রধান বিচারপতি যা বলেছেন তা হয়তো ব্যক্তিগত হতাশা এবং বিচারপতি মানিকের সাথে পেরে না ওঠার ব্যর্থতার গ্লানি থেকে বলেছেন। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয়, বিচারপতি মানিক অবসরে গিয়েও রায় লিখতে পারবেন, যা প্রথা অনুযায়ী আইনগতভাবে বৈধ। অবসরে রায় লেখার বিষয়টি পৃথিবীর কোথাও নেই এবং এটি বাংলাদেশের সংবিধানের পরিপন্থী- প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যও আইনমন্ত্রীর কথায় পাল্টা চ্যালেঞ্জে পড়েছে, যা সার্বিক বিবেচনায় সরকারের বিপক্ষে যাবে।
আইনের একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে আমার মনে হচ্ছে, প্রধান বিচারপতির বক্তব্যই সঠিক এবং বিরুদ্ধবাদীরা জেনে-শুনে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করছেন। প্রথা অনুসরণের ধারণাটি এসেছে ব্রিটিশ কমন ল থেকে। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রথা অনুসরণ করা যাবে এবং কোন ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ আইনের কারণে প্রথা অনুসরণ করা যাবে না, তাবৎ দুনিয়ায় মোটামুটি সেটেলড হয়ে গেছে। কোনো প্রথা অনুসরণ করতে গিয়ে যদি বিধিবদ্ধ কোনো আইনের ব্যত্যয় হয়, তাহলে অবশ্যই সেই প্রথাটির আইনগত অগ্রাধিকার সৃষ্টি হয় না। বিচারপতিগণের শপথ, অবসরে যাওয়ার পর শপথের বাধ্যবাধকতা না থাকা এবং রাষ্ট্রীয় নথির গোপনীয়তাসংক্রান্ত আইনের কারণে অবসর সময়ে রায় লেখা বিধিসম্মত নয়। অন্য দিকে বিষয়টি একেবারেই সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধানের কোথাও লেখা নেই যে- অবসরে গিয়ে রায় লেখা যাবে না, এই যুক্তিতে বিষয়টিকে সংবিধানসম্মত বলা যাবে না, কারণ সংবিধানে এ কথাও লেখা নেই যে, অবসরে বসে রায় লেখা যাবে। সংবিধানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা এবং বিচারপতিগণের কার্যকাল সম্পর্কিত ধারাগুলো বিশ্লেষণ করলে অবসরে রায় না লেখার ব্যাপারে একাধিক নির্দেশনা বের করা যাবে। কিন্তু পুরো সংবিধান তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একটি অন্তর্নিহিত নির্দেশনা বের করা যাবে না, সেটার বলে বলীয়ান হয়ে বলা যাবে যে, অবসরে বসে যত দিন ইচ্ছে তত দিন সময় নিয়ে আদালতের পুরো নথি নিজগৃহে এনে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি তার কার্যকালীন মামলার রায় লিখতে পারবেন এবং আদালতের এজলাসের পরিবর্তে আদালতের সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে পুরো জাতির উদ্দেশ্যে রায়সংক্রান্ত বয়ান পেশ করতে পারবেন।
No comments