বেতনবৃত্তান্ত by সৈয়দ আবুল মকসুদ
কিছুদিন যাবৎ বাংলার মাটিতে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ: বেতন। ড্রয়িংরুমে, সরকারি অফিসে, আদালতের সেরেস্তাখানায়, রেস্তোরাঁর টেবিলে, রাস্তার পাশের চা-দোকানে, তেমাথার বটতলায়, খেলার মাঠে, কসাইখানা থেকে শুঁড়িখানায়—কোথায় নেই বেতন নিয়ে আলোচনা। বাসে ও ট্রেনের কামরায় বসে যাত্রীরা ঝিমুনি বাদ দিয়ে বেতন নিয়ে আলোচনা করেন। গ্রামের হাটুরেরা হাটবারে বেচাকেনা করে বাড়ি ফেরার সময় আলোচনা করেন বেতন নিয়ে; তাঁদের নিজেদের বেতন-ভাতা বলে কিছু নেই, রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে কারা কত বেতন পান বা কার বেতন কত বাড়ল, তাই নিয়ে আলোচনা। মুদি দোকানদারের নিজের বেতনের প্রশ্ন আসে না, কিন্তু অন্যদের বেতন বাড়ার কথায় তাঁর খুশি সীমাহীন।
মুক্তবাজার অর্থনীতির মৌসুমে বাংলার মাটিতে সবকিছুর মাপকাঠি আজ বেতন। রাষ্ট্রের কল্যাণে কার কী অবদান তা নয়, কার বেতন কত, সেটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এমনকি যে কবির বেতন বেশি, তাঁর কবিতায় শিল্পগুণ যেমন বেশি, তাঁর কাব্যের কদরও বেশি। কার বেতন কত, তাই নিয়ে মুক্ত আলোচনার ফলে আজ বাংলার বহু পরিবারে বিপর্যয় পর্যন্ত দেখা দিয়েছে। যেমন ধরুন, আমাদের পরিচিত হেকতম আলী চৌধুরীর পরিবারের স্নায়ুযুদ্ধ।
চৌধুরী সাহেবের ফাটা কপাল। ছেলে নেই, চার-চারটে মেয়েকেই সুপাত্রে সমর্পণ করতে পেরেছেন। নিজে জেলা শহরে তিনতলা বাড়িতে থাকেন। তাঁর শরীর ৭৮ বছরেরও মাশাল্লাহ ভালো, কিন্তু স্ত্রীকে নিয়েই পেরেশানে থাকেন। ফরকুন্দা বেগম ছিলেন যুবতী বয়স থেকেই ভোজনরসিক। মিষ্টি-মাংসের প্রতি প্রবল ঝোঁক। আস্ত একটা মোরগের সিনা-রান গিলা-কলিজাসহ খেয়ে ফেলতেন। মেজো মেয়ে হওয়ার পরেই মুটিয়ে যান। অনেক দিন থেকে ডায়াবেটিসে ও হার্টের সমস্যায় মর-মর। হঠাৎ অবস্থা খারাপ। মেয়েদের কাছে মুহূর্তে মোবাইলে খবর যায়। চার মেয়েই স্বামীদের নিয়ে ছুটে আসেন। বড় মেয়ের জামাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। মেজো জামাই অতিরিক্ত সচিব। তৃতীয় মেয়ের স্বামী একটি প্রাইভেট ব্যাংকের (যে ব্যাংকের ঋণখেলাপির পরিমাণ বিপুল) ডিএমডি এবং ছোট জামাই সাবেক এমপি। তিনি প্রথম জীবনে জ্ঞানসাগর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। বিশেষ উপায়ে ডিগ্রিটা নেওয়ার পর সড়ক ও জনপথ বিভাগে সাব-কন্ট্রাকটারি করতেন। রাজনীতিতে ভালো করায় সংসদেও গিয়েছিলেন। শুল্কমুক্ত দামি গাড়ি হাঁকান। এখন রাজউকের প্লটে বাড়ি নির্মাণের কাজ চলছে। শাশুড়ির খবর শুনে বাড়ির বাথরুমের ফিটিংসের মালপত্র কেনা বাদ দিয়ে ছুটে এসেছেন।
চৌধুরী ভিলার সামনে মেজো, সেজো ও ছোট জামাইয়ের তিনটি দামি গাড়ি দাঁড়ানো। এমন সময় ভটভট শব্দ করে ইজিবাইক নিয়ে বড় জামাই ড. খালিদ বাহাউল্লাহ এলেন সস্ত্রীক। চৌধুরী সাহেব বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেয়েকে বললেন, তোমরা বাসস্ট্যান্ড থিকা ফোন করতা। একটা গাড়ি পাঠাইয়া দিতাম। ড. বাহাউল্লাহর শ্বশুরের কথা শুনে গা জ্বালা করে ওঠে। ভায়রার গাড়িতে উঠবেন!
রাষ্ট্রের সেবায় কে কত গুরুত্বপূর্ণ তার ওপর নির্ভর করে মর্যাদা, কে কত টাকা বেতন পান সেটা নয় বিপত্তি ঘটে রাতে খাবারের সময়। টেবিলে গিয়ে বসেন মেজো জামাই সচিব সমির শেখ, সেজো ডিএমডি জামশেদ তোফাদার এবং ছোট জামাই সাবেদ আলী সাবু। বড় জামাই আসেন না। কাজের মেয়েটি গিয়ে বলে, দুলাভাই-আপা আসেন। দুলাভাইরা বইয়া রইছে আপনেগো লাইগা। ড. বাহাউল্লাহ নিম্মিকে বলেন, বলে দাও এখন আমি খাব না। মাথা ধরেছে। রাতে এক গেলাস দুধ দিয়ো।
কাজের মেয়েটি চলে গেলে নিম্মি বলেন, খেয়ে নিলেই পারতা। তোমার মাথা ধরল কখন?
ড. বাহাউল্লাহ খুব নিচু স্তরে ধমকে ওঠেন, তোমার যদি সেই আক্কেল থাকত, তাহলে তোমার আব্বা আমার ঘাড়ে তোমাকে চাপাত না। তুমি জানো, ওই টেবিলে গিয়ে বসলেই বেতনের কথা উঠবে? সমির, জামশেদ, সাবু সবাই বেতনের প্রসঙ্গে ঘাঁটাঘাঁটি করবে।
প্রফেসর বিশেষভাবে শঙ্কিত ছিলেন তাঁর এক মামাশ্বশুরকে নিয়ে। ভদ্রলোক সারা জীবন কিছুই করেননি। ভগ্নিপতির ওপরই চলেছেন। বেশি কথা বলেন। কার বেতন কত—এই সব নিয়ে তাঁরই যত মাথাব্যথা। যা হোক, সবাই এক রকম না। পাশের বাড়ির দূরসম্পর্কের এক চাচিশাশুড়ি এলেন জামাইদের সঙ্গে দেখা করতে। সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। এখন রিটায়ার করেছেন। টেলিভিশন দেখেন। খবরের কাগজও পড়েন। কোথায় কারা কী দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেন, সে খবর রাখেন। বড় জামাইয়ের সঙ্গেই তাঁর অনেকক্ষণ কথা হয়। কথা প্রসঙ্গে একটি পুরোনো গল্প বড় দুলামিয়াকে স্মরণ করিয়ে দেন:
মোগল সম্রাট তাঁর ছেলেকে বিদ্যাশিক্ষা দিতে শিক্ষক রেখে দেন। একদিন সম্রাট দেখেন যুবরাজ তার ওস্তাদের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে আর ওস্তাদজি নিজের হাতে পা ধুচ্ছেন। তা দেখে সম্রাট ক্ষুব্ধ হন এবং পুত্রকে বকুনি দিয়ে বলেন, এটা স্রেফ বেয়াদবি। তুমি নিজের হাতে ওস্তাদজির পা ধুইয়ে দাও। এই কাহিনিতে শিক্ষকের মর্যাদার কথাই বলা হয়েছে।
বেতন হলো কর্মমূল্য। বেশি বেতনে ব্যক্তির আর্থিক সামর্থ্য বাড়ে, মর্যাদা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সত্যেন বসু, রমেশ মজুমদার যে বেতন পেতেন, তার চার গুণ বেশি পেতেন ঢাকা ডিএম—জেলা প্রশাসক। বাংলাদেশ বিমানের বিদেশি এমডি আমাদের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের বেতন-ভাতা যোগ দিলে যা হয়, তার দ্বিগুণের বেশি বেতন পান। প্রাইভেট ব্যাংকের অনেক এমডিও তাই। রাষ্ট্রের সেবায় কে কত গুরুত্বপূর্ণ, তার ওপর নির্ভর করে মর্যাদা, কে কত টাকা বেতন পান সেটা নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
মুক্তবাজার অর্থনীতির মৌসুমে বাংলার মাটিতে সবকিছুর মাপকাঠি আজ বেতন। রাষ্ট্রের কল্যাণে কার কী অবদান তা নয়, কার বেতন কত, সেটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এমনকি যে কবির বেতন বেশি, তাঁর কবিতায় শিল্পগুণ যেমন বেশি, তাঁর কাব্যের কদরও বেশি। কার বেতন কত, তাই নিয়ে মুক্ত আলোচনার ফলে আজ বাংলার বহু পরিবারে বিপর্যয় পর্যন্ত দেখা দিয়েছে। যেমন ধরুন, আমাদের পরিচিত হেকতম আলী চৌধুরীর পরিবারের স্নায়ুযুদ্ধ।
চৌধুরী সাহেবের ফাটা কপাল। ছেলে নেই, চার-চারটে মেয়েকেই সুপাত্রে সমর্পণ করতে পেরেছেন। নিজে জেলা শহরে তিনতলা বাড়িতে থাকেন। তাঁর শরীর ৭৮ বছরেরও মাশাল্লাহ ভালো, কিন্তু স্ত্রীকে নিয়েই পেরেশানে থাকেন। ফরকুন্দা বেগম ছিলেন যুবতী বয়স থেকেই ভোজনরসিক। মিষ্টি-মাংসের প্রতি প্রবল ঝোঁক। আস্ত একটা মোরগের সিনা-রান গিলা-কলিজাসহ খেয়ে ফেলতেন। মেজো মেয়ে হওয়ার পরেই মুটিয়ে যান। অনেক দিন থেকে ডায়াবেটিসে ও হার্টের সমস্যায় মর-মর। হঠাৎ অবস্থা খারাপ। মেয়েদের কাছে মুহূর্তে মোবাইলে খবর যায়। চার মেয়েই স্বামীদের নিয়ে ছুটে আসেন। বড় মেয়ের জামাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। মেজো জামাই অতিরিক্ত সচিব। তৃতীয় মেয়ের স্বামী একটি প্রাইভেট ব্যাংকের (যে ব্যাংকের ঋণখেলাপির পরিমাণ বিপুল) ডিএমডি এবং ছোট জামাই সাবেক এমপি। তিনি প্রথম জীবনে জ্ঞানসাগর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। বিশেষ উপায়ে ডিগ্রিটা নেওয়ার পর সড়ক ও জনপথ বিভাগে সাব-কন্ট্রাকটারি করতেন। রাজনীতিতে ভালো করায় সংসদেও গিয়েছিলেন। শুল্কমুক্ত দামি গাড়ি হাঁকান। এখন রাজউকের প্লটে বাড়ি নির্মাণের কাজ চলছে। শাশুড়ির খবর শুনে বাড়ির বাথরুমের ফিটিংসের মালপত্র কেনা বাদ দিয়ে ছুটে এসেছেন।
চৌধুরী ভিলার সামনে মেজো, সেজো ও ছোট জামাইয়ের তিনটি দামি গাড়ি দাঁড়ানো। এমন সময় ভটভট শব্দ করে ইজিবাইক নিয়ে বড় জামাই ড. খালিদ বাহাউল্লাহ এলেন সস্ত্রীক। চৌধুরী সাহেব বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেয়েকে বললেন, তোমরা বাসস্ট্যান্ড থিকা ফোন করতা। একটা গাড়ি পাঠাইয়া দিতাম। ড. বাহাউল্লাহর শ্বশুরের কথা শুনে গা জ্বালা করে ওঠে। ভায়রার গাড়িতে উঠবেন!
রাষ্ট্রের সেবায় কে কত গুরুত্বপূর্ণ তার ওপর নির্ভর করে মর্যাদা, কে কত টাকা বেতন পান সেটা নয় বিপত্তি ঘটে রাতে খাবারের সময়। টেবিলে গিয়ে বসেন মেজো জামাই সচিব সমির শেখ, সেজো ডিএমডি জামশেদ তোফাদার এবং ছোট জামাই সাবেদ আলী সাবু। বড় জামাই আসেন না। কাজের মেয়েটি গিয়ে বলে, দুলাভাই-আপা আসেন। দুলাভাইরা বইয়া রইছে আপনেগো লাইগা। ড. বাহাউল্লাহ নিম্মিকে বলেন, বলে দাও এখন আমি খাব না। মাথা ধরেছে। রাতে এক গেলাস দুধ দিয়ো।
কাজের মেয়েটি চলে গেলে নিম্মি বলেন, খেয়ে নিলেই পারতা। তোমার মাথা ধরল কখন?
ড. বাহাউল্লাহ খুব নিচু স্তরে ধমকে ওঠেন, তোমার যদি সেই আক্কেল থাকত, তাহলে তোমার আব্বা আমার ঘাড়ে তোমাকে চাপাত না। তুমি জানো, ওই টেবিলে গিয়ে বসলেই বেতনের কথা উঠবে? সমির, জামশেদ, সাবু সবাই বেতনের প্রসঙ্গে ঘাঁটাঘাঁটি করবে।
প্রফেসর বিশেষভাবে শঙ্কিত ছিলেন তাঁর এক মামাশ্বশুরকে নিয়ে। ভদ্রলোক সারা জীবন কিছুই করেননি। ভগ্নিপতির ওপরই চলেছেন। বেশি কথা বলেন। কার বেতন কত—এই সব নিয়ে তাঁরই যত মাথাব্যথা। যা হোক, সবাই এক রকম না। পাশের বাড়ির দূরসম্পর্কের এক চাচিশাশুড়ি এলেন জামাইদের সঙ্গে দেখা করতে। সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। এখন রিটায়ার করেছেন। টেলিভিশন দেখেন। খবরের কাগজও পড়েন। কোথায় কারা কী দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেন, সে খবর রাখেন। বড় জামাইয়ের সঙ্গেই তাঁর অনেকক্ষণ কথা হয়। কথা প্রসঙ্গে একটি পুরোনো গল্প বড় দুলামিয়াকে স্মরণ করিয়ে দেন:
মোগল সম্রাট তাঁর ছেলেকে বিদ্যাশিক্ষা দিতে শিক্ষক রেখে দেন। একদিন সম্রাট দেখেন যুবরাজ তার ওস্তাদের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে আর ওস্তাদজি নিজের হাতে পা ধুচ্ছেন। তা দেখে সম্রাট ক্ষুব্ধ হন এবং পুত্রকে বকুনি দিয়ে বলেন, এটা স্রেফ বেয়াদবি। তুমি নিজের হাতে ওস্তাদজির পা ধুইয়ে দাও। এই কাহিনিতে শিক্ষকের মর্যাদার কথাই বলা হয়েছে।
বেতন হলো কর্মমূল্য। বেশি বেতনে ব্যক্তির আর্থিক সামর্থ্য বাড়ে, মর্যাদা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সত্যেন বসু, রমেশ মজুমদার যে বেতন পেতেন, তার চার গুণ বেশি পেতেন ঢাকা ডিএম—জেলা প্রশাসক। বাংলাদেশ বিমানের বিদেশি এমডি আমাদের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের বেতন-ভাতা যোগ দিলে যা হয়, তার দ্বিগুণের বেশি বেতন পান। প্রাইভেট ব্যাংকের অনেক এমডিও তাই। রাষ্ট্রের সেবায় কে কত গুরুত্বপূর্ণ, তার ওপর নির্ভর করে মর্যাদা, কে কত টাকা বেতন পান সেটা নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
No comments