চাপের মুখে মানবাধিকার -এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদন by আনু মুহাম্মদ
বাংলাদেশের
মানুষ কতটা গণতান্ত্রিক পরিবেশে বাস করছে, তা বোঝার জন্য আমাদের
আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট দেখার অপেক্ষা করতে হয় না। নিজেদের
প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা আর নানা রকম হুমকি, হয়রানি, বিধিনিষেধ কিংবা আরোপিত
নিয়ন্ত্রণ (সেলফ সেন্সরশিপ) সত্ত্বেও গণমাধ্যমে যতটুকু খবর প্রকাশিত হয়,
তাতেই এটা স্পষ্ট যে মানবাধিকার লঙ্ঘনে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এখন প্রায়
অপ্রতিরোধ্য।
স্বাভাবিক চিন্তা-মত প্রকাশের পথ বন্ধ করার জন্য আইসিটি আইন দিয়ে ত্রাসের আবহাওয়া সৃষ্টি করা হয়েছে। সংবাদপত্র-টিভি চ্যানেল শুধু নয়, ফেসবুকও এখন চাপের মুখে। যেন মত প্রকাশ করতে না দিলে সেই মত সমাজ থেকে উবে যাবে! ফেসবুকে মন্তব্য করার জন্য একের পর এক আটক হচ্ছে, আবার কোনো কিছু না করেও আটক, গুম, খুন হচ্ছেন তরুণ যুবকেরা। গ্রেপ্তার, আটক, ক্রসফায়ার এখন শুধু নিপীড়নের নাম নয়, বাণিজ্যেরও বিষয়। অবিরাম ‘ক্রসফায়ারে’ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মানুষ মারা যাচ্ছে।
অন্যদিকে, সাত খুনের আসামি অসুস্থতার নামে বহাল তবিয়তে বাস করছেন হাসপাতালের আরামদায়ক কক্ষে। ত্বকীর খুনিসহ অনেক খুনির রক্ষায় নিয়োজিত আছে প্রশাসন। পথে, ঘরে, ঘাটে, বাজারে, প্রতিষ্ঠানে নারীর ওপর যৌন–সন্ত্রাস চলছেই। পাহাড়ে, সমতলে সংখ্যালঘু জাতি ও ধর্মের মানুষের ওপর হামলা-মামলা, জমি-সম্পত্তি দখলে কোনো বিরতি নেই। সাংসদসহ ÿক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধেই উঠছে ‘সংখ্যালঘু’দের জমি দখলের অভিযোগ। খুনি-লুটেরাদের বিরুদ্ধে কথা বললে আটক, ক্রসফায়ারের হুমকি। জমি-টাকা-প্রতিষ্ঠান দখল করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করছে সরকারি দলের বিভিন্ন পক্ষ।
এই পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুললে বলা হচ্ছে ‘উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র ছাড় দিতে হবে’। বারবার সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার দৃষ্টান্ত টানা হয়। সেসব দেশে কি জাতীয় সংস্থাকে ডুবিয়ে কমিশনের লোভে বিদেশি কোম্পানির হাতে দেশের সম্পদ তুলে দেওয়া হয়েছে? এসব দেশে কি ভিআইপি হলে যা খুশি তা-ই করা সম্ভব? এসব দেশে কি প্রতিষ্ঠানের বদলে জমিদারি স্বেচ্ছাচারিতা চলে? সেসব দেশে কি নদী-নালা খাল-বিল, পাহাড়—সবই দখলের বিষয়? সেখানে কি কতিপয়ের লোভ মেটানোর জন্য সুন্দরবনের মতো অনবায়নযোগ্য-অতুলনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে? সেখানে কি জ্বালানি খাতে দায়মুক্তি আইন দিয়ে সব অনিয়ম-দুর্নীতিকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে?
উন্নয়নের নামে একদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার ঘটে চলেছে; অন্যদিকে টাকার অভাবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, সড়ক, রেলওয়ে ধুঁকছে। বিশাল ব্যয়বহুল প্রকল্পকে সরকারের সাফল্য হিসেবে হাজির করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়াচ্ছে অস্বাভাবিক। বিশ্বের মধ্যে প্রতি কিলোমিটার সড়ক, ফ্লাইওভার, সেতুর খরচ এখন বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। এর জন্যই কি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পথে এত প্রতিবন্ধকতা?
বাংলাদেশে গত ৪৪ বছরে জিডিপি বেড়েছে বহুগুণ, বিপুল বিত্তশালী তৈরি হয়েছে, ভবনসহ সড়ক, গাড়ি, বাড়ি বেড়েছে অনেক। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও চর্চার বিকাশ ঘটেনি। গণতন্ত্র মানে যেমন শুধু ভোট দেওয়ার অধিকার বোঝায় না, উন্নয়ন বলতেও তেমনি শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি বোঝায় না। কিন্তু গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্ত সর্বজনীন ভোটাধিকারও এখন আক্রমণের মুখে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো, নৃশংসতার পক্ষে সমাজে নানা পক্ষ তৈরি করছে সম্মতি। কাউকে সন্ত্রাসী বললে ক্রসফায়ার, কাউকে চোর বললে নৃশংস নির্যাতন, কাউকে নাস্তিক বললে কুপিয়ে হত্যা—এসব কিছুর পক্ষে নানা যুক্তি সমাজে তৈরি করা হচ্ছে। অপরাধের জন্য আইন-বিচার, কথার উত্তর কথা, লেখার উত্তর লেখা—এতটুকু সহিষ্ণুতা আশা করাই যেন দিনে দিনে আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
অনেক সময়ই গণতন্ত্র হরণ করার পক্ষে উন্নয়ন ছাড়া আরেকটি যুক্তি দেওয়া হয় এভাবে যে ‘জঙ্গি’, ‘মৌলবাদী’, যুদ্ধাপরাধীদের থাবা থেকে দেশকে মুক্ত করতে কিছুদিনের জন্য গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ দরকার। ফলাফল হচ্ছে উল্টো। প্রকৃতপক্ষে অগণতান্ত্রিক, আর তার সুযোগে দখল-লুণ্ঠনের বিস্তার ঘটিয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তি দমন করা যায় না। দীর্ঘ মেয়াদে তা বরং অধিকতর অগণতান্ত্রিক শক্তিরই জায়গা তৈরি করে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) প্রতিবেদনে বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এই নেতিবাচক প্রতিবেদন আমাদের সবার জন্য লজ্জার। এই লজ্জা আরও বাড়ে দেশের মানবাধিকার কমিশনের অকার্যকর ভূমিকার কারণে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anujuniv@gmail.com
স্বাভাবিক চিন্তা-মত প্রকাশের পথ বন্ধ করার জন্য আইসিটি আইন দিয়ে ত্রাসের আবহাওয়া সৃষ্টি করা হয়েছে। সংবাদপত্র-টিভি চ্যানেল শুধু নয়, ফেসবুকও এখন চাপের মুখে। যেন মত প্রকাশ করতে না দিলে সেই মত সমাজ থেকে উবে যাবে! ফেসবুকে মন্তব্য করার জন্য একের পর এক আটক হচ্ছে, আবার কোনো কিছু না করেও আটক, গুম, খুন হচ্ছেন তরুণ যুবকেরা। গ্রেপ্তার, আটক, ক্রসফায়ার এখন শুধু নিপীড়নের নাম নয়, বাণিজ্যেরও বিষয়। অবিরাম ‘ক্রসফায়ারে’ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মানুষ মারা যাচ্ছে।
অন্যদিকে, সাত খুনের আসামি অসুস্থতার নামে বহাল তবিয়তে বাস করছেন হাসপাতালের আরামদায়ক কক্ষে। ত্বকীর খুনিসহ অনেক খুনির রক্ষায় নিয়োজিত আছে প্রশাসন। পথে, ঘরে, ঘাটে, বাজারে, প্রতিষ্ঠানে নারীর ওপর যৌন–সন্ত্রাস চলছেই। পাহাড়ে, সমতলে সংখ্যালঘু জাতি ও ধর্মের মানুষের ওপর হামলা-মামলা, জমি-সম্পত্তি দখলে কোনো বিরতি নেই। সাংসদসহ ÿক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধেই উঠছে ‘সংখ্যালঘু’দের জমি দখলের অভিযোগ। খুনি-লুটেরাদের বিরুদ্ধে কথা বললে আটক, ক্রসফায়ারের হুমকি। জমি-টাকা-প্রতিষ্ঠান দখল করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করছে সরকারি দলের বিভিন্ন পক্ষ।
