জ্বালানি তেলের দাম কমালে প্রবৃদ্ধি বাড়বে
উৎপাদন
ব্যয় কমাতে জ্বালানি তেলের দামের সমন্বয় চান বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা।
অর্থনীতিবিদেরাও রীতিমতো অঙ্ক কষে দেখাচ্ছেন, জ্বালানি তেলের দাম কমালে
অর্থনীতির কতটা উপকার হবে। সাধারণ ভোক্তারাও চান তেলের দাম কমুক, তাতে
প্রতিদিনকার পরিবহন ব্যয় খানিকটা কমবে।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হওয়ায় এই দাবিটি আরও জোরালো হয়েছে। গতকাল রোববার ব্যবসায়ীদের প্রভাবশালী সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) নেতারা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে দেখা করে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর দাবি জানিয়েছেন। আর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুপারিশ করেছে। তারা বলছে, দেশে জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ১০ শতাংশ কমানো হলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গতকাল এ নিয়ে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম না কমানোয় রাজস্ব আদায় কম হওয়ার পরও ‘নিশ্বাস’ ফেলতে পারছে সরকার। এখন উৎপাদক ও ভোক্তাকেও ‘নিশ্বাস’ ফেলতে দিতে হবে।
সরকার সচেতনভাবেই এত দিন জ্বালানি তেলের দাম কমায়নি। সরকারের মনোভাব ছিল বিপিসির লোকসান কিছুটা সমন্বয় করা। বিপিসির লোকসান পুরোটা সমন্বয় করা গেছে:- এ এম এ মুহিত অর্থমন্ত্রী
একই ধরনের কথা বলেছেন এমসিসিআইয়ের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘লিটারপ্রতি ডিজেলে ১০ ও অকটেনে ২০ টাকা কমানো হলে সরকারের খুব বেশি মুনাফা কমবে না। তবে আমরা ব্যবসায়ীরা একটু নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পাব।’
সরকার সর্বশেষ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে। সে সময় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ছিল ৯৭ ডলার। আর এখন তা ৩৬ ডলার। ফলে এখন সরকার প্রতি লিটার অকটেনে মুনাফা করছে প্রায় ৪০ টাকা, আর কেরোসিন, ডিজেল ও ফার্নেস তেলে মুনাফা করছে ১৫ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত।
এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই তেলের দাম কমানো হবে না বলে জানানো হয়েছিল। তবে এই দফায় বিশ্ববাজারে তেলের দাম এতটাই কমেছে যে এবার আর সরাসরি নাকচ করেননি অর্থমন্ত্রী। তবে শিগগিরই দাম কমছে সে ভরসাও দেননি। এমসিসিআইয়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকার দাম কমানোর জন্য নতুন উদ্যোগ নেবে। তবে এর আগে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করবে। তবে নীতিমালায় কী থাকবে, তা তিনি বলেননি।
এ নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে (বিপিসি) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দাম কমানোর বিষয়ে সরকারের কোনো পক্ষ থেকেই কোনো ধরনের নির্দেশনা আসেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল প্রথম আলোকে বলেন, আশপাশের সব দেশই তেলের দাম কমিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নিম্ন পর্যায়ে থাকায় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে এর সুবিধা নেওয়া উচিত। কেননা, সময় গেলে সাধন হবে না। তেলের দাম কমালে মূল্যস্ফীতি কমবে। আর তা দুভাবে অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলবে। প্রথমত, মূল্যস্ফীতি কমলে তা ভোক্তা চাহিদা বাড়িয়ে দেবে। ভোক্তা চাহিদা বাড়লে উৎপাদন বাড়বে। আর উৎপাদন বাড়লে তা প্রবৃদ্ধিকেও বাড়িয়ে দেবে। দ্বিতীয়টি হলো, মূল্যস্ফীতি কমলে সুদের হার কমবে, এতে বিনিয়োগ বাড়বে। বিনিয়োগ বাড়লে তা উৎপাদনকে বাড়িয়ে দেবে। উৎপাদন বাড়লে প্রবৃদ্ধিও বাড়বে।
জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এটা আমার মন্ত্রণালয়ের বিষয় না হলেও ব্যবসায়ীদের এই দাবি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলে কথা বলব:- তোফায়েল আহমেদ, বাণিজ্যমন্ত্রী
সিপিডির মূল্যায়ন: সিপিডি বিশেষ করে কেরোসিন, ডিজেল ও ফার্নেস তেলের দাম কমানোর কথা বলেছে। জ্বালানি তেলের পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করার সুপারিশও করেছে তারা।
