সম্পদ কেন্দ্রীকরণ কি বন্ধ করা সম্ভব? by মুহাম্মদ ইউনূস
জনগণের বিজয়
প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন ২০১৫-এর ফলাফল আমাকে রোমাঞ্চিত ও আশান্বিত করেছে। ৪০ বছর ধরে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে চলা যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসীদেরই জয় হয়েছে। তারা সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, পৃথিবী একটি সত্যিকারের বিপদের মধ্যে রয়েছে এবং আমাদের সবাইকেই একযোগে কাজ করতে হবে। পৃথিবীকে আসন্ন পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে প্যারিস সম্মেলন ছোট-বড় সব জাতিকে একটি আইনগতভাবে বাধ্যবাধকতাপূর্ণ দলিলে স্বাক্ষর করাতে পেরেছে। রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ সবাইকে বহু বছরে সঞ্চিত দেয়াল-লিখনগুলো বোঝানোর পর্বতসম কাজটি করার জন্য আমি প্রতিনিয়ত এই সক্রিয় কর্মীদের ধন্যবাদ জানাই। রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বোধোদয় সৃষ্টির কাজটিকে তাদের অনেকেই আজীবন-সঙ্কল্প হিসেবে নিয়েছিল। জনগণের মধ্যে যারা নিশ্চুপ ছিল, তারাও ক্রমান্বয়ে সক্রিয় কর্মীতে পরিণত হলো। তারা পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় এমন রাজনৈতিক নেতাদের ভোট দিলেন। পরিবেশ সচেতন রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে জয়ী হতে শুরু করল।
প্যারিস সম্মেলনকে আমি অঙ্গীকারবদ্ধ সক্রিয় কর্মীদের নেতৃত্বে জনগণের বিজয় হিসেবে দেখছি। এই কর্র্মীরা কখনোই তাদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি। এমনকি প্যারিস সম্মেলন চলাকালে পৃথিবীর ১৭৫টি দেশে ২,৩০০টি স্থানে ৭,৮৫,০০০ মানুষ একত্র হয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে তাদের ভালোবাসার পৃথিবীকে রক্ষা করে একটি শতভাগ নিরাপদ ভবিষ্যতের দাবি তুলেছে। সাধারণত আমরা সরকারগুলোকেই তাদের সাহসী পরিকল্পনার পক্ষে জনগণকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে দেখি। তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে আমরা এর বিপরীতটাই দেখতে পেলাম। এখানে পৃথিবীজুড়ে নাগরিকরাই তাদের সরকারগুলোকে চালিত করেছে।
প্যারিস সম্মেলন আমাকে এই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত করেছে যে, এ ধরনের গণ-আন্দোলন দিগন্তে জমতে থাকা আরেকটি আসন্ন দুর্যোগ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারবে। রাজনীতিতে যুগ যুগ ধরে এটি একটি উত্তপ্ত বিষয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই সমস্যাটি মোকাবেলা করতে অনেক শক্তিশালী আন্দোলন, অনেক উচ্চাকাক্সক্ষী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অনেক রক্তও এজন্য ঝরেছে। কিন্তু এর সুরাহাতো হয়ইনি, বরং সমস্যাটি প্রতিনিয়ত আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। সমস্যাটি হচ্ছে মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পদ বৈষম্যের ক্রমাগত বিস্ফোরণ। এই বৈষম্য স্থানীয়, জাতীয় ও বৈশ্বিকভাবে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার যত বাড়ছে, সম্পদের বৈষম্যও ততই বেড়ে চলেছে। এই দুর্যোগটি ভয়ঙ্কর, কেননা এটি মানুষের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে। এটি পৃথিবীকে একের পর এক সামাজিক সংঘর্ষের দিকে ধাবিত করে। এটি জাতিগুলোর মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ সৃষ্টি করে।
সম্পদ কেন্দ্রীকরণসংক্রান্ত অক্সফামের তথ্য
অক্সফাম সম্পদ কেন্দ্রীকরণের উপর প্রতি বছর আমাদের ভীতিকর আপডেট দিয়ে আসছে। এ বছর তারা বলছে যে, পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৬২ জন ব্যক্তির সম্পদ পৃথিবীর নীচের অর্ধেক মানুষের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি। ২০১৫ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৮০ জন এবং ২০১৪ সালে সবচেয়ে ধনী ৮৫ জন ব্যক্তির সম্পদ তখনকার পৃথিবীর অর্ধেকাংশ মানুষের মোট সম্পদের চেয়ে বেশি ছিল বলে অক্সফাম আমাদের জানিয়েছিল। ছয় বছর আগে, ২০১০ সালে, পৃথিবীতে একই ধরনের ভাগ্যবানের সংখ্যা ছিল ৩৮৮ জন। অক্সফাম আরো জানিয়েছিল যে, ২০০৯ ও ২০১৪ সালের মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৮০ জন ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
২০১৬ সালের জন্য অক্সফামের কিছু ভীতিকর তথ্য রয়েছে। তাদের হিসাব মতে, এ বছর পৃথিবীর ৯৯% সম্পদ সবচেয়ে ধনী ১% মানুষের দখলে থাকবে। অর্থাৎ পৃথিবীর ৯৯% মানুষের কাছে থাকবে পৃথিবীর মোট সম্পদের মাত্র ১%।
অক্সফামের এসব তথ্য এতই চমকে ওঠার মত যে প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এসব তথ্য আমাদের মনে আরো অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। পৃথিবীর ক’জন শীর্ষ ধনীর কাছে, ধরুন ২০২৫ সালে, এই গ্রহের অর্ধেক মানুষের মোট সম্পদের চাইতে বেশি সম্পদ থাকবে? কখন পৃথিবীর একজন মানুষের কাছে নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি সম্পদ থাকবে। আমাদের হয়তো বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। মাত্র ছয় বছরে এই সংখ্যাটি যদি ৩৮৮ থেকে ৬২ জনে নেমে আসতে পারে, মাত্র একজন ভাগ্যবান ব্যক্তির কাছে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের সম্পদের চেয়েও বেশি সম্পদের মালিকানা চলে আসতে খুব একটা দেরি হবে বলে মনে হয় না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স তার নির্বাচনী বক্তব্যে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোট জাতীয় সম্পদের ৯০% সে দেশের সবচেয়ে ধনী ০.১% লোকের দখলে রয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থা কী রকম? এ দেশের ৬২ জনের হাতে, নাকি তার বেশি বা কম সংখ্যক মানুষের হাতে নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের মোট সম্পদের চাইতেও বেশি সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। এটা নিয়ে কি কারো কোন দুর্ভাবনা আছে। কোন দেশের নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের সম্পদের চেয়ে বেশি সম্পদ যদি একজন লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন কী হবে? নিঃসন্দেহে তিনি হয়ে যাবেন ‘রাজা’। তাঁর ইচ্ছাই হবে দেশের আইন। এমনটা ভাবাটি কি খুব বেশি হয়ে যাবে?
সম্পদের কেন্দ্রীকরণ একই সাথে ক্ষমতারও কেন্দ্রীকরণ- রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা, সুবিধা ও সুযোগের কেন্দ্রীকরণ। এর বিপরীতটাও সত্য। আপনার যদি সম্পদ না থাকে তাহলে আপনার ক্ষমতা, সুযোগ, সুবিধা কিছুই নেই। পৃথিবীর নিচের দিকের অর্ধেক মানুষ যারা পৃথিবীর মোট সম্পদের ১ শতাংশেরও ক্ষুদ্রাংশের মালিক তারা এই শ্রেণীভুক্ত। আগামীকাল পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।
আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদের কেন্দ্রীকরণ একটি বিরামহীনভাবে চলতে থাকা প্রক্রিয়া। আমি এই বিষয়টির প্রতিই আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ধনী মানুষ মানেই কিন্তু অবশ্যম্ভাবীভাবে খারাপ মানুষ যারা অসৎ উদ্দেশ্যে সম্পদকে ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত করে যাচ্ছেন এবং মানুষে-মানুষে বৈষম্য বৃদ্ধি করছেন - এটা ধরে নেয়া ঠিক হবে না। তারা ভালো হোন মন্দ হোন আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই তাদের পক্ষে কেন্দ্রীকরণের কাজটি করে যাচ্ছে। সম্পদ হচ্ছে চুম্বকের মতো। চুম্বক যত বড় তার আকর্ষণী ক্ষমতা তত বেশী। সে ছোট চুম্বকগুলোকে তার নিজের দিকে টেনে আনে। আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিও এভাবেই গড়ে উঠেছে। যাদের হাতে চুম্বক নেই তাদের পক্ষে কোন কিছু নিজের দিকে টেনে আনা খুব কঠিন। তারা কোনভাবে ছোট একটি চুম্বকের মালিক হয়ে গেলে তা ধরে রাখাও তাদের জন্য শক্ত; বড় চুম্বকগুলো সেগুলো তাদের হাত থেকে কেড়ে নেয়। একমুখী সম্পদ কেন্দ্রীকরণের শক্তিগুলো সম্পদ-পিরামিডের আকৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করে দিচ্ছে: এর ভিত্তিটা ক্রমাগত সরু হয়ে আসছে, আর এর চূড়াটা হচ্ছে আরো সরু, আরো উঁচু - যা শেষ পর্যন্ত একটি সরু কিন্তু বড় ভিত থেকে গজিয়ে ওঠা একটি শীর্ণ হয়ে আসা স্তম্ভের মতো দেখায়।
এই ভয়াবহ বাস্তবতাগুলো আমাদের প্রতিদিনকার ব্যস্ত জীবন-যাপনের মধ্যেই প্রতি মুহূর্তেই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, এই গ্রহের তাপমাত্রা নীরবে, অনেকটা আমাদের অজান্তেই কয়েক মাস আগে শিল্প বিপ্লবের সময়কালের চেয়ে ১ ডিগি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এই বড় পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য না করলে আমাদের এই গ্রহটি ক্রমাগত উত্তপ্ত হতে থাকবে এবং এক সময়ে আমরা এমন এক যায়গায় পৌঁছে যাবো যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব হবেনা। আমাদের নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী ও সক্রিয় কর্মীদের বহু বছরের রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রমই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সরকারগুলোকে চালিত করার মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক সমঝোতা সম্ভব করে তুলেছে।
সম্পদের কেন্দ্রীকরণ পরিবেশ বিপর্যয়ের মতোই ভয়ঙ্কর। এই ভীতির একটি হচ্ছে, পৃথিবী ভৌতিকভাবে টিকে থাকবে কি না। অপরটি ভীতিটি মানবতার বিরুদ্ধে, অর্থাৎ আত্মমর্যাদা ও প্রশান্তির সাথে এবং উচ্চতর আদর্শের অনুসন্ধানে বেঁচে থাকার অধিকার মানুষের থাকবে কি না।
যদি সমাজের সকল অংশের নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী ও পরিবেশ কর্মীদের নেতৃত্বে নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন করতে পারে, তাহলে একই রোড ম্যাপ অনুসরণ করে আমরা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলা সম্পদ-কেন্দ্রীকরণের আসন্ন ঝুঁকি থেকে পৃথিবীকে রক্ষার উদ্দেশ্যে মানুষকে সমবেত ও উজ্জীবিত করতে পারবো বলে আমি বিশ্বাস করি। নাগরিকদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় সম্পদ-সামঞ্জস্যের ছোট ছোট দ্বীপ গড়ে তুলতে হবে। পৃথিবীকে, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে, উৎসাহিত করতে হবে যে এটা করা সম্ভব এবং এটা করতেই হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে আমরা অসম্ভবকে দ্রুত এবং আরো দ্রুত সম্ভব করতে পারি। এটিও এমনই একটি অসম্ভব, হাজারো বাধা সত্ত্বেও যাকে আমাদের খুব দ্রুত সম্ভব করে তুলতে হবে।
এটা কিভাবে সম্ভব আমি এখন সে বিষয়ে বলতে চাই।
মানুষই সব কিছুর কেন্দ্রে
সম্পদ বিস্ফোরণ কি বন্ধ করা সম্ভব?
আমার দৃঢ় উত্তর হচ্ছে: হ্যাঁ, সম্ভব। মানুষ চাইলে যে কানো কিছু করতে পারে, তবে এর পেছনে দৃঢ় ইচ্ছা থাকতে হবে। সরকার ও চ্যারিটিগুলো সনাতন উপায়ে যা করে আসছে তার দ্বারা এটা সম্ভব না। প্রত্যেককে এটা তার ব্যক্তিগত অগ্রাধিকার হিসেবে নিতে হবে। মানুষকে নিজেদেরই এজন্য নেতৃত্বের ভূমিকায় এগিয়ে আসতে হবে এবং এটা সম্ভব করার জন্য উপযুক্ত নীতি-কাঠামো তৈরীতে এগিয়ে আসতে সরকারের উপর শক্তিশালী চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
প্রায় ২৫০ বছর আগে আধুনিক পুঁজিবাদের উদ্ভবের পর মুক্ত বাজারের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বাস করা হয়েছে যে, বাজারের অদৃশ্য হাত অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে এবং বাজারে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে। আরো বিশ্বাস করা হয়েছে যে, ব্যক্তিরা যার যার নিজের স্বার্থ অনুসন্ধান করলেই - সমাজের মঙ্গলের চিন্তা না করে - তা নিজে থেকেই সমাজের মঙ্গল সাধন করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: এই অদৃশ্য হাত কি সমাজের সকলের জন্য সমান মঙ্গল নিশ্চিত করে?
এতে কোনো সন্দেহ নেই, এই অদৃশ্য হাত একান্তভাবে অতি ধনীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। আর এর ফলেই সম্পদের এই প্রবল কেন্দ্রীকরণ কখনোই থামছে না।
কিভাবে সম্পদ কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়া যায়
সম্পদ-পিরামিডকে রুহিতন-আকৃতির (Diamond-Shaped) সম্পদ বণ্টনে রূপান্তরের সম্ভাবনায় আমার বিশ্বাস আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে প্যারিসে জনগণের বিজয় দেখে। আমি এখন নিশ্চিত যে আমরা চাইলেই সম্পদের বিস্ফোরণকে রুদ্ধ করতে পারি। প্রথমত এটা কোনো অপরিবর্তনীয় নিয়তি নয় যা নিয়ে মানুষ জন্ম গ্রহণ করেছে। যেহেতু এটা আমাদেরই সৃষ্টি, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মতো এ সমস্যার সমাধানও আমরাই করতে পারবো। আমাদের মনের রুদ্ধতাই আমাদেরকে সমস্যাটি দেখতে দিচ্ছে না এবং আমাদেরকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে আমাদের অবরুদ্ধ মনকে মুক্ত করতে। প্রচলিত চিন্তাধারা, যেগুলো আমাদের এই সমস্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে সেগুলোকে আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে।
এ সমস্যা মোকাবেলায় রাজনৈতিক প্রচারণায় সচরাচর যা গুরুত্ব পায় তা হলো আয়-বৈষম্য, সম্পদ-বৈষম্য নয়। আয়-বৈষম্যকে যে কর্মসূচির দ্বারা মোকাবেলা করা হয় তা হলো আয় পুনর্বণ্টন। ধনীদের নিকট থেকে নাও (প্রগতিশীল করের মাধ্যমে) আর গরিবদের দাও (বিভিন্ন ট্রান্সফার পেমেন্টের মাধ্যমে)।
নিঃসন্দেহে আয় পুনর্বণ্টনের কর্মসূচিগুলো শুধু সরকারই গ্রহণ করতে পারে। কোনো কোনো সরকার এ কাজটি কঠোরভাবে করে থাকে, কেউ কেউ আবার এ ব্যাপারে অতটা কঠোর নয়।
দুঃখজনকভাবে, একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে আয়-পুনর্বণ্টনের কাজে সরকার তেমন একটা সাফল্য দেখাতে পারে না। যাদের নিকট থেকে সরকারের বড় অঙ্কের কর আদায় করার কথা, সেই ধনীরা রাজনৈতিকভাবে খুবই ক্ষমতাশালী। সরকার যাতে তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো কিছু করতে না পারে সেজন্য সরকারকে প্রভাবিত করার মতো বিপুল ক্ষমতা তাদের রয়েছে।
আমি মনে করিনা যে আয়-বৈষম্যের দিকে মনোযোগ দেয়াতে সমস্যার প্রকৃত সমাধান রয়েছে। আমাদের সমস্যার মূলে যেতে হবে, এর বাহ্যিক ফলাফলে নয়। আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে সম্পদের বৈষম্যের দিকে, যেখান থেকে আয়ের বৈষম্য সৃষ্টি হয়। সম্পদের ভিত অপরিবর্তিত থাকলে আয়-বৈষম্য কমিয়ে আনার কোনো প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হবে না। সর্বোপরি, সরকারের নগদ হস্তান্তর কর্মসূচিগুলো প্রায়ই খয়রাতি কর্মসূচি। এ ধরনের কর্মসূচি সাময়িক উপশমের জন্য চমৎকার হলেও এগুলো সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারে না। এগুলো বরং সমস্যাকে আড়াল করে রাখে। আইনের শাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর পক্ষে সম্পদ পুনর্বণ্টনের কাজে হাত দেয়া অত্যন্ত কঠিন। কোনো কোনো গণতান্ত্রিক সরকার দ্বারা ভূমি পুনর্বণ্টন কর্মসূচিই সম্পদ পুনর্বণ্টনে এ পর্যন্ত একমাত্র সফল কর্মসূচি বলে মনে হয়।
আমি এখন আপনাদের বলতে চাই, একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অর্থনৈতিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাস কেন একান্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
আমি যখন পেছনে ফিরে তাকাই, আমি দেখতে পাই পরিস্থিতি কিভাবে আমাকে এমন সব কাজে ঠেলে দিলো যেগুলো সম্পর্কে আগে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ জোবরা গ্রামে সেচনির্ভর একটি তৃতীয় শস্য চাষে আমাকে এগিয়ে দিলো। এ কাজ করতে গিয়ে আমি গ্রামের মহাজনী ব্যবসার সাথে পরিচিত হলাম। মহাজনী প্রথার ভুক্তভোগীদের আমি সাহায্য করতে চাইলাম। ১৯৭৬ সালে আমি মহাজনদের কবল থেকে তাদের রক্ষা করতে নিজের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে টাকা দিলাম। ক্রমান্বয়ে আরো বেশি লোককে ঋণ দিতে গিয়ে আমার নিজের পকেটের টাকা শেষ হওয়ার উপক্রম হলো। তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত জনতা ব্যাংকে গেলাম আর তাদের অনুরোধ করলাম গরিব মানুষদের ঋণ দিতে। তারা অস্বীকার করল। শেষ পর্যন্ত আমি নিজে জামিনদার হয়ে তাদের ঋণ দিতে রাজি করালাম। আমি প্রকল্পটির নাম দিলাম : ‘গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প’। এরপর কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত আগ্রহে কৃষি ব্যাংক সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। তারা আমাকে কার্যত প্রধান নির্বাহী বানিয়ে জোবরায় কৃষি ব্যাংকের একটি বিশেষ শাখা খুলল, যা ওই শাখার জন্য আমার নিযুক্ত লোক দিয়ে, যাদের সবাই ছিল আমার ছাত্র, পরিচালিত হতে থাকল। আমি এর নাম দিলাম ‘পরীক্ষামূলক গ্রামীণ শাখা’। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কিছু সদস্যের প্রবল আগ্রহে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকল্পটির কাজ টাঙ্গাইলে সম্প্রসারিত করতে চাইল। ১৯৮৩ সালে আমরা একটি আনুষ্ঠানিক ব্যাংকে পরিণত হলাম।
তারা যা করে আমরা করি তার উল্টোটা
আমরা যা তৈরি করলাম তা কেবল আরেকটি ব্যাংক ছিল না; এটি পরিণত হলো প্রচলিত ব্যাংকের একটি অ্যান্টি-থিসিসে। প্রচলিত ব্যাংক যা করে, গ্রামীণ ব্যাংকে আমরা ঠিক তার বিপরীতটা করতে শুরু করলাম। প্রচলিত ব্যাংকগুলো বড় বড় ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিদের যেখানে কর্মস্থল সেখানে কাজ করতে পছন্দ করে। ফলে তারা শহরে কাজ করে। গ্রামীণ ব্যাংক কাজ করে গ্রামে। এমনকি প্রতিষ্ঠার চল্লিশ বছর পরও গ্রামীণ ব্যাংক আজো কোনো শহর বা পৌর এলাকায় তার কোনো শাখা করেনি। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর মালিক ধনী মানুষরা। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক গরিব মহিলারা, এর পরিচালনা পরিষদেও এই গরিব মহিলারা বসেন। প্রচলিত ব্যাংক মূলত পুরুষদের সেবা দেয়, গ্রামীণ ব্যাংক কাজ করে মূলত মহিলাদের নিয়ে। প্রচলিত ব্যাংকগুলো মনে করে যে গরিব মানুষ ঋণ পাওয়ার যোগ্য নয়। ইতিহাসে গ্রামীণ ব্যাংকই সর্বপ্রথম এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেছে যে গরিব মানুষ, বিশেষ করে গরিব মহিলারা যেকোনো ব্যাংকিং বিবেচনায় ঋণ পাওয়ার যোগ্য। ‘গ্রামীণ আমেরিকা’ দেখিয়েছে যে, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও দরিদ্র মহিলারা ব্যাংকঋণ দিয়ে তাদের জীবনে চমৎকার পরিবর্তন আনতে পারে। আমেরিকার ৯টি শহরে গ্রামীণ আমেরিকার ১৮টি শাখা রয়েছে যাদের মাধ্যমে ৬০,০০০ মহিলাকে ঋণসেবা দেয়া হচ্ছে। এঁদের সবাই মহিলা। ‘গ্রামীণ আমেরিকা’ এ পর্যন্ত ৩৮০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। ঋণগ্রহীতাদের প্রথম ঋণের পরিমাণ গড়ে ১,০০০ ডলার। ঋণ পরিশোধের হার ৯৯.৯%।
প্রচলিত ব্যাংক কাজ করে জামানতের ওপর ভিত্তি করে। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ সম্পূর্ণ জামানতবিহীন। ফলে এই ঋণ আইনজীবীবিহীনও। আমরা যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি তা সম্পূর্ণ বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। গ্রামীণের ঋণগ্রহীতাদের ব্যাংকের আছে আসতে হয় না, ব্যাংকই তাদের দোরগোড়ায় যায়। ঋণগ্রহীতারা যাতে বৃদ্ধ বয়সে নিজেদের দেখাশোনা করতে পারেন সেজন্য গ্রামীণ ব্যাংক তাদের জন্য পেনশন ফান্ডের ব্যবস্থা করেছে। গ্রামীণ ব্যাংক তাদের জন্য স্বাস্থ্যবীমার ব্যবস্থা করেছে, ভিক্ষুকদের ঋণ দিচ্ছে, ঋণী পরিবারের সন্তানদের শিক্ষাঋণ প্রদান করছে। এই ব্যাংক তাদের স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও নলকূপের জন্যও ঋণেরব্যবস্থা করেছে। কোনো ঋণী মারা গেলে গ্রামীণ ব্যাংক তার দাফনের খরচ আংশিকভাবে বহন করে এবং মৃত ঋণীর সব ঋণ মওকুফ করা হয়। এই ব্যাংকে ঋণের সুদের পরিমাণ কখনোই মূল ঋণের চেয়ে বেশি হয় না, ঋণ পরিশোধ করতে যত সময়ই লাগুক না কেন।
নভেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক ১.২১ লাখ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এবং এ সময়ে ব্যাংকের মোট আদায়যোগ্য ঋণের পরিমাণ ৯,৪০০ কোটি টাকা। একই সময়ে ঋণীদের সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০,৮২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে ঋণীদের মোট আদায়যোগ্য ঋণের চেয়ে ব্যাংকে গচ্ছিত তাদের আমানতের পরিমাণ বেশি। কেউ বলতেই পারে, প্রকৃতপক্ষে তারা ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা নন, বরং তারাই ব্যাংককে ঋণ দিচ্ছেন!
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্র তহবিল, জাতিসঙ্ঘ এবং অনেক দ্বিপাক্ষিক তহবিল দাতারা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নকে উৎসাহিত করছে। প্রথাগত ব্যাংকগুলোকে দরিদ্রদের কাছে সীমিত আকারে আর্থিক সেবা পৌঁছাতে এটা উৎসাহিত করে। কেউ যদি সত্যিকারভাবে ব্যাংকিংয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিকে আনতে চান, নিশ্চিতভাবেই সেটা প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেমে অর্জন করা সম্ভব নয়। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেসব নীতি ও কর্মপদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে কাজ করে তা হলো আর্থিক বহির্ভুক্তি। তাদের ডিএনএ তাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পক্ষে কাজ করতে দেবে না।
আমরা যদি সত্যিই দরিদ্রদের কাছে পৌঁছাতে চাই, তবে আমাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন নকশায় ভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। ধনীদের ব্যাংক গরিবদের সেবার নকশায় তৈরি নয়। তারা বড়জোর, ওপর থেকে আসা চাপে, এনজিওদের মাধ্যমে কিছু প্রতীকী কর্মসূচি নিতে পারে, কিন্তু সেটা তাদের ব্যবসায়ের ১ শতাংশের কোনো ভগ্নাংশও হবে না। ব্যাংকসেবা-বহির্ভূত মানুষদের জন্য প্রয়োজন সত্যিকারের ব্যাংকিং, কোনো লোকদেখানো ভালোমানুষি কর্মসূচি নয়।
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি ব্যাংকিং ব্যবস্থার মৌলিক নীতিগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। আমি যুক্তি দেখিয়ে আসছিলাম যে, আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা মানুষ সম্পর্কে যে তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে অনেক বড়। গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস তারই জীবন্ত প্রমাণ।
গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণের ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে কারণ এনজিওরা এটিকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে পৌঁছাচ্ছে না সেই বিশাল শূন্য জায়গাটা শুধু এনজিওদের দ্বারা পূর্ণ হওয়ার নয়। আমি যুক্তি দেখিয়ে আসছি যে, একটি সহজ পথ হতে পারে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী এনজিওদের ব্যাংকিং লাইসেন্স দেয়া, যাতে তারা ব্যাংক হিসেবে কাজ করতে ও আমানত নিতে পারে এবং এভাবে আত্মনির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে। আমি খুবই আনন্দিত যে, বহু বছর চিন্তাভাবনার পর ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ভারতের ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী এনজিওদের ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকে পরিণত হতে লাইসেন্স দিচ্ছে। এটি হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের পথে প্রথম সঠিক পদক্ষেপ, যদিও লক্ষ্য অর্জনে আমাদের আরো অনেক এগিয়ে যেতে হবে। ব্যাংকসেবা-বহির্ভূতদের বিভিন্ন অতি প্রয়োজনীয় আর্থিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে একটি শূন্যস্থান এখনো রয়ে গেছে, যেগেুলো হতে হবে বিশেষভাবে তাদেরই জন্য প্রণীত, নিয়মিত গ্রাহকদের জন্য প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার কোনো অতিক্ষুদ্র সংস্করণ কেবল নয়।
আমি বহু দিন ধরেই যুক্তি দেখিয়ে আসছি যে, ঋণকে একটি মানবিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে যাতে এর প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়া যায় এবং এটিকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দেয়া যায়। দরিদ্রদের জন্য একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমেই কেবল আমরা এই মানবিক অধিকারটি প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
গ্রামীণ ব্যাংকের সমালোচকরা বরাবরই বলে আসছিলেন যে, ‘গরিবদের ঋণ দেয়াটা আসলে অর্থের অপচয়, কেননা তারা জানে না এ টাকা কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। এতে কেবল তাদের ঋণের বোঝাই বাড়ে।’ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। ঋণের বোঝার পরিবর্তে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে তারা বিপুল সঞ্চয়ের মালিক হয়েছে, যা এখন তাদের মোট আদায়যোগ্য ঋণের চেয়ে বেশি। গ্রামীণ ব্যাংক তাদেরকে চমৎকার সঞ্চয়কারীতে পরিণত হতে, মূলধন তহবিলের গর্বিত মালিক হতে এবং আর্থিকভাবে শক্তিশালী ও দেশব্যাপী বিস্তৃত একটি ব্যাংকের মালিক হতে সহায়তা করেছে।
আমি যুক্তি দেখিয়ে আসছি যে, প্রতিটি মানুষই সীমাহীন সৃষ্টিশীল শক্তি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। সমাজ তাকে তার ক্ষমতা অবারিত করার সুযোগ করে দিলে সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে।
সমালোচকেরা উল্টো যুক্তি দেখালেন। তারা বললেন যে, ‘গরিবের হাতে টাকা দেয়া মানে সেটা অপচয় করা, বরং টাকাটা তারই হাতেই দেয়া উচিত যে অন্য লোককে চাকরি দিতে পারবে।’ আমি বিষয়টা সেভাবে দেখলাম না। আমি দরিদ্রতম মহিলাদের মধ্যে চাপা পড়া উদ্যোক্তার প্রতিভাটি বাইরে বের করে এনে তাদেরকে উদ্যোক্তায় পরিণত করতে চাইলাম। সমালোচকেরা এই বিশ্বাস নিয়ে রইলেন যে, উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়টি কেবল কিছু বিশেষ লোকের একটি ছোট্ট শ্রেণীর ব্যাপার, অন্যদের জন্ম হয়েছে তাদের অধীনে কাজ করতে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন যেভাবে চলছে আমরা যদি তাদের সেভাবেই চলতে দিই, তাহলে সেটা সম্পদকেন্দ্রীকরণে ঘি ঢালারই শামিল হবে। ব্যক্তিগত সম্পদের কেন্দ্রীকরণ কমাতে হলে আমাদের দুটো কাজ করতে হবে। বিদ্যমান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে তারা আর সম্পদকেন্দ্রীকরণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে না পারে।
দ্বিতীয়ত, দরিদ্রদের সকল ধরনের আর্থিক সেবা দেয়ার জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। দরিদ্ররা যাতে তাদের নিজ শক্তিতেই ওপরে উঠে আসতে পারে সে জন্য আর্থিক সেবা সরবরাহ করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশেষ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামাজিক ব্যবসা হিসেবে তৈরি করতে হবে যেন তারা ধনীদের ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে তাদের পক্ষে সম্পদকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়াকে আরো শক্তিশালী করতে না পারে।
একজন ধনী কিভাবে আরো ধনী হন, তা জানতে হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে ভালোভাবে তাকালেই চলবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোই সম্পদকেন্দ্রীকরণের চালিকাশক্তি। আমরা যদি সম্পদ-পিরামিডকে দরিদ্রদের অনুকূলে রূপান্তরিত করতে চাই, তাহলে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। বিদ্যমান আর্থিক কাঠামো এই সম্পদ-পিরামিডকে কেবল তৈরিই করেনি, একে ক্রমাগতভাবে আরো ভয়াবহ করে চলেছে।
সামাজিক ব্যবসা
দরিদ্রদের সাথে কাজ করতে গিয়ে আমি তাদের আরো অনেক সমস্যার মুখোমুখি হলাম। সেসব সমস্যার কিছু কিছু সমাধানেরও চেষ্টা করলাম। আমি সব সময়ই এক একটি নতুন ব্যবসা সৃষ্টি করে এক একটি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছি। একসময়ে এটা আমার অভ্যাসে পরিণত হলো : যখনই আমি একটা সমস্যার মুখোমুখি হই, তা সমাধানের জন্য আমি একটা ব্যবসা সৃষ্টি করি। শিগগিরই আমি অনেকগুলো কোম্পানি তৈরি করে ফেললাম, সাথে কোম্পানির মতো কিছু স্বতন্ত্র প্রকল্পও। যেমন দরিদ্রদের জন্য গৃহায়ণ, দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, স্বাস্থ্যসেবা, নবায়নযোগ্য শক্তি, পুষ্টি, পানি, নার্সিং কলেজ, চক্ষু হাসপাতাল, অটোমেকানিক ট্রেনিং স্কুল এবং আরো অনেক।
ক্রমান্বয়ে এগুলো কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিতে শুরু করল। এগুলো তৈরি হলো টেকসই ব্যবসা হিসেবে, কিন্তু এগুলো থেকে কেউ কোনো ব্যক্তিগত মুনাফা নিতে পারবে না। বিনিয়োগকারী তার বিনিয়োজিত টাকা ফেরত নিতে পারবেন, তবে এর বেশি নয়। কোম্পানির মুনাফা কোম্পানিতেই পুনর্বিনিয়োগ করা হবে তার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য। এই নতুন ধরনের ব্যবসাকে আমি নাম দিলাম ‘সামাজিক ব্যবসা’ : মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যক্তিগত লভ্যাংশবিহীন ব্যবসা।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ব্যবসা থেকে ব্যক্তিগত লাভের প্রত্যাশা না করে কেবল সমাজের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কোনো ব্যবসা সৃষ্টি করলে তা দিয়ে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কাজটা কত সহজ। আমাদের সব সময় বলা হয়েছে যে, ব্যবসা নামের এই যন্ত্রটির একটিই ব্যবহার আছে, আর তা হচ্ছে টাকা বানানো। আমি এই যন্ত্রটিকেই সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলাম, অর্থাৎ মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কাজে। আর এ কাজে ব্যবসাকে আমি অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকায় দেখতে পেলাম। হঠাৎ করে সমস্ত সৃষ্টিশীল শক্তিকে একটি লক্ষ্যে- মানুষের সমস্যা সমাধানে- এই যন্ত্রটির পেছনে সম্মিলিত করা সম্ভব হয়ে উঠল।
আমি ভাবলাম, পৃথিবীতে সমস্যা সমাধানের কাজটি কেন শুধু সরকার বা চ্যারিটির উপর ছেড়ে দেয়া হলো? আমি এর জবাব খুঁজে পেলাম। কারণ অর্থনৈতিক তত্ত্বে ব্যবসার দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য টাকা বানানো। মানুষের সমস্যা সমাধানের কাজটি ছেড়ে দেয়া হয়েছে সরকার ও চ্যারিটির ওপর। একজন ব্যবসায়ী কেবল আত্মস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হবে, এমনটাই সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তার কাছে ব্যবসা মানে ব্যবসাই। কিন্তু প্রকৃত মানুষতো টাকা বানানোর রোবট নয়। মানুষ একটি বহুমাত্রিক প্রাণী, যার মধ্যে স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা দু’টোই আছে। আমি যখন একটি সামাজিক ব্যবসা তৈরি করি, তখন আমি পরার্থপরতাকে ব্যবসায়ের মধ্য দিয়ে প্রকাশের সুযোগ করে দেই। পুরনো ব্যাখ্যা অনুসারে পরার্থপরতা ব্যবসায়িক জগতের অংশ হতে পারে না, এটি চ্যারিটির জগতের অংশ। আমার যুক্তি হচ্ছে, মানুষের ডিএনএতে পরার্থপরতা থেকে থাকলে সেটাকে ব্যবসার জগৎ থেকে দূরে রাখতে হবে কেন? ব্যবসার জগতে স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা দু’টোকেই পক্ষপাতহীনভাবে চলতে দেয়া উচিত। অর্থশাস্ত্রের টেক্সট বইগুলোর উচিত ছাত্রদের দুই ধরনের ব্যবসার সাথেই পরিচিত করানো : আত্মস্বার্থ চালিত ব্যবসা ও পরার্থপরতা চালিত ব্যবসা। কে কোনটা বেছে নেবে, তারা কি বিভিন্ন অনুপাতে দুই ধরনের ব্যবসারই কোনো সংমিশ্রণ তৈরি করবে, নাকি তারা প্রত্যেকটিই আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠা করবে, তা তরুণ ছাত্রদের ওপরই ছেড়ে দেয়া হোক।
আত্মস্বার্থ চালিত ব্যবসায়ে অনেকেই তাদের স্বার্থপরতাকে চূড়ান্ত রূপে প্রকাশ করেন, তারা সীমাহীনভাবে লোভী হয়ে ওঠেন। টাকার জন্য নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এই প্রক্রিয়ায় মানবজাতি তার মানবীয় পরিচিতি হারানোর প্রায় একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। মানুষ প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও বন্ধুত্ববোধ সম্পন্ন একটি সত্তা। আমরা যদি এমন একটি তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারি, যা আমাদের চরিত্রের গভীরে প্রোথিত মানবিক মূল্যবোধগুলোকে আমাদের অর্থনৈতিক জীবনে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ করে দেবে, তাহলে আমরা সম্পদ-পিরামিডকে সম্পদ-রুহিতনে (Wealth-Diamond) পরিণত করতে পারব। এই মূল্যবোধগুলো সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে পরিষ্ফুট হয়ে আমাদের সেখানে পৌঁছে দিতে পারে।
সামাজিক ব্যবসাকে দু’টি পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখা যেতে পারে। চ্যারিটির দৃষ্টিকোণ থেকে একে টেকসই দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা যায়। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে একে পরার্থপর ব্যবসা হিসেবে দেখা যেতে পারে। সামাজিক ব্যবসার একটি বড় জিনিস এই যে, এর পেছনে কাজ করে সদিচ্ছা, কোনো বাধ্যবাধকতা নয়। কেউ তার ইচ্ছা মতো সামাজিক ব্যবসা করতে বা তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এতে মানুষ স্বাধীন বোধ করে, কী করতে চায় তা ঠিক করতে পারে।
আমি আনন্দিত যে সামাজিক ব্যবসার ধারণাটি পৃথিবীর সব দেশে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সামাজিক ব্যবসাকেন্দ্র চালু করছে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সামাজিক ব্যবসা চালু করতে এগিয়ে আসছে, তরুণ প্রজন্ম এই ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আমরা মানুষরা নিজেরাই আমাদের সব সমস্যা সমাধান করতে সক্ষমÑ এই ধারণায় বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারুণ্য, প্রযুক্তি ও সামাজিক ব্যবসার সম্মিলিত শক্তি একে সম্ভব করে তুলবে।
প্রযুক্তি
প্রযুক্তি প্রচণ্ড গতিতে প্রসারিত হচ্ছে। আজ যা অসম্ভব, তা কালই সম্ভব হচ্ছে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পরিবর্তন প্রতিনিয়ত এত দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে ঘটছে যে তা আমাদের আর অবাক করে না। অবিশ্বাস্য তথ্যপ্রযুক্তির পুরো শক্তিটা ভোগ করছে তরুণ প্রজন্ম। তারা তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের চেয়ে অনেক দ্রুততার সাথে নতুন প্রযুক্তিকে আত্মস্থ করতে পারে। তাদের কল্পনার শক্তিই কেবল নতুন নতুন প্রযুক্তির সীমানা। তাদের কল্পনা যত সাহসী, তাদের অর্জনও তত বড়। তারা যদি এমন বিশ্ব কল্পনা করতে শুরু করে যেখানে কোনো সম্পদ বৈষম্য থাকবে না, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে সম্পদবৈষম্য বলে কিছু থাকবে না। তারুণ্য, প্রযুক্তি ও সামাজিক ব্যবসার মিলিত শক্তি হতে পারে অপ্রতিরোধ্য।
শিক্ষাকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে
সম্পদ কেন্দ্রীকরণের সমস্যা বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হলে শিক্ষাকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য পুনঃনির্ধারণ এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর অনেক উচ্চাকাক্সক্ষী লক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল কাজ হয়ে গেছে তরুণদের চাকরির জন্য তৈরি করা। ধরে নেয়া হয় যে, প্রতিটি তরুণকেই চাকরি খুঁজে নিতে সক্ষম হতে হবে। চাকরি খোঁজার সক্ষমতার কাছে শিক্ষার আর সব উদ্দেশ্যই গৌণ হয়ে গেছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নিজেকে আবিষ্কার করতে ও জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেতে একজন তরুণকে সাহায্য করা। এর মূল লক্ষ্য ছিল, ‘নিজেকে জানো’। এখন অধিকাংশ সময় তাকে ব্যস্ত থাকতে হয় ‘তোমার নিয়োগকর্তাকে জানো’ এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য।
মানুষের এমন একটি পরিণতিকে আমি অত্যন্ত অসম্মানজনক মনে করি। মানুষের জীবনটা নিয়োগকর্তার ইচ্ছার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টায় কাটিয়ে দেয়ার চেয়ে অনেক অনেক বড়। মানুষকে আমি দেখি এমন এক সত্তা হিসেবে, যে নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে চলে, নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করে, সমস্যার সমাধান করে।
আমরা চাকরিপ্রার্থী নই, আমরা চাকরিদাতা
মানুষ সীমাহীন সৃষ্টিশীল সক্ষমতায় পূর্ণ একটি জীব। তার জীবদ্দশায়ই তাকে তার সম্ভাবনাগুলোকে আবিষ্কার করতে হবে। শিক্ষার কাজ হচ্ছে মানুষ হিসেবে তাকে তার সম্ভাবনাগুলোর সাথে পরিচিত করানো, যাতে সে তার ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হতে পারে, ক্ষমতার ব্যবহার সম্পর্কে চিন্তা শুরু করতে পারে। শিক্ষার উচিত তাকে উদ্যোক্তা বা চাকরি সৃষ্টিকারী হতে প্রস্তুত করা, চাকরি খুঁজতে নয়। এ দু’টোর মধ্যে বিশাল পার্থক্য। তরুণদের চাকরি খুঁজতে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমরা বেকারত্ব তৈরি করছি। কারণ সবার জন্য চাকরির ব্যবস্থা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হয় না। আমরা যদি তরুণদের চাকরি সৃষ্টিকারী হিসেবে গড়ে তুলতাম, তাহলে বেকারত্ব বলে কিছু থাকত না।
সবাই কি উদ্যোক্তা হতে পারে- প্রশ্নটি প্রায়ই আমাকে করা হয়। আমার বিশ্বাস, প্রতিটি মানুষই জন্মগতভাবে একজন উদ্যোক্তা। আমরা এভাবেই পৃথিবীতে আমাদের জীবন শুরু করেছি। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ক্ষুদ্রঋণীর প্রত্যেকেই একেক জন উদ্যোক্তা। গ্রামের নিরক্ষর নারীরা যদি উদ্যোক্তা হতে পারে, শিক্ষিত তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কেন? তাদের শুধু যা প্রয়োজন তা হলো একটি সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থা ও আর্থিক কাঠামো।
সহায়ক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা সামাজিক ব্যবসা তহবিল তৈরি করেছি। তরুণদের আমরা বলছি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে। তারা এগিয়ে এলে আমরা তাদের ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করছি। আমরা তাদের ব্যবসায়িক অংশীদার হয়ে যাচ্ছি, এনজেল ইনভেস্টারের মতো; পার্থক্য একটাই : আমরা তাদের ব্যবসা থেকে কোনো মুনাফা নিচ্ছি না, কারণ আমরা সামাজিক ব্যবসা। তারা তাদের ব্যবসা একবার দাঁড় করিয়ে ফেললে আমাদের শেয়ারগুলোও তারা কিনে নেয়, কোনো মুনাফা না দিয়েই।
এই মুহূর্তে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী আমাদের সাথে অংশীদারিত্বে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা এই তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই বিশ্বাস জাগ্রত করেছি- ‘আমরা চাকরিপ্রার্থী নই, আমরা চাকরিদাতা,’ এবং তারা এটা বাস্তবায়িতও করছে।
আমি খুবই আনন্দিত যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার বক্তব্যে ভারতের যুবসমাজকে ক্রমাগতভাবে এই বলে উজ্জীবিত করছেন যে, ‘আমরা চাকরিপ্রার্থী নই, আমরা চাকরিদাতা।’ তিনি এই কর্মসূচির প্রকৃত বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ‘মুদ্রাব্যাংক’ নামে একটি পুনঃঅর্থায়ন ব্যাংকও প্রতিষ্ঠা করেছেন। আশা করছি একে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি একটি সহায়তা ব্যবস্থা (ইকো সিস্টেম) গড়ে তুলতেও সফল হবেন।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সৃষ্টিশীল উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিবর্তিত করার কাজটি একবার করতে পারলে সম্পদ বৈষম্যের বর্তমান চেহারাটি বদলাতে শুরু করবে। আমাদের প্রতিভাবান তরুণদের আমরা যদি অন্যদের ধনী বানানোর পরিণতির হাতে ছেড়ে দিই, সম্পদের কেন্দ্রীকরণ আকাশচুম্বী হয়ে উঠবে। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের তরুণদের সম্পদ কেন্দ্রীকরণের গতর খাটা সৈনিক হতে দিতে পারি না।
সম্পদের কেন্দ্রীকরণ রুখতে হলে আমাদের এক মুখী সম্পদ প্রবাহের স্থলে দ্বিমুখী সম্পদ প্রবাহ সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমান সম্পদপ্রবাহ সম্পদশালীদের দিকে প্রবাহিত হয়। আমাদের প্রয়োজন এমন ধরনের প্রবাহ, যা সম্পদশালীর নিকট থেকে সম্পদ নিয়ে আসবে সম্পদহীনের কাছে।
সামাজিক ব্যবসায়ের মধ্যে আমি এই নতুন শক্তিটি দেখতে পাই। এটা বর্তমান ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহের মতো শক্তিশালী হবে কিনা তা নির্ভর করবে মানুষ কত দৃঢ়ভাবে এর পেছনে দাঁড়াচ্ছে তার ওপর।
সামাজিক ব্যবসার অর্থ সংস্থান
সামাজিক ব্যবসার ধারণাটিকে আমি যত এগিয়ে নিতে যাচ্ছি, আমি আনন্দের সাথে লক্ষ করছি যে সব দেশ থেকে আমি ঊষ্ণ সাড়া পাচ্ছি। সামাজিক ব্যবসা এখন পৃথিবীর অনেক দেশে বিকশিত হচ্ছে। সামাজিক ব্যবসা নিয়ে আলোচনার সময়ে একটি প্রশ্ন প্রায়ই উঠে আসে : এই ব্যবসাকে বিশ্বজুড়ে প্রসারিত করতে গেলে প্রয়োজনীয় তহবিল কোত্থেকে আসবে?
দাতব্য প্রতিষ্ঠান
বিদ্যমান বিনিয়োগ তহবিলগুলো কেবল ব্যক্তিগত মুনাফাকারী ব্যবসার জন্য। আপনি যত বেশি ব্যক্তিগত মুনাফার প্রতিশ্রুতি দিতে বা নিশ্চিত করতে পারবেন, বিনিয়োগের জন্য তত বেশি তহবিল আপনি পাবেন। এই বিনিয়োগকারীদের সামাজিক ব্যবসায়ে আগ্রহী হওয়ার কোনো কারণ নেই। সে ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসা তার বিনিয়োগের তহবিল কোথায় পাবে? একে অবশ্য মানুষের পরার্থপরতার জায়গাটি থেকে আসতে হবে। পরার্থপরতার সর্বোচ্চ প্রকাশ হচ্ছে দানশীলতা। চ্যারিটির জগতে যা ঘটে তা থেকে পরার্থপরতার একটা পরিমাপ করা যায়। এখন দেখতে হবে দানের অর্থকে কিভাবে সামাজিক ব্যবসা তহবিলে রূপান্তরিত করা যায়। দানশীলতা আর সামাজিক ব্যবসার মূলতো একই জায়গায়, উভয়েরই লক্ষ্য মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
দানশীলতা স্মরণাতীত কাল থেকে সমাজে চলে আসছে। এটা মানব চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিগণিত। সব ধর্মই এর ওপর খুব জোর দিয়ে থাকে। দানশীলতা ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের একটি। প্রতিটি মুসলমানকে প্রতি বছর তার সম্পদ ও আয়ের ২.৫% দান করে দিতে হয়। কল্পনা করুন এর সম্ভাব্য পরিমাণ কত। আমরা যদি প্রতি বছর প্রকৃতপক্ষে প্রদত্ত অঙ্কগুলো যোগ করি, তার আকারও হবে বিশাল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনদাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো (যেসব প্রতিষ্ঠান সাধারণ জনগণ ও অন্যদের নিকট থেকে তহবিল সংগ্রহ করে চলে থাকে) প্রতি বছর ১.৬ ট্রিলিয়ন ডলার দান করে থাকে। তাদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি।
আমি উদাহরণ হিসেবে এই দু’টোর কথা উল্লেখ করলাম। পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য ধরনের দাতব্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের তহবিলের পরিমাণ বিশাল।
ব্যক্তিগত দান
এ ছাড়াও ব্যক্তিগত দানের অগণিত কাহিনী আমাদের সামনে রয়েছে। একটি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হচ্ছেন মার্ক জুকারবার্গ। তিনি তার মেয়ের জন্ম উপলক্ষে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি ফেসবুকের ৯৯% শেয়ার, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার, দান করে দেবেন। আগামী তিন বছর প্রতি বছর ১ বিলিয়ন ডলার করে দেবেন সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি তার দান শুরু করে দিয়েছেন। পরার্থপরতার ক্ষেত্রে এটি একটি আগ্রহোদ্দীপক ঘটনা। তার প্রথম সন্তানের জন্ম উপলক্ষে তিনি এই দানটি করেছেন। স্বাভাবিক মনে হতো যদি পিতা তার ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ নবজাতক সন্তানকে সময়ের আগেই তার নামে সম্পত্তি হস্তান্তর করে দিতেন। মার্ক উল্টোটি করেছেন। তিনি তার সন্তানকে সম্পদের উত্তরাধিকার হওয়া থেকে বঞ্চিত করে তার জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে তার সম্পদ দান করে দিয়েছেন। সাধারণত মানুষ তার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সম্পদ বিলিয়ে দেয়ার কাজটি করে। মার্ক একটি অসাধারণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; তিনি তার জীবনের শুরুতেই তার সম্পদের প্রায় সবটুকু দান করে দিয়েছেন। তার বয়স মাত্র ৩১ বছর। ফেসবুকের শুরু থেকে এর প্রধান নির্বাহী হিসেবে মার্ক মাত্র ১ ডলার করে বেতন নিয়ে আসছেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি ‘দ্য গিভিং প্লেজ’-এ স্বাক্ষর করেছেন। জুকারবার্গ, বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেট ২০১০ সালে একটি প্রতিশ্রুতিতে স্বাক্ষর করেন, তারা যার নাম দিয়েছেন ‘দ্য গিভিং প্লেজ’। এতে তারা তাদের সম্পদের কমপক্ষে অর্ধেক ভবিষ্যতে দাতব্য কাজে প্রদানের অঙ্গীকার করেন এবং অন্যান্য ধনী ব্যক্তিকেও তাদের সম্পদের ৫০% বা তার বেশি একই ভাবে দান করার আহ্বান জানান। গিভিং প্লেজ ৪০ জন মাল্টি বিলিয়নিয়ারকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে। প্লেজে স্বাক্ষরকারী মাল্টি-বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা এখন ১৪১ জন।
আমি মার্কের উদাহরণ দিচ্ছি কারণ তিনি বয়সে তরুণ। তার এই বয়সে টাকার ব্যাপারে উচ্চাকাক্সক্ষী হওয়ার এবং নিজ ‘ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে’ ব্যস্ত থাকার কথা। কিন্তু তিনি তার বিপরীতটা করছেন। মার্ক হয়তো তার প্রজন্মের তরুণদের জন্য একটি নতুন গতিধারার প্রতিনিধিত্ব করছেন। এরা ভিন্ন ধরনের। এরা কেবল নিজের ভাগ্য গড়ার চেয়ে একটি নতুন পৃথিবী গড়ার কাজে বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমার ভয় হয়, পূর্ববর্তী প্রজন্ম তাদের পুরোন কাঠামোগুলো এই নতুন প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করে এই নতুন প্রজন্মটিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
সামাজিক ব্যবসার ধারণা জনপ্রিয় হওয়ার সাথে সাথে এই দাতব্য তহবিলের একটি অংশ, আইন বা ধর্মীয় বাধানিষেধ সাপেক্ষে, সামাজিক ব্যবসার দিকে প্রবাহিত হবে। আর এই প্রবাহটি ক্রমাগত বড় হতে থাকবে। দাতব্য কাজের সিদ্ধান্তের সাথে সাথে এ প্রশ্নটিও উঠবে যে, আমি কি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে টাকা দেব নাকি সামাজিক ব্যবসা তহবিলে দেব? ব্যক্তি, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, ফাউন্ডেশন, কোম্পানি সবাই সামাজিক ব্যবসাকে এমন একটি টেকসই দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে পাবে যেখানে একই টাকা অসংখ্যবার ব্যবহার করা যাবে।
ব্যবসায়ের জগতে পরার্থপরতা
কিন্তু ব্যবসার টাকার কী হবে? ব্যবসার দরজা কি সামাজিক ব্যবসার জন্য চিরতরে বন্ধ থাকবে? আমি তা মনে করি না। ব্যবসার জগতে পরার্থপরতার অনেক নজির এখনই রয়েছে। অতীতেও অনেক ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে এগুলো কখনোই বিজনেস স্কুলের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আমি অতীত থেকে দু’টো চমৎকার উদাহরণ দিচ্ছি।
বশ (Bosch)
বশ ১৩০ বছরের পুরোন একটি জার্মান ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইলেকট্রনিকস বহুজাতিক কোম্পানি, যার বার্ষিক আয় ৫০ বিলিয়ন ডলার। কোম্পানিটি বিশ্বে ব্যাপকভাবে পরিচিত। অনেকেই জানেন না যে কোম্পানিটির মালিক বশ ফাউন্ডেশন। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা কোম্পানিটির ৯২% মালিকানা অর্পণ করার জন্য একটি ফাউন্ডেশন সৃষ্টি করেন। তার পরিবারকে কোম্পানির মাত্র ৮% শেয়ার দিয়ে যান, যা এখনো সেভাবেই আছে। ফাউন্ডেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা করে এবং মুনাফা দাতব্য কাজে ব্যবহার করে। ব্যবসা ও পরার্থপরতা কিভাবে একসাথে কাজ করতে পারে বশ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমরা একে দ্বিতীয় ধরনের সামাজিক ব্যবসা বলে থাকি যেখানে একটি কোম্পানি মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো ট্রাস্ট বা ফাউন্ডেশনের মালিকানাধীনে পরিচালিত হয়।
টাটা ট্রাস্ট
আরেকটি উদাহরণ। পৃথিবীর অনেক জায়গায় বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় বহুল পরিচিত একটি নাম ‘টাটা’। টাটার প্রতিষ্ঠাতা ১২৮ বছর আগে একই কাজ করেছিলেন। টাটা গ্রুপ অব কোম্পানিজের দুই-তৃতীয়াংশ শেয়ারের মালিক টাটা ট্রাস্ট। টাটা গ্রুপের মোট সম্পদ ১১৮ বিলিয়ন ডলার।
পৃথিবীজুড়ে এরকম অসংখ্য ছোট-বড়, নতুন-পুরোনো উদাহরণ রয়েছে। এগুলো পুঁজিবাদের নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে, কিন্তু এত দক্ষতা ও কুশলতার সাথে এগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে এদের ব্যবসা জগৎ থেকে বহিষ্কার করে দেয়া যায়নি। একটি নতুন ধরনের ব্যবসায়িক বিশ্ব গড়ে তুলতে এই উদ্যোগগুলো ছিল শীর্ষস্থানীয়। এই ধরনের উদারণগুলো সাহসের সাথে ব্যাপকভাবে অনুসরণ করা যেত, কিন্তু সনাতন ব্যবসায়ের তত্ত্ব এদের কোনো স্বীকৃতিই দেয়নি।
করপোরেটসমূহ ও সামাজিক ব্যবসা
ব্যক্তি মানুষরা ছাড়াও করপোরেটগুলোও সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে পারে। সচরাচর করপোরেটগুলো তাদের নিজ নিজ কোম্পানির জন্য ফাউন্ডেশন সৃষ্টি করে থাকে। তারা সহজেই তাদের ফাউন্ডেশনগুলোকে সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে বলতে পারে। ফাউন্ডেশনগুলো নিয়মিত কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে পারে এবং সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগের জন্য মুনাফা করতে পারে, যেমনটা বশ ও টাটা করছে। এ ছাড়া করপোরেটগুলো তাদের সাবসিডিয়ারি হিসেবে সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি করতে পারে, অন্য সামাজিক ব্যবসার সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার করতে পারে। আমরা এরই মধ্যে ড্যানোন, ভিওলিয়া, ইউনিক্লো, ইন্টেল করপোরেশন, ম্যাক-কেইন, ইউগ্লেনার মতো কোম্পানির দ্বারা তৈরি চমৎকার সব জয়েন্ট ভেঞ্চার পেয়েছি। করপোরেটগুলো আরো কিছু করতে পারে। তারা তাদের শেয়ারহোল্ডারদের একটি ‘গিভিং প্লেজ’-এ স্বাক্ষর করতে আহ্বান জানাতে পারে। শেয়ারহোল্ডারদের অনুমতি নিয়ে তাদের লভ্যাংশের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ কেটে রেখে তা ইকুইটি হিসেবে সামাজিক ব্যবসায়ে দিয়ে দেয়া হবে। প্রয়োজন হলে তহবিলের এই শেয়ারগুলো অভিহিত মূল্যে অন্য কোনো সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারী কারো কাছে বিক্রি করে দেয়া যাবে। এভাবে তাদের টাকা একেবারে শেষ হয়ে যাবে না।
করপোরেটগুলো তাদের বার্ষিক করপোরেট সামাজিক দায়িত্বের (সিএসআর) অনুদান সামাজিক ব্যবসা ট্রাস্টে দিতে পারে।
আমি অনুরূপ একটি কর্মসূচি সৃষ্টি করার জন্য ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছি। তারা বিপুল পরিমাণ তহবিল ব্যবস্থাপনা করে থাকে। বিশ্বব্যাপী মিউচুয়াল ফান্ডগুলোতে বিনিয়োজিত সম্পদের পরিমাণই ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ তহবিল রয়েছে। সবগুলোর মোট সম্পদ মহাসাগর সমতুল্য হবে।
তাদের কাছে আমার প্রস্তাবটি হচ্ছে- প্রত্যেক বিনিয়োগকারীকে এই মর্মে পছন্দের একটি সুযোগ দেয়া হোক যে তিনি চাইলে তার সম্পদের একটি অংশ, যেমন ২.৫% (বা কম-বেশি), আলাদা করে এক ধরনের পুনরুদ্ধারযোগ্য প্রদত্ত তহবিল (Recoverable endowment fund) তৈরি করতে পারবেন। এই তহবিল থেকে উপার্জিত বার্ষিক আয় সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করা হবে। বিনিয়োগকারী যা করছেন তা হলো তিনি কোনো সামাজিক উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য তার সম্পদের ২.৫% পরিমাণ আয় ত্যাগ করছেন, তার সম্পত্তি ত্যাগ না করেই। কোম্পানিগুলো সম্মত হলে এবং বিনিয়োগকারীরা রাজি হলে এই পুনরুদ্ধারযোগ্য তহবিলের পরিমাণ হতে পারে বিশাল।
আমি বিশাল আকৃতির পেনশন ফান্ডগুলোর সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতি-প্রণেতাদের একই উদ্দেশ্যে একই ভঙ্গিতে পুনরুদ্ধারযোগ্য প্রদত্ত তহবিল সৃষ্টিতে প্রয়োগ করার পরামর্শ দিচ্ছি। বিশ্বব্যাপী পেনশন ফান্ডগুলোর সম্মিলিত সম্পদ ৮৪ ট্রিলিয়ন ডলার। তাদের কেবল যা করতে হবে তা হলো বিনিয়োগকারীদের তাদের পরিকল্পনাটি জানানো এবং এ কাজে তাদের সম্মতি নেয়া। আমি এখন পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাইনি। তাদের মতে, এই আইডিয়াতে কেউ ইতিবাচকভাবে সাড়া দেবে না, কারণ বিনিয়োগকারীরা যা চায় তা হলো তাদের তহবিলের দ্রুত বৃদ্ধি; তারা ‘দিয়ে দেয়া’য় আগ্রহী নয় মোটেই। আমি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি যে, তারা একেবারে অপ্রত্যাশিত রকম সাড়াও পেয়ে যেতে পারেন। আমি বলি, আপনারা যতক্ষণ না বিনিয়োগকারীদের সত্যি সত্যি জিজ্ঞেস করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত জানতে পারছেন না কী চমক আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি বললাম, আমি এমন একটি ফরচুন ৫০০ কোম্পানিকে জানি তারা তাদের শেয়ারহোল্ডারদের কাছে অনুরূপ একটা প্রস্তাব করেছিল এবং পরে একবারে অবাক হয়ে গিয়েছিল তাদের ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া পেয়ে। ৯৮% শেয়ারহোল্ডার তাদের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিলেন। অবশ্যই এমনো হতে পারে যে প্রথম অনুরোধে সবাই রাজি হবেন না। তবে তাদের কয়েকজনও যদি রাজি হন সেটা হবে এক বিরাট কাহিনীর শুরু। সামাজিক ব্যবসাগুলোর ফলাফল যদি সন্তোষজনক হয়, অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে।
এটা মূলত উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপার। একটি শহরে একটি পেনশন তহবিল দিয়ে এটা শুরু হতে পারে। শুরুতে সাড়া যত কমই হোক না কেন, এটা একটা দরজা খুলে দেবে, যা ক্রমান্বয়ে বড় হতে থাকবে। কিন্তু শুরুটা করতে হবে। আমাদের এই পুরনো বিশ্বাস নিয়ে থাকলে চলবে না যে, বিনিয়োাগকারীরা লাভ ছাড়া আর কিছুতে আগ্রহী নয়, তারা লাভ ছাড়া আর কিছু দেখে না, আর কিছু শোনে না। আমাদের বুঝতে হবে যে, পৃথিবী ও তার মানুষগুলো বদলে যাচ্ছে। তারা ভিন্নভাবে আচরণ করতে শুরু করেছে।
পেনশন ফান্ড থেকে জন্ম নেয়া পুনরুদ্ধারযোগ্য প্রদত্ত তহবিলের সৃষ্ট টাকা বিনিয়োগ করে তা দিয়ে পার্থক্যকৃত মূল্যে ধনী-দরিদ্র সব বৃদ্ধ মানুষের দেখভাল করা সম্ভব। এটা দিয়ে স্বাস্থ্যবীমা ও বিভিন্ন স্বাস্থ্যসুবিধা যেমন- হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিংসেবা, সেবাসদন, বৃদ্ধ নিবাস এবং আয়ের সুযোগ, গৃহায়ন, খেলাধুলা, ভ্রমণ ইত্যাদি সেবা দেয়ার জন্য সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি করতে পারে।
সামাজিক ব্যবসা দিবস
যখনই মানুষ পৃথিবীতে সম্পদের বৈষম্য কমিয়ে আনার পথ খুঁজবে, সামাজিক ব্যবসাকে তারা এই উদ্দেশ্য সাধনে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখতে পাবে। সামাজিক ব্যবসা সমাজের ওপরের স্তরের মানুষদের সম্পদ সঞ্চয়নের প্রক্রিয়াকে শ্লথ করবে এবং সমাজের নিচের স্তরের মানুষদের সম্পদের ভিত গড়ে তুলতে ও তাদের যা কিছু অর্জন তা ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
আমরাও আমাদের নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে পারি। আমরা সবাই এই ধারণাটি আসলে কতটুকু কাজের তা পরীক্ষা করে দেখতে পারি। আমরা প্রত্যেকেই কোনো সামাজিক ব্যবসার আইডিয়া নিয়ে আসতে পারি। সামাজিক ব্যবসায়ে আইডিয়া সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস। আমরা প্রত্যেকেই কোনো একটি সামাজিক ব্যবসায়ে সরাসরি বা এর সাথে যুক্ত কারো মাধ্যমে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আমরা আমাদের বার্ষিক আয়ের ৫% এই উদ্দেশ্যে একটি আলাদা হিসাবে রাখতে পারি, অনেকটা ব্যক্তিগত সামাজিক ব্যবসা তহবিলের মতো আর তা সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে পারি। একটি সহজ উদাহরণ হিসেবে, যেকেউ ৫, ১০, ২৫ বা আরো বেশি বেকার তরুণ বা তরুণীকে উদ্যোক্তায় পরিণত করতে পারি। আমরা এটা কিভাবে করছি তা আপনাকে দেখিয়ে দেবো; আপনার ভালো লাগতে পারে।
আমরা প্রতি বছর ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস’ পালন করে থাকি। এ বছর আমরা ২৮-২৯ জুলাই দিবসটি পালন করব। পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসার অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সেশন ছাড়াও আমরা কান্ট্রি ফোরামের আয়োজন করব যেখানে প্রত্যেক দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিরা তাদের নিজ দেশের জন্য আলাদা সেশন পরিচালনা করবেন এবং নিজ নিজ দেশের জন্য সামাজিক ব্যবসা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করবেন। এই কান্ট্রি ফোরামগুলোতে অংশগ্রহণ করার জন্য তারা নিজ নিজ দেশ থেকে ব্যবসায়ী নেতা, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষাবিদ, ফাউন্ডেশন নেতাদের নিয়ে আসবেন। সামাজিক ব্যবসার ওপর একটি বাংলাদেশী ফোরামও সেখানে থাকবে। আপনি বাংলাদেশ ফোরামের আয়োজনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিতে পারেন বা এই ফোরামে সক্রিয় অংশ নিতে পারেন। বাংলাদেশের জন্য এই ফোরাম কী সামাজিক ব্যবসা পরিকল্পনা নিলো তার ঘোষণার মধ্য দিয়ে ফোরামের কাজ শেষ হবে।
সম্পদের কেন্দ্রীকরণ মন্থর করতে কিংবা বন্ধ করতে আপনি কী করতে পারেন তা নিয়ে ভাবতে আপনার ভালো লাগতে পারে। কিছু সহজ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে সম্পদের বৈষম্য কমিয়ে আনতে আপনি ভূমিকা রাখতে পারেন। আপনার নিজের ‘গিভিং প্লেজ’ তৈরির কথা ভাবুন অথবা আপনার বন্ধুদের বা আপনার ব্যবসায়িক পার্টনারদের নিয়ে একটি সম্মিলিত গিভিং প্লেজ তৈরির কথা ভাবুন। আপনি এখনই একটি ‘উইল’ তৈরির সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যেখানে আপনার সম্পদের অধিকাংশ বা কমপক্ষে অর্ধেক আপনি আপনার জীবদ্দশায়ই আপনার নিজের কোনো সামাজিক ব্যবসা বা ট্রাস্টকে দিয়ে যাবেন, যা সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আপনি আপনার সব কোম্পানিকে একটি ট্রাস্টের হাতে দিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন। এভাবে আপনার সম্পদ চিরস্থায়ী হবে, বশ ও টাটার মতো বেড়ে উঠবে এবং দেশ ও বিশ্বকে মৌলিকভাবে পরিবর্তিত করতে ভূমিকা রাখবে।
আমি সবাইকে সবসময় মনে করিয়ে দিই যে অর্থোপার্জন একটি সুখকর বিষয়, কিন্তু অন্যদের সুখী করাটা পরম সুখকর। এই পরম সুখকে হারাবেন না। দেরি না করে এখনই শুরু করা ভালো, যেন পরিবর্তনগুলো আপনি দেখে যেতে এবং তা থেকে সৃষ্ট পরম সুখটা উপভোগ করতে পারেন। আপনি যা শুরু করলেন তার ফলাফল আপনার জীবদ্দশায়ই দেখে যেতে পারেন।
আপনার সৃষ্ট ট্রাস্ট বা সামাজিক ব্যবসা তহবিল কর্তৃক অর্থায়নকৃত সামাজিক ব্যবসাটি পরিচালনা করার জন্য আপনার সন্তানদের আহ্বান জানান। আপনি দেখে অবাক হবেন তারা কাজটি কত উপভোগ করছে। শুধু দ্বিতীয় প্রজন্মের সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পরিবর্তে তারা বিশ্বব্যাপী সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি ও সফলভাবে ছড়িয়ে দিয়ে গ্লোবাল সেলিব্রিটিতে পরিণত হতে পারে। তারা নিশ্চয়ই নতুন বিশ্ব প্রজন্মের নেতৃত্ব দিতে পছন্দ করবে।
যে কেউ তার সম্পদ কোনো সামাজিক ব্যবসা ট্রাস্ট বা তহবিলে দিয়ে যেতে উইল করতে পারেন। তার সন্তানেরা এই ট্রাস্ট বা ফান্ডগুলোর সাথে জড়িত থাকতে পারে, যাতে তারা না ভাবে যে তাদের পিতা বা মাতার সম্পদের নিয়ন্ত্রণ থেকে তাদের দূরে রাখা হয়েছে। আপনি ও আপনার পরিবার পৃথিবীকে কিভাবে প্রভাবিত করতে পারেন তা দেখে আপনারা অবাক হবেন।
আপনি যদি এই উদ্যোগগুলোর কোনো একটি গ্রহণ করতে চান, আপনাকে এ-কাজে সাহায্য করতে ইউনূস সেন্টারে আমরা আনন্দের সাথে এগিয়ে আসব। আপনি নির্দ্বিধায় আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
এ ছাড়াও সামাজিক ব্যবসা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে আপনি আপনার বন্ধু বা আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক পার্টনারদের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার করতে পারেন এবং দেখতে পারেন আপনাদের কেমন লাগছে। আপনারা চাইলে খুব ছোট আকারে শুরু করতে পারেন, আকারটা কোনো বিষয় নয়; উদ্দেশ্যটাই আসল। ২০১৩ সালের মধ্যে দারিদ্র্য অর্ধেকে কমিয়ে এনে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর বাহবা অর্জন করেছে। সম্পদ বৈষম্যের প্রক্রিয়া উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও আমরা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিতে পারি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ প্রতি বছর আগে যে গতিতে বেড়েছিল তার চেয়ে গতি কমিয়ে আনতে পারি। তারপর আমরা প্যারিস সম্মেলনের মতো একটি বিশ্ব সম্মেলনের (হতে পারে ঢাকা সম্মেলন) আয়োজন করতে পারি যেখানে আমরা পৃথিবীর সব দেশকে ডেকে বলব কিভাবে আমরা এটা সম্ভব করেছি, এই প্রক্রিয়ায় কার কী ভূমিকা ছিল। সম্মেলন শেষ হবে জাতিসঙ্ঘকে এই আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে যে, তারা পৃথিবীর সব দেশকে নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করবে যেখানে প্রতিটি দেশ সম্পদ কেন্দ্রীভূত করার গতিকে প্রথম পর্যায়ে শূন্যে নামিয়ে আনার এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে এই প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রীভূত সম্পদ হ্রাসের গতিতে রূপান্তরিত করার জন্য যার যার ডেডলাইন ঘোষণা করবে।
উপসংহার
সম্পদ কেন্দ্রীকরণ একটি বৈশ্বিক হুমকি। পৃথিবীর ১% লোকের হাতে পৃথিবীর ৯৯% সম্পদ পুঞ্জিভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে সমস্যাটি এ বছর একটি বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছেছে। সমস্যাটি শুধু বৈশ্বিকভাবেই দিন দিন খারাপ হচ্ছে না, সমস্যাটি বিভিন্ন জাতির মধ্যে এবং প্রতিটি জাতির নিজের মধ্যে প্রতিনিয়ত গভীরতর হচ্ছে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে সম্পদবৈষম্য শান্তির প্রতি সবসময়েই একটি হুমকি। ঐতিহাসিকভাবে কোনো কোনো জাতি অন্যদের চেয়ে বেশি সম্পদ সঞ্চিত করেছে। সম্পদ সঞ্চয়নে কোনো কোনো জাতি অন্য জাতির ওপর অন্যায় সুবিধা নিয়েছে। পুরনো ক্ষোভের পাশাপাশি নতুন ক্ষোভও সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো বিরোধ, সংঘর্ষ ও যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জাতিগুলো বিপন্ন বোধ করলে তারা তাদের সামরিক ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা বৃদ্ধি পেতে পেতে ইতোমধ্যে ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সামরিক খাতে বিশ্বে বার্ষিক ব্যয় এখন ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যার ৩৯% মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই ব্যয় করে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে এবং জাতিগুলোর নিজেদের মধ্যে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ যত তীব্র হবে, সশস্ত্র বিরোধে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা ততই আসন্ন হয়ে উঠবে।
সম্পদকেন্দ্রীকরণ থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করার এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। বৈশ্বিক ঊষ্ণায়ন বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক ঐকমত্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া থেকে আমরা যে শিক্ষা নিয়েছি, সম্পদকেন্দ্রীকরণ বন্ধে ও হ্রাসেও আমরা একইভাবে একটি আন্তর্জাতিক ঐকমত্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে পারি। বৈশ্বিক ঊষ্ণায়ন ও সম্পদকেন্দ্রীকরণ উভয়েরই মূল একই যায়গায়- মানুষের লোভের ওপর গড়ে ওঠা ত্রুটিপূর্ণ অর্থনৈতিক কাঠামো।
পারস্পরিক দায়িত্ববোধ সম্পন্ন ও সুখ-দুঃখের অংশীদার সামাজিক জীব হিসেবে নিজেদের পুনঃআবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা সম্পদের কেন্দ্রীকরণকে ঘুরিয়ে দিতে পারি। আমরা তিনটি শূন্যের একটি পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এগোতে পারি- শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ; একটি রুহিতন আকৃতির সম্পদ বণ্টনের বিশ্ব; একটি সমতা, সম্প্রীতি, শান্তি ও সুখের বিশ্ব। আমরা নাগরিকেরা তৎপর হলেই এটা সম্ভব হবে।
আসুন, আমরা সবাই মিলে এটা সম্ভব করে তুলি।
ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৬ তারিখে অনুষ্ঠিত দি ডেইলি স্টার পত্রিকার ২৫তম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ইংরেজি বক্তৃতার অনুবাদ।
অনুবাদ : কাজী নজরুল হক।
প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন ২০১৫-এর ফলাফল আমাকে রোমাঞ্চিত ও আশান্বিত করেছে। ৪০ বছর ধরে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে চলা যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসীদেরই জয় হয়েছে। তারা সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, পৃথিবী একটি সত্যিকারের বিপদের মধ্যে রয়েছে এবং আমাদের সবাইকেই একযোগে কাজ করতে হবে। পৃথিবীকে আসন্ন পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে প্যারিস সম্মেলন ছোট-বড় সব জাতিকে একটি আইনগতভাবে বাধ্যবাধকতাপূর্ণ দলিলে স্বাক্ষর করাতে পেরেছে। রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ সবাইকে বহু বছরে সঞ্চিত দেয়াল-লিখনগুলো বোঝানোর পর্বতসম কাজটি করার জন্য আমি প্রতিনিয়ত এই সক্রিয় কর্মীদের ধন্যবাদ জানাই। রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বোধোদয় সৃষ্টির কাজটিকে তাদের অনেকেই আজীবন-সঙ্কল্প হিসেবে নিয়েছিল। জনগণের মধ্যে যারা নিশ্চুপ ছিল, তারাও ক্রমান্বয়ে সক্রিয় কর্মীতে পরিণত হলো। তারা পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় এমন রাজনৈতিক নেতাদের ভোট দিলেন। পরিবেশ সচেতন রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে জয়ী হতে শুরু করল।
প্যারিস সম্মেলনকে আমি অঙ্গীকারবদ্ধ সক্রিয় কর্মীদের নেতৃত্বে জনগণের বিজয় হিসেবে দেখছি। এই কর্র্মীরা কখনোই তাদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি। এমনকি প্যারিস সম্মেলন চলাকালে পৃথিবীর ১৭৫টি দেশে ২,৩০০টি স্থানে ৭,৮৫,০০০ মানুষ একত্র হয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে তাদের ভালোবাসার পৃথিবীকে রক্ষা করে একটি শতভাগ নিরাপদ ভবিষ্যতের দাবি তুলেছে। সাধারণত আমরা সরকারগুলোকেই তাদের সাহসী পরিকল্পনার পক্ষে জনগণকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে দেখি। তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে আমরা এর বিপরীতটাই দেখতে পেলাম। এখানে পৃথিবীজুড়ে নাগরিকরাই তাদের সরকারগুলোকে চালিত করেছে।
প্যারিস সম্মেলন আমাকে এই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত করেছে যে, এ ধরনের গণ-আন্দোলন দিগন্তে জমতে থাকা আরেকটি আসন্ন দুর্যোগ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারবে। রাজনীতিতে যুগ যুগ ধরে এটি একটি উত্তপ্ত বিষয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই সমস্যাটি মোকাবেলা করতে অনেক শক্তিশালী আন্দোলন, অনেক উচ্চাকাক্সক্ষী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অনেক রক্তও এজন্য ঝরেছে। কিন্তু এর সুরাহাতো হয়ইনি, বরং সমস্যাটি প্রতিনিয়ত আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। সমস্যাটি হচ্ছে মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পদ বৈষম্যের ক্রমাগত বিস্ফোরণ। এই বৈষম্য স্থানীয়, জাতীয় ও বৈশ্বিকভাবে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার যত বাড়ছে, সম্পদের বৈষম্যও ততই বেড়ে চলেছে। এই দুর্যোগটি ভয়ঙ্কর, কেননা এটি মানুষের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে। এটি পৃথিবীকে একের পর এক সামাজিক সংঘর্ষের দিকে ধাবিত করে। এটি জাতিগুলোর মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ সৃষ্টি করে।
সম্পদ কেন্দ্রীকরণসংক্রান্ত অক্সফামের তথ্য
অক্সফাম সম্পদ কেন্দ্রীকরণের উপর প্রতি বছর আমাদের ভীতিকর আপডেট দিয়ে আসছে। এ বছর তারা বলছে যে, পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৬২ জন ব্যক্তির সম্পদ পৃথিবীর নীচের অর্ধেক মানুষের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি। ২০১৫ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৮০ জন এবং ২০১৪ সালে সবচেয়ে ধনী ৮৫ জন ব্যক্তির সম্পদ তখনকার পৃথিবীর অর্ধেকাংশ মানুষের মোট সম্পদের চেয়ে বেশি ছিল বলে অক্সফাম আমাদের জানিয়েছিল। ছয় বছর আগে, ২০১০ সালে, পৃথিবীতে একই ধরনের ভাগ্যবানের সংখ্যা ছিল ৩৮৮ জন। অক্সফাম আরো জানিয়েছিল যে, ২০০৯ ও ২০১৪ সালের মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৮০ জন ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
২০১৬ সালের জন্য অক্সফামের কিছু ভীতিকর তথ্য রয়েছে। তাদের হিসাব মতে, এ বছর পৃথিবীর ৯৯% সম্পদ সবচেয়ে ধনী ১% মানুষের দখলে থাকবে। অর্থাৎ পৃথিবীর ৯৯% মানুষের কাছে থাকবে পৃথিবীর মোট সম্পদের মাত্র ১%।
অক্সফামের এসব তথ্য এতই চমকে ওঠার মত যে প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এসব তথ্য আমাদের মনে আরো অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। পৃথিবীর ক’জন শীর্ষ ধনীর কাছে, ধরুন ২০২৫ সালে, এই গ্রহের অর্ধেক মানুষের মোট সম্পদের চাইতে বেশি সম্পদ থাকবে? কখন পৃথিবীর একজন মানুষের কাছে নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি সম্পদ থাকবে। আমাদের হয়তো বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। মাত্র ছয় বছরে এই সংখ্যাটি যদি ৩৮৮ থেকে ৬২ জনে নেমে আসতে পারে, মাত্র একজন ভাগ্যবান ব্যক্তির কাছে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের সম্পদের চেয়েও বেশি সম্পদের মালিকানা চলে আসতে খুব একটা দেরি হবে বলে মনে হয় না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স তার নির্বাচনী বক্তব্যে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোট জাতীয় সম্পদের ৯০% সে দেশের সবচেয়ে ধনী ০.১% লোকের দখলে রয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থা কী রকম? এ দেশের ৬২ জনের হাতে, নাকি তার বেশি বা কম সংখ্যক মানুষের হাতে নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের মোট সম্পদের চাইতেও বেশি সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। এটা নিয়ে কি কারো কোন দুর্ভাবনা আছে। কোন দেশের নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের সম্পদের চেয়ে বেশি সম্পদ যদি একজন লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন কী হবে? নিঃসন্দেহে তিনি হয়ে যাবেন ‘রাজা’। তাঁর ইচ্ছাই হবে দেশের আইন। এমনটা ভাবাটি কি খুব বেশি হয়ে যাবে?
সম্পদের কেন্দ্রীকরণ একই সাথে ক্ষমতারও কেন্দ্রীকরণ- রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা, সুবিধা ও সুযোগের কেন্দ্রীকরণ। এর বিপরীতটাও সত্য। আপনার যদি সম্পদ না থাকে তাহলে আপনার ক্ষমতা, সুযোগ, সুবিধা কিছুই নেই। পৃথিবীর নিচের দিকের অর্ধেক মানুষ যারা পৃথিবীর মোট সম্পদের ১ শতাংশেরও ক্ষুদ্রাংশের মালিক তারা এই শ্রেণীভুক্ত। আগামীকাল পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।
আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদের কেন্দ্রীকরণ একটি বিরামহীনভাবে চলতে থাকা প্রক্রিয়া। আমি এই বিষয়টির প্রতিই আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ধনী মানুষ মানেই কিন্তু অবশ্যম্ভাবীভাবে খারাপ মানুষ যারা অসৎ উদ্দেশ্যে সম্পদকে ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত করে যাচ্ছেন এবং মানুষে-মানুষে বৈষম্য বৃদ্ধি করছেন - এটা ধরে নেয়া ঠিক হবে না। তারা ভালো হোন মন্দ হোন আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই তাদের পক্ষে কেন্দ্রীকরণের কাজটি করে যাচ্ছে। সম্পদ হচ্ছে চুম্বকের মতো। চুম্বক যত বড় তার আকর্ষণী ক্ষমতা তত বেশী। সে ছোট চুম্বকগুলোকে তার নিজের দিকে টেনে আনে। আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিও এভাবেই গড়ে উঠেছে। যাদের হাতে চুম্বক নেই তাদের পক্ষে কোন কিছু নিজের দিকে টেনে আনা খুব কঠিন। তারা কোনভাবে ছোট একটি চুম্বকের মালিক হয়ে গেলে তা ধরে রাখাও তাদের জন্য শক্ত; বড় চুম্বকগুলো সেগুলো তাদের হাত থেকে কেড়ে নেয়। একমুখী সম্পদ কেন্দ্রীকরণের শক্তিগুলো সম্পদ-পিরামিডের আকৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করে দিচ্ছে: এর ভিত্তিটা ক্রমাগত সরু হয়ে আসছে, আর এর চূড়াটা হচ্ছে আরো সরু, আরো উঁচু - যা শেষ পর্যন্ত একটি সরু কিন্তু বড় ভিত থেকে গজিয়ে ওঠা একটি শীর্ণ হয়ে আসা স্তম্ভের মতো দেখায়।
এই ভয়াবহ বাস্তবতাগুলো আমাদের প্রতিদিনকার ব্যস্ত জীবন-যাপনের মধ্যেই প্রতি মুহূর্তেই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, এই গ্রহের তাপমাত্রা নীরবে, অনেকটা আমাদের অজান্তেই কয়েক মাস আগে শিল্প বিপ্লবের সময়কালের চেয়ে ১ ডিগি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এই বড় পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য না করলে আমাদের এই গ্রহটি ক্রমাগত উত্তপ্ত হতে থাকবে এবং এক সময়ে আমরা এমন এক যায়গায় পৌঁছে যাবো যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব হবেনা। আমাদের নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী ও সক্রিয় কর্মীদের বহু বছরের রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রমই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সরকারগুলোকে চালিত করার মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক সমঝোতা সম্ভব করে তুলেছে।
সম্পদের কেন্দ্রীকরণ পরিবেশ বিপর্যয়ের মতোই ভয়ঙ্কর। এই ভীতির একটি হচ্ছে, পৃথিবী ভৌতিকভাবে টিকে থাকবে কি না। অপরটি ভীতিটি মানবতার বিরুদ্ধে, অর্থাৎ আত্মমর্যাদা ও প্রশান্তির সাথে এবং উচ্চতর আদর্শের অনুসন্ধানে বেঁচে থাকার অধিকার মানুষের থাকবে কি না।
যদি সমাজের সকল অংশের নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী ও পরিবেশ কর্মীদের নেতৃত্বে নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন করতে পারে, তাহলে একই রোড ম্যাপ অনুসরণ করে আমরা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলা সম্পদ-কেন্দ্রীকরণের আসন্ন ঝুঁকি থেকে পৃথিবীকে রক্ষার উদ্দেশ্যে মানুষকে সমবেত ও উজ্জীবিত করতে পারবো বলে আমি বিশ্বাস করি। নাগরিকদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় সম্পদ-সামঞ্জস্যের ছোট ছোট দ্বীপ গড়ে তুলতে হবে। পৃথিবীকে, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে, উৎসাহিত করতে হবে যে এটা করা সম্ভব এবং এটা করতেই হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে আমরা অসম্ভবকে দ্রুত এবং আরো দ্রুত সম্ভব করতে পারি। এটিও এমনই একটি অসম্ভব, হাজারো বাধা সত্ত্বেও যাকে আমাদের খুব দ্রুত সম্ভব করে তুলতে হবে।
এটা কিভাবে সম্ভব আমি এখন সে বিষয়ে বলতে চাই।
মানুষই সব কিছুর কেন্দ্রে
সম্পদ বিস্ফোরণ কি বন্ধ করা সম্ভব?
আমার দৃঢ় উত্তর হচ্ছে: হ্যাঁ, সম্ভব। মানুষ চাইলে যে কানো কিছু করতে পারে, তবে এর পেছনে দৃঢ় ইচ্ছা থাকতে হবে। সরকার ও চ্যারিটিগুলো সনাতন উপায়ে যা করে আসছে তার দ্বারা এটা সম্ভব না। প্রত্যেককে এটা তার ব্যক্তিগত অগ্রাধিকার হিসেবে নিতে হবে। মানুষকে নিজেদেরই এজন্য নেতৃত্বের ভূমিকায় এগিয়ে আসতে হবে এবং এটা সম্ভব করার জন্য উপযুক্ত নীতি-কাঠামো তৈরীতে এগিয়ে আসতে সরকারের উপর শক্তিশালী চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
প্রায় ২৫০ বছর আগে আধুনিক পুঁজিবাদের উদ্ভবের পর মুক্ত বাজারের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বাস করা হয়েছে যে, বাজারের অদৃশ্য হাত অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে এবং বাজারে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে। আরো বিশ্বাস করা হয়েছে যে, ব্যক্তিরা যার যার নিজের স্বার্থ অনুসন্ধান করলেই - সমাজের মঙ্গলের চিন্তা না করে - তা নিজে থেকেই সমাজের মঙ্গল সাধন করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: এই অদৃশ্য হাত কি সমাজের সকলের জন্য সমান মঙ্গল নিশ্চিত করে?
এতে কোনো সন্দেহ নেই, এই অদৃশ্য হাত একান্তভাবে অতি ধনীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। আর এর ফলেই সম্পদের এই প্রবল কেন্দ্রীকরণ কখনোই থামছে না।
কিভাবে সম্পদ কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়া যায়
সম্পদ-পিরামিডকে রুহিতন-আকৃতির (Diamond-Shaped) সম্পদ বণ্টনে রূপান্তরের সম্ভাবনায় আমার বিশ্বাস আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে প্যারিসে জনগণের বিজয় দেখে। আমি এখন নিশ্চিত যে আমরা চাইলেই সম্পদের বিস্ফোরণকে রুদ্ধ করতে পারি। প্রথমত এটা কোনো অপরিবর্তনীয় নিয়তি নয় যা নিয়ে মানুষ জন্ম গ্রহণ করেছে। যেহেতু এটা আমাদেরই সৃষ্টি, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মতো এ সমস্যার সমাধানও আমরাই করতে পারবো। আমাদের মনের রুদ্ধতাই আমাদেরকে সমস্যাটি দেখতে দিচ্ছে না এবং আমাদেরকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে আমাদের অবরুদ্ধ মনকে মুক্ত করতে। প্রচলিত চিন্তাধারা, যেগুলো আমাদের এই সমস্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে সেগুলোকে আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে।
এ সমস্যা মোকাবেলায় রাজনৈতিক প্রচারণায় সচরাচর যা গুরুত্ব পায় তা হলো আয়-বৈষম্য, সম্পদ-বৈষম্য নয়। আয়-বৈষম্যকে যে কর্মসূচির দ্বারা মোকাবেলা করা হয় তা হলো আয় পুনর্বণ্টন। ধনীদের নিকট থেকে নাও (প্রগতিশীল করের মাধ্যমে) আর গরিবদের দাও (বিভিন্ন ট্রান্সফার পেমেন্টের মাধ্যমে)।
নিঃসন্দেহে আয় পুনর্বণ্টনের কর্মসূচিগুলো শুধু সরকারই গ্রহণ করতে পারে। কোনো কোনো সরকার এ কাজটি কঠোরভাবে করে থাকে, কেউ কেউ আবার এ ব্যাপারে অতটা কঠোর নয়।
দুঃখজনকভাবে, একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে আয়-পুনর্বণ্টনের কাজে সরকার তেমন একটা সাফল্য দেখাতে পারে না। যাদের নিকট থেকে সরকারের বড় অঙ্কের কর আদায় করার কথা, সেই ধনীরা রাজনৈতিকভাবে খুবই ক্ষমতাশালী। সরকার যাতে তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো কিছু করতে না পারে সেজন্য সরকারকে প্রভাবিত করার মতো বিপুল ক্ষমতা তাদের রয়েছে।
আমি মনে করিনা যে আয়-বৈষম্যের দিকে মনোযোগ দেয়াতে সমস্যার প্রকৃত সমাধান রয়েছে। আমাদের সমস্যার মূলে যেতে হবে, এর বাহ্যিক ফলাফলে নয়। আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে সম্পদের বৈষম্যের দিকে, যেখান থেকে আয়ের বৈষম্য সৃষ্টি হয়। সম্পদের ভিত অপরিবর্তিত থাকলে আয়-বৈষম্য কমিয়ে আনার কোনো প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হবে না। সর্বোপরি, সরকারের নগদ হস্তান্তর কর্মসূচিগুলো প্রায়ই খয়রাতি কর্মসূচি। এ ধরনের কর্মসূচি সাময়িক উপশমের জন্য চমৎকার হলেও এগুলো সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারে না। এগুলো বরং সমস্যাকে আড়াল করে রাখে। আইনের শাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর পক্ষে সম্পদ পুনর্বণ্টনের কাজে হাত দেয়া অত্যন্ত কঠিন। কোনো কোনো গণতান্ত্রিক সরকার দ্বারা ভূমি পুনর্বণ্টন কর্মসূচিই সম্পদ পুনর্বণ্টনে এ পর্যন্ত একমাত্র সফল কর্মসূচি বলে মনে হয়।
আমি এখন আপনাদের বলতে চাই, একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অর্থনৈতিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাস কেন একান্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
আমি যখন পেছনে ফিরে তাকাই, আমি দেখতে পাই পরিস্থিতি কিভাবে আমাকে এমন সব কাজে ঠেলে দিলো যেগুলো সম্পর্কে আগে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ জোবরা গ্রামে সেচনির্ভর একটি তৃতীয় শস্য চাষে আমাকে এগিয়ে দিলো। এ কাজ করতে গিয়ে আমি গ্রামের মহাজনী ব্যবসার সাথে পরিচিত হলাম। মহাজনী প্রথার ভুক্তভোগীদের আমি সাহায্য করতে চাইলাম। ১৯৭৬ সালে আমি মহাজনদের কবল থেকে তাদের রক্ষা করতে নিজের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে টাকা দিলাম। ক্রমান্বয়ে আরো বেশি লোককে ঋণ দিতে গিয়ে আমার নিজের পকেটের টাকা শেষ হওয়ার উপক্রম হলো। তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত জনতা ব্যাংকে গেলাম আর তাদের অনুরোধ করলাম গরিব মানুষদের ঋণ দিতে। তারা অস্বীকার করল। শেষ পর্যন্ত আমি নিজে জামিনদার হয়ে তাদের ঋণ দিতে রাজি করালাম। আমি প্রকল্পটির নাম দিলাম : ‘গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প’। এরপর কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত আগ্রহে কৃষি ব্যাংক সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। তারা আমাকে কার্যত প্রধান নির্বাহী বানিয়ে জোবরায় কৃষি ব্যাংকের একটি বিশেষ শাখা খুলল, যা ওই শাখার জন্য আমার নিযুক্ত লোক দিয়ে, যাদের সবাই ছিল আমার ছাত্র, পরিচালিত হতে থাকল। আমি এর নাম দিলাম ‘পরীক্ষামূলক গ্রামীণ শাখা’। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কিছু সদস্যের প্রবল আগ্রহে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকল্পটির কাজ টাঙ্গাইলে সম্প্রসারিত করতে চাইল। ১৯৮৩ সালে আমরা একটি আনুষ্ঠানিক ব্যাংকে পরিণত হলাম।
তারা যা করে আমরা করি তার উল্টোটা
আমরা যা তৈরি করলাম তা কেবল আরেকটি ব্যাংক ছিল না; এটি পরিণত হলো প্রচলিত ব্যাংকের একটি অ্যান্টি-থিসিসে। প্রচলিত ব্যাংক যা করে, গ্রামীণ ব্যাংকে আমরা ঠিক তার বিপরীতটা করতে শুরু করলাম। প্রচলিত ব্যাংকগুলো বড় বড় ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিদের যেখানে কর্মস্থল সেখানে কাজ করতে পছন্দ করে। ফলে তারা শহরে কাজ করে। গ্রামীণ ব্যাংক কাজ করে গ্রামে। এমনকি প্রতিষ্ঠার চল্লিশ বছর পরও গ্রামীণ ব্যাংক আজো কোনো শহর বা পৌর এলাকায় তার কোনো শাখা করেনি। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর মালিক ধনী মানুষরা। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক গরিব মহিলারা, এর পরিচালনা পরিষদেও এই গরিব মহিলারা বসেন। প্রচলিত ব্যাংক মূলত পুরুষদের সেবা দেয়, গ্রামীণ ব্যাংক কাজ করে মূলত মহিলাদের নিয়ে। প্রচলিত ব্যাংকগুলো মনে করে যে গরিব মানুষ ঋণ পাওয়ার যোগ্য নয়। ইতিহাসে গ্রামীণ ব্যাংকই সর্বপ্রথম এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেছে যে গরিব মানুষ, বিশেষ করে গরিব মহিলারা যেকোনো ব্যাংকিং বিবেচনায় ঋণ পাওয়ার যোগ্য। ‘গ্রামীণ আমেরিকা’ দেখিয়েছে যে, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও দরিদ্র মহিলারা ব্যাংকঋণ দিয়ে তাদের জীবনে চমৎকার পরিবর্তন আনতে পারে। আমেরিকার ৯টি শহরে গ্রামীণ আমেরিকার ১৮টি শাখা রয়েছে যাদের মাধ্যমে ৬০,০০০ মহিলাকে ঋণসেবা দেয়া হচ্ছে। এঁদের সবাই মহিলা। ‘গ্রামীণ আমেরিকা’ এ পর্যন্ত ৩৮০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। ঋণগ্রহীতাদের প্রথম ঋণের পরিমাণ গড়ে ১,০০০ ডলার। ঋণ পরিশোধের হার ৯৯.৯%।
প্রচলিত ব্যাংক কাজ করে জামানতের ওপর ভিত্তি করে। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ সম্পূর্ণ জামানতবিহীন। ফলে এই ঋণ আইনজীবীবিহীনও। আমরা যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি তা সম্পূর্ণ বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। গ্রামীণের ঋণগ্রহীতাদের ব্যাংকের আছে আসতে হয় না, ব্যাংকই তাদের দোরগোড়ায় যায়। ঋণগ্রহীতারা যাতে বৃদ্ধ বয়সে নিজেদের দেখাশোনা করতে পারেন সেজন্য গ্রামীণ ব্যাংক তাদের জন্য পেনশন ফান্ডের ব্যবস্থা করেছে। গ্রামীণ ব্যাংক তাদের জন্য স্বাস্থ্যবীমার ব্যবস্থা করেছে, ভিক্ষুকদের ঋণ দিচ্ছে, ঋণী পরিবারের সন্তানদের শিক্ষাঋণ প্রদান করছে। এই ব্যাংক তাদের স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও নলকূপের জন্যও ঋণেরব্যবস্থা করেছে। কোনো ঋণী মারা গেলে গ্রামীণ ব্যাংক তার দাফনের খরচ আংশিকভাবে বহন করে এবং মৃত ঋণীর সব ঋণ মওকুফ করা হয়। এই ব্যাংকে ঋণের সুদের পরিমাণ কখনোই মূল ঋণের চেয়ে বেশি হয় না, ঋণ পরিশোধ করতে যত সময়ই লাগুক না কেন।
নভেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক ১.২১ লাখ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এবং এ সময়ে ব্যাংকের মোট আদায়যোগ্য ঋণের পরিমাণ ৯,৪০০ কোটি টাকা। একই সময়ে ঋণীদের সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০,৮২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে ঋণীদের মোট আদায়যোগ্য ঋণের চেয়ে ব্যাংকে গচ্ছিত তাদের আমানতের পরিমাণ বেশি। কেউ বলতেই পারে, প্রকৃতপক্ষে তারা ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা নন, বরং তারাই ব্যাংককে ঋণ দিচ্ছেন!
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্র তহবিল, জাতিসঙ্ঘ এবং অনেক দ্বিপাক্ষিক তহবিল দাতারা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নকে উৎসাহিত করছে। প্রথাগত ব্যাংকগুলোকে দরিদ্রদের কাছে সীমিত আকারে আর্থিক সেবা পৌঁছাতে এটা উৎসাহিত করে। কেউ যদি সত্যিকারভাবে ব্যাংকিংয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিকে আনতে চান, নিশ্চিতভাবেই সেটা প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেমে অর্জন করা সম্ভব নয়। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেসব নীতি ও কর্মপদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে কাজ করে তা হলো আর্থিক বহির্ভুক্তি। তাদের ডিএনএ তাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পক্ষে কাজ করতে দেবে না।
আমরা যদি সত্যিই দরিদ্রদের কাছে পৌঁছাতে চাই, তবে আমাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন নকশায় ভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। ধনীদের ব্যাংক গরিবদের সেবার নকশায় তৈরি নয়। তারা বড়জোর, ওপর থেকে আসা চাপে, এনজিওদের মাধ্যমে কিছু প্রতীকী কর্মসূচি নিতে পারে, কিন্তু সেটা তাদের ব্যবসায়ের ১ শতাংশের কোনো ভগ্নাংশও হবে না। ব্যাংকসেবা-বহির্ভূত মানুষদের জন্য প্রয়োজন সত্যিকারের ব্যাংকিং, কোনো লোকদেখানো ভালোমানুষি কর্মসূচি নয়।
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি ব্যাংকিং ব্যবস্থার মৌলিক নীতিগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। আমি যুক্তি দেখিয়ে আসছিলাম যে, আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা মানুষ সম্পর্কে যে তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে অনেক বড়। গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস তারই জীবন্ত প্রমাণ।
গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণের ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে কারণ এনজিওরা এটিকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে পৌঁছাচ্ছে না সেই বিশাল শূন্য জায়গাটা শুধু এনজিওদের দ্বারা পূর্ণ হওয়ার নয়। আমি যুক্তি দেখিয়ে আসছি যে, একটি সহজ পথ হতে পারে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী এনজিওদের ব্যাংকিং লাইসেন্স দেয়া, যাতে তারা ব্যাংক হিসেবে কাজ করতে ও আমানত নিতে পারে এবং এভাবে আত্মনির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে। আমি খুবই আনন্দিত যে, বহু বছর চিন্তাভাবনার পর ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ভারতের ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী এনজিওদের ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকে পরিণত হতে লাইসেন্স দিচ্ছে। এটি হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের পথে প্রথম সঠিক পদক্ষেপ, যদিও লক্ষ্য অর্জনে আমাদের আরো অনেক এগিয়ে যেতে হবে। ব্যাংকসেবা-বহির্ভূতদের বিভিন্ন অতি প্রয়োজনীয় আর্থিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে একটি শূন্যস্থান এখনো রয়ে গেছে, যেগেুলো হতে হবে বিশেষভাবে তাদেরই জন্য প্রণীত, নিয়মিত গ্রাহকদের জন্য প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার কোনো অতিক্ষুদ্র সংস্করণ কেবল নয়।
আমি বহু দিন ধরেই যুক্তি দেখিয়ে আসছি যে, ঋণকে একটি মানবিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে যাতে এর প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়া যায় এবং এটিকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দেয়া যায়। দরিদ্রদের জন্য একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমেই কেবল আমরা এই মানবিক অধিকারটি প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
গ্রামীণ ব্যাংকের সমালোচকরা বরাবরই বলে আসছিলেন যে, ‘গরিবদের ঋণ দেয়াটা আসলে অর্থের অপচয়, কেননা তারা জানে না এ টাকা কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। এতে কেবল তাদের ঋণের বোঝাই বাড়ে।’ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। ঋণের বোঝার পরিবর্তে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে তারা বিপুল সঞ্চয়ের মালিক হয়েছে, যা এখন তাদের মোট আদায়যোগ্য ঋণের চেয়ে বেশি। গ্রামীণ ব্যাংক তাদেরকে চমৎকার সঞ্চয়কারীতে পরিণত হতে, মূলধন তহবিলের গর্বিত মালিক হতে এবং আর্থিকভাবে শক্তিশালী ও দেশব্যাপী বিস্তৃত একটি ব্যাংকের মালিক হতে সহায়তা করেছে।
আমি যুক্তি দেখিয়ে আসছি যে, প্রতিটি মানুষই সীমাহীন সৃষ্টিশীল শক্তি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। সমাজ তাকে তার ক্ষমতা অবারিত করার সুযোগ করে দিলে সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে।
সমালোচকেরা উল্টো যুক্তি দেখালেন। তারা বললেন যে, ‘গরিবের হাতে টাকা দেয়া মানে সেটা অপচয় করা, বরং টাকাটা তারই হাতেই দেয়া উচিত যে অন্য লোককে চাকরি দিতে পারবে।’ আমি বিষয়টা সেভাবে দেখলাম না। আমি দরিদ্রতম মহিলাদের মধ্যে চাপা পড়া উদ্যোক্তার প্রতিভাটি বাইরে বের করে এনে তাদেরকে উদ্যোক্তায় পরিণত করতে চাইলাম। সমালোচকেরা এই বিশ্বাস নিয়ে রইলেন যে, উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়টি কেবল কিছু বিশেষ লোকের একটি ছোট্ট শ্রেণীর ব্যাপার, অন্যদের জন্ম হয়েছে তাদের অধীনে কাজ করতে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন যেভাবে চলছে আমরা যদি তাদের সেভাবেই চলতে দিই, তাহলে সেটা সম্পদকেন্দ্রীকরণে ঘি ঢালারই শামিল হবে। ব্যক্তিগত সম্পদের কেন্দ্রীকরণ কমাতে হলে আমাদের দুটো কাজ করতে হবে। বিদ্যমান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে তারা আর সম্পদকেন্দ্রীকরণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে না পারে।
দ্বিতীয়ত, দরিদ্রদের সকল ধরনের আর্থিক সেবা দেয়ার জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। দরিদ্ররা যাতে তাদের নিজ শক্তিতেই ওপরে উঠে আসতে পারে সে জন্য আর্থিক সেবা সরবরাহ করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশেষ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামাজিক ব্যবসা হিসেবে তৈরি করতে হবে যেন তারা ধনীদের ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে তাদের পক্ষে সম্পদকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়াকে আরো শক্তিশালী করতে না পারে।
একজন ধনী কিভাবে আরো ধনী হন, তা জানতে হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে ভালোভাবে তাকালেই চলবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোই সম্পদকেন্দ্রীকরণের চালিকাশক্তি। আমরা যদি সম্পদ-পিরামিডকে দরিদ্রদের অনুকূলে রূপান্তরিত করতে চাই, তাহলে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। বিদ্যমান আর্থিক কাঠামো এই সম্পদ-পিরামিডকে কেবল তৈরিই করেনি, একে ক্রমাগতভাবে আরো ভয়াবহ করে চলেছে।
সামাজিক ব্যবসা
দরিদ্রদের সাথে কাজ করতে গিয়ে আমি তাদের আরো অনেক সমস্যার মুখোমুখি হলাম। সেসব সমস্যার কিছু কিছু সমাধানেরও চেষ্টা করলাম। আমি সব সময়ই এক একটি নতুন ব্যবসা সৃষ্টি করে এক একটি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছি। একসময়ে এটা আমার অভ্যাসে পরিণত হলো : যখনই আমি একটা সমস্যার মুখোমুখি হই, তা সমাধানের জন্য আমি একটা ব্যবসা সৃষ্টি করি। শিগগিরই আমি অনেকগুলো কোম্পানি তৈরি করে ফেললাম, সাথে কোম্পানির মতো কিছু স্বতন্ত্র প্রকল্পও। যেমন দরিদ্রদের জন্য গৃহায়ণ, দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, স্বাস্থ্যসেবা, নবায়নযোগ্য শক্তি, পুষ্টি, পানি, নার্সিং কলেজ, চক্ষু হাসপাতাল, অটোমেকানিক ট্রেনিং স্কুল এবং আরো অনেক।
ক্রমান্বয়ে এগুলো কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিতে শুরু করল। এগুলো তৈরি হলো টেকসই ব্যবসা হিসেবে, কিন্তু এগুলো থেকে কেউ কোনো ব্যক্তিগত মুনাফা নিতে পারবে না। বিনিয়োগকারী তার বিনিয়োজিত টাকা ফেরত নিতে পারবেন, তবে এর বেশি নয়। কোম্পানির মুনাফা কোম্পানিতেই পুনর্বিনিয়োগ করা হবে তার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য। এই নতুন ধরনের ব্যবসাকে আমি নাম দিলাম ‘সামাজিক ব্যবসা’ : মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যক্তিগত লভ্যাংশবিহীন ব্যবসা।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ব্যবসা থেকে ব্যক্তিগত লাভের প্রত্যাশা না করে কেবল সমাজের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কোনো ব্যবসা সৃষ্টি করলে তা দিয়ে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কাজটা কত সহজ। আমাদের সব সময় বলা হয়েছে যে, ব্যবসা নামের এই যন্ত্রটির একটিই ব্যবহার আছে, আর তা হচ্ছে টাকা বানানো। আমি এই যন্ত্রটিকেই সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলাম, অর্থাৎ মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কাজে। আর এ কাজে ব্যবসাকে আমি অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকায় দেখতে পেলাম। হঠাৎ করে সমস্ত সৃষ্টিশীল শক্তিকে একটি লক্ষ্যে- মানুষের সমস্যা সমাধানে- এই যন্ত্রটির পেছনে সম্মিলিত করা সম্ভব হয়ে উঠল।
আমি ভাবলাম, পৃথিবীতে সমস্যা সমাধানের কাজটি কেন শুধু সরকার বা চ্যারিটির উপর ছেড়ে দেয়া হলো? আমি এর জবাব খুঁজে পেলাম। কারণ অর্থনৈতিক তত্ত্বে ব্যবসার দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য টাকা বানানো। মানুষের সমস্যা সমাধানের কাজটি ছেড়ে দেয়া হয়েছে সরকার ও চ্যারিটির ওপর। একজন ব্যবসায়ী কেবল আত্মস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হবে, এমনটাই সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তার কাছে ব্যবসা মানে ব্যবসাই। কিন্তু প্রকৃত মানুষতো টাকা বানানোর রোবট নয়। মানুষ একটি বহুমাত্রিক প্রাণী, যার মধ্যে স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা দু’টোই আছে। আমি যখন একটি সামাজিক ব্যবসা তৈরি করি, তখন আমি পরার্থপরতাকে ব্যবসায়ের মধ্য দিয়ে প্রকাশের সুযোগ করে দেই। পুরনো ব্যাখ্যা অনুসারে পরার্থপরতা ব্যবসায়িক জগতের অংশ হতে পারে না, এটি চ্যারিটির জগতের অংশ। আমার যুক্তি হচ্ছে, মানুষের ডিএনএতে পরার্থপরতা থেকে থাকলে সেটাকে ব্যবসার জগৎ থেকে দূরে রাখতে হবে কেন? ব্যবসার জগতে স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা দু’টোকেই পক্ষপাতহীনভাবে চলতে দেয়া উচিত। অর্থশাস্ত্রের টেক্সট বইগুলোর উচিত ছাত্রদের দুই ধরনের ব্যবসার সাথেই পরিচিত করানো : আত্মস্বার্থ চালিত ব্যবসা ও পরার্থপরতা চালিত ব্যবসা। কে কোনটা বেছে নেবে, তারা কি বিভিন্ন অনুপাতে দুই ধরনের ব্যবসারই কোনো সংমিশ্রণ তৈরি করবে, নাকি তারা প্রত্যেকটিই আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠা করবে, তা তরুণ ছাত্রদের ওপরই ছেড়ে দেয়া হোক।
আত্মস্বার্থ চালিত ব্যবসায়ে অনেকেই তাদের স্বার্থপরতাকে চূড়ান্ত রূপে প্রকাশ করেন, তারা সীমাহীনভাবে লোভী হয়ে ওঠেন। টাকার জন্য নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এই প্রক্রিয়ায় মানবজাতি তার মানবীয় পরিচিতি হারানোর প্রায় একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। মানুষ প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও বন্ধুত্ববোধ সম্পন্ন একটি সত্তা। আমরা যদি এমন একটি তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারি, যা আমাদের চরিত্রের গভীরে প্রোথিত মানবিক মূল্যবোধগুলোকে আমাদের অর্থনৈতিক জীবনে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ করে দেবে, তাহলে আমরা সম্পদ-পিরামিডকে সম্পদ-রুহিতনে (Wealth-Diamond) পরিণত করতে পারব। এই মূল্যবোধগুলো সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে পরিষ্ফুট হয়ে আমাদের সেখানে পৌঁছে দিতে পারে।
সামাজিক ব্যবসাকে দু’টি পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখা যেতে পারে। চ্যারিটির দৃষ্টিকোণ থেকে একে টেকসই দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা যায়। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে একে পরার্থপর ব্যবসা হিসেবে দেখা যেতে পারে। সামাজিক ব্যবসার একটি বড় জিনিস এই যে, এর পেছনে কাজ করে সদিচ্ছা, কোনো বাধ্যবাধকতা নয়। কেউ তার ইচ্ছা মতো সামাজিক ব্যবসা করতে বা তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এতে মানুষ স্বাধীন বোধ করে, কী করতে চায় তা ঠিক করতে পারে।
আমি আনন্দিত যে সামাজিক ব্যবসার ধারণাটি পৃথিবীর সব দেশে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সামাজিক ব্যবসাকেন্দ্র চালু করছে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সামাজিক ব্যবসা চালু করতে এগিয়ে আসছে, তরুণ প্রজন্ম এই ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আমরা মানুষরা নিজেরাই আমাদের সব সমস্যা সমাধান করতে সক্ষমÑ এই ধারণায় বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারুণ্য, প্রযুক্তি ও সামাজিক ব্যবসার সম্মিলিত শক্তি একে সম্ভব করে তুলবে।
প্রযুক্তি
প্রযুক্তি প্রচণ্ড গতিতে প্রসারিত হচ্ছে। আজ যা অসম্ভব, তা কালই সম্ভব হচ্ছে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পরিবর্তন প্রতিনিয়ত এত দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে ঘটছে যে তা আমাদের আর অবাক করে না। অবিশ্বাস্য তথ্যপ্রযুক্তির পুরো শক্তিটা ভোগ করছে তরুণ প্রজন্ম। তারা তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের চেয়ে অনেক দ্রুততার সাথে নতুন প্রযুক্তিকে আত্মস্থ করতে পারে। তাদের কল্পনার শক্তিই কেবল নতুন নতুন প্রযুক্তির সীমানা। তাদের কল্পনা যত সাহসী, তাদের অর্জনও তত বড়। তারা যদি এমন বিশ্ব কল্পনা করতে শুরু করে যেখানে কোনো সম্পদ বৈষম্য থাকবে না, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে সম্পদবৈষম্য বলে কিছু থাকবে না। তারুণ্য, প্রযুক্তি ও সামাজিক ব্যবসার মিলিত শক্তি হতে পারে অপ্রতিরোধ্য।
শিক্ষাকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে
সম্পদ কেন্দ্রীকরণের সমস্যা বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হলে শিক্ষাকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য পুনঃনির্ধারণ এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর অনেক উচ্চাকাক্সক্ষী লক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল কাজ হয়ে গেছে তরুণদের চাকরির জন্য তৈরি করা। ধরে নেয়া হয় যে, প্রতিটি তরুণকেই চাকরি খুঁজে নিতে সক্ষম হতে হবে। চাকরি খোঁজার সক্ষমতার কাছে শিক্ষার আর সব উদ্দেশ্যই গৌণ হয়ে গেছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নিজেকে আবিষ্কার করতে ও জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেতে একজন তরুণকে সাহায্য করা। এর মূল লক্ষ্য ছিল, ‘নিজেকে জানো’। এখন অধিকাংশ সময় তাকে ব্যস্ত থাকতে হয় ‘তোমার নিয়োগকর্তাকে জানো’ এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য।
মানুষের এমন একটি পরিণতিকে আমি অত্যন্ত অসম্মানজনক মনে করি। মানুষের জীবনটা নিয়োগকর্তার ইচ্ছার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টায় কাটিয়ে দেয়ার চেয়ে অনেক অনেক বড়। মানুষকে আমি দেখি এমন এক সত্তা হিসেবে, যে নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে চলে, নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করে, সমস্যার সমাধান করে।
আমরা চাকরিপ্রার্থী নই, আমরা চাকরিদাতা
মানুষ সীমাহীন সৃষ্টিশীল সক্ষমতায় পূর্ণ একটি জীব। তার জীবদ্দশায়ই তাকে তার সম্ভাবনাগুলোকে আবিষ্কার করতে হবে। শিক্ষার কাজ হচ্ছে মানুষ হিসেবে তাকে তার সম্ভাবনাগুলোর সাথে পরিচিত করানো, যাতে সে তার ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হতে পারে, ক্ষমতার ব্যবহার সম্পর্কে চিন্তা শুরু করতে পারে। শিক্ষার উচিত তাকে উদ্যোক্তা বা চাকরি সৃষ্টিকারী হতে প্রস্তুত করা, চাকরি খুঁজতে নয়। এ দু’টোর মধ্যে বিশাল পার্থক্য। তরুণদের চাকরি খুঁজতে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমরা বেকারত্ব তৈরি করছি। কারণ সবার জন্য চাকরির ব্যবস্থা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হয় না। আমরা যদি তরুণদের চাকরি সৃষ্টিকারী হিসেবে গড়ে তুলতাম, তাহলে বেকারত্ব বলে কিছু থাকত না।
সবাই কি উদ্যোক্তা হতে পারে- প্রশ্নটি প্রায়ই আমাকে করা হয়। আমার বিশ্বাস, প্রতিটি মানুষই জন্মগতভাবে একজন উদ্যোক্তা। আমরা এভাবেই পৃথিবীতে আমাদের জীবন শুরু করেছি। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ক্ষুদ্রঋণীর প্রত্যেকেই একেক জন উদ্যোক্তা। গ্রামের নিরক্ষর নারীরা যদি উদ্যোক্তা হতে পারে, শিক্ষিত তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কেন? তাদের শুধু যা প্রয়োজন তা হলো একটি সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থা ও আর্থিক কাঠামো।
সহায়ক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা সামাজিক ব্যবসা তহবিল তৈরি করেছি। তরুণদের আমরা বলছি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে। তারা এগিয়ে এলে আমরা তাদের ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করছি। আমরা তাদের ব্যবসায়িক অংশীদার হয়ে যাচ্ছি, এনজেল ইনভেস্টারের মতো; পার্থক্য একটাই : আমরা তাদের ব্যবসা থেকে কোনো মুনাফা নিচ্ছি না, কারণ আমরা সামাজিক ব্যবসা। তারা তাদের ব্যবসা একবার দাঁড় করিয়ে ফেললে আমাদের শেয়ারগুলোও তারা কিনে নেয়, কোনো মুনাফা না দিয়েই।
এই মুহূর্তে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী আমাদের সাথে অংশীদারিত্বে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা এই তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই বিশ্বাস জাগ্রত করেছি- ‘আমরা চাকরিপ্রার্থী নই, আমরা চাকরিদাতা,’ এবং তারা এটা বাস্তবায়িতও করছে।
আমি খুবই আনন্দিত যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার বক্তব্যে ভারতের যুবসমাজকে ক্রমাগতভাবে এই বলে উজ্জীবিত করছেন যে, ‘আমরা চাকরিপ্রার্থী নই, আমরা চাকরিদাতা।’ তিনি এই কর্মসূচির প্রকৃত বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ‘মুদ্রাব্যাংক’ নামে একটি পুনঃঅর্থায়ন ব্যাংকও প্রতিষ্ঠা করেছেন। আশা করছি একে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি একটি সহায়তা ব্যবস্থা (ইকো সিস্টেম) গড়ে তুলতেও সফল হবেন।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সৃষ্টিশীল উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিবর্তিত করার কাজটি একবার করতে পারলে সম্পদ বৈষম্যের বর্তমান চেহারাটি বদলাতে শুরু করবে। আমাদের প্রতিভাবান তরুণদের আমরা যদি অন্যদের ধনী বানানোর পরিণতির হাতে ছেড়ে দিই, সম্পদের কেন্দ্রীকরণ আকাশচুম্বী হয়ে উঠবে। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের তরুণদের সম্পদ কেন্দ্রীকরণের গতর খাটা সৈনিক হতে দিতে পারি না।
সম্পদের কেন্দ্রীকরণ রুখতে হলে আমাদের এক মুখী সম্পদ প্রবাহের স্থলে দ্বিমুখী সম্পদ প্রবাহ সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমান সম্পদপ্রবাহ সম্পদশালীদের দিকে প্রবাহিত হয়। আমাদের প্রয়োজন এমন ধরনের প্রবাহ, যা সম্পদশালীর নিকট থেকে সম্পদ নিয়ে আসবে সম্পদহীনের কাছে।
সামাজিক ব্যবসায়ের মধ্যে আমি এই নতুন শক্তিটি দেখতে পাই। এটা বর্তমান ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহের মতো শক্তিশালী হবে কিনা তা নির্ভর করবে মানুষ কত দৃঢ়ভাবে এর পেছনে দাঁড়াচ্ছে তার ওপর।
সামাজিক ব্যবসার অর্থ সংস্থান
সামাজিক ব্যবসার ধারণাটিকে আমি যত এগিয়ে নিতে যাচ্ছি, আমি আনন্দের সাথে লক্ষ করছি যে সব দেশ থেকে আমি ঊষ্ণ সাড়া পাচ্ছি। সামাজিক ব্যবসা এখন পৃথিবীর অনেক দেশে বিকশিত হচ্ছে। সামাজিক ব্যবসা নিয়ে আলোচনার সময়ে একটি প্রশ্ন প্রায়ই উঠে আসে : এই ব্যবসাকে বিশ্বজুড়ে প্রসারিত করতে গেলে প্রয়োজনীয় তহবিল কোত্থেকে আসবে?
দাতব্য প্রতিষ্ঠান
বিদ্যমান বিনিয়োগ তহবিলগুলো কেবল ব্যক্তিগত মুনাফাকারী ব্যবসার জন্য। আপনি যত বেশি ব্যক্তিগত মুনাফার প্রতিশ্রুতি দিতে বা নিশ্চিত করতে পারবেন, বিনিয়োগের জন্য তত বেশি তহবিল আপনি পাবেন। এই বিনিয়োগকারীদের সামাজিক ব্যবসায়ে আগ্রহী হওয়ার কোনো কারণ নেই। সে ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসা তার বিনিয়োগের তহবিল কোথায় পাবে? একে অবশ্য মানুষের পরার্থপরতার জায়গাটি থেকে আসতে হবে। পরার্থপরতার সর্বোচ্চ প্রকাশ হচ্ছে দানশীলতা। চ্যারিটির জগতে যা ঘটে তা থেকে পরার্থপরতার একটা পরিমাপ করা যায়। এখন দেখতে হবে দানের অর্থকে কিভাবে সামাজিক ব্যবসা তহবিলে রূপান্তরিত করা যায়। দানশীলতা আর সামাজিক ব্যবসার মূলতো একই জায়গায়, উভয়েরই লক্ষ্য মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
দানশীলতা স্মরণাতীত কাল থেকে সমাজে চলে আসছে। এটা মানব চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিগণিত। সব ধর্মই এর ওপর খুব জোর দিয়ে থাকে। দানশীলতা ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের একটি। প্রতিটি মুসলমানকে প্রতি বছর তার সম্পদ ও আয়ের ২.৫% দান করে দিতে হয়। কল্পনা করুন এর সম্ভাব্য পরিমাণ কত। আমরা যদি প্রতি বছর প্রকৃতপক্ষে প্রদত্ত অঙ্কগুলো যোগ করি, তার আকারও হবে বিশাল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনদাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো (যেসব প্রতিষ্ঠান সাধারণ জনগণ ও অন্যদের নিকট থেকে তহবিল সংগ্রহ করে চলে থাকে) প্রতি বছর ১.৬ ট্রিলিয়ন ডলার দান করে থাকে। তাদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি।
আমি উদাহরণ হিসেবে এই দু’টোর কথা উল্লেখ করলাম। পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য ধরনের দাতব্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের তহবিলের পরিমাণ বিশাল।
ব্যক্তিগত দান
এ ছাড়াও ব্যক্তিগত দানের অগণিত কাহিনী আমাদের সামনে রয়েছে। একটি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হচ্ছেন মার্ক জুকারবার্গ। তিনি তার মেয়ের জন্ম উপলক্ষে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি ফেসবুকের ৯৯% শেয়ার, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার, দান করে দেবেন। আগামী তিন বছর প্রতি বছর ১ বিলিয়ন ডলার করে দেবেন সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি তার দান শুরু করে দিয়েছেন। পরার্থপরতার ক্ষেত্রে এটি একটি আগ্রহোদ্দীপক ঘটনা। তার প্রথম সন্তানের জন্ম উপলক্ষে তিনি এই দানটি করেছেন। স্বাভাবিক মনে হতো যদি পিতা তার ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ নবজাতক সন্তানকে সময়ের আগেই তার নামে সম্পত্তি হস্তান্তর করে দিতেন। মার্ক উল্টোটি করেছেন। তিনি তার সন্তানকে সম্পদের উত্তরাধিকার হওয়া থেকে বঞ্চিত করে তার জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে তার সম্পদ দান করে দিয়েছেন। সাধারণত মানুষ তার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সম্পদ বিলিয়ে দেয়ার কাজটি করে। মার্ক একটি অসাধারণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; তিনি তার জীবনের শুরুতেই তার সম্পদের প্রায় সবটুকু দান করে দিয়েছেন। তার বয়স মাত্র ৩১ বছর। ফেসবুকের শুরু থেকে এর প্রধান নির্বাহী হিসেবে মার্ক মাত্র ১ ডলার করে বেতন নিয়ে আসছেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি ‘দ্য গিভিং প্লেজ’-এ স্বাক্ষর করেছেন। জুকারবার্গ, বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেট ২০১০ সালে একটি প্রতিশ্রুতিতে স্বাক্ষর করেন, তারা যার নাম দিয়েছেন ‘দ্য গিভিং প্লেজ’। এতে তারা তাদের সম্পদের কমপক্ষে অর্ধেক ভবিষ্যতে দাতব্য কাজে প্রদানের অঙ্গীকার করেন এবং অন্যান্য ধনী ব্যক্তিকেও তাদের সম্পদের ৫০% বা তার বেশি একই ভাবে দান করার আহ্বান জানান। গিভিং প্লেজ ৪০ জন মাল্টি বিলিয়নিয়ারকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে। প্লেজে স্বাক্ষরকারী মাল্টি-বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা এখন ১৪১ জন।
আমি মার্কের উদাহরণ দিচ্ছি কারণ তিনি বয়সে তরুণ। তার এই বয়সে টাকার ব্যাপারে উচ্চাকাক্সক্ষী হওয়ার এবং নিজ ‘ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে’ ব্যস্ত থাকার কথা। কিন্তু তিনি তার বিপরীতটা করছেন। মার্ক হয়তো তার প্রজন্মের তরুণদের জন্য একটি নতুন গতিধারার প্রতিনিধিত্ব করছেন। এরা ভিন্ন ধরনের। এরা কেবল নিজের ভাগ্য গড়ার চেয়ে একটি নতুন পৃথিবী গড়ার কাজে বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমার ভয় হয়, পূর্ববর্তী প্রজন্ম তাদের পুরোন কাঠামোগুলো এই নতুন প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করে এই নতুন প্রজন্মটিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
সামাজিক ব্যবসার ধারণা জনপ্রিয় হওয়ার সাথে সাথে এই দাতব্য তহবিলের একটি অংশ, আইন বা ধর্মীয় বাধানিষেধ সাপেক্ষে, সামাজিক ব্যবসার দিকে প্রবাহিত হবে। আর এই প্রবাহটি ক্রমাগত বড় হতে থাকবে। দাতব্য কাজের সিদ্ধান্তের সাথে সাথে এ প্রশ্নটিও উঠবে যে, আমি কি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে টাকা দেব নাকি সামাজিক ব্যবসা তহবিলে দেব? ব্যক্তি, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, ফাউন্ডেশন, কোম্পানি সবাই সামাজিক ব্যবসাকে এমন একটি টেকসই দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে পাবে যেখানে একই টাকা অসংখ্যবার ব্যবহার করা যাবে।
ব্যবসায়ের জগতে পরার্থপরতা
কিন্তু ব্যবসার টাকার কী হবে? ব্যবসার দরজা কি সামাজিক ব্যবসার জন্য চিরতরে বন্ধ থাকবে? আমি তা মনে করি না। ব্যবসার জগতে পরার্থপরতার অনেক নজির এখনই রয়েছে। অতীতেও অনেক ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে এগুলো কখনোই বিজনেস স্কুলের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আমি অতীত থেকে দু’টো চমৎকার উদাহরণ দিচ্ছি।
বশ (Bosch)
বশ ১৩০ বছরের পুরোন একটি জার্মান ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইলেকট্রনিকস বহুজাতিক কোম্পানি, যার বার্ষিক আয় ৫০ বিলিয়ন ডলার। কোম্পানিটি বিশ্বে ব্যাপকভাবে পরিচিত। অনেকেই জানেন না যে কোম্পানিটির মালিক বশ ফাউন্ডেশন। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা কোম্পানিটির ৯২% মালিকানা অর্পণ করার জন্য একটি ফাউন্ডেশন সৃষ্টি করেন। তার পরিবারকে কোম্পানির মাত্র ৮% শেয়ার দিয়ে যান, যা এখনো সেভাবেই আছে। ফাউন্ডেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা করে এবং মুনাফা দাতব্য কাজে ব্যবহার করে। ব্যবসা ও পরার্থপরতা কিভাবে একসাথে কাজ করতে পারে বশ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমরা একে দ্বিতীয় ধরনের সামাজিক ব্যবসা বলে থাকি যেখানে একটি কোম্পানি মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো ট্রাস্ট বা ফাউন্ডেশনের মালিকানাধীনে পরিচালিত হয়।
টাটা ট্রাস্ট
আরেকটি উদাহরণ। পৃথিবীর অনেক জায়গায় বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় বহুল পরিচিত একটি নাম ‘টাটা’। টাটার প্রতিষ্ঠাতা ১২৮ বছর আগে একই কাজ করেছিলেন। টাটা গ্রুপ অব কোম্পানিজের দুই-তৃতীয়াংশ শেয়ারের মালিক টাটা ট্রাস্ট। টাটা গ্রুপের মোট সম্পদ ১১৮ বিলিয়ন ডলার।
পৃথিবীজুড়ে এরকম অসংখ্য ছোট-বড়, নতুন-পুরোনো উদাহরণ রয়েছে। এগুলো পুঁজিবাদের নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে, কিন্তু এত দক্ষতা ও কুশলতার সাথে এগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে এদের ব্যবসা জগৎ থেকে বহিষ্কার করে দেয়া যায়নি। একটি নতুন ধরনের ব্যবসায়িক বিশ্ব গড়ে তুলতে এই উদ্যোগগুলো ছিল শীর্ষস্থানীয়। এই ধরনের উদারণগুলো সাহসের সাথে ব্যাপকভাবে অনুসরণ করা যেত, কিন্তু সনাতন ব্যবসায়ের তত্ত্ব এদের কোনো স্বীকৃতিই দেয়নি।
করপোরেটসমূহ ও সামাজিক ব্যবসা
ব্যক্তি মানুষরা ছাড়াও করপোরেটগুলোও সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে পারে। সচরাচর করপোরেটগুলো তাদের নিজ নিজ কোম্পানির জন্য ফাউন্ডেশন সৃষ্টি করে থাকে। তারা সহজেই তাদের ফাউন্ডেশনগুলোকে সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে বলতে পারে। ফাউন্ডেশনগুলো নিয়মিত কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে পারে এবং সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগের জন্য মুনাফা করতে পারে, যেমনটা বশ ও টাটা করছে। এ ছাড়া করপোরেটগুলো তাদের সাবসিডিয়ারি হিসেবে সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি করতে পারে, অন্য সামাজিক ব্যবসার সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার করতে পারে। আমরা এরই মধ্যে ড্যানোন, ভিওলিয়া, ইউনিক্লো, ইন্টেল করপোরেশন, ম্যাক-কেইন, ইউগ্লেনার মতো কোম্পানির দ্বারা তৈরি চমৎকার সব জয়েন্ট ভেঞ্চার পেয়েছি। করপোরেটগুলো আরো কিছু করতে পারে। তারা তাদের শেয়ারহোল্ডারদের একটি ‘গিভিং প্লেজ’-এ স্বাক্ষর করতে আহ্বান জানাতে পারে। শেয়ারহোল্ডারদের অনুমতি নিয়ে তাদের লভ্যাংশের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ কেটে রেখে তা ইকুইটি হিসেবে সামাজিক ব্যবসায়ে দিয়ে দেয়া হবে। প্রয়োজন হলে তহবিলের এই শেয়ারগুলো অভিহিত মূল্যে অন্য কোনো সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারী কারো কাছে বিক্রি করে দেয়া যাবে। এভাবে তাদের টাকা একেবারে শেষ হয়ে যাবে না।
করপোরেটগুলো তাদের বার্ষিক করপোরেট সামাজিক দায়িত্বের (সিএসআর) অনুদান সামাজিক ব্যবসা ট্রাস্টে দিতে পারে।
আমি অনুরূপ একটি কর্মসূচি সৃষ্টি করার জন্য ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছি। তারা বিপুল পরিমাণ তহবিল ব্যবস্থাপনা করে থাকে। বিশ্বব্যাপী মিউচুয়াল ফান্ডগুলোতে বিনিয়োজিত সম্পদের পরিমাণই ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ তহবিল রয়েছে। সবগুলোর মোট সম্পদ মহাসাগর সমতুল্য হবে।
তাদের কাছে আমার প্রস্তাবটি হচ্ছে- প্রত্যেক বিনিয়োগকারীকে এই মর্মে পছন্দের একটি সুযোগ দেয়া হোক যে তিনি চাইলে তার সম্পদের একটি অংশ, যেমন ২.৫% (বা কম-বেশি), আলাদা করে এক ধরনের পুনরুদ্ধারযোগ্য প্রদত্ত তহবিল (Recoverable endowment fund) তৈরি করতে পারবেন। এই তহবিল থেকে উপার্জিত বার্ষিক আয় সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করা হবে। বিনিয়োগকারী যা করছেন তা হলো তিনি কোনো সামাজিক উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য তার সম্পদের ২.৫% পরিমাণ আয় ত্যাগ করছেন, তার সম্পত্তি ত্যাগ না করেই। কোম্পানিগুলো সম্মত হলে এবং বিনিয়োগকারীরা রাজি হলে এই পুনরুদ্ধারযোগ্য তহবিলের পরিমাণ হতে পারে বিশাল।
আমি বিশাল আকৃতির পেনশন ফান্ডগুলোর সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতি-প্রণেতাদের একই উদ্দেশ্যে একই ভঙ্গিতে পুনরুদ্ধারযোগ্য প্রদত্ত তহবিল সৃষ্টিতে প্রয়োগ করার পরামর্শ দিচ্ছি। বিশ্বব্যাপী পেনশন ফান্ডগুলোর সম্মিলিত সম্পদ ৮৪ ট্রিলিয়ন ডলার। তাদের কেবল যা করতে হবে তা হলো বিনিয়োগকারীদের তাদের পরিকল্পনাটি জানানো এবং এ কাজে তাদের সম্মতি নেয়া। আমি এখন পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাইনি। তাদের মতে, এই আইডিয়াতে কেউ ইতিবাচকভাবে সাড়া দেবে না, কারণ বিনিয়োগকারীরা যা চায় তা হলো তাদের তহবিলের দ্রুত বৃদ্ধি; তারা ‘দিয়ে দেয়া’য় আগ্রহী নয় মোটেই। আমি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি যে, তারা একেবারে অপ্রত্যাশিত রকম সাড়াও পেয়ে যেতে পারেন। আমি বলি, আপনারা যতক্ষণ না বিনিয়োগকারীদের সত্যি সত্যি জিজ্ঞেস করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত জানতে পারছেন না কী চমক আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি বললাম, আমি এমন একটি ফরচুন ৫০০ কোম্পানিকে জানি তারা তাদের শেয়ারহোল্ডারদের কাছে অনুরূপ একটা প্রস্তাব করেছিল এবং পরে একবারে অবাক হয়ে গিয়েছিল তাদের ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া পেয়ে। ৯৮% শেয়ারহোল্ডার তাদের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিলেন। অবশ্যই এমনো হতে পারে যে প্রথম অনুরোধে সবাই রাজি হবেন না। তবে তাদের কয়েকজনও যদি রাজি হন সেটা হবে এক বিরাট কাহিনীর শুরু। সামাজিক ব্যবসাগুলোর ফলাফল যদি সন্তোষজনক হয়, অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে।
এটা মূলত উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপার। একটি শহরে একটি পেনশন তহবিল দিয়ে এটা শুরু হতে পারে। শুরুতে সাড়া যত কমই হোক না কেন, এটা একটা দরজা খুলে দেবে, যা ক্রমান্বয়ে বড় হতে থাকবে। কিন্তু শুরুটা করতে হবে। আমাদের এই পুরনো বিশ্বাস নিয়ে থাকলে চলবে না যে, বিনিয়োাগকারীরা লাভ ছাড়া আর কিছুতে আগ্রহী নয়, তারা লাভ ছাড়া আর কিছু দেখে না, আর কিছু শোনে না। আমাদের বুঝতে হবে যে, পৃথিবী ও তার মানুষগুলো বদলে যাচ্ছে। তারা ভিন্নভাবে আচরণ করতে শুরু করেছে।
পেনশন ফান্ড থেকে জন্ম নেয়া পুনরুদ্ধারযোগ্য প্রদত্ত তহবিলের সৃষ্ট টাকা বিনিয়োগ করে তা দিয়ে পার্থক্যকৃত মূল্যে ধনী-দরিদ্র সব বৃদ্ধ মানুষের দেখভাল করা সম্ভব। এটা দিয়ে স্বাস্থ্যবীমা ও বিভিন্ন স্বাস্থ্যসুবিধা যেমন- হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিংসেবা, সেবাসদন, বৃদ্ধ নিবাস এবং আয়ের সুযোগ, গৃহায়ন, খেলাধুলা, ভ্রমণ ইত্যাদি সেবা দেয়ার জন্য সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি করতে পারে।
সামাজিক ব্যবসা দিবস
যখনই মানুষ পৃথিবীতে সম্পদের বৈষম্য কমিয়ে আনার পথ খুঁজবে, সামাজিক ব্যবসাকে তারা এই উদ্দেশ্য সাধনে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখতে পাবে। সামাজিক ব্যবসা সমাজের ওপরের স্তরের মানুষদের সম্পদ সঞ্চয়নের প্রক্রিয়াকে শ্লথ করবে এবং সমাজের নিচের স্তরের মানুষদের সম্পদের ভিত গড়ে তুলতে ও তাদের যা কিছু অর্জন তা ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
আমরাও আমাদের নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে পারি। আমরা সবাই এই ধারণাটি আসলে কতটুকু কাজের তা পরীক্ষা করে দেখতে পারি। আমরা প্রত্যেকেই কোনো সামাজিক ব্যবসার আইডিয়া নিয়ে আসতে পারি। সামাজিক ব্যবসায়ে আইডিয়া সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস। আমরা প্রত্যেকেই কোনো একটি সামাজিক ব্যবসায়ে সরাসরি বা এর সাথে যুক্ত কারো মাধ্যমে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আমরা আমাদের বার্ষিক আয়ের ৫% এই উদ্দেশ্যে একটি আলাদা হিসাবে রাখতে পারি, অনেকটা ব্যক্তিগত সামাজিক ব্যবসা তহবিলের মতো আর তা সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে পারি। একটি সহজ উদাহরণ হিসেবে, যেকেউ ৫, ১০, ২৫ বা আরো বেশি বেকার তরুণ বা তরুণীকে উদ্যোক্তায় পরিণত করতে পারি। আমরা এটা কিভাবে করছি তা আপনাকে দেখিয়ে দেবো; আপনার ভালো লাগতে পারে।
আমরা প্রতি বছর ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস’ পালন করে থাকি। এ বছর আমরা ২৮-২৯ জুলাই দিবসটি পালন করব। পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসার অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সেশন ছাড়াও আমরা কান্ট্রি ফোরামের আয়োজন করব যেখানে প্রত্যেক দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিরা তাদের নিজ দেশের জন্য আলাদা সেশন পরিচালনা করবেন এবং নিজ নিজ দেশের জন্য সামাজিক ব্যবসা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করবেন। এই কান্ট্রি ফোরামগুলোতে অংশগ্রহণ করার জন্য তারা নিজ নিজ দেশ থেকে ব্যবসায়ী নেতা, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষাবিদ, ফাউন্ডেশন নেতাদের নিয়ে আসবেন। সামাজিক ব্যবসার ওপর একটি বাংলাদেশী ফোরামও সেখানে থাকবে। আপনি বাংলাদেশ ফোরামের আয়োজনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিতে পারেন বা এই ফোরামে সক্রিয় অংশ নিতে পারেন। বাংলাদেশের জন্য এই ফোরাম কী সামাজিক ব্যবসা পরিকল্পনা নিলো তার ঘোষণার মধ্য দিয়ে ফোরামের কাজ শেষ হবে।
সম্পদের কেন্দ্রীকরণ মন্থর করতে কিংবা বন্ধ করতে আপনি কী করতে পারেন তা নিয়ে ভাবতে আপনার ভালো লাগতে পারে। কিছু সহজ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে সম্পদের বৈষম্য কমিয়ে আনতে আপনি ভূমিকা রাখতে পারেন। আপনার নিজের ‘গিভিং প্লেজ’ তৈরির কথা ভাবুন অথবা আপনার বন্ধুদের বা আপনার ব্যবসায়িক পার্টনারদের নিয়ে একটি সম্মিলিত গিভিং প্লেজ তৈরির কথা ভাবুন। আপনি এখনই একটি ‘উইল’ তৈরির সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যেখানে আপনার সম্পদের অধিকাংশ বা কমপক্ষে অর্ধেক আপনি আপনার জীবদ্দশায়ই আপনার নিজের কোনো সামাজিক ব্যবসা বা ট্রাস্টকে দিয়ে যাবেন, যা সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আপনি আপনার সব কোম্পানিকে একটি ট্রাস্টের হাতে দিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন। এভাবে আপনার সম্পদ চিরস্থায়ী হবে, বশ ও টাটার মতো বেড়ে উঠবে এবং দেশ ও বিশ্বকে মৌলিকভাবে পরিবর্তিত করতে ভূমিকা রাখবে।
আমি সবাইকে সবসময় মনে করিয়ে দিই যে অর্থোপার্জন একটি সুখকর বিষয়, কিন্তু অন্যদের সুখী করাটা পরম সুখকর। এই পরম সুখকে হারাবেন না। দেরি না করে এখনই শুরু করা ভালো, যেন পরিবর্তনগুলো আপনি দেখে যেতে এবং তা থেকে সৃষ্ট পরম সুখটা উপভোগ করতে পারেন। আপনি যা শুরু করলেন তার ফলাফল আপনার জীবদ্দশায়ই দেখে যেতে পারেন।
আপনার সৃষ্ট ট্রাস্ট বা সামাজিক ব্যবসা তহবিল কর্তৃক অর্থায়নকৃত সামাজিক ব্যবসাটি পরিচালনা করার জন্য আপনার সন্তানদের আহ্বান জানান। আপনি দেখে অবাক হবেন তারা কাজটি কত উপভোগ করছে। শুধু দ্বিতীয় প্রজন্মের সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পরিবর্তে তারা বিশ্বব্যাপী সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি ও সফলভাবে ছড়িয়ে দিয়ে গ্লোবাল সেলিব্রিটিতে পরিণত হতে পারে। তারা নিশ্চয়ই নতুন বিশ্ব প্রজন্মের নেতৃত্ব দিতে পছন্দ করবে।
যে কেউ তার সম্পদ কোনো সামাজিক ব্যবসা ট্রাস্ট বা তহবিলে দিয়ে যেতে উইল করতে পারেন। তার সন্তানেরা এই ট্রাস্ট বা ফান্ডগুলোর সাথে জড়িত থাকতে পারে, যাতে তারা না ভাবে যে তাদের পিতা বা মাতার সম্পদের নিয়ন্ত্রণ থেকে তাদের দূরে রাখা হয়েছে। আপনি ও আপনার পরিবার পৃথিবীকে কিভাবে প্রভাবিত করতে পারেন তা দেখে আপনারা অবাক হবেন।
আপনি যদি এই উদ্যোগগুলোর কোনো একটি গ্রহণ করতে চান, আপনাকে এ-কাজে সাহায্য করতে ইউনূস সেন্টারে আমরা আনন্দের সাথে এগিয়ে আসব। আপনি নির্দ্বিধায় আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
এ ছাড়াও সামাজিক ব্যবসা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে আপনি আপনার বন্ধু বা আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক পার্টনারদের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার করতে পারেন এবং দেখতে পারেন আপনাদের কেমন লাগছে। আপনারা চাইলে খুব ছোট আকারে শুরু করতে পারেন, আকারটা কোনো বিষয় নয়; উদ্দেশ্যটাই আসল। ২০১৩ সালের মধ্যে দারিদ্র্য অর্ধেকে কমিয়ে এনে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর বাহবা অর্জন করেছে। সম্পদ বৈষম্যের প্রক্রিয়া উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও আমরা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিতে পারি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ প্রতি বছর আগে যে গতিতে বেড়েছিল তার চেয়ে গতি কমিয়ে আনতে পারি। তারপর আমরা প্যারিস সম্মেলনের মতো একটি বিশ্ব সম্মেলনের (হতে পারে ঢাকা সম্মেলন) আয়োজন করতে পারি যেখানে আমরা পৃথিবীর সব দেশকে ডেকে বলব কিভাবে আমরা এটা সম্ভব করেছি, এই প্রক্রিয়ায় কার কী ভূমিকা ছিল। সম্মেলন শেষ হবে জাতিসঙ্ঘকে এই আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে যে, তারা পৃথিবীর সব দেশকে নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করবে যেখানে প্রতিটি দেশ সম্পদ কেন্দ্রীভূত করার গতিকে প্রথম পর্যায়ে শূন্যে নামিয়ে আনার এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে এই প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রীভূত সম্পদ হ্রাসের গতিতে রূপান্তরিত করার জন্য যার যার ডেডলাইন ঘোষণা করবে।
উপসংহার
সম্পদ কেন্দ্রীকরণ একটি বৈশ্বিক হুমকি। পৃথিবীর ১% লোকের হাতে পৃথিবীর ৯৯% সম্পদ পুঞ্জিভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে সমস্যাটি এ বছর একটি বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছেছে। সমস্যাটি শুধু বৈশ্বিকভাবেই দিন দিন খারাপ হচ্ছে না, সমস্যাটি বিভিন্ন জাতির মধ্যে এবং প্রতিটি জাতির নিজের মধ্যে প্রতিনিয়ত গভীরতর হচ্ছে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে সম্পদবৈষম্য শান্তির প্রতি সবসময়েই একটি হুমকি। ঐতিহাসিকভাবে কোনো কোনো জাতি অন্যদের চেয়ে বেশি সম্পদ সঞ্চিত করেছে। সম্পদ সঞ্চয়নে কোনো কোনো জাতি অন্য জাতির ওপর অন্যায় সুবিধা নিয়েছে। পুরনো ক্ষোভের পাশাপাশি নতুন ক্ষোভও সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো বিরোধ, সংঘর্ষ ও যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জাতিগুলো বিপন্ন বোধ করলে তারা তাদের সামরিক ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা বৃদ্ধি পেতে পেতে ইতোমধ্যে ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সামরিক খাতে বিশ্বে বার্ষিক ব্যয় এখন ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যার ৩৯% মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই ব্যয় করে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে এবং জাতিগুলোর নিজেদের মধ্যে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ যত তীব্র হবে, সশস্ত্র বিরোধে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা ততই আসন্ন হয়ে উঠবে।
সম্পদকেন্দ্রীকরণ থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করার এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। বৈশ্বিক ঊষ্ণায়ন বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক ঐকমত্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া থেকে আমরা যে শিক্ষা নিয়েছি, সম্পদকেন্দ্রীকরণ বন্ধে ও হ্রাসেও আমরা একইভাবে একটি আন্তর্জাতিক ঐকমত্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে পারি। বৈশ্বিক ঊষ্ণায়ন ও সম্পদকেন্দ্রীকরণ উভয়েরই মূল একই যায়গায়- মানুষের লোভের ওপর গড়ে ওঠা ত্রুটিপূর্ণ অর্থনৈতিক কাঠামো।
পারস্পরিক দায়িত্ববোধ সম্পন্ন ও সুখ-দুঃখের অংশীদার সামাজিক জীব হিসেবে নিজেদের পুনঃআবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা সম্পদের কেন্দ্রীকরণকে ঘুরিয়ে দিতে পারি। আমরা তিনটি শূন্যের একটি পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এগোতে পারি- শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ; একটি রুহিতন আকৃতির সম্পদ বণ্টনের বিশ্ব; একটি সমতা, সম্প্রীতি, শান্তি ও সুখের বিশ্ব। আমরা নাগরিকেরা তৎপর হলেই এটা সম্ভব হবে।
আসুন, আমরা সবাই মিলে এটা সম্ভব করে তুলি।
ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৬ তারিখে অনুষ্ঠিত দি ডেইলি স্টার পত্রিকার ২৫তম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ইংরেজি বক্তৃতার অনুবাদ।
অনুবাদ : কাজী নজরুল হক।
No comments