অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে ভীতি কেন? by আমীর খসরু
আইন
যেখানে শাসন করে না সেখানে কোনো শাসন ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে না
এ্যারিস্টেটল (পলিটিকস্ ৪:৪) গণতন্ত্র কোনো খণ্ডিত বিষয় নয়, এটি
পুরোপুরিভাবেই একটি শাসন ব্যবস্থা। শুধুমাত্র একটি অংশ বাস্তবায়ন করার
মাধ্যমে গণতন্ত্র পুরোটা কায়েম হয়ে যাবে এমনটা কখনই হয় না। কিংবা মনের
গভীরে স্বৈরতন্ত্র লালন করে উপরে উপরে গণতন্ত্র বলে জিকির করলেও গণতন্ত্র
কায়েম হয়ে গেছে এমনটি মনে করারও কোনো যুক্তিগ্রাহ্য উপায় বা ক্ষেত্র নেই।
শাসন ব্যবস্থায় জনগণের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে গেলে তাই গণতন্ত্রের
সবটুকুই বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, শাসক শ্রেণী সব সময়ই
সূক্ষ্মভাবে অথবা স্থুলভাবে, নানা কৌশলে গণতন্ত্র এবং নির্বাচনকে একাকার ও
সমার্থক বানিয়ে ফেলেছে। নির্বাচন গণতন্ত্র বাস্তবায়নে প্রথম ধাপ মাত্র। এ
কারণে বর্তমানের অনেক দেশেই রাষ্ট্রটি গণতান্ত্রিক বলে শাসকদের পক্ষ থেকে
দাবি করা হলেও বা এমনটা আপাত প্রতীয়মান হলেও আসলে ওই রাষ্ট্রটি বা
রাষ্ট্রসমূহ পূর্ণ মাত্রার গণতান্ত্রিক নয়। প্রতিনিধিত্বশীল শাসনে
নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্থান এ কারণেই সংকটের সৃষ্টি
করেছে। সংকটটি এখানে যে, প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থায় অধিকাংশ মানুষের
প্রতিনিধিত্বশীলতা পুরো মাত্রায় নিশ্চিত করে না। তবে এ ব্যবস্থাটির একটি
ভালো দিক হচ্ছে অন্তত নির্দিষ্ট সময়ান্তে জনগণ তার ভোটের অধিকারকে প্রয়োগের
মধ্য দিয়ে নিদেনপক্ষে না বলার ক্ষমতাটুকু রাখে।
তারপরেও আমাদের মতো দেশে যাদের পূর্ণ মাত্রার গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নেই, রয়েছে নির্বাচনের ইতিহাস ও স্মৃতি তাদের জন্য অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন একেবারে কম কথা নয়। অন্তত মন্দের ভালো খুঁজে ফেরার একটা সুযোগ তৈরি হয় মাঝে মাঝে। তাও এখন নির্ভর করছে শাসকদের উপরে।
বেসামরিক কিংবা সামরিক শাসনামলে বাংলাদেশের নির্বাচনী গণতন্ত্রের ইতিহাস সুখকর তো নয়ই, বরং খুবই বেদনার, কষ্টের এবং নিদারুণ যন্ত্রণার। বেদনা, কষ্ট এবং যন্ত্রণার কারণ হচ্ছে সংবিধানে ভোটাধিকারের কথা লিপিবদ্ধ থাকলেও বাস্তবে হয় এর অনুপস্থিতি অথবা ভোট লুণ্ঠন। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টির আগের ইতিহাস যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাওয়া যাবে, পাকিস্তান আমলে নির্বাচনের ইতিহাস যাই বা রয়েছে তাও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেই। ১৯৭০-এর নির্বাচনটি একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হলেও এ কথাটি বলতেই হবে যে, ওই নির্বাচনটি যতোটা না ছিল নির্বাচন তার চেয়েও ঢের বেশি ছিল মানুষের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির একটি হাতিয়ার। ওই সময় এই নির্বাচনী বিষয়টিকে মানুষ ভিন্ন দৃষ্টিতেই দেখছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অতি স্বল্পকালেই শাসকদের মনোজগৎ অতীতের আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ১৯৭৩-এর নির্বাচনে ভোট কারচুপি, নির্বাচনের ফলাফল বদলের ধারাটির সূত্রপাত। যার পুনরাবৃত্তি পরবর্তীকালে ঘটেছে নব্বইয়ের স্বৈরাচারী এরশাদের পতন পর্যন্ত।
এদেশের মানুষের গণতন্ত্র প্রাপ্তি এবং এর সুফল ভোগ করার ইতিহাস না থাকলেও, এক্ষেত্রে বড় বড় হোঁচট খেয়ে কোমর ভাঙার ইতিহাস রয়েছে বেশুমার। ১৯৭৩ থেকে অসংখ্যবার এসব হোঁচটের ঘটনা ঘটেছে। এসব হোঁচটের ঘটনা ঘটেছে সামরিক শাসনামলে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট কিংবা বেসামরিক শাসনামলের ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মর্মার্থ ছিল এর বিপরীত। স্বাধীনতার আগে মানুষের মনে, চিন্তা-চেতনায় অসংখ্য আকাক্সক্ষার জন্ম নিয়েছিল, প্রত্যাশার জাল তারা বুনতে শুরু করেছিলেন দেশটি হবে পূর্ণমাত্রার গণতন্ত্র চর্চার এবং প্রাপ্তির, এই আকাক্সক্ষাটিই ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বলতম।
এরপরে দীর্ঘ বিরতি। ১৯৯০-এর পরেও জনগণের মনে আবার সেই প্রত্যাশার বুনন এবং বীজ বপনের উৎসব শুরু হয়। তবে এবারেও পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না এসে তার স্থান দখল করে নির্বাচনী গণতন্ত্র। এতেও মানুষ খুশি ছিল। ১৯৯১ থেকে নির্বাচনী গণতন্ত্র কিছুটা সচল হলেও সজীব, সতেজ, ফলবান এবং দীর্ঘজীবী হতে পারেনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে। আবারও হোঁচট খেতে শুরু করে মানুষ। কতো আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা আর যাতনা সহ্য করা যায়। তারপরেও মানুষের নিরন্তর প্রত্যাশার বীজ বপন বন্ধ হয়নি, তারা ক্ষান্ত দেননি, আশাবাদ পরিত্যাগ করেননি।
১৯৯০-এর পরে যে নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু হয়েছিল তাতে ঘুণ ধরতে বেশি সময় লাগেনি। একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, একটি দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে ওই ’৯০-এর পরেই। দ্বিদলীয় ব্যবস্থা ভালো সেই সমাজের জন্য যেখানে কি-না গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি সুদৃঢ়। কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে এর উল্টোটি। দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে এখানে দ্বিদলীয় ব্যবস্থাটি অনেকটা জাতিগত সংঘাতের মতোই রূপ নিয়েছে। অনেকেই বলে থাকেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতি রুয়ান্ডার হুতু এবং টুটসিদের জাতিগত সংঘাতের মতোই হয়ে পড়েছে। দুর্বল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সম্পন্ন সমাজ অগণতান্ত্রিক শক্তিকে উত্থানের পথ সুগম করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতা দখলে উদ্বুদ্ধ করে।
বিএনপি’র ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করলে এ কথাটি স্পষ্ট হয় যে, ওই সময়কালের শাসনে ক্ষমতাসীন বিএনপির ভেতরে জন্ম নেয় ক্ষমতার অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র। ক্ষমতার আনুষ্ঠানিক কেন্দ্রই যেখানে শক্তিশালী হওয়ার কথা সেখানে ওই অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র পুরো শাসন ব্যবস্থায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টিও উত্থাপিত হয়। ক্ষমতার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্রের যৌথ তত্ত্বাবধানে ধর্মীয় উগ্রবাদী শক্তিকেও মদত দেয়া হয়েছে। অপারেশন ক্লিনহার্টসহ নানা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে।
বিএনপির শাসনামলে ১৯৯৬ সালের ২০শে মার্চ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলেও ২০০১-২০০৬ সময়কালে তাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রচেষ্টাটি এমন ছিল যে, ওই ব্যবস্থার প্রতি তারা আর আস্থাশীল থাকতে পারেনি ক্ষমতার অসীম লিপ্সার কারণে। ২০০৬ সালে এসে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি নিয়ে এমন কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়, যা বিশাল রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দেয়। ওই সময়কালের দু’দলের রাজনৈতিক বৈরিতা এবং সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির কারণেই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পথকে উন্মুক্ত করে। ওই সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন ছিল যে, প্রধান দুই দল পারস্পরিকভাবে নিজেদের মধ্যে কেউ ক্ষমতায় না এসে তৃতীয় কোনো পক্ষ ক্ষমতায় আসুক এমনটাই মনে-প্রাণে চেয়েছে। এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, ওই সময়কালে যে রক্তক্ষয়ী পালটাপালটি লড়াই-সংগ্রাম হয়েছে রাজপথে তা পরবর্তীকালের সম্ভাবনাময় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুদূর পরাহত করেছে। বিএনপির বিরুদ্ধে ১৯৯৬-এ একটি ভোটারবিহীন এবং প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টিও রয়েছে। তবে বিএনপি বলছে, ওই নির্বাচনটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজনের জন্য সংবিধান সংশোধনী আনার লক্ষ্যে।
১৯৯০’র পরে মানুষের পুঞ্জীভূত আশাভঙ্গের যে বেদনা তাকে অবৈধ পুঁজি করে জনআকাক্সক্ষাকে বাদ দিয়ে দু’বছরের জন্য সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ওই যে মানুষের আকাক্সক্ষার কমতি নেই, প্রত্যাশার যে ঘাটতি নেই, সে সম্বলে বলিয়ান মানুষ অগণতান্ত্রিক শাসনকে ‘না’ বলে দিয়ে পুনর্বার গণতান্ত্রিক শাসনের প্রত্যাশা করেছে, কামনা করেছে পূর্ণ একটি গণতান্ত্রিক সমাজের। মানুষ ধারণা করেছিল, এবার পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। ২০০৮-এর নির্বাচনটিতে এ কারণেই প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে আগের তুলনায় অনেক অনেক গুণে বেশি আশাবাদের কথা শোনাতে হয়েছে, জানান দিতে হয়েছে নানা অঙ্গীকারের। কিন্তু সাধারণ মানুষ বুঝতেও পারেনি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হোঁচট খাওয়ার সময়কালে তারা প্রবেশ করছে।
২০০৯-এর শাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই এই দফায় ক্ষমতাসীনরা দুটো কারণে জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারগুলোকে প্রথম দিন থেকেই অগ্রাহ্য, অস্বীকার করতে শুরু করে। এর একটি কারণ বহির্দেশীয় সম্পর্ক উন্নয়ন এবং দ্বিতীয় কারণ ক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদে আঁকড়ে থাকার অদম্য বাসনা। এ কারণে তারা প্রথমদিন থেকেই একদিকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল, হত্যাসহ এ জাতীয় নানা কর্মকা- বাস্তবায়ন করতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভিন্ন আরেকটি বিষয় তারা বাস্তবায়ন করতে শুরু করে। আর এটি হচ্ছে, বিরোধী দল, মত, পথ, পক্ষ ও ব্যক্তিবর্গকে নির্মূল ও নিশ্চিহ্ন করার যাবতীয় প্রচেষ্টা গ্রহণ করা। রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণের প্রচেষ্টাটি শুরু হয় ক্ষমতা গ্রহণের পরমুহূর্ত থেকেই। আর এটা করা হয়েছে পরিকল্পনামাফিক এবং এখনও তা চলছে। বলা প্রয়োজন যে, এখানেই ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সময়কালের সঙ্গে বর্তমান আওয়ামী লীগ শাসনামলের পার্থক্য। আর অমিল ও পার্থক্যটি যোজন যোজন দূরত্বের হলেও এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই চায় না প্রতি পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের অপেক্ষা করতে এবং জনগণের রায়ের উপরে নির্ভরশীল হতে। এ কারণেই বর্তমানে নানা কর্মকাণ্ড চলছে। এ কাজগুলো যে একদিনে ঘটেছে বা ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঘটানো হয়েছে তা নয়, পরিকল্পনামাফিক তারা অগ্রসর হয়েছে এটি জনঅঙ্গীকার ও জনআকাংক্ষাকে অগ্রাহ্য করা হোক কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, অপহরণ, খুন, কথিত গণপিটুনিসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডই হোক। দেশের রাজনৈতিক প্রথা-প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতিসহ সামগ্রিকভাবে সমাজের সর্বক্ষেত্রে কি কি ক্ষতি হয়েছে তা আর বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাটিকে যে ভয়ের চোখে দেখে তার প্রমাণ এই সময়কালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো এসব নির্বাচন জাতীয় হোক কিংবা স্থানীয় পর্যায়েরই হোক। ২০১৪’র ৫ই জানুয়ারির ভোটারহীন, নজিরবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এর চূড়ান্ত সূচনা। আগেই বলা হয়েছে আওয়ামী লীগ সূক্ষ্মভাবে এবং কৌশলে এ কাজটি করেছে।
এ কথাটি সবারই মনে থাকার কথা যে, ক্ষমতা গ্রহণের স্বল্পকালের মধ্যেই আওয়ামী লীগ ১৯৭২-এর মূল সংবিধানে ফিরে যাবে বলে বেশ জোরেশোরে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছিল। তাদের দল ও দলের বাইরের বিবেকহীন বুদ্ধিজীবী শ্রেণীও একই সুরে গান গাইতে থাকে। ২০১১’র ৩০শে জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয় বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি সত্ত্বেও। কিন্তু ’৭২-এর সংবিধানে তারা ফিরে না গিয়ে বেশকিছু কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাদের মনের একান্ত বাসনাটি তারা পূরণ করে ফেলে। আর তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটিকে বাতিল করে দেয়া। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর মূল সংবিধানের সঙ্গে বৈপরীত্যমূলক ও সাংঘর্ষিক যে সব বিধান আনা হয়েছে সে সব বিষয়ে স্বল্প পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয় বিধায় তা আলোচনা করা হলো না।
অথচ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনের কারণেই সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযুক্ত করা হয়েছিল। জনগণ এর প্রতি সমর্থনও জানিয়েছিল। বর্তমানেও এর প্রতি সমর্থন আছে বলে আন্দাজ করা যায়। ২০১৩ সালের মে মাসে প্রথম আলো’র উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট পরিচালিত জনমত জরিপে দেখা যায় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চান ৯০ শতাংশ মানুষ। একই বছরের ১০ই অক্টোবর প্রকাশিত অপর এক জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৮২ শতাংশ মানুষ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে। পরবর্তীকালের জরিপগুলোতেও সাধারণ মানুষের একই আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে বলে দেখা যায়।
২০১৪’র ৫ই জানুয়ারি দেশি এবং ভারত বাদে অপরাপর বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর পরামর্শ, অনুরোধ উপেক্ষা করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয়। এ নির্বাচনের পরিকল্পনাটি যে হুট করে নেয়া হয়নি তা আগেই বলা হয়েছে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনটির আগে জাতিসংঘ বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোসহ বিদেশিরা সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। দেশের বিশিষ্টজনরাসহ সবাই চেয়েছিলেন সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। ২০১৩’র ১০ই অক্টোবর প্রথম আলো এক জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিল, ৭৩ শতাংশ মানুষ শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, সমঝোতা না হলে দেশে নৈরাজ্য শুরু হবে।
কিন্তু ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পরে যতো সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, এমন কি সদ্য অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই একই ধারায়। এই ধারাকে শক্তিশালীকরণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকেও করা হয়েছে দলীয় মনোনয়ন এবং প্রতীকনির্ভর।
কিন্তু নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান, অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করার কারণ কি সে বিষয়টি সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করা জরুরি। নির্বাচনে অনাস্থা ও অবিশ্বাস স্থাপনের কারণগুলো হচ্ছে শাসকদের মনোজগতে যখন এই বিশ্বাস দৃঢ় ও বদ্ধমূল হয় যে, জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আশা-আকাক্সক্ষা মুখ্য নয়, তাদের সর্বময় কর্তৃত্ব বিস্তারই মুখ্য তখন এ ধরনের ঘটনাবলী ঘটে থাকে।
গণতন্ত্র কোনো খ-িত বিষয় যেমন নয়, তেমনি এ শাসন ব্যবস্থাকে শাসকদের লালন-পালন ও পরিচর্যা করতে হয় পরম মমতায় এবং সার্বক্ষণিকভাবে। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী শাসকদের মনোস্তত্ত্ব হচ্ছে, এক এবং এককের শাসনই মুখ্য। এখানে জনগণ মুখ্য নয়, প্রধান বিষয় হচ্ছে ক্ষমতা। তবে এই মনোস্তত্ত্ব ভিন্ন কারণ যেমন, ভীতি থেকেও সৃষ্টি হতে পারে। শাসকদের এই মনোস্তাত্ত্বিক ও মনোজগতের বিষয়-আশয় তাকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে জনগণ থেকে। আর যতোই বিচ্ছিন্নতা বাড়বে ততোই নিজকে ছাড়িয়েও ভীতির সংস্কৃতিটি সমাজে বিস্তারিত হবে। জনগণের জীবনমান এবং উন্নয়নের কথা বলা হলেও এতে জনবিচ্ছিন্নতা যেমন কাটে না, তেমনি ভীতিও দূর হয় না। বরং ভীতির সংস্কৃতি সৃষ্টি করে নানা অনিবার্য সংকটের। এই সংকট থেকে জন্ম নেয় ভারসাম্যহীনতা। ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক শূন্যতা। এটি চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। এই দুষ্ট চক্রের মধ্যে পড়ে গেলে তা থেকে বের হওয়া খুবই কঠিন। ব্যক্তি যতোই জনবিচ্ছিন্ন হবে ততোই তাকে বেছে নিতে হবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার লক্ষ্যে নানা পথ এবং পন্থা তা যতো ভয়ঙ্করই হোক না কেন। এ এক ভয়ঙ্কর পথ। তারপরেও আশাবাদ রইলো নির্বাচনী আতঙ্ক কেটে যাবে, উন্মুক্ত হবে গণতন্ত্রের পথ। আর এটাই হচ্ছে ওই ভয়ঙ্কর পথ থেকে ফিরে আসার একমাত্র উপায়। (আমীর খসরু, সম্পাদক, আমাদের বুধবার ডটকম)।
তারপরেও আমাদের মতো দেশে যাদের পূর্ণ মাত্রার গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নেই, রয়েছে নির্বাচনের ইতিহাস ও স্মৃতি তাদের জন্য অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন একেবারে কম কথা নয়। অন্তত মন্দের ভালো খুঁজে ফেরার একটা সুযোগ তৈরি হয় মাঝে মাঝে। তাও এখন নির্ভর করছে শাসকদের উপরে।
বেসামরিক কিংবা সামরিক শাসনামলে বাংলাদেশের নির্বাচনী গণতন্ত্রের ইতিহাস সুখকর তো নয়ই, বরং খুবই বেদনার, কষ্টের এবং নিদারুণ যন্ত্রণার। বেদনা, কষ্ট এবং যন্ত্রণার কারণ হচ্ছে সংবিধানে ভোটাধিকারের কথা লিপিবদ্ধ থাকলেও বাস্তবে হয় এর অনুপস্থিতি অথবা ভোট লুণ্ঠন। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টির আগের ইতিহাস যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাওয়া যাবে, পাকিস্তান আমলে নির্বাচনের ইতিহাস যাই বা রয়েছে তাও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেই। ১৯৭০-এর নির্বাচনটি একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হলেও এ কথাটি বলতেই হবে যে, ওই নির্বাচনটি যতোটা না ছিল নির্বাচন তার চেয়েও ঢের বেশি ছিল মানুষের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির একটি হাতিয়ার। ওই সময় এই নির্বাচনী বিষয়টিকে মানুষ ভিন্ন দৃষ্টিতেই দেখছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অতি স্বল্পকালেই শাসকদের মনোজগৎ অতীতের আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ১৯৭৩-এর নির্বাচনে ভোট কারচুপি, নির্বাচনের ফলাফল বদলের ধারাটির সূত্রপাত। যার পুনরাবৃত্তি পরবর্তীকালে ঘটেছে নব্বইয়ের স্বৈরাচারী এরশাদের পতন পর্যন্ত।
এদেশের মানুষের গণতন্ত্র প্রাপ্তি এবং এর সুফল ভোগ করার ইতিহাস না থাকলেও, এক্ষেত্রে বড় বড় হোঁচট খেয়ে কোমর ভাঙার ইতিহাস রয়েছে বেশুমার। ১৯৭৩ থেকে অসংখ্যবার এসব হোঁচটের ঘটনা ঘটেছে। এসব হোঁচটের ঘটনা ঘটেছে সামরিক শাসনামলে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট কিংবা বেসামরিক শাসনামলের ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মর্মার্থ ছিল এর বিপরীত। স্বাধীনতার আগে মানুষের মনে, চিন্তা-চেতনায় অসংখ্য আকাক্সক্ষার জন্ম নিয়েছিল, প্রত্যাশার জাল তারা বুনতে শুরু করেছিলেন দেশটি হবে পূর্ণমাত্রার গণতন্ত্র চর্চার এবং প্রাপ্তির, এই আকাক্সক্ষাটিই ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বলতম।
এরপরে দীর্ঘ বিরতি। ১৯৯০-এর পরেও জনগণের মনে আবার সেই প্রত্যাশার বুনন এবং বীজ বপনের উৎসব শুরু হয়। তবে এবারেও পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না এসে তার স্থান দখল করে নির্বাচনী গণতন্ত্র। এতেও মানুষ খুশি ছিল। ১৯৯১ থেকে নির্বাচনী গণতন্ত্র কিছুটা সচল হলেও সজীব, সতেজ, ফলবান এবং দীর্ঘজীবী হতে পারেনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে। আবারও হোঁচট খেতে শুরু করে মানুষ। কতো আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা আর যাতনা সহ্য করা যায়। তারপরেও মানুষের নিরন্তর প্রত্যাশার বীজ বপন বন্ধ হয়নি, তারা ক্ষান্ত দেননি, আশাবাদ পরিত্যাগ করেননি।
১৯৯০-এর পরে যে নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু হয়েছিল তাতে ঘুণ ধরতে বেশি সময় লাগেনি। একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, একটি দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে ওই ’৯০-এর পরেই। দ্বিদলীয় ব্যবস্থা ভালো সেই সমাজের জন্য যেখানে কি-না গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি সুদৃঢ়। কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে এর উল্টোটি। দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে এখানে দ্বিদলীয় ব্যবস্থাটি অনেকটা জাতিগত সংঘাতের মতোই রূপ নিয়েছে। অনেকেই বলে থাকেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতি রুয়ান্ডার হুতু এবং টুটসিদের জাতিগত সংঘাতের মতোই হয়ে পড়েছে। দুর্বল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সম্পন্ন সমাজ অগণতান্ত্রিক শক্তিকে উত্থানের পথ সুগম করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতা দখলে উদ্বুদ্ধ করে।
বিএনপি’র ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করলে এ কথাটি স্পষ্ট হয় যে, ওই সময়কালের শাসনে ক্ষমতাসীন বিএনপির ভেতরে জন্ম নেয় ক্ষমতার অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র। ক্ষমতার আনুষ্ঠানিক কেন্দ্রই যেখানে শক্তিশালী হওয়ার কথা সেখানে ওই অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র পুরো শাসন ব্যবস্থায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টিও উত্থাপিত হয়। ক্ষমতার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্রের যৌথ তত্ত্বাবধানে ধর্মীয় উগ্রবাদী শক্তিকেও মদত দেয়া হয়েছে। অপারেশন ক্লিনহার্টসহ নানা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে।
বিএনপির শাসনামলে ১৯৯৬ সালের ২০শে মার্চ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলেও ২০০১-২০০৬ সময়কালে তাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রচেষ্টাটি এমন ছিল যে, ওই ব্যবস্থার প্রতি তারা আর আস্থাশীল থাকতে পারেনি ক্ষমতার অসীম লিপ্সার কারণে। ২০০৬ সালে এসে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি নিয়ে এমন কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়, যা বিশাল রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দেয়। ওই সময়কালের দু’দলের রাজনৈতিক বৈরিতা এবং সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির কারণেই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পথকে উন্মুক্ত করে। ওই সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন ছিল যে, প্রধান দুই দল পারস্পরিকভাবে নিজেদের মধ্যে কেউ ক্ষমতায় না এসে তৃতীয় কোনো পক্ষ ক্ষমতায় আসুক এমনটাই মনে-প্রাণে চেয়েছে। এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, ওই সময়কালে যে রক্তক্ষয়ী পালটাপালটি লড়াই-সংগ্রাম হয়েছে রাজপথে তা পরবর্তীকালের সম্ভাবনাময় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুদূর পরাহত করেছে। বিএনপির বিরুদ্ধে ১৯৯৬-এ একটি ভোটারবিহীন এবং প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টিও রয়েছে। তবে বিএনপি বলছে, ওই নির্বাচনটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজনের জন্য সংবিধান সংশোধনী আনার লক্ষ্যে।
১৯৯০’র পরে মানুষের পুঞ্জীভূত আশাভঙ্গের যে বেদনা তাকে অবৈধ পুঁজি করে জনআকাক্সক্ষাকে বাদ দিয়ে দু’বছরের জন্য সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ওই যে মানুষের আকাক্সক্ষার কমতি নেই, প্রত্যাশার যে ঘাটতি নেই, সে সম্বলে বলিয়ান মানুষ অগণতান্ত্রিক শাসনকে ‘না’ বলে দিয়ে পুনর্বার গণতান্ত্রিক শাসনের প্রত্যাশা করেছে, কামনা করেছে পূর্ণ একটি গণতান্ত্রিক সমাজের। মানুষ ধারণা করেছিল, এবার পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। ২০০৮-এর নির্বাচনটিতে এ কারণেই প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে আগের তুলনায় অনেক অনেক গুণে বেশি আশাবাদের কথা শোনাতে হয়েছে, জানান দিতে হয়েছে নানা অঙ্গীকারের। কিন্তু সাধারণ মানুষ বুঝতেও পারেনি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হোঁচট খাওয়ার সময়কালে তারা প্রবেশ করছে।
২০০৯-এর শাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই এই দফায় ক্ষমতাসীনরা দুটো কারণে জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারগুলোকে প্রথম দিন থেকেই অগ্রাহ্য, অস্বীকার করতে শুরু করে। এর একটি কারণ বহির্দেশীয় সম্পর্ক উন্নয়ন এবং দ্বিতীয় কারণ ক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদে আঁকড়ে থাকার অদম্য বাসনা। এ কারণে তারা প্রথমদিন থেকেই একদিকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল, হত্যাসহ এ জাতীয় নানা কর্মকা- বাস্তবায়ন করতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভিন্ন আরেকটি বিষয় তারা বাস্তবায়ন করতে শুরু করে। আর এটি হচ্ছে, বিরোধী দল, মত, পথ, পক্ষ ও ব্যক্তিবর্গকে নির্মূল ও নিশ্চিহ্ন করার যাবতীয় প্রচেষ্টা গ্রহণ করা। রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণের প্রচেষ্টাটি শুরু হয় ক্ষমতা গ্রহণের পরমুহূর্ত থেকেই। আর এটা করা হয়েছে পরিকল্পনামাফিক এবং এখনও তা চলছে। বলা প্রয়োজন যে, এখানেই ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সময়কালের সঙ্গে বর্তমান আওয়ামী লীগ শাসনামলের পার্থক্য। আর অমিল ও পার্থক্যটি যোজন যোজন দূরত্বের হলেও এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই চায় না প্রতি পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের অপেক্ষা করতে এবং জনগণের রায়ের উপরে নির্ভরশীল হতে। এ কারণেই বর্তমানে নানা কর্মকাণ্ড চলছে। এ কাজগুলো যে একদিনে ঘটেছে বা ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঘটানো হয়েছে তা নয়, পরিকল্পনামাফিক তারা অগ্রসর হয়েছে এটি জনঅঙ্গীকার ও জনআকাংক্ষাকে অগ্রাহ্য করা হোক কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, অপহরণ, খুন, কথিত গণপিটুনিসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডই হোক। দেশের রাজনৈতিক প্রথা-প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতিসহ সামগ্রিকভাবে সমাজের সর্বক্ষেত্রে কি কি ক্ষতি হয়েছে তা আর বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাটিকে যে ভয়ের চোখে দেখে তার প্রমাণ এই সময়কালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো এসব নির্বাচন জাতীয় হোক কিংবা স্থানীয় পর্যায়েরই হোক। ২০১৪’র ৫ই জানুয়ারির ভোটারহীন, নজিরবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এর চূড়ান্ত সূচনা। আগেই বলা হয়েছে আওয়ামী লীগ সূক্ষ্মভাবে এবং কৌশলে এ কাজটি করেছে।
এ কথাটি সবারই মনে থাকার কথা যে, ক্ষমতা গ্রহণের স্বল্পকালের মধ্যেই আওয়ামী লীগ ১৯৭২-এর মূল সংবিধানে ফিরে যাবে বলে বেশ জোরেশোরে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছিল। তাদের দল ও দলের বাইরের বিবেকহীন বুদ্ধিজীবী শ্রেণীও একই সুরে গান গাইতে থাকে। ২০১১’র ৩০শে জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয় বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি সত্ত্বেও। কিন্তু ’৭২-এর সংবিধানে তারা ফিরে না গিয়ে বেশকিছু কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাদের মনের একান্ত বাসনাটি তারা পূরণ করে ফেলে। আর তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটিকে বাতিল করে দেয়া। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর মূল সংবিধানের সঙ্গে বৈপরীত্যমূলক ও সাংঘর্ষিক যে সব বিধান আনা হয়েছে সে সব বিষয়ে স্বল্প পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয় বিধায় তা আলোচনা করা হলো না।
অথচ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনের কারণেই সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযুক্ত করা হয়েছিল। জনগণ এর প্রতি সমর্থনও জানিয়েছিল। বর্তমানেও এর প্রতি সমর্থন আছে বলে আন্দাজ করা যায়। ২০১৩ সালের মে মাসে প্রথম আলো’র উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট পরিচালিত জনমত জরিপে দেখা যায় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চান ৯০ শতাংশ মানুষ। একই বছরের ১০ই অক্টোবর প্রকাশিত অপর এক জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৮২ শতাংশ মানুষ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে। পরবর্তীকালের জরিপগুলোতেও সাধারণ মানুষের একই আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে বলে দেখা যায়।
২০১৪’র ৫ই জানুয়ারি দেশি এবং ভারত বাদে অপরাপর বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর পরামর্শ, অনুরোধ উপেক্ষা করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয়। এ নির্বাচনের পরিকল্পনাটি যে হুট করে নেয়া হয়নি তা আগেই বলা হয়েছে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনটির আগে জাতিসংঘ বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোসহ বিদেশিরা সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। দেশের বিশিষ্টজনরাসহ সবাই চেয়েছিলেন সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। ২০১৩’র ১০ই অক্টোবর প্রথম আলো এক জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিল, ৭৩ শতাংশ মানুষ শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, সমঝোতা না হলে দেশে নৈরাজ্য শুরু হবে।
কিন্তু ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পরে যতো সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, এমন কি সদ্য অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই একই ধারায়। এই ধারাকে শক্তিশালীকরণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকেও করা হয়েছে দলীয় মনোনয়ন এবং প্রতীকনির্ভর।
কিন্তু নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান, অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করার কারণ কি সে বিষয়টি সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করা জরুরি। নির্বাচনে অনাস্থা ও অবিশ্বাস স্থাপনের কারণগুলো হচ্ছে শাসকদের মনোজগতে যখন এই বিশ্বাস দৃঢ় ও বদ্ধমূল হয় যে, জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আশা-আকাক্সক্ষা মুখ্য নয়, তাদের সর্বময় কর্তৃত্ব বিস্তারই মুখ্য তখন এ ধরনের ঘটনাবলী ঘটে থাকে।
গণতন্ত্র কোনো খ-িত বিষয় যেমন নয়, তেমনি এ শাসন ব্যবস্থাকে শাসকদের লালন-পালন ও পরিচর্যা করতে হয় পরম মমতায় এবং সার্বক্ষণিকভাবে। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী শাসকদের মনোস্তত্ত্ব হচ্ছে, এক এবং এককের শাসনই মুখ্য। এখানে জনগণ মুখ্য নয়, প্রধান বিষয় হচ্ছে ক্ষমতা। তবে এই মনোস্তত্ত্ব ভিন্ন কারণ যেমন, ভীতি থেকেও সৃষ্টি হতে পারে। শাসকদের এই মনোস্তাত্ত্বিক ও মনোজগতের বিষয়-আশয় তাকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে জনগণ থেকে। আর যতোই বিচ্ছিন্নতা বাড়বে ততোই নিজকে ছাড়িয়েও ভীতির সংস্কৃতিটি সমাজে বিস্তারিত হবে। জনগণের জীবনমান এবং উন্নয়নের কথা বলা হলেও এতে জনবিচ্ছিন্নতা যেমন কাটে না, তেমনি ভীতিও দূর হয় না। বরং ভীতির সংস্কৃতি সৃষ্টি করে নানা অনিবার্য সংকটের। এই সংকট থেকে জন্ম নেয় ভারসাম্যহীনতা। ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক শূন্যতা। এটি চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। এই দুষ্ট চক্রের মধ্যে পড়ে গেলে তা থেকে বের হওয়া খুবই কঠিন। ব্যক্তি যতোই জনবিচ্ছিন্ন হবে ততোই তাকে বেছে নিতে হবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার লক্ষ্যে নানা পথ এবং পন্থা তা যতো ভয়ঙ্করই হোক না কেন। এ এক ভয়ঙ্কর পথ। তারপরেও আশাবাদ রইলো নির্বাচনী আতঙ্ক কেটে যাবে, উন্মুক্ত হবে গণতন্ত্রের পথ। আর এটাই হচ্ছে ওই ভয়ঙ্কর পথ থেকে ফিরে আসার একমাত্র উপায়। (আমীর খসরু, সম্পাদক, আমাদের বুধবার ডটকম)।
No comments