এই পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুললে বলা হচ্ছে ‘উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র ছাড় দিতে হবে’। বারবার সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার দৃষ্টান্ত টানা হয়। সেসব দেশে কি জাতীয় সংস্থাকে ডুবিয়ে কমিশনের লোভে বিদেশি কোম্পানির হাতে দেশের সম্পদ তুলে দেওয়া হয়েছে? এসব দেশে কি ভিআইপি হলে যা খুশি তা-ই করা সম্ভব? এসব দেশে কি প্রতিষ্ঠানের বদলে জমিদারি স্বেচ্ছাচারিতা চলে? সেসব দেশে কি নদী-নালা খাল-বিল, পাহাড়—সবই দখলের বিষয়? সেখানে কি কতিপয়ের লোভ মেটানোর জন্য সুন্দরবনের মতো অনবায়নযোগ্য-অতুলনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে? সেখানে কি জ্বালানি খাতে দায়মুক্তি আইন দিয়ে সব অনিয়ম-দুর্নীতিকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে?
উন্নয়নের নামে একদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার ঘটে চলেছে; অন্যদিকে টাকার অভাবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, সড়ক, রেলওয়ে ধুঁকছে। বিশাল ব্যয়বহুল প্রকল্পকে সরকারের সাফল্য হিসেবে হাজির করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়াচ্ছে অস্বাভাবিক। বিশ্বের মধ্যে প্রতি কিলোমিটার সড়ক, ফ্লাইওভার, সেতুর খরচ এখন বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। এর জন্যই কি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পথে এত প্রতিবন্ধকতা?
বাংলাদেশে গত ৪৪ বছরে জিডিপি বেড়েছে বহুগুণ, বিপুল বিত্তশালী তৈরি হয়েছে, ভবনসহ সড়ক, গাড়ি, বাড়ি বেড়েছে অনেক। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও চর্চার বিকাশ ঘটেনি। গণতন্ত্র মানে যেমন শুধু ভোট দেওয়ার অধিকার বোঝায় না, উন্নয়ন বলতেও তেমনি শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি বোঝায় না। কিন্তু গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্ত সর্বজনীন ভোটাধিকারও এখন আক্রমণের মুখে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো, নৃশংসতার পক্ষে সমাজে নানা পক্ষ তৈরি করছে সম্মতি। কাউকে সন্ত্রাসী বললে ক্রসফায়ার, কাউকে চোর বললে নৃশংস নির্যাতন, কাউকে নাস্তিক বললে কুপিয়ে হত্যা—এসব কিছুর পক্ষে নানা যুক্তি সমাজে তৈরি করা হচ্ছে। অপরাধের জন্য আইন-বিচার, কথার উত্তর কথা, লেখার উত্তর লেখা—এতটুকু সহিষ্ণুতা আশা করাই যেন দিনে দিনে আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
অনেক সময়ই গণতন্ত্র হরণ করার পক্ষে উন্নয়ন ছাড়া আরেকটি যুক্তি দেওয়া হয় এভাবে যে ‘জঙ্গি’, ‘মৌলবাদী’, যুদ্ধাপরাধীদের থাবা থেকে দেশকে মুক্ত করতে কিছুদিনের জন্য গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ দরকার। ফলাফল হচ্ছে উল্টো। প্রকৃতপক্ষে অগণতান্ত্রিক, আর তার সুযোগে দখল-লুণ্ঠনের বিস্তার ঘটিয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তি দমন করা যায় না। দীর্ঘ মেয়াদে তা বরং অধিকতর অগণতান্ত্রিক শক্তিরই জায়গা তৈরি করে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) প্রতিবেদনে বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এই নেতিবাচক প্রতিবেদন আমাদের সবার জন্য লজ্জার। এই লজ্জা আরও বাড়ে দেশের মানবাধিকার কমিশনের অকার্যকর ভূমিকার কারণে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anujuniv@gmail.com
No comments