ভূমিকম্পের বিপদ ও আমাদের প্রস্তুতি by ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল
গতকাল ভোররাতে শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল দেশ। এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভারতের মণিপুর রাজ্যে বলে জানা গেছে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৭। এ ঘটনা আবারও আমাদের স্মরণ করিয়ে দিল, দেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। কতটা ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ, এ বিষয়েই আজ আলোচনা করব। ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে আলোচনার শুরুতে এর আপদ ও বিপদ সম্পর্কে আলোচনা করা শ্রেয়। কারণ এ দুটি বিষয়ের সমন্বিত ফলাফলই হল ঝুঁকি।
ভূমিকম্পের আপদ (Hazard): দু’ধরনের ভূতাত্ত্বিক কাঠামোতে বেশিরভাগ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। একটি ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা, অন্যটি ভূতাত্ত্বিক প্লেট বাউন্ডারি। বাংলাদেশের উত্তরে নেপাল-ভুটানের দক্ষিণ সীমান্তে পূর্ব-পশ্চিমে ২৭০০ কিলোমিটার বিস্তৃত ইন্ডিয়ান ও ইউরেশিয়ান প্লেট বাউন্ডারি, যেখানে নেপাল সেগমেন্টে গত ২৫ এপ্রিল ও ১২ মে বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছে। ১৯৩৪ সালেও এ প্লেট বাউন্ডারিতে ৮.২ মাত্রার নেপাল-বিহার ভূমিকম্প হয়েছিল। এ প্লেট বাