দেশে ঝুঁকির শীর্ষে ঢাকা by ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার
সোমবার ভোর ৫টা ৫ মিনিটে ৬.৭ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়ে গেল (উৎপত্তিস্থল ভারতের মণিপুর), তা বাংলাদেশের সবাই কমবেশি অনুভব করেছে এবং যেহেতু এটা ভোরবেলায় সংঘটিত হয়েছে, তাই এ কম্পনের ফলে ঘুম ভেঙে আতংকিত হয়ে অনেকেই বাড়ির বাইরে চলে আসে। এর ফলে বেশকিছু হতাহতের খবর পাওয়া যায়। তিনজনের মৃত্যু ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। সিলেট ও ঢাকা অঞ্চলের কিছু বিল্ডিংয়েও ফাটল দেখা দিয়েছে।
এই ৬.৭ মাত্রার যে ভূমিকম্প, তা ভারত ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে ৩৫ কিলোমিটার গভীরতায় সংঘটিত হয়। আমাদের গবেষণায় এ প্লেট বাউন্ডারিতে গত ১০০০ বছরে উল্লেখযোগ্য বড় ভূমিকম্প হয়নি। ফলে ভূ-অভ্যন্তরে প্রচুর পরিমাণে শক্তি সঞ্চিত হয়ে রয়েছে। তারই খুব সামান্য অংশ সোমবার ভোরে ছেড়ে দিয়েছে প্রকৃতি। বেশিরভাগ শক্তি এখনও সঞ্চিত রয়েছে। আমাদের জন্য এটা এক বড় বিপদের কথা। যে কোনো সময় এই শক্তি ৮ মাত্রার অধিক ভূকম্পন ঘটাতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) গবেষণার উপাত্ত থেকে দেখতে পাই, এই দুটো প্লেট প্রতি ১০০ বছরে দেড় মিটার করে সংকুচিত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি ১০০ বছরে এ অঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরের শিলারাশির মধ্যে দেড় মিটারের চ্যুতি সংঘটন করার মতো শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। যেহেতু গত ১০০০ বছরে বড় ভূমিকম্প হয়নি, তাই এ অঞ্চলে ১৫ মিটার চ্যুতি ঘটানোর মতো শক্তি সঞ্চিত হয়ে রয়েছে, যা ৮ মাত্রার অধিক ভূকম্পন সৃষ্টি করতে পারে। একইভাবে ঢাকার উত্তরে মেঘালয় ও বাংলাদেশের সীমান্তরেখা বরাবর ৩৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত ডাউকি ফল্টের অবস্থান। এই ডাউকি ফল্টের পশ্চিম প্রান্তে গত ৩০০ বছরে ৮ মাত্রার বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৮৯৭ সালে ৮.৪ মাত্রার ভূমিকম্প, যা গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়াক নামে পরিচিত। তারও আগে ১৭৮৭ সালে ওই অঞ্চলে আরেকটা বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়, যা ওই অঞ্চলের ভূ-পৃষ্ঠের ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে এবং ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। এই ডাউকি ফল্টের পূর্ব প্রান্তে অর্থাৎ সিলেট অঞ্চলে গত ৫০০-৭০০ বছরে উল্লেখযোগ্য বড় ভূমিকম্প হয়নি। অর্থাৎ এ অঞ্চলে বড় ধরনের শক্তি ভূ-অভ্যন্তরে সঞ্চিত হয়ে রয়েছে। এই ডাউকি ফল্টে প্রতি ১০০ বছরে এক মিটার চ্যুতি ঘটানোর শক্তি সঞ্চয় হচ্ছে। এখানে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত রয়েছে, তাতে ৫ থেকে ৭ মিটার চ্যুতি ঘটানোর মতো শক্তি এখানে রয়েছে এবং যে কোনো সময় তা ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটাতে পারে।
অর্থাৎ আমরা গবেষণায় যা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের সিলেট অঞ্চলের ডাউকি ফল্ট ও পূর্বে ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের প্লেট বাউন্ডারি ফল্টে ভূমিকম্প আমাদের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। যে কোনো সময় বড় আকারের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে, যার পূর্বাভাস গত সোমবার ভোরের ভূমিকম্প।
আমাদের গ্যাস-ফিল্ডগুলো সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী অঞ্চলে অবস্থিত। আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজারসহ ভারি শিল্প-কারখানার অবস্থানও এখানে। ফলে এ অঞ্চলে ভূমিকম্প হলে এসব শিল্প-কারখানা, গ্যাস ফিল্ড ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিরই বিপদ ডেকে আনবে। অন্যদিকে জনবহুল ঢাকা অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত হওয়ায় ভূমিকম্পের ঝুঁকির প্রশ্নে শীর্ষে অবস্থান করছে এ নগরী। বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়তো কল্পনারও অতীত হবে।
সুতরাং এখনই সরকার ও সব বেসরকারি সংস্থার-প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসার।
প্রফেসর সৈয়দ হুমায়ুন আখতার : চেয়ারম্যান, স্ট্রাকচারাল জিওলজি অ্যান্ড সিসমোলজি, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এই ৬.৭ মাত্রার যে ভূমিকম্প, তা ভারত ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে ৩৫ কিলোমিটার গভীরতায় সংঘটিত হয়। আমাদের গবেষণায় এ প্লেট বাউন্ডারিতে গত ১০০০ বছরে উল্লেখযোগ্য বড় ভূমিকম্প হয়নি। ফলে ভূ-অভ্যন্তরে প্রচুর পরিমাণে শক্তি সঞ্চিত হয়ে রয়েছে। তারই খুব সামান্য অংশ সোমবার ভোরে ছেড়ে দিয়েছে প্রকৃতি। বেশিরভাগ শক্তি এখনও সঞ্চিত রয়েছে। আমাদের জন্য এটা এক বড় বিপদের কথা। যে কোনো সময় এই শক্তি ৮ মাত্রার অধিক ভূকম্পন ঘটাতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) গবেষণার উপাত্ত থেকে দেখতে পাই, এই দুটো প্লেট প্রতি ১০০ বছরে দেড় মিটার করে সংকুচিত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি ১০০ বছরে এ অঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরের শিলারাশির মধ্যে দেড় মিটারের চ্যুতি সংঘটন করার মতো শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। যেহেতু গত ১০০০ বছরে বড় ভূমিকম্প হয়নি, তাই এ অঞ্চলে ১৫ মিটার চ্যুতি ঘটানোর মতো শক্তি সঞ্চিত হয়ে রয়েছে, যা ৮ মাত্রার অধিক ভূকম্পন সৃষ্টি করতে পারে। একইভাবে ঢাকার উত্তরে মেঘালয় ও বাংলাদেশের সীমান্তরেখা বরাবর ৩৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত ডাউকি ফল্টের অবস্থান। এই ডাউকি ফল্টের পশ্চিম প্রান্তে গত ৩০০ বছরে ৮ মাত্রার বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৮৯৭ সালে ৮.৪ মাত্রার ভূমিকম্প, যা গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়াক নামে পরিচিত। তারও আগে ১৭৮৭ সালে ওই অঞ্চলে আরেকটা বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়, যা ওই অঞ্চলের ভূ-পৃষ্ঠের ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে এবং ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। এই ডাউকি ফল্টের পূর্ব প্রান্তে অর্থাৎ সিলেট অঞ্চলে গত ৫০০-৭০০ বছরে উল্লেখযোগ্য বড় ভূমিকম্প হয়নি। অর্থাৎ এ অঞ্চলে বড় ধরনের শক্তি ভূ-অভ্যন্তরে সঞ্চিত হয়ে রয়েছে। এই ডাউকি ফল্টে প্রতি ১০০ বছরে এক মিটার চ্যুতি ঘটানোর শক্তি সঞ্চয় হচ্ছে। এখানে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত রয়েছে, তাতে ৫ থেকে ৭ মিটার চ্যুতি ঘটানোর মতো শক্তি এখানে রয়েছে এবং যে কোনো সময় তা ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটাতে পারে।
অর্থাৎ আমরা গবেষণায় যা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের সিলেট অঞ্চলের ডাউকি ফল্ট ও পূর্বে ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের প্লেট বাউন্ডারি ফল্টে ভূমিকম্প আমাদের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। যে কোনো সময় বড় আকারের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে, যার পূর্বাভাস গত সোমবার ভোরের ভূমিকম্প।
আমাদের গ্যাস-ফিল্ডগুলো সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী অঞ্চলে অবস্থিত। আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজারসহ ভারি শিল্প-কারখানার অবস্থানও এখানে। ফলে এ অঞ্চলে ভূমিকম্প হলে এসব শিল্প-কারখানা, গ্যাস ফিল্ড ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিরই বিপদ ডেকে আনবে। অন্যদিকে জনবহুল ঢাকা অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত হওয়ায় ভূমিকম্পের ঝুঁকির প্রশ্নে শীর্ষে অবস্থান করছে এ নগরী। বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়তো কল্পনারও অতীত হবে।
সুতরাং এখনই সরকার ও সব বেসরকারি সংস্থার-প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসার।
প্রফেসর সৈয়দ হুমায়ুন আখতার : চেয়ারম্যান, স্ট্রাকচারাল জিওলজি অ্যান্ড সিসমোলজি, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments