এরশাদকে পদত্যাগ করাতে সচেষ্ট ছিলেন মেজর জেনারেল সালাম
মূলত
এরশাদই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে সামরিক আইনের মাধ্যমে দেশ শাসন করেছিলেন।
এর আগ পর্যন্ত সামরিক আইনের মাধ্যমে কেউ দেশ শাসন করেননি। জিয়া সামরিক আইন
জারি করেননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাক
ক্ষমতায় এসে সামরিক আইন জারি করেন। জিয়া তার অধীনে ছিলেন। পরে তিনি সায়েমের
অধীনে ছিলেন। পরে যদিও জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছেন, কিন্তু
প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তিনি নিজে কোনো ফরমান জারি করেননি। খালেদ মোশাররফও
কোনো সামরিক ফরমান জারি করেননি। এরশাদ প্রথম থেকেই সামরিক ফরমান জারি করে
দেশ শাসন করেন। জিয়া দ্রুত সামরিক আইন প্রত্যাহার করে গণতন্ত্রে ফিরে
গিয়েছিলেন। আর এরশাদ এই দেশে গণতন্ত্রের ভিত্তিকে নষ্ট করেছেন। টাকাপয়সার
বিনিময়ে প্রকল্প গ্রহণ ও নীতিনির্ধারণ এরশাদের আমলেই শুরু হয়। তিনি
ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দেয়ার নামে রীতিমতো অঙ্ক কষে পয়সা খেতে শুরু করেন।
রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী থেকে শুরু করে বেসামরিক-সামরিক প্রশাসনের সকল
স্তরের বেশির ভাগই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যেটা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। এ
থেকে আমরা এখনও বেরিয়ে আসতে পারিনি। তবে এরশাদ অনেক অপকর্মের পরও দৃশ্যমান
অবকাঠামোর কাজগুলো ভালোভাবেই করেছিলেন। যার জন্য লোকে এখনও তার কথা মনে
রেখেছে।
প্রয়াত মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী তার লেখা ‘১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন’ বইয়ে এসব কথা লিখেছেন। প্রথমা থেকে প্রকাশিত ওই বইয়ে তিনি আরও লিখেছেন, সেনাপ্রধান এরশাদ ক্ষমতা দখল করার কয়েক মাস পর ১৯৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে আমাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। আমি সেখানে কয়েক বছর যুগ্ম সচিব হিসেবে কাজ করি। ১৯৮৬ সালের ১৫ই মার্চ আমি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিযুক্ত হই। ১৯৮৯ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এখানে থাকাকালে এরশাদ আমাকে প্রস্তাব দিলেন ট্রাস্টের সম্পত্তি হরদের গ্লাস ফ্যাক্টরি তার এক আত্মীয়ের কাছে বিক্রি বা লিজ দিতে। এ নিয়ে তার সঙ্গে আমার বচসা হয়। আমি তাকে বলি, এটা সরকারি সম্পত্তি। আই ক্যান নট ডিল ইট। তাছাড়া এটা দেবোত্তর সম্পত্তি। এমন সম্পত্তি আল্লাহও নিতে পারেন না। আপনার আত্মীয়কে এই সম্পত্তি কী করে দেবো! এই নিয়ে তার সঙ্গে বেশ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। এ ঘটনার কিছুদিন পর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে আমি যাই এবং বক্তৃতার একপর্যায়ে এরশাদকে উদ্দেশ্য করে বললাম, মুক্তিযোদ্ধাদের যদি প্রমোশন না দেয়া হয়, তাহলে তো এটা ভারতের খড়ম রাজ্য বা রামরাজত্ব করার মতোই হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধার নাম নিয়ে আপনি বলছেন, তারা দেশ স্বাধীন করেছে, তারা সূর্যসন্তান। আবার যখন চাকরিতে তারা যাচ্ছেন, তখন তাদের হেয় করা হচ্ছে, তাদের বের করে দেয়া হচ্ছে।
সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে এই কথা বলায় এরশাদ মৌখিকভাবে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে চাকরি থেকে ডিসমিসড করেন। কিন্তু চাকরিচ্যুতির লিখিত আদেশ জারি হয়নি। ফলে, আমি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বহাল থাকি। এরপর আমি ট্রাস্ট থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, জিয়াসহ ছয়জনের ছবি সংবলিত একটি ক্যালেন্ডার বের করি। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গাওয়া গানগুলো ১৯৮৭ সালে পুনরায় রেকর্ড করে একটি অ্যালবাম প্রকাশ করি। অ্যালবামের নাম ছিল মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি। এ কারণে তিনি আবার আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে আর্মি হেড কোয়ার্টারকে লেখেন। আমার সৌভাগ্য বলতে হয়, আর্মি হেড কোয়ার্টার তার প্রথম ও দ্বিতীয় আদেশ কোনোটাই মানেনি। যার জন্য তিনি আমাকে চাকরি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন।
