সব জয় জয় নয়, সব পরাজয় পরাজয় নয় by বিমল সরকার
সব জয় জয় নয়। সব পরাজয়ও পরাজয় নয়। এমন অনেক জয় আছে যা কিনা পরাজয়েরই শামিল, এমনকি পরাজয়ের চেয়েও গ্লানিকর। আবার এমনও পরাজয় আছে যা জয়ের চেয়েও অধিকতর আনন্দ ও স্বস্তিদায়ক। এজন্যই বোধকরি কবি বলেছেন, ‘... একচ্ছত্র জয় নেই নেই কোনো জয়ী/বিজয়ী বিজিত কভু বিজিত বিজয়ী।’ আজ থেকে আনুমানিক দুই দশক আগে প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রয়াত সন্তোষ গুপ্ত তৎকালীন বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক ‘সংবাদে’ অনিরুদ্ধ ছদ্মনামে তার নিয়মিত লেখা কলামের শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘বর্তমান ইতিহাসের শেষ মিছিল নয়।’ শ্রদ্ধাভাজন সন্তোষদার লেখার শিরোনামটির কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। যে কোনো উপায়ে বিজয়ী হতে হবে কিংবা নিজেকে বিজয়ী করতে হবে এ প্রবণতা যে মানুষের জীবনে কত দুঃখ-দুর্দশা, অস্বস্তি-অশান্তি এবং বিড়ম্বনার কারণ তা বোধকরি সমাজবিজ্ঞানীরাও সহজে বলে শেষ করতে পারবেন না। বিজয়ের আনন্দ বরাবরই ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু অস্বস্তির যাতনা কি মন থেকে ইচ্ছা করলেই সরানো যায়, নাকি সরে? উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী কিশোর কুমারের গাওয়া গানটির কথা এ মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে- গায়ের জোরে সবই কিছু কেড়ে নেয়া যায়। পয়সা-কড়ি, গয়নাগাঁটি; কিন্তু ভালবাসা?
মহাসমারোহে, বলতে গেলে ধুমধামের সঙ্গেই ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়ে গেল দেশব্যাপী ২৩৪টি পৌরসভা নির্বাচন। অবশ্য শুরুটা যেভাবে হয়েছিল শেষটা তেমন হয়নি। সুষ্ঠু, সুশৃংখল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সহিংসতা, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ, জাল-জালিয়াতি এসব কিছুও হয়েছে কম-বেশি। সারা দেশেই সংঘটিত কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নির্বাচনকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মেয়র, সংরক্ষিত (মহিলা) কাউন্সিলর এবং সাধারণ কাউন্সিলর প্রত্যেকটি পদের বিপরীতে দুইজন, তিন-চারজন, পাঁচ-ছয়জন, এমনকি পৌরসভা কিংবা ওয়ার্ড বিশেষে আরও বেশি সংখ্যক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। প্রায় মাসব্যাপী চালানো প্রচার-প্রচারণা, সভা-সমাবেশ এবং মিছিল-স্লোগান কোনো কিছুরই কমতি ছিল না নির্বাচনে। পৌর নির্বাচন ঘিরে উৎসাহ-উদ্দীপনার পাশাপাশি জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে আবেগ-উত্তেজনা ছিল না একথা বলা যাবে না। তা সত্ত্বেও স্বাভাবিকভাবেই বেশিরভাগ প্রার্থীকে পরাজয়কেই বরণ করে নিতে হয়েছে। অনেক পৌরসভায় সুন্দর, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব স্থানে পরাজিত সব প্রার্থী নির্বাচনের ফলাফল এবং নিজেদের পরাজয়কে সহজে মেনে নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু যেখানে জোরজবরদস্তি, জাল-জালিয়াতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা এবং কৌশল করে প্রার্থীকে হারানো হয়েছে তারা সেটাকে মেনে নেবেন এটি কী করে আশা করা যায় বিপত্তির বড় কারণ সেখানেই। এখানে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি নেই। দলীয় আর বিদ্রোহীতেও ব্যবধান নেই। যে যেখানে পেরেছেন, ‘কাজ’ সেরে নিয়েছেন। প্রশাসন এবং আইনশৃংখলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা সবাই সমান দক্ষ, সাহসী, সৎ ও দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত নন। তাদের দুর্বলতার ফাঁক দিয়ে এ সুযোগটি মতলববাজরা গ্রহণ করেছেন। এতকিছুর পরও মোটামুটি ভালোয় ভালোয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এটাই বড় কথা। অন্যান্য নির্বাচনের মতো বুধবার অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো সহিংসতা ঘটেনি।
দেশে প্রথমবারের মতো এবার পৌরসভার মেয়র পদটিকে আইনগতভাবে দলীয়করণ করা হল। রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন এবং প্রতীক নিয়ে এবার মেয়র প্রার্থীদের লড়তে হয়েছে। মাঠে লড়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও। এক একজন প্রার্থী দলের মনোনয়ন ও প্রতীক নিয়ে নির্বাচনযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে দলের ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল করেছেন, পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী দলীয় প্রার্থীর কাছে গো-হারা হেরে সবার কাছে সম্মানহানিও ঘটিয়েছেন। কেবল প্রার্থী নয়, দলগুলোর ভাবমূর্তিরও মোটামুটি বিচার হয়ে গেছে নির্বাচনী জনআদালতে। আর মনোনীত প্রার্থী যেমন-তেমন, বড় দল দুটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে শিক্ষা পেয়েছে এ নির্বাচন থেকে তা-ও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। দলের মনোনীত নয়, বরং বিদ্রোহী ও দল থেকে বহিষ্কৃত প্রার্থী কতল করেছে প্রতিপক্ষীয় প্রার্থীর দম্ভ! বেশ কয়েকটি পৌরসভায় উভয় দলের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে। দলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান চরম অন্তর্বিরোধ, মনোনয়ন দেয়ার বেলায় জেদ, তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্ব, কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতার অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং স্বার্থপরতাই প্রধানত এসব কিছুর জন্য দায়ী। বিদ্রোহী প্রার্থীদের এহেন সাফল্যকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ তো নেই-ই, উপরন্তু এতে বড় দলগুলোর ভেতরকার অন্তঃসারশূন্যতার চিত্রটিই সর্বসমক্ষে নতুন করে ফুটে উঠেছে।
যে করেই হোক, পৌর নির্বাচন হয়ে গেছে। আরও নির্বাচন বাকি আছে। যিনি আজ হেরে গেছেন, হেরে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন বলে ভাবছেন; একবার চিন্তা করুন তো, আপনি যদি বিজয়ী হতেন তাহলে প্রতিপক্ষের কী অবস্থা হতো। আপনার আস্ফালনে বিজিত পক্ষ সারাক্ষণ তটস্থ থাকত না কি? অতএব বিজয়ী ও বিজিত আসুন সবাই এবার আমরা সামনের দিকে তাকাই। পরস্পরের বিরুদ্ধে হুমকি-ধমকি, মামলা-মোকদ্দমা এবং প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবণতা পরিহার করি। আবারও বলি, সব আনন্দ আনন্দ নয়। সব জয় জয় নয়। ক্ষমতা যেমন কারোরই চিরস্থায়ী কিছু নয়, তেমনি মনে রাখতে হবে বর্তমানও ইতিহাসের শেষ মিছিল নয়। সদ্যসমাপ্ত পৌর নির্বাচন থেকে আশা করি সরকার, নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং রাজনৈতিক দলসহ প্রত্যেকেই নতুন করে শিক্ষালাভ করে ভবিষ্যতে সুন্দর, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা কাজে লাগাবেন। যে কোনো পরিস্থিতিতে প্রত্যেকেরই মেরুদণ্ড শক্ত রাখা উচিত। বর্তমান মন্ত্রিসভায় সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একজনই। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর বলে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেশের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামের সংসদীয় আসন ১৬৬ ময়মনসিংহ ২৮ (কিশোরগঞ্জ সদর) শূন্য হলে এ আসনে ২০ এপ্রিল, ১৯৭৫ যথারীতি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী তিনজন প্রার্থীর একজন ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছোট ভাই সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম পট্টু মিয়া। উপনির্বাচনে পট্টু মিয়ার অংশগ্রহণের আগ্রহ ব্যক্ত করাটাই সৈয়দ নজরুলের জন্য ছিল এক বিড়ম্বনার কারণ। নানাভাবে তিনি চেষ্টা করেন তাকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে। কিন্তু অতি উৎসাহী কিছু নেতাকর্মীর তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত তিনি সফলকাম হতে পারেননি। সুন্দর, সুষ্ঠু ও সুশৃংখল পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। ফলাফল ঘোষণার সময় দেখা যায়, কাস্ট হওয়া বৈধ মোট ২৮ হাজার ৮২টি ভোটের মধ্যে ওয়াহিদুল ইসলাম পট্টু মিয়া ৪০২ ভোট কম পেয়ে আশরাফউদ্দিন মাস্টারের কাছে হেরে যান। আশরাফউদ্দিন পান ১২ হাজার ৭২ ভোট আর পট্টু মিয়া পান ১১ হাজার ৬৭০ ভোট। তৃতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বাক্সে পড়ে বাকি ৪ হাজার ৩৪০ ভোট। মহকুমা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গেই নির্বাচনের ফলাফলটি ঘোষণা করেন। কোনোরূপ গোলযোগ হয়নি কোথাও।
