বিচারপতির ওপর বিএনপির অহেতুক আক্রমণ by মইনুল ইসলাম
জিয়াউর
রহমানের অবৈধ ক্ষমতা দখলকে সাংবিধানিক বৈধতা প্রদানে সংবিধানের যে পঞ্চম
সংশোধনী গৃহীত হয়েছিল, ওই সংশোধনীকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে প্রদত্ত
ঐতিহাসিক রায়ের কারণে ইতিহাসে স্থায়ী সম্মান ও শ্রদ্ধার আসন অর্জন
করেছেন বিচারপতি খায়রুল হক। আর এটাই বিএনপির জন্য গাত্রদাহের কারণ হয়েছে।
উল্লেখ্য, পঞ্চম সংশোধনীর প্রবক্তা জিয়াউর রহমান অবৈধ সামরিক শাসনের গায়ে ‘সিভিলিয়ান ডেমোক্রেসির’ জোব্বা পরানোর উদ্দেশ্যে সুবিধা-শিকারি রাজনীতিবিদ, সামরিক অফিসার, সিভিল আমলা ও ব্যবসায়ীদের জড়ো করে প্রথমে জাগদল এবং পরে বিএনপির জন্ম দিয়েছিলেন। সে কারণে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের কাছে যে বিচারপতি খায়রুল হক শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন হাইকোর্টের রায়ের পর থেকেই। পরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ওই রায় চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করায় বিএনপি সরাসরি ওই ইস্যুতে বিচারপতি খায়রুল হককে গালমন্দ করতে পারছে না, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা–সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রদানের পর তাঁকে উদ্দেশ করে অপমানজনক গালাগালের তুবড়ি ফোটাচ্ছেন বিএনপির বাক্যবাগীশ নেতারা।
সম্প্রতি তাঁরা প্রধান বিচারপতির একটা বক্তব্যের কারণে বিচারপতি খায়রুল হককে ব্যক্তিগত আক্রমণ করার স্বর্ণ-সুযোগ পেয়ে গেছেন। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সম্প্রতি তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন যে বিচারপতিরা অবসর গ্রহণের পর চাকরিরত থাকাকালীন তাঁদের প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত রায়কে পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায়ে পরিণত করে তাতে স্বাক্ষর করার যে রেওয়াজ এ দেশের উচ্চ আদালতে চালু রয়েছে, সেটাকে তিনি সংবিধান পরিপন্থী মনে করেন। কারণ, তিনি মনে করেন, বিচারপতিরা সংবিধান সমুন্নত রাখার যে শপথ নেন, অবসর গ্রহণের পর তা আর বলবৎ থাকে না। ভবিষ্যতে তিনি এই প্রথাটি আর চলতে দেবেন না বলে অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন। (অবসর গ্রহণের চার বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোনো কোনো বিচারপতির নাকি লিখিত রায় লিখে স্বাক্ষর প্রদানের কাজ সম্পন্ন করার সময় হয়নি।) বলা বাহুল্য, তাঁর এই মতামত সারা দেশের আইনজ্ঞ ও সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, যদিও তিনি অতীতে প্রদত্ত কোনো রায় এর ফলে অবৈধ হবে না বলে স্পষ্ট মত প্রদান করেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনেও প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্য তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। বিএনপির সংকটাপন্ন রাজনীতির জন্য এই ইস্যুটা টনিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের ব্যাপারে আমি পক্ষে-বিপক্ষে কিছু বলতে চাই না। তবে সংক্ষিপ্ত রায় যেহেতু শপথের অধীনে থাকাকালীনই দেওয়া হয়েছে, অতএব পরে এর পূর্ণাঙ্গ লিখিত ব্যাখ্যাসংবলিত রায়ে ওই সংক্ষিপ্ত রায়ের কোনো ব্যত্যয় না করা হলে সেটা অসাংবিধানিক কেন হবে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। আর এই প্রথা তো এ দেশে বহুদিন ধরেই চালু রয়েছে, কেউ তো প্রশ্ন তোলেননি? অসমাপ্ত রায়গুলো লিখে জমা দেওয়া না হলে বিচারপতি শামসুদ্দিনের পেনশনের ফাইলে স্বাক্ষর করা হবে না মর্মে যে সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতি গ্রহণ করেছিলেন, সেখান থেকেই এই ইস্যুটির উৎপত্তি বলে ধারণা করা যাচ্ছে। বিচারপতি শামসুদ্দিনও দাবি করে চলেছেন, ‘এই প্রথা ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বহু দেশেই প্রচলিত রয়েছে। সুদূর পাকিস্তান আমল থেকেই এ দেশে প্রথাটি বহাল রয়েছে।’ তিনি এ প্রসঙ্গে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি মোস্তাফা কামাল ও বিচারপতি খায়রুল হকের নাম উল্লেখ করেছেন।
অপরদিকে, বিএনপির পক্ষ থেকে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ভারত ও পাকিস্তানে সম্প্রতি অবসরকালীন রায় লেখা নিষেধ করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন। বোঝা যাচ্ছে, এটা হয়তো অদূর ভবিষ্যতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট মামলার বিষয়ে পরিণত হবে এবং শেষ পর্যন্ত আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ের মাধ্যমেই এর ফয়সালা হবে। সে জন্য, বিএনপি যদি সুনিশ্চিত অবস্থান গ্রহণ করে যে প্রধান বিচারপতির এহেন মন্তব্যের কারণে বিচারপতি খায়রুল হক কর্তৃক লিখিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল–সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়টি ‘বাতিলযোগ্য’ হয়ে গেছে, তাহলে কালবিলম্ব না করে তাদের রিট করাই হবে যৌক্তিক পদক্ষেপ। কিন্তু তা না করে বিএনপির বিভিন্ন নেতা যেভাবে অশিষ্ট ভাষায় বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণাচ্ছেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁর গ্রেপ্তার দাবি করা চরম অশিষ্টতারই পরিচায়ক।
আমার মতে, বিএনপির নেতারা অহেতুক বিচারপতি খায়রুল হককে অপমান করছেন। যেহেতু নিজের সমর্থনে পত্রপত্রিকায় বা গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়াটা তাঁর পক্ষে শোভন হবে না, তাই এহেন একতরফা গালাগাল ভদ্রজনোচিত নয়। আইনকানুন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন যে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণাসংবলিত রায় একটি ঐতিহাসিক রায়। তবে এ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়েও ভিন্নমত ছিল এবং ৪-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের মতামতের ভিত্তিতেই ওই রায় প্রদত্ত হয়েছিল। আবার, ঐকমত্য পোষণকারী বিচারপতিদের লিখিত ব্যাখ্যায় ভিন্নতা ছিল। ওই ভিন্নমতগুলো প্রদান করতে অস্বাভাবিক বিলম্ব হওয়াতেই ওই রায়ের চূড়ান্ত লিখিত ও স্বাক্ষরিত ভার্সনটি প্রকাশে ১৬ মাস সময় লেগে গিয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছে, নির্বাচিত সংসদ চাইলে আরও দুইবারের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখতে পারবে। লিখিত ব্যাখ্যায় বিচারপতি খায়রুল হক ‘নির্বাচিত সাংসদদের’ মধ্য থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্যদের নিযুক্ত করার কথা লিখেছেন, যা মূল রায়ের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। কিন্তু মূল লিখিত রায় প্রকাশের আগেই নির্বাচিত সংসদ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে ফেলেছে, যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংসদ আর প্রয়োজনীয় মনে করেনি। এর দায় কেন বিচারপতি খায়রুল হকের ওপর বর্তাবে? এটা একান্তই সংসদের এখতিয়ারভুক্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
প্রকৃতপক্ষে, বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিচারপতি খায়রুল হককে অহেতুক ‘নন্দ ঘোষ’ বানাচ্ছেন! তাঁদের কাছে হয়তো কখনোই এ সত্য গ্রহণযোগ্য হবে না যে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকে কোনো বিবেকবান বিচারক কোনো আইনি যুক্তিতেই বৈধতা দিতে পারেন না। সামরিক শাসনকে ‘লেজিটিমেসি’ প্রদানের জন্য ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দলবিধি আদেশ জারি করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারপ্রধানের পদের সর্বময় ক্ষমতা অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর ব্ল্যাকমেল বা লোভনীয় টোপের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল গঠন করে জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে সেটাকে জিতিয়ে এনে সামরিক শাসনের গায়ে গণতন্ত্রের লেবাস পরালেই অবৈধ ক্ষমতা দখলকে যে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া যায় না, সেটাই এ দেশের হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করার রায় দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আমার দৃঢ়বিশ্বাস, এই ঐতিহাসিক রায় যুগ যুগ ধরে নন্দিত হবে এবং এ জন্য বিচারপতি খায়রুল হকের ভূমিকাও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁকে ছোট করার জন্য বিএনপির মরিয়া প্রয়াস আদতে বিএনপির প্রশ্নবিদ্ধ জন্মবৃত্তান্তকেই বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। অর্থের লোভে কিংবা পদের লোভে তিনি এই রায়গুলো দিয়েছেন—এই হাস্যকর প্রলাপগুলো অচিরেই বন্ধ করা হোক। অবসরে যাওয়ার পর বাংলাদেশের একাধিক প্রধান বিচারপতি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছেন। বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি মোস্তাফা কামাল, বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলাম এ ক্ষেত্রে নিকট অতীতের নজির। তাঁদের মধ্যে দুজনকে বিএনপি-নেতৃত্বাধীন সরকারই নিয়োগ দিয়েছিল। তাহলে, বিচারপতি খায়রুল হক একই পথ অনুসরণ করে কীভাবে দোষ করলেন?
বিএনপি নিজেদের ক্ষীয়মাণ জনপ্রিয়তাকে পুনরুদ্ধারকল্পে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণা, ২৫ মার্চের রাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার, ২৬ মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা—সবকিছুকে নিয়ে একের পর এক বিতর্ক সৃষ্টি করছে। স্বীকৃত ইতিহাসকে অস্বীকার করে এসব আবোলতাবোল বক্তব্য দিয়ে তারা কী ফায়দা হাসিল করতে চাইছে? বিএনপির জন্মের আগের ইতিহাসকে তাদের নিজের মতো করে সাজিয়ে নেওয়ার বদমতলব কি পরিত্যাগ করার সময় আসেনি? ১৯৭৮ সালে জন্ম নেওয়া বিএনপির ১৯৪৭-১৯৭১ সালের সংগ্রামের ইতিহাসকে অস্বীকার করার কী যুক্তি থাকতে পারে? ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে পণ্ডিতি করে নতুন নতুন তত্ত্ব আবিষ্কারের মাধ্যমে তারেক রহমান বিএনপির রাজনীতিকে কোথায় দাঁড় করাতে চাইছেন?
৩০ লাখ শহীদ সম্পর্কে পাকিস্তান প্রশ্ন তুলতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের তিন দফায় প্রধানমন্ত্রীর কুরসিতে বসা খালেদা জিয়া ৪৫ বছর পর পাকিস্তানের এই প্রোপাগান্ডায় শরিক হবেন কেন? কাকে কী মেসেজ দিতে চাইলেন তিনি? আর ভুল স্বীকার না করে কিছু কিছু পদলোভী বিএনপি নেতা যেভাবে খালেদা জিয়ার এই মারাত্মক ভুলকে বাহবা দিয়ে চলেছেন, সেটা কি আদতেই বিএনপির উপকার করছে? বিএনপির ভুলের পর ভুলের এই কাফেলায় বিচারপতি খায়রুল হককে টার্গেট করাটাও একটা বড় ভুল মনে করি।
বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের পর সংক্ষিপ্ত রায় লেখা এবং স্বাক্ষর করার বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির ঘোষিত অবস্থানকে অবলম্বন করে আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অদূর ভবিষ্যতে সংবিধানে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন এক্ষণে বিএনপির জন্য দিবাস্বপ্নের শামিল হবে। আর এই উদ্দেশ্যে বিচারপতি খায়রুল হককে যতই বিতর্কিত করা হোক না কেন, তিনি দেশবাসীর কাছে শ্রদ্ধাভাজনই থাকবেন।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
উল্লেখ্য, পঞ্চম সংশোধনীর প্রবক্তা জিয়াউর রহমান অবৈধ সামরিক শাসনের গায়ে ‘সিভিলিয়ান ডেমোক্রেসির’ জোব্বা পরানোর উদ্দেশ্যে সুবিধা-শিকারি রাজনীতিবিদ, সামরিক অফিসার, সিভিল আমলা ও ব্যবসায়ীদের জড়ো করে প্রথমে জাগদল এবং পরে বিএনপির জন্ম দিয়েছিলেন। সে কারণে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের কাছে যে বিচারপতি খায়রুল হক শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন হাইকোর্টের রায়ের পর থেকেই। পরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ওই রায় চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করায় বিএনপি সরাসরি ওই ইস্যুতে বিচারপতি খায়রুল হককে গালমন্দ করতে পারছে না, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা–সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রদানের পর তাঁকে উদ্দেশ করে অপমানজনক গালাগালের তুবড়ি ফোটাচ্ছেন বিএনপির বাক্যবাগীশ নেতারা।
সম্প্রতি তাঁরা প্রধান বিচারপতির একটা বক্তব্যের কারণে বিচারপতি খায়রুল হককে ব্যক্তিগত আক্রমণ করার স্বর্ণ-সুযোগ পেয়ে গেছেন। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সম্প্রতি তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন যে বিচারপতিরা অবসর গ্রহণের পর চাকরিরত থাকাকালীন তাঁদের প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত রায়কে পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায়ে পরিণত করে তাতে স্বাক্ষর করার যে রেওয়াজ এ দেশের উচ্চ আদালতে চালু রয়েছে, সেটাকে তিনি সংবিধান পরিপন্থী মনে করেন। কারণ, তিনি মনে করেন, বিচারপতিরা সংবিধান সমুন্নত রাখার যে শপথ নেন, অবসর গ্রহণের পর তা আর বলবৎ থাকে না। ভবিষ্যতে তিনি এই প্রথাটি আর চলতে দেবেন না বলে অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন। (অবসর গ্রহণের চার বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোনো কোনো বিচারপতির নাকি লিখিত রায় লিখে স্বাক্ষর প্রদানের কাজ সম্পন্ন করার সময় হয়নি।) বলা বাহুল্য, তাঁর এই মতামত সারা দেশের আইনজ্ঞ ও সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, যদিও তিনি অতীতে প্রদত্ত কোনো রায় এর ফলে অবৈধ হবে না বলে স্পষ্ট মত প্রদান করেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনেও প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্য তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। বিএনপির সংকটাপন্ন রাজনীতির জন্য এই ইস্যুটা টনিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের ব্যাপারে আমি পক্ষে-বিপক্ষে কিছু বলতে চাই না। তবে সংক্ষিপ্ত রায় যেহেতু শপথের অধীনে থাকাকালীনই দেওয়া হয়েছে, অতএব পরে এর পূর্ণাঙ্গ লিখিত ব্যাখ্যাসংবলিত রায়ে ওই সংক্ষিপ্ত রায়ের কোনো ব্যত্যয় না করা হলে সেটা অসাংবিধানিক কেন হবে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। আর এই প্রথা তো এ দেশে বহুদিন ধরেই চালু রয়েছে, কেউ তো প্রশ্ন তোলেননি? অসমাপ্ত রায়গুলো লিখে জমা দেওয়া না হলে বিচারপতি শামসুদ্দিনের পেনশনের ফাইলে স্বাক্ষর করা হবে না মর্মে যে সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতি গ্রহণ করেছিলেন, সেখান থেকেই এই ইস্যুটির উৎপত্তি বলে ধারণা করা যাচ্ছে। বিচারপতি শামসুদ্দিনও দাবি করে চলেছেন, ‘এই প্রথা ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বহু দেশেই প্রচলিত রয়েছে। সুদূর পাকিস্তান আমল থেকেই এ দেশে প্রথাটি বহাল রয়েছে।’ তিনি এ প্রসঙ্গে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি মোস্তাফা কামাল ও বিচারপতি খায়রুল হকের নাম উল্লেখ করেছেন।
অপরদিকে, বিএনপির পক্ষ থেকে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ভারত ও পাকিস্তানে সম্প্রতি অবসরকালীন রায় লেখা নিষেধ করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন। বোঝা যাচ্ছে, এটা হয়তো অদূর ভবিষ্যতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট মামলার বিষয়ে পরিণত হবে এবং শেষ পর্যন্ত আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ের মাধ্যমেই এর ফয়সালা হবে। সে জন্য, বিএনপি যদি সুনিশ্চিত অবস্থান গ্রহণ করে যে প্রধান বিচারপতির এহেন মন্তব্যের কারণে বিচারপতি খায়রুল হক কর্তৃক লিখিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল–সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়টি ‘বাতিলযোগ্য’ হয়ে গেছে, তাহলে কালবিলম্ব না করে তাদের রিট করাই হবে যৌক্তিক পদক্ষেপ। কিন্তু তা না করে বিএনপির বিভিন্ন নেতা যেভাবে অশিষ্ট ভাষায় বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণাচ্ছেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁর গ্রেপ্তার দাবি করা চরম অশিষ্টতারই পরিচায়ক।
আমার মতে, বিএনপির নেতারা অহেতুক বিচারপতি খায়রুল হককে অপমান করছেন। যেহেতু নিজের সমর্থনে পত্রপত্রিকায় বা গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়াটা তাঁর পক্ষে শোভন হবে না, তাই এহেন একতরফা গালাগাল ভদ্রজনোচিত নয়। আইনকানুন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন যে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণাসংবলিত রায় একটি ঐতিহাসিক রায়। তবে এ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়েও ভিন্নমত ছিল এবং ৪-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের মতামতের ভিত্তিতেই ওই রায় প্রদত্ত হয়েছিল। আবার, ঐকমত্য পোষণকারী বিচারপতিদের লিখিত ব্যাখ্যায় ভিন্নতা ছিল। ওই ভিন্নমতগুলো প্রদান করতে অস্বাভাবিক বিলম্ব হওয়াতেই ওই রায়ের চূড়ান্ত লিখিত ও স্বাক্ষরিত ভার্সনটি প্রকাশে ১৬ মাস সময় লেগে গিয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছে, নির্বাচিত সংসদ চাইলে আরও দুইবারের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখতে পারবে। লিখিত ব্যাখ্যায় বিচারপতি খায়রুল হক ‘নির্বাচিত সাংসদদের’ মধ্য থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্যদের নিযুক্ত করার কথা লিখেছেন, যা মূল রায়ের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। কিন্তু মূল লিখিত রায় প্রকাশের আগেই নির্বাচিত সংসদ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে ফেলেছে, যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংসদ আর প্রয়োজনীয় মনে করেনি। এর দায় কেন বিচারপতি খায়রুল হকের ওপর বর্তাবে? এটা একান্তই সংসদের এখতিয়ারভুক্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