১৯৮৯ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর আমাকে বাংলাদেশ টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে বদলি করা হয়। তখন এর প্রধান কার্যালয় ছিল চট্টগ্রামে। পরে প্রধান কার্যালয় ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। বাংলাদেশ টি বোর্ডে যোগ দেয়ার কিছুদিন পর থেকে দেখতে পেলাম এরশাদের বিরুদ্ধে মধ্য স্তরের সেনা কর্মকর্তারা ক্রমশ সোচ্চার হচ্ছেন। তাদের অনেকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তখন সেনাবাহিনীর ৪৬ ব্রিগেডে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার সালাম। তিনি আমার বন্ধু ছিলেন। তিনিও আমার কাছ থেকে কয়েকবার মতামত নেন। এরশাদের কর্মকাণ্ডের একটা মূল্যায়নও তিনি চান। পরে সালাম (পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল এবং সিজিএস নিযুক্ত হন) চিফ অব জেনারেল স্টাফের দপ্তরে ছিলেন। তখন মেজর জেনারেল নূরউদ্দীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ ছিলেন। নূরউদ্দীনও ১৯৭৪ থেকে এরশাদের সঙ্গে নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের নভেম্বরে এরশাদ নূরউদ্দীনকে সেনাপ্রধান করেন।
১৯৯০ সালের ২৭শে নভেম্বর ডা. মিলন হত্যার পর সেনাবাহিনীতে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। মধ্যম স্তরের সেনা কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে মেজর জেনারেল সালামের মাধ্যমে এরশাদকে জানিয়ে দেন যে সেনাবাহিনী তাকে আর সমর্থন দিতে পারবে না। যদি তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকতে চান, তাহলে সমস্যাগুলো তাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। সেনাবাহিনী এরপর রমনা পার্কে অবস্থান নেয় এবং আইএস ডিউটি (শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশকে সহায়তা করা) থেকে বিরত থাকে। এদিকে এরশাদ চেষ্টা করছিলেন সামরিক আইন জারির। কিন্তু তাকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, সামরিক আইন জারি করা হলে সেটা তারা বাস্তবায়ন করবে না। ২রা ডিসেম্বর রাত একটা-দুইটার দিকে আমাকে ডেকে পাঠানো হয় আর্মি হেড কোয়ার্টারে। তখন আমি সেখানে যাই এবং বুঝতে পারি, সেনাসদর এরশাদের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত করার চেষ্টা করছে। সারা রাত সেখানে আলোচনা হয়। সকাল বেলা আমি আমার বন্ধু মেজর জেনারেল মতিনকে (আবদুল মতিন) বলে আসি যে তিনি যেন এরশাদের পক্ষে কোনো রকম অবস্থান না নেন। ৪ঠা ডিসেম্বর রাতে এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ওই দিন গভীর রাতে সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূরউদ্দীন আমাকে ডেকে পাঠান। আমি তার কাছে যাই। তিনি আমাকে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার কাছ থেকে দুটো বিবৃতি (স্টেটমেন্ট) নিয়ে আসতে বলেন বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারের জন্য। তখন সংবাদপত্রে ধর্মঘট চলছিল। নূরউদ্দীনের নির্দেশে আমি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার খোঁজ করতে থাকি। শেখ হাসিনা তার বিবৃতি দেন। কিন্তু খালেদা জিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরদিন সকালবেলা আমি সাইদ ইস্কান্দারের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার কাছ থেকে বিবৃতি সংগ্রহ করি। সেটি রেডিও ও টিভিতে প্রচারিত হয়।
এরশাদকে পদত্যাগ করাতে মেজর জেনারেল সালাম অত্যন্ত শক্তভাবে সচেষ্ট ছিলেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তার যে অবদান, তা অভূতপূর্ব। তিনি ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডারসহ তরুণ অফিসারদের মোটিভেট করে তার দিকে রেখেছিলেন। এটা তার একক প্রচেষ্টার ফলে হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তার এই অবদানের মূল্যায়ন করা হয়নি।
৪ঠা ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েও ক্ষমতা নিজের আয়ত্তে রাখার জন্য নতুন একটি চাল চালেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদের মাধ্যমে সেনাপ্রধান নূরউদ্দীনকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সামরিক আইন জারি করার। তারপর মওদুদ প্রেসিডেন্ট হবেন আর নূরউদ্দীন হবেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। কিন্তু সেনাসদর এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ফলে মওদুদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর আগে এরশাদ মেজর জেনারেল সালামকে বলেছিলেন, ‘তোমরা তাহলে অ্যাসেমব্লি ডাকো, আমি বক্তব্য দেবো।’ সালাম বলেছিলেন, ‘স্যার, এটা আর সম্ভব নয়। আপনি ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতা হ্যান্ডওভার করেন।’ মওদুদ আহমদের পদত্যাগের পর রাজনৈতিক নেতাদের সম্মতিতে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ভাইস প্রেসিডেন্ট করে এরশাদ তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। প্রথমে অবশ্য রাজনীতিকদের পক্ষ থেকে এ কে খন্দকারের (এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আবদুল করিম খন্দকার বীর উত্তম) নাম বলা হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিএনপি তার ব্যাপারে আপত্তি জানায়।
প্রয়াত মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী তার লেখা ‘১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন’ বইয়ে এসব কথা লিখেছেন। প্রথমা থেকে প্রকাশিত ওই বইয়ে তিনি আরও লিখেছেন, সেনাপ্রধান এরশাদ ক্ষমতা দখল করার কয়েক মাস পর ১৯৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে আমাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। আমি সেখানে কয়েক বছর যুগ্ম সচিব হিসেবে কাজ করি। ১৯৮৬ সালের ১৫ই মার্চ আমি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিযুক্ত হই। ১৯৮৯ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এখানে থাকাকালে এরশাদ আমাকে প্রস্তাব দিলেন ট্রাস্টের সম্পত্তি হরদের গ্লাস ফ্যাক্টরি তার এক আত্মীয়ের কাছে বিক্রি বা লিজ দিতে। এ নিয়ে তার সঙ্গে আমার বচসা হয়। আমি তাকে বলি, এটা সরকারি সম্পত্তি। আই ক্যান নট ডিল ইট। তাছাড়া এটা দেবোত্তর সম্পত্তি। এমন সম্পত্তি আল্লাহও নিতে পারেন না। আপনার আত্মীয়কে এই সম্পত্তি কী করে দেবো! এই নিয়ে তার সঙ্গে বেশ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। এ ঘটনার কিছুদিন পর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে আমি যাই এবং বক্তৃতার একপর্যায়ে এরশাদকে উদ্দেশ্য করে বললাম, মুক্তিযোদ্ধাদের যদি প্রমোশন না দেয়া হয়, তাহলে তো এটা ভারতের খড়ম রাজ্য বা রামরাজত্ব করার মতোই হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধার নাম নিয়ে আপনি বলছেন, তারা দেশ স্বাধীন করেছে, তারা সূর্যসন্তান। আবার যখন চাকরিতে তারা যাচ্ছেন, তখন তাদের হেয় করা হচ্ছে, তাদের বের করে দেয়া হচ্ছে।
সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে এই কথা বলায় এরশাদ মৌখিকভাবে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে চাকরি থেকে ডিসমিসড করেন। কিন্তু চাকরিচ্যুতির লিখিত আদেশ জারি হয়নি। ফলে, আমি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বহাল থাকি। এরপর আমি ট্রাস্ট থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, জিয়াসহ ছয়জনের ছবি সংবলিত একটি ক্যালেন্ডার বের করি। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গাওয়া গানগুলো ১৯৮৭ সালে পুনরায় রেকর্ড করে একটি অ্যালবাম প্রকাশ করি। অ্যালবামের নাম ছিল মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি। এ কারণে তিনি আবার আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে আর্মি হেড কোয়ার্টারকে লেখেন। আমার সৌভাগ্য বলতে হয়, আর্মি হেড কোয়ার্টার তার প্রথম ও দ্বিতীয় আদেশ কোনোটাই মানেনি। যার জন্য তিনি আমাকে চাকরি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন।
১৯৮৯ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর আমাকে বাংলাদেশ টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে বদলি করা হয়। তখন এর প্রধান কার্যালয় ছিল চট্টগ্রামে। পরে প্রধান কার্যালয় ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। বাংলাদেশ টি বোর্ডে যোগ দেয়ার কিছুদিন পর থেকে দেখতে পেলাম এরশাদের বিরুদ্ধে মধ্য স্তরের সেনা কর্মকর্তারা ক্রমশ সোচ্চার হচ্ছেন। তাদের অনেকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তখন সেনাবাহিনীর ৪৬ ব্রিগেডে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার সালাম। তিনি আমার বন্ধু ছিলেন। তিনিও আমার কাছ থেকে কয়েকবার মতামত নেন। এরশাদের কর্মকাণ্ডের একটা মূল্যায়নও তিনি চান। পরে সালাম (পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল এবং সিজিএস নিযুক্ত হন) চিফ অব জেনারেল স্টাফের দপ্তরে ছিলেন। তখন মেজর জেনারেল নূরউদ্দীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ ছিলেন। নূরউদ্দীনও ১৯৭৪ থেকে এরশাদের সঙ্গে নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের নভেম্বরে এরশাদ নূরউদ্দীনকে সেনাপ্রধান করেন।
১৯৯০ সালের ২৭শে নভেম্বর ডা. মিলন হত্যার পর সেনাবাহিনীতে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। মধ্যম স্তরের সেনা কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে মেজর জেনারেল সালামের মাধ্যমে এরশাদকে জানিয়ে দেন যে সেনাবাহিনী তাকে আর সমর্থন দিতে পারবে না। যদি তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকতে চান, তাহলে সমস্যাগুলো তাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। সেনাবাহিনী এরপর রমনা পার্কে অবস্থান নেয় এবং আইএস ডিউটি (শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশকে সহায়তা করা) থেকে বিরত থাকে। এদিকে এরশাদ চেষ্টা করছিলেন সামরিক আইন জারির। কিন্তু তাকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, সামরিক আইন জারি করা হলে সেটা তারা বাস্তবায়ন করবে না। ২রা ডিসেম্বর রাত একটা-দুইটার দিকে আমাকে ডেকে পাঠানো হয় আর্মি হেড কোয়ার্টারে। তখন আমি সেখানে যাই এবং বুঝতে পারি, সেনাসদর এরশাদের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত করার চেষ্টা করছে। সারা রাত সেখানে আলোচনা হয়। সকাল বেলা আমি আমার বন্ধু মেজর জেনারেল মতিনকে (আবদুল মতিন) বলে আসি যে তিনি যেন এরশাদের পক্ষে কোনো রকম অবস্থান না নেন। ৪ঠা ডিসেম্বর রাতে এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ওই দিন গভীর রাতে সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূরউদ্দীন আমাকে ডেকে পাঠান। আমি তার কাছে যাই। তিনি আমাকে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার কাছ থেকে দুটো বিবৃতি (স্টেটমেন্ট) নিয়ে আসতে বলেন বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারের জন্য। তখন সংবাদপত্রে ধর্মঘট চলছিল। নূরউদ্দীনের নির্দেশে আমি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার খোঁজ করতে থাকি। শেখ হাসিনা তার বিবৃতি দেন। কিন্তু খালেদা জিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরদিন সকালবেলা আমি সাইদ ইস্কান্দারের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার কাছ থেকে বিবৃতি সংগ্রহ করি। সেটি রেডিও ও টিভিতে প্রচারিত হয়।
এরশাদকে পদত্যাগ করাতে মেজর জেনারেল সালাম অত্যন্ত শক্তভাবে সচেষ্ট ছিলেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তার যে অবদান, তা অভূতপূর্ব। তিনি ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডারসহ তরুণ অফিসারদের মোটিভেট করে তার দিকে রেখেছিলেন। এটা তার একক প্রচেষ্টার ফলে হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তার এই অবদানের মূল্যায়ন করা হয়নি।
৪ঠা ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েও ক্ষমতা নিজের আয়ত্তে রাখার জন্য নতুন একটি চাল চালেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদের মাধ্যমে সেনাপ্রধান নূরউদ্দীনকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সামরিক আইন জারি করার। তারপর মওদুদ প্রেসিডেন্ট হবেন আর নূরউদ্দীন হবেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। কিন্তু সেনাসদর এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ফলে মওদুদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর আগে এরশাদ মেজর জেনারেল সালামকে বলেছিলেন, ‘তোমরা তাহলে অ্যাসেমব্লি ডাকো, আমি বক্তব্য দেবো।’ সালাম বলেছিলেন, ‘স্যার, এটা আর সম্ভব নয়। আপনি ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতা হ্যান্ডওভার করেন।’ মওদুদ আহমদের পদত্যাগের পর রাজনৈতিক নেতাদের সম্মতিতে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ভাইস প্রেসিডেন্ট করে এরশাদ তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। প্রথমে অবশ্য রাজনীতিকদের পক্ষ থেকে এ কে খন্দকারের (এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আবদুল করিম খন্দকার বীর উত্তম) নাম বলা হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিএনপি তার ব্যাপারে আপত্তি জানায়।
No comments