এর চার বছর পর ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এম ওসমান গণি। ওই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের নিজ হাতে গড়া দল বিএনপি সারা দেশে ২০৭টি আসনে জয়লাভ করলেও কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে ড. ওসমান গণি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দলীয় প্রার্থীদের বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে বিজয়মুকুট ধারণ করেন। এক্ষেত্রেও কোথাও কোনো গোলযোগ নেই। বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের আমলে অনুষ্ঠিত দুটি পৃথক নির্বাচন সবার জন্যই অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।
বিমল সরকার : সহকারী অধ্যাপক
মহাসমারোহে, বলতে গেলে ধুমধামের সঙ্গেই ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়ে গেল দেশব্যাপী ২৩৪টি পৌরসভা নির্বাচন। অবশ্য শুরুটা যেভাবে হয়েছিল শেষটা তেমন হয়নি। সুষ্ঠু, সুশৃংখল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সহিংসতা, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ, জাল-জালিয়াতি এসব কিছুও হয়েছে কম-বেশি। সারা দেশেই সংঘটিত কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নির্বাচনকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মেয়র, সংরক্ষিত (মহিলা) কাউন্সিলর এবং সাধারণ কাউন্সিলর প্রত্যেকটি পদের বিপরীতে দুইজন, তিন-চারজন, পাঁচ-ছয়জন, এমনকি পৌরসভা কিংবা ওয়ার্ড বিশেষে আরও বেশি সংখ্যক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। প্রায় মাসব্যাপী চালানো প্রচার-প্রচারণা, সভা-সমাবেশ এবং মিছিল-স্লোগান কোনো কিছুরই কমতি ছিল না নির্বাচনে। পৌর নির্বাচন ঘিরে উৎসাহ-উদ্দীপনার পাশাপাশি জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে আবেগ-উত্তেজনা ছিল না একথা বলা যাবে না। তা সত্ত্বেও স্বাভাবিকভাবেই বেশিরভাগ প্রার্থীকে পরাজয়কেই বরণ করে নিতে হয়েছে। অনেক পৌরসভায় সুন্দর, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব স্থানে পরাজিত সব প্রার্থী নির্বাচনের ফলাফল এবং নিজেদের পরাজয়কে সহজে মেনে নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু যেখানে জোরজবরদস্তি, জাল-জালিয়াতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা এবং কৌশল করে প্রার্থীকে হারানো হয়েছে তারা সেটাকে মেনে নেবেন এটি কী করে আশা করা যায় বিপত্তির বড় কারণ সেখানেই। এখানে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি নেই। দলীয় আর বিদ্রোহীতেও ব্যবধান নেই। যে যেখানে পেরেছেন, ‘কাজ’ সেরে নিয়েছেন। প্রশাসন এবং আইনশৃংখলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা সবাই সমান দক্ষ, সাহসী, সৎ ও দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত নন। তাদের দুর্বলতার ফাঁক দিয়ে এ সুযোগটি মতলববাজরা গ্রহণ করেছেন। এতকিছুর পরও মোটামুটি ভালোয় ভালোয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এটাই বড় কথা। অন্যান্য নির্বাচনের মতো বুধবার অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো সহিংসতা ঘটেনি।
দেশে প্রথমবারের মতো এবার পৌরসভার মেয়র পদটিকে আইনগতভাবে দলীয়করণ করা হল। রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন এবং প্রতীক নিয়ে এবার মেয়র প্রার্থীদের লড়তে হয়েছে। মাঠে লড়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও। এক একজন প্রার্থী দলের মনোনয়ন ও প্রতীক নিয়ে নির্বাচনযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে দলের ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল করেছেন, পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী দলীয় প্রার্থীর কাছে গো-হারা হেরে সবার কাছে সম্মানহানিও ঘটিয়েছেন। কেবল প্রার্থী নয়, দলগুলোর ভাবমূর্তিরও মোটামুটি বিচার হয়ে গেছে নির্বাচনী জনআদালতে। আর মনোনীত প্রার্থী যেমন-তেমন, বড় দল দুটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে শিক্ষা পেয়েছে এ নির্বাচন থেকে তা-ও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। দলের মনোনীত নয়, বরং বিদ্রোহী ও দল থেকে বহিষ্কৃত প্রার্থী কতল করেছে প্রতিপক্ষীয় প্রার্থীর দম্ভ! বেশ কয়েকটি পৌরসভায় উভয় দলের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে। দলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান চরম অন্তর্বিরোধ, মনোনয়ন দেয়ার বেলায় জেদ, তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্ব, কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতার অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং স্বার্থপরতাই প্রধানত এসব কিছুর জন্য দায়ী। বিদ্রোহী প্রার্থীদের এহেন সাফল্যকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ তো নেই-ই, উপরন্তু এতে বড় দলগুলোর ভেতরকার অন্তঃসারশূন্যতার চিত্রটিই সর্বসমক্ষে নতুন করে ফুটে উঠেছে।
যে করেই হোক, পৌর নির্বাচন হয়ে গেছে। আরও নির্বাচন বাকি আছে। যিনি আজ হেরে গেছেন, হেরে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন বলে ভাবছেন; একবার চিন্তা করুন তো, আপনি যদি বিজয়ী হতেন তাহলে প্রতিপক্ষের কী অবস্থা হতো। আপনার আস্ফালনে বিজিত পক্ষ সারাক্ষণ তটস্থ থাকত না কি? অতএব বিজয়ী ও বিজিত আসুন সবাই এবার আমরা সামনের দিকে তাকাই। পরস্পরের বিরুদ্ধে হুমকি-ধমকি, মামলা-মোকদ্দমা এবং প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবণতা পরিহার করি। আবারও বলি, সব আনন্দ আনন্দ নয়। সব জয় জয় নয়। ক্ষমতা যেমন কারোরই চিরস্থায়ী কিছু নয়, তেমনি মনে রাখতে হবে বর্তমানও ইতিহাসের শেষ মিছিল নয়। সদ্যসমাপ্ত পৌর নির্বাচন থেকে আশা করি সরকার, নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং রাজনৈতিক দলসহ প্রত্যেকেই নতুন করে শিক্ষালাভ করে ভবিষ্যতে সুন্দর, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা কাজে লাগাবেন। যে কোনো পরিস্থিতিতে প্রত্যেকেরই মেরুদণ্ড শক্ত রাখা উচিত। বর্তমান মন্ত্রিসভায় সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একজনই। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর বলে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেশের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামের সংসদীয় আসন ১৬৬ ময়মনসিংহ ২৮ (কিশোরগঞ্জ সদর) শূন্য হলে এ আসনে ২০ এপ্রিল, ১৯৭৫ যথারীতি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী তিনজন প্রার্থীর একজন ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছোট ভাই সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম পট্টু মিয়া। উপনির্বাচনে পট্টু মিয়ার অংশগ্রহণের আগ্রহ ব্যক্ত করাটাই সৈয়দ নজরুলের জন্য ছিল এক বিড়ম্বনার কারণ। নানাভাবে তিনি চেষ্টা করেন তাকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে। কিন্তু অতি উৎসাহী কিছু নেতাকর্মীর তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত তিনি সফলকাম হতে পারেননি। সুন্দর, সুষ্ঠু ও সুশৃংখল পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। ফলাফল ঘোষণার সময় দেখা যায়, কাস্ট হওয়া বৈধ মোট ২৮ হাজার ৮২টি ভোটের মধ্যে ওয়াহিদুল ইসলাম পট্টু মিয়া ৪০২ ভোট কম পেয়ে আশরাফউদ্দিন মাস্টারের কাছে হেরে যান। আশরাফউদ্দিন পান ১২ হাজার ৭২ ভোট আর পট্টু মিয়া পান ১১ হাজার ৬৭০ ভোট। তৃতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বাক্সে পড়ে বাকি ৪ হাজার ৩৪০ ভোট। মহকুমা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গেই নির্বাচনের ফলাফলটি ঘোষণা করেন। কোনোরূপ গোলযোগ হয়নি কোথাও।
এর চার বছর পর ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এম ওসমান গণি। ওই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের নিজ হাতে গড়া দল বিএনপি সারা দেশে ২০৭টি আসনে জয়লাভ করলেও কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে ড. ওসমান গণি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দলীয় প্রার্থীদের বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে বিজয়মুকুট ধারণ করেন। এক্ষেত্রেও কোথাও কোনো গোলযোগ নেই। বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের আমলে অনুষ্ঠিত দুটি পৃথক নির্বাচন সবার জন্যই অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।
বিমল সরকার : সহকারী অধ্যাপক
No comments