প্রকৃতপক্ষে, বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিচারপতি খায়রুল হককে অহেতুক ‘নন্দ ঘোষ’ বানাচ্ছেন! তাঁদের কাছে হয়তো কখনোই এ সত্য গ্রহণযোগ্য হবে না যে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকে কোনো বিবেকবান বিচারক কোনো আইনি যুক্তিতেই বৈধতা দিতে পারেন না। সামরিক শাসনকে ‘লেজিটিমেসি’ প্রদানের জন্য ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দলবিধি আদেশ জারি করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারপ্রধানের পদের সর্বময় ক্ষমতা অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর ব্ল্যাকমেল বা লোভনীয় টোপের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল গঠন করে জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে সেটাকে জিতিয়ে এনে সামরিক শাসনের গায়ে গণতন্ত্রের লেবাস পরালেই অবৈধ ক্ষমতা দখলকে যে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া যায় না, সেটাই এ দেশের হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করার রায় দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আমার দৃঢ়বিশ্বাস, এই ঐতিহাসিক রায় যুগ যুগ ধরে নন্দিত হবে এবং এ জন্য বিচারপতি খায়রুল হকের ভূমিকাও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁকে ছোট করার জন্য বিএনপির মরিয়া প্রয়াস আদতে বিএনপির প্রশ্নবিদ্ধ জন্মবৃত্তান্তকেই বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। অর্থের লোভে কিংবা পদের লোভে তিনি এই রায়গুলো দিয়েছেন—এই হাস্যকর প্রলাপগুলো অচিরেই বন্ধ করা হোক। অবসরে যাওয়ার পর বাংলাদেশের একাধিক প্রধান বিচারপতি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছেন। বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি মোস্তাফা কামাল, বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলাম এ ক্ষেত্রে নিকট অতীতের নজির। তাঁদের মধ্যে দুজনকে বিএনপি-নেতৃত্বাধীন সরকারই নিয়োগ দিয়েছিল। তাহলে, বিচারপতি খায়রুল হক একই পথ অনুসরণ করে কীভাবে দোষ করলেন?
বিএনপি নিজেদের ক্ষীয়মাণ জনপ্রিয়তাকে পুনরুদ্ধারকল্পে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণা, ২৫ মার্চের রাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার, ২৬ মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা—সবকিছুকে নিয়ে একের পর এক বিতর্ক সৃষ্টি করছে। স্বীকৃত ইতিহাসকে অস্বীকার করে এসব আবোলতাবোল বক্তব্য দিয়ে তারা কী ফায়দা হাসিল করতে চাইছে? বিএনপির জন্মের আগের ইতিহাসকে তাদের নিজের মতো করে সাজিয়ে নেওয়ার বদমতলব কি পরিত্যাগ করার সময় আসেনি? ১৯৭৮ সালে জন্ম নেওয়া বিএনপির ১৯৪৭-১৯৭১ সালের সংগ্রামের ইতিহাসকে অস্বীকার করার কী যুক্তি থাকতে পারে? ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে পণ্ডিতি করে নতুন নতুন তত্ত্ব আবিষ্কারের মাধ্যমে তারেক রহমান বিএনপির রাজনীতিকে কোথায় দাঁড় করাতে চাইছেন?
৩০ লাখ শহীদ সম্পর্কে পাকিস্তান প্রশ্ন তুলতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের তিন দফায় প্রধানমন্ত্রীর কুরসিতে বসা খালেদা জিয়া ৪৫ বছর পর পাকিস্তানের এই প্রোপাগান্ডায় শরিক হবেন কেন? কাকে কী মেসেজ দিতে চাইলেন তিনি? আর ভুল স্বীকার না করে কিছু কিছু পদলোভী বিএনপি নেতা যেভাবে খালেদা জিয়ার এই মারাত্মক ভুলকে বাহবা দিয়ে চলেছেন, সেটা কি আদতেই বিএনপির উপকার করছে? বিএনপির ভুলের পর ভুলের এই কাফেলায় বিচারপতি খায়রুল হককে টার্গেট করাটাও একটা বড় ভুল মনে করি।
বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের পর সংক্ষিপ্ত রায় লেখা এবং স্বাক্ষর করার বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির ঘোষিত অবস্থানকে অবলম্বন করে আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অদূর ভবিষ্যতে সংবিধানে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন এক্ষণে বিএনপির জন্য দিবাস্বপ্নের শামিল হবে। আর এই উদ্দেশ্যে বিচারপতি খায়রুল হককে যতই বিতর্কিত করা হোক না কেন, তিনি দেশবাসীর কাছে শ্রদ্ধাভাজনই থাকবেন।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments