গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব সবার by হারুন-আর-রশিদ
মাঝে
মধ্যে আমার এলাকার একটি মুদির দোকান থেকে কেনাকাটা করি। দোকানদার বললেন-
আজকের পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার একটা খবর দেখুন। রাজশাহীর চারঘাটে বেশ ঘটা
করে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন কৃষক দলের বড়মাপের স্থানীয় এক নেতা। তার সাথে
শতাধিক লোক আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। দোকানদার বললেন, এ রকম যোগদানের খবর
প্রায় সময়ই কাগজে ওঠে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগেই যোগ দিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে
নাকি কয়েক ডজন আগুন বোমার মামলা। জান বাঁচানো ফরজ- তাই তারা কাজটি করছেন।
দোকানদার এক নিঃশ্বাসে এসব কথা যখন বলছিলেন, তখন আমরা কয়েকজন নিশ্চুপ।
একজন বললেন, অপজিশনে যারা রয়েছেন, সবার বিরুদ্ধেই মামলা। তারা মাঠে-ময়দানে কথা বলতে পারছেন না। রাস্তায় মিটিং-মিছিল করলে সরকারি দল হামলা চালিয়ে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে মামলার নিত্যনতুন নাটক সৃষ্টি করছে। সহযোগিতায় থাকছে বিভিন্ন বাহিনী। আরেকজন বললেন, এ রকম কথা এখন রাস্তাঘাটে চলার পথে আমরা সবাই শুনছি। কিন্তু এর সমাধান কোথায়? গণতন্ত্রকে উদ্ধারের জন্য শুধু যে বিএনপিকে একাই কাজ করতে হবে- এটা সঠিক নয়। গণতন্ত্র কোনো একটি দলের জন্য নয়, এর সুফল ভোগ করতে চাইলে সবাইকে প্রতিবাদমুখর হতে হবে। গণতন্ত্র রক্ষায় তৃণমূল পর্যায়ে সব গণমানুষকেই সক্রিয় হতে হবে। মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে কত দিন চলা যাবে? অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা না বললে পাপ। এ জন্য দায়ী তো আমরা সবাই কম-বেশি। ঘুষ, দুর্নীতি, গুম, খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, বিএসএফের হত্যাকাণ্ড, মাদক পাচার এসবের বিরুদ্ধে কথা বলা নৈতিক দায়িত্ব; অন্যথায় নিরীহ মানুষের অভিশাপ থেকে কেউ নিষ্কৃতি পাবে না। সব ধর্মেই এ কথা জোরালোভাবে উচ্চারিত হয়েছে। যা হোক, অনেকেই ভাবছেন, জানমাল রক্ষায় এখন আওয়ামী লীগে যোগদান ছাড়া বিকল্প নেই।
যেভাবে কথায় কথায় মামলা-হামলা গণহারে চলছে, তাতে সত্য কথা বলা মনে হয় সম্ভব নয়। অথচ সত্য কথা না বলাও পাপ বলে বিবেচিত। এখন আমরা দেশবাসী কোনটা বেছে নেব? সত্য পথ, না অন্যায় পথ- সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসে গেছে। যত বিলম্ব হবে দেশের ক্ষতি তত বাড়বে। গণতন্ত্রের মালিক তো শুধু ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল নয়, গণতন্ত্রের মূল মালিক দেশের জনগণ। জনগণের ভোটের মাধ্যমেই গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। জনগণ ভোট দিতে না পারলে গণতন্ত্র মৃত্যুবরণ করে। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। সেহেতু গণতন্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব বর্তায় জনগণের ওপর। দেশ পরিচালনায় সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য গণতন্ত্র জনগণের কাছে আমানতস্বরূপ। সুতরাং গণতন্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব শুধু রাজনৈতিক দলের নয়; মূল দায়িত্ব হলো জনগণের। সিল-ছাপ্পর মেরে ভুয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার অর্থই হলো, মূল গণতন্ত্রের জীবন্ত কবর দেয়া। দেশবাসীর দায়িত্ব এখন আসল গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করা, অন্যথায় ভুয়া গণতন্ত্রের ম্যাকিয়াভেলির মাধ্যমে দেশে ভুয়া প্রার্থীরা জনগণের কথিত প্রতিনিধি হয়ে সংসদে বসে ইচ্ছামতো আইন প্রণয়ন করবেন, আর তা জনগণ মেনে চলতে বাধ্য হবে। এটা কোনো সভ্য দেশে আছে বলে জানা নেই। উত্তরাধিকারতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সামরিক একনায়কতন্ত্র, এসবের সাথে গণতন্ত্রের কোনো সাদৃশ্য নেই। গণতন্ত্রের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে শুধু জনগণের। জনগণই গণতন্ত্রের মালিক। দেশের মালিকও তারা। প্রকৃত ভোটের মাধ্যমেই জনগণের প্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনার অধিকার পেয়ে থাকেন। সেই অধিকার যদি দেয়া না হয়- তাহলে পরবর্তী নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে জবাব দেয়াই হলো গণতন্ত্রের প্রতি সুবিচার। এই নিয়ম বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো। কিন্তু বাংলাদেশে বিগত ৪৪ বছর ধরে যে শাসনব্যবস্থা চলে আসছে, সে ক্ষেত্রে শুধু সেই নির্বাচন, যা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল- সেগুলো নিরপেক্ষ বলে স্বীকৃতি পেয়েছিল। আন্তর্জাতিক মহলেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। অন্য সব নির্বাচনই ছিল ভুয়া কিংবা বিতর্কিত।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গণতন্ত্রের যে ব্যবস্থার কথা আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, সেটা বর্তমানে অনেকটা নেই বললেই চলে। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে দীর্ঘ ৬৬ বছর পর এখন বলছে, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নই বেশি জরুরি এবং উন্নয়ন যেভাবে হবে, রাষ্ট্রযন্ত্র সেভাবেই পরিচালিত হবে। এ কথা তো পাকিস্তান আমলের একনায়ক জেনারেল আইয়ুবের উক্তি। কথিত উন্নয়ন দশক (১৯৫৮-১৯৬৮) পালনকালে পত্রিকায় দেখেছিলাম, তিনি বলেছিলেন, “পাকিস্তানের জন্য গণতন্ত্র উপযুক্ত বিধান নয়, ‘মৌলিক’ গণতন্ত্রই পাকিস্তানের জন্য প্রযোজ্য।” জনগণ নয়, ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার দ্বারা প্রতিনিধি নির্বাচিত করে স্বৈরাচারী আইয়ুব ১০ বছর দেশ শাসন করেছিলেন। তার এই দীর্ঘ সময় শাসনকালে দেশের দুই অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়নের ব্যাপকতা জাতি দেখতে পেয়েছিল। এরশাদের ৯ বছর স্বৈরশাসনকালেও বাংলাদেশে প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। গণতন্ত্র ছাড়াই সাবেক এ দুই জেনারেল দেশের প্রচুর উন্নয়ন করেছিলেন। বর্তমান সরকারও নিজ দলের মূল আদর্শ গণতন্ত্রকে কাটছাঁট করে দেশ পরিচালনা করছে বলে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও বলছেন। এখন প্রশ্ন- ব্রিটেন, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলো, অস্ট্রেলিয়া, পার্শ্ববর্তী ভারত, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ তাহলে কিভাবে গণতন্ত্রের মাধ্যমে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করল? তারা যদি গণতান্ত্রিক ধারাকে অনুসরণ করে দেশে সার্বিক উন্নয়ন সাধনে সক্ষম হয়, তাহলে বাংলাদেশ গণতন্ত্র কায়েম করে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে নিজেকে কেন শামিল করতে পারবে না?
সততা ও নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন করা বাংলাদেশেও সম্ভব। তখন গণতন্ত্র যেমন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে, তেমনি দেশও উন্নতির দিকে ধাবিত হবে। এখন গণতন্ত্রের নামে লুটপাট চলছে। বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন অনেকটা স্বেচ্ছাচারী কায়দায় চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে কারাগারে বিরোধী দলের বড় মাপের দুই নেতা মৃত্যুবরণ করেছেন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আছেন বিএনপির একডজনেরও বেশি কেন্দ্রীয় নেতা। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং রাজনীতিক মাহমুদুর রহমান মান্নার শারীরিক অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। দেশের আইন নিজস্ব গতিতে চলছে না বলে স্পষ্ট। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক চর্চার মাধ্যমে যদি দেশ চলতে দেয়া না হয়, কথা বললেই ধরপাকড়, মামলা-হামলার জালে আটকে দেয়া হয়; সেটাকে কখনোই গণতান্ত্রিক শাসন বলা যায় না। কেউ যদি মনে করে, সারাজীবন এভাবেই চালিয়ে যাবেন, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘ সময় ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনের পরও এর চরম করুণ পরিণতি ঘটেছে বারবার। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা মহাদেশেও এর নজির রয়েছে। অনিয়মের মাত্রা সহ্যসীমার বাইরে চলে গেলে এ অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। আল্লাহ পাক কুরআনে বহু জায়গায় বলেছেন, ‘সীমা লঙ্ঘন কোরো না, তিনি সীমা লঙ্ঘনকারীদের কঠিনভাবে পাকড়াও করেন।’
প্রথম আলো ৫-৭-১৫ তারিখে লিখেছে, একদলীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠা চেয়েছিল আওয়ামী লীগ- উইকিলিকসে সৌদি আরবের গোপন নথিতে এ কথা বলা হয়েছে। পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্য : মামলা থেকে বাঁচতে আওয়ামী লীগে যোগদান, তাহলে আইনের শাসন কোথায়। প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী (পররাষ্ট্র), আইনের চোখে পলাতক এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেও গ্রেফতার না করে কিভাবে ফুল দিয়ে বরণ করে দলে টেনে নিলেন- সেই অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ছিল। এ রকম আরেকটি নিউজ (৭-৭-১৫) পুলিশ ছেড়ে দেয়ার পরই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন চট্টগ্রামে এক রাজনৈতিক নেতা। তাহলে ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেয়ার অর্থ কি আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া? আওয়ামী লীগ তাহলে কি আইনের নিয়ন্ত্রক হয়ে গেছে- প্রশ্নটি ওঠা স্বাভাবিক। এ দিকে, আমরা নিত্যদিন মিথ্যা মামলা ও গ্রেফতারবাণিজ্য দেখে আসছি। এখন দেখছি দলীয় স্বার্থে মামলার আসামিকে সাদরে দলে নেয়ার মহড়াও।
লেখক : গ্রন্থকার ও কলামিস্ট
harunrashidar@gmail.com
একজন বললেন, অপজিশনে যারা রয়েছেন, সবার বিরুদ্ধেই মামলা। তারা মাঠে-ময়দানে কথা বলতে পারছেন না। রাস্তায় মিটিং-মিছিল করলে সরকারি দল হামলা চালিয়ে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে মামলার নিত্যনতুন নাটক সৃষ্টি করছে। সহযোগিতায় থাকছে বিভিন্ন বাহিনী। আরেকজন বললেন, এ রকম কথা এখন রাস্তাঘাটে চলার পথে আমরা সবাই শুনছি। কিন্তু এর সমাধান কোথায়? গণতন্ত্রকে উদ্ধারের জন্য শুধু যে বিএনপিকে একাই কাজ করতে হবে- এটা সঠিক নয়। গণতন্ত্র কোনো একটি দলের জন্য নয়, এর সুফল ভোগ করতে চাইলে সবাইকে প্রতিবাদমুখর হতে হবে। গণতন্ত্র রক্ষায় তৃণমূল পর্যায়ে সব গণমানুষকেই সক্রিয় হতে হবে। মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে কত দিন চলা যাবে? অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা না বললে পাপ। এ জন্য দায়ী তো আমরা সবাই কম-বেশি। ঘুষ, দুর্নীতি, গুম, খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, বিএসএফের হত্যাকাণ্ড, মাদক পাচার এসবের বিরুদ্ধে কথা বলা নৈতিক দায়িত্ব; অন্যথায় নিরীহ মানুষের অভিশাপ থেকে কেউ নিষ্কৃতি পাবে না। সব ধর্মেই এ কথা জোরালোভাবে উচ্চারিত হয়েছে। যা হোক, অনেকেই ভাবছেন, জানমাল রক্ষায় এখন আওয়ামী লীগে যোগদান ছাড়া বিকল্প নেই।
যেভাবে কথায় কথায় মামলা-হামলা গণহারে চলছে, তাতে সত্য কথা বলা মনে হয় সম্ভব নয়। অথচ সত্য কথা না বলাও পাপ বলে বিবেচিত। এখন আমরা দেশবাসী কোনটা বেছে নেব? সত্য পথ, না অন্যায় পথ- সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসে গেছে। যত বিলম্ব হবে দেশের ক্ষতি তত বাড়বে। গণতন্ত্রের মালিক তো শুধু ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল নয়, গণতন্ত্রের মূল মালিক দেশের জনগণ। জনগণের ভোটের মাধ্যমেই গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। জনগণ ভোট দিতে না পারলে গণতন্ত্র মৃত্যুবরণ করে। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। সেহেতু গণতন্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব বর্তায় জনগণের ওপর। দেশ পরিচালনায় সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য গণতন্ত্র জনগণের কাছে আমানতস্বরূপ। সুতরাং গণতন্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব শুধু রাজনৈতিক দলের নয়; মূল দায়িত্ব হলো জনগণের। সিল-ছাপ্পর মেরে ভুয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার অর্থই হলো, মূল গণতন্ত্রের জীবন্ত কবর দেয়া। দেশবাসীর দায়িত্ব এখন আসল গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করা, অন্যথায় ভুয়া গণতন্ত্রের ম্যাকিয়াভেলির মাধ্যমে দেশে ভুয়া প্রার্থীরা জনগণের কথিত প্রতিনিধি হয়ে সংসদে বসে ইচ্ছামতো আইন প্রণয়ন করবেন, আর তা জনগণ মেনে চলতে বাধ্য হবে। এটা কোনো সভ্য দেশে আছে বলে জানা নেই। উত্তরাধিকারতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সামরিক একনায়কতন্ত্র, এসবের সাথে গণতন্ত্রের কোনো সাদৃশ্য নেই। গণতন্ত্রের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে শুধু জনগণের। জনগণই গণতন্ত্রের মালিক। দেশের মালিকও তারা। প্রকৃত ভোটের মাধ্যমেই জনগণের প্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনার অধিকার পেয়ে থাকেন। সেই অধিকার যদি দেয়া না হয়- তাহলে পরবর্তী নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে জবাব দেয়াই হলো গণতন্ত্রের প্রতি সুবিচার। এই নিয়ম বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো। কিন্তু বাংলাদেশে বিগত ৪৪ বছর ধরে যে শাসনব্যবস্থা চলে আসছে, সে ক্ষেত্রে শুধু সেই নির্বাচন, যা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল- সেগুলো নিরপেক্ষ বলে স্বীকৃতি পেয়েছিল। আন্তর্জাতিক মহলেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। অন্য সব নির্বাচনই ছিল ভুয়া কিংবা বিতর্কিত।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গণতন্ত্রের যে ব্যবস্থার কথা আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, সেটা বর্তমানে অনেকটা নেই বললেই চলে। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে দীর্ঘ ৬৬ বছর পর এখন বলছে, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নই বেশি জরুরি এবং উন্নয়ন যেভাবে হবে, রাষ্ট্রযন্ত্র সেভাবেই পরিচালিত হবে। এ কথা তো পাকিস্তান আমলের একনায়ক জেনারেল আইয়ুবের উক্তি। কথিত উন্নয়ন দশক (১৯৫৮-১৯৬৮) পালনকালে পত্রিকায় দেখেছিলাম, তিনি বলেছিলেন, “পাকিস্তানের জন্য গণতন্ত্র উপযুক্ত বিধান নয়, ‘মৌলিক’ গণতন্ত্রই পাকিস্তানের জন্য প্রযোজ্য।” জনগণ নয়, ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার দ্বারা প্রতিনিধি নির্বাচিত করে স্বৈরাচারী আইয়ুব ১০ বছর দেশ শাসন করেছিলেন। তার এই দীর্ঘ সময় শাসনকালে দেশের দুই অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়নের ব্যাপকতা জাতি দেখতে পেয়েছিল। এরশাদের ৯ বছর স্বৈরশাসনকালেও বাংলাদেশে প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। গণতন্ত্র ছাড়াই সাবেক এ দুই জেনারেল দেশের প্রচুর উন্নয়ন করেছিলেন। বর্তমান সরকারও নিজ দলের মূল আদর্শ গণতন্ত্রকে কাটছাঁট করে দেশ পরিচালনা করছে বলে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও বলছেন। এখন প্রশ্ন- ব্রিটেন, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলো, অস্ট্রেলিয়া, পার্শ্ববর্তী ভারত, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ তাহলে কিভাবে গণতন্ত্রের মাধ্যমে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করল? তারা যদি গণতান্ত্রিক ধারাকে অনুসরণ করে দেশে সার্বিক উন্নয়ন সাধনে সক্ষম হয়, তাহলে বাংলাদেশ গণতন্ত্র কায়েম করে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে নিজেকে কেন শামিল করতে পারবে না?
সততা ও নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন করা বাংলাদেশেও সম্ভব। তখন গণতন্ত্র যেমন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে, তেমনি দেশও উন্নতির দিকে ধাবিত হবে। এখন গণতন্ত্রের নামে লুটপাট চলছে। বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন অনেকটা স্বেচ্ছাচারী কায়দায় চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে কারাগারে বিরোধী দলের বড় মাপের দুই নেতা মৃত্যুবরণ করেছেন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আছেন বিএনপির একডজনেরও বেশি কেন্দ্রীয় নেতা। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং রাজনীতিক মাহমুদুর রহমান মান্নার শারীরিক অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। দেশের আইন নিজস্ব গতিতে চলছে না বলে স্পষ্ট। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক চর্চার মাধ্যমে যদি দেশ চলতে দেয়া না হয়, কথা বললেই ধরপাকড়, মামলা-হামলার জালে আটকে দেয়া হয়; সেটাকে কখনোই গণতান্ত্রিক শাসন বলা যায় না। কেউ যদি মনে করে, সারাজীবন এভাবেই চালিয়ে যাবেন, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘ সময় ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনের পরও এর চরম করুণ পরিণতি ঘটেছে বারবার। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা মহাদেশেও এর নজির রয়েছে। অনিয়মের মাত্রা সহ্যসীমার বাইরে চলে গেলে এ অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। আল্লাহ পাক কুরআনে বহু জায়গায় বলেছেন, ‘সীমা লঙ্ঘন কোরো না, তিনি সীমা লঙ্ঘনকারীদের কঠিনভাবে পাকড়াও করেন।’
প্রথম আলো ৫-৭-১৫ তারিখে লিখেছে, একদলীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠা চেয়েছিল আওয়ামী লীগ- উইকিলিকসে সৌদি আরবের গোপন নথিতে এ কথা বলা হয়েছে। পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্য : মামলা থেকে বাঁচতে আওয়ামী লীগে যোগদান, তাহলে আইনের শাসন কোথায়। প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী (পররাষ্ট্র), আইনের চোখে পলাতক এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেও গ্রেফতার না করে কিভাবে ফুল দিয়ে বরণ করে দলে টেনে নিলেন- সেই অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ছিল। এ রকম আরেকটি নিউজ (৭-৭-১৫) পুলিশ ছেড়ে দেয়ার পরই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন চট্টগ্রামে এক রাজনৈতিক নেতা। তাহলে ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেয়ার অর্থ কি আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া? আওয়ামী লীগ তাহলে কি আইনের নিয়ন্ত্রক হয়ে গেছে- প্রশ্নটি ওঠা স্বাভাবিক। এ দিকে, আমরা নিত্যদিন মিথ্যা মামলা ও গ্রেফতারবাণিজ্য দেখে আসছি। এখন দেখছি দলীয় স্বার্থে মামলার আসামিকে সাদরে দলে নেয়ার মহড়াও।
লেখক : গ্রন্থকার ও কলামিস্ট
harunrashidar@gmail.com
No comments