গবেষণা সংস্থাটি হিসাব দিয়ে বলেছে, জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ১০ শতাংশ কমানো হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে। তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়বে দশমিক ৪ শতাংশ। ভোক্তা চাহিদা বাড়বে দশমিক ৬ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি কমবে দশমিক ২ শতাংশ। তবে সরকারের সঞ্চয় কমবে দশমিক ৪ শতাংশ।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে চলতি অর্থবছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছে সিপিডি। সেখানে তেলের দাম কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে এ সংবাদ সম্মেলন হয়।
এ বিষয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শুধু জ্বালানি তেল নয়, গ্যাস-বিদ্যুতের দামও সমন্বয় করতে হবে। তবে এটা কীভাবে ভারসাম্য আনা হবে, সেটা ঠিক করতে হবে। তিনি মনে করেন, এখনই ভালো সময় এ তিন বিষয়ের সমন্বয় করার।
সিপিডি বলছে, ক্রমাগত লোকসানের কারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) এখন পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার ফলে গত অর্থবছর বিপিসি ৫ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এ বছর তেলের দাম অপরিবর্তিত থাকলে ১১ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করবে বিপিসি। এ মুনাফার অর্থ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে কি না, তা পরিষ্কার নয়।
দুই মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক: সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় এমসিসিআইয়ের নেতারা বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। এত দিন বলা হচ্ছিল, সরকার এই খাতে লোকসান করেছে। সেই লোকসান ইতিমধ্যে সমন্বয় হয়ে গেছে উল্লেখ করে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, এখন জ্বালানি তেলের দাম কমানো উচিত।
জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এটা আমার মন্ত্রণালয়ের বিষয় না হলেও ব্যবসায়ীদের এই দাবি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলে কথা বলব।’
গতকাল একই দাবি অর্থমন্ত্রীর কাছে জানানো হলে তিনি বলেন, সরকার সচেতনভাবেই এত দিন জ্বালানি তেলের দাম কমায়নি। সরকারের মনোভাব ছিল বিপিসির লোকসান কিছুটা সমন্বয় করা। বিপিসির লোকসান পুরোটা সমন্বয় করা গেছে।
এ বিষয়ে এমসিসিআইয়ের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায় খরচ কমানোর অন্যতম বড় সুযোগ হলো জ্বালানি খরচ কমানো। উৎপাদন পর্যায়ের বড় একটি অংশই খরচ হয় এ জ্বালানি বাবদ ব্যয়ে। এখন যদি জ্বালানি তেলের দাম আংশিকও কমানো হয়, তবে ২০১৬ সালে যে বিনিয়োগ বৃদ্ধির চেষ্টা করার কথা বলা হচ্ছে, তাতে কাজে লাগবে। ব্যবসায় খরচ কমলে বিনিয়োগ বাড়বে।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও কমবে: বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এখন এই তেল বিক্রি হচ্ছে ব্যারেলপ্রতি ৩৬ থেকে ৩৭ ডলারের মধ্যে। মূলত তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেক উত্তোলন ও সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে দাম আরও কমে যাওয়ায় দেশগুলো আয় ধরে রাখতে সরবরাহ আরও বৃদ্ধি করেছে। আবার তেলের অন্যতম ভোক্তা চীনের অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়ায় চাহিদা কমে গেছে। এর মধ্যে আবার রাশিয়া আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের সরবরাহ আরও বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও ১৮ ডিসেম্বর থেকে নিজস্ব তেল রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। ফলে দেশটি যেকোনো সময় আন্তর্জাতিক বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল রপ্তানি শুরু করতে পারে। আবার ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ফলে ২০১৬ সালে সেই দেশের তেলও ঢুকবে বাজারে। তাদের কাছেও রয়েছে তেলের বিশাল মজুত। এ অবস্থায় গোল্ডম্যান স্যাক্স ও সিটি গ্রুপসহ বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, চলতি বছর বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম কমে ২০ ডলারেও আসতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, বর্তমান এই বিশ্ব পরিস্থিতিতে মূল্য নির্ধারণের জন্য একটি নীতিমালা তৈরির সুযোগ এসেছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, জনসাধারণকে আগে থেকেই জানিয়ে দিতে হবে, আন্তর্জাতিক তেলের দাম কমলে বা বাড়লে তা সমন্বয় করা হবে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে যাতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে না হয়। আবার সরকারের ইচ্ছার ওপরও যাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো বা কমানো না হয়। এই পদ্ধতিতে দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পাওয়া যাবে।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হওয়ায় এই দাবিটি আরও জোরালো হয়েছে। গতকাল রোববার ব্যবসায়ীদের প্রভাবশালী সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) নেতারা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে দেখা করে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর দাবি জানিয়েছেন। আর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুপারিশ করেছে। তারা বলছে, দেশে জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ১০ শতাংশ কমানো হলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গতকাল এ নিয়ে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম না কমানোয় রাজস্ব আদায় কম হওয়ার পরও ‘নিশ্বাস’ ফেলতে পারছে সরকার। এখন উৎপাদক ও ভোক্তাকেও ‘নিশ্বাস’ ফেলতে দিতে হবে।
সরকার সচেতনভাবেই এত দিন জ্বালানি তেলের দাম কমায়নি। সরকারের মনোভাব ছিল বিপিসির লোকসান কিছুটা সমন্বয় করা। বিপিসির লোকসান পুরোটা সমন্বয় করা গেছে:- এ এম এ মুহিত অর্থমন্ত্রী
একই ধরনের কথা বলেছেন এমসিসিআইয়ের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘লিটারপ্রতি ডিজেলে ১০ ও অকটেনে ২০ টাকা কমানো হলে সরকারের খুব বেশি মুনাফা কমবে না। তবে আমরা ব্যবসায়ীরা একটু নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পাব।’
সরকার সর্বশেষ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে। সে সময় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ছিল ৯৭ ডলার। আর এখন তা ৩৬ ডলার। ফলে এখন সরকার প্রতি লিটার অকটেনে মুনাফা করছে প্রায় ৪০ টাকা, আর কেরোসিন, ডিজেল ও ফার্নেস তেলে মুনাফা করছে ১৫ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত।
এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই তেলের দাম কমানো হবে না বলে জানানো হয়েছিল। তবে এই দফায় বিশ্ববাজারে তেলের দাম এতটাই কমেছে যে এবার আর সরাসরি নাকচ করেননি অর্থমন্ত্রী। তবে শিগগিরই দাম কমছে সে ভরসাও দেননি। এমসিসিআইয়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকার দাম কমানোর জন্য নতুন উদ্যোগ নেবে। তবে এর আগে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করবে। তবে নীতিমালায় কী থাকবে, তা তিনি বলেননি।
এ নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে (বিপিসি) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দাম কমানোর বিষয়ে সরকারের কোনো পক্ষ থেকেই কোনো ধরনের নির্দেশনা আসেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল প্রথম আলোকে বলেন, আশপাশের সব দেশই তেলের দাম কমিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নিম্ন পর্যায়ে থাকায় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে এর সুবিধা নেওয়া উচিত। কেননা, সময় গেলে সাধন হবে না। তেলের দাম কমালে মূল্যস্ফীতি কমবে। আর তা দুভাবে অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলবে। প্রথমত, মূল্যস্ফীতি কমলে তা ভোক্তা চাহিদা বাড়িয়ে দেবে। ভোক্তা চাহিদা বাড়লে উৎপাদন বাড়বে। আর উৎপাদন বাড়লে তা প্রবৃদ্ধিকেও বাড়িয়ে দেবে। দ্বিতীয়টি হলো, মূল্যস্ফীতি কমলে সুদের হার কমবে, এতে বিনিয়োগ বাড়বে। বিনিয়োগ বাড়লে তা উৎপাদনকে বাড়িয়ে দেবে। উৎপাদন বাড়লে প্রবৃদ্ধিও বাড়বে।
জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এটা আমার মন্ত্রণালয়ের বিষয় না হলেও ব্যবসায়ীদের এই দাবি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলে কথা বলব:- তোফায়েল আহমেদ, বাণিজ্যমন্ত্রী
সিপিডির মূল্যায়ন: সিপিডি বিশেষ করে কেরোসিন, ডিজেল ও ফার্নেস তেলের দাম কমানোর কথা বলেছে। জ্বালানি তেলের পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করার সুপারিশও করেছে তারা।
গবেষণা সংস্থাটি হিসাব দিয়ে বলেছে, জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ১০ শতাংশ কমানো হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে। তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়বে দশমিক ৪ শতাংশ। ভোক্তা চাহিদা বাড়বে দশমিক ৬ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি কমবে দশমিক ২ শতাংশ। তবে সরকারের সঞ্চয় কমবে দশমিক ৪ শতাংশ।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে চলতি অর্থবছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছে সিপিডি। সেখানে তেলের দাম কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে এ সংবাদ সম্মেলন হয়।
এ বিষয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শুধু জ্বালানি তেল নয়, গ্যাস-বিদ্যুতের দামও সমন্বয় করতে হবে। তবে এটা কীভাবে ভারসাম্য আনা হবে, সেটা ঠিক করতে হবে। তিনি মনে করেন, এখনই ভালো সময় এ তিন বিষয়ের সমন্বয় করার।
সিপিডি বলছে, ক্রমাগত লোকসানের কারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) এখন পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার ফলে গত অর্থবছর বিপিসি ৫ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এ বছর তেলের দাম অপরিবর্তিত থাকলে ১১ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করবে বিপিসি। এ মুনাফার অর্থ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে কি না, তা পরিষ্কার নয়।
দুই মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক: সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় এমসিসিআইয়ের নেতারা বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। এত দিন বলা হচ্ছিল, সরকার এই খাতে লোকসান করেছে। সেই লোকসান ইতিমধ্যে সমন্বয় হয়ে গেছে উল্লেখ করে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, এখন জ্বালানি তেলের দাম কমানো উচিত।
জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এটা আমার মন্ত্রণালয়ের বিষয় না হলেও ব্যবসায়ীদের এই দাবি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলে কথা বলব।’
গতকাল একই দাবি অর্থমন্ত্রীর কাছে জানানো হলে তিনি বলেন, সরকার সচেতনভাবেই এত দিন জ্বালানি তেলের দাম কমায়নি। সরকারের মনোভাব ছিল বিপিসির লোকসান কিছুটা সমন্বয় করা। বিপিসির লোকসান পুরোটা সমন্বয় করা গেছে।
এ বিষয়ে এমসিসিআইয়ের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায় খরচ কমানোর অন্যতম বড় সুযোগ হলো জ্বালানি খরচ কমানো। উৎপাদন পর্যায়ের বড় একটি অংশই খরচ হয় এ জ্বালানি বাবদ ব্যয়ে। এখন যদি জ্বালানি তেলের দাম আংশিকও কমানো হয়, তবে ২০১৬ সালে যে বিনিয়োগ বৃদ্ধির চেষ্টা করার কথা বলা হচ্ছে, তাতে কাজে লাগবে। ব্যবসায় খরচ কমলে বিনিয়োগ বাড়বে।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও কমবে: বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এখন এই তেল বিক্রি হচ্ছে ব্যারেলপ্রতি ৩৬ থেকে ৩৭ ডলারের মধ্যে। মূলত তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেক উত্তোলন ও সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে দাম আরও কমে যাওয়ায় দেশগুলো আয় ধরে রাখতে সরবরাহ আরও বৃদ্ধি করেছে। আবার তেলের অন্যতম ভোক্তা চীনের অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়ায় চাহিদা কমে গেছে। এর মধ্যে আবার রাশিয়া আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের সরবরাহ আরও বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও ১৮ ডিসেম্বর থেকে নিজস্ব তেল রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। ফলে দেশটি যেকোনো সময় আন্তর্জাতিক বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল রপ্তানি শুরু করতে পারে। আবার ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ফলে ২০১৬ সালে সেই দেশের তেলও ঢুকবে বাজারে। তাদের কাছেও রয়েছে তেলের বিশাল মজুত। এ অবস্থায় গোল্ডম্যান স্যাক্স ও সিটি গ্রুপসহ বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, চলতি বছর বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম কমে ২০ ডলারেও আসতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, বর্তমান এই বিশ্ব পরিস্থিতিতে মূল্য নির্ধারণের জন্য একটি নীতিমালা তৈরির সুযোগ এসেছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, জনসাধারণকে আগে থেকেই জানিয়ে দিতে হবে, আন্তর্জাতিক তেলের দাম কমলে বা বাড়লে তা সমন্বয় করা হবে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে যাতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে না হয়। আবার সরকারের ইচ্ছার ওপরও যাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো বা কমানো না হয়। এই পদ্ধতিতে দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পাওয়া যাবে।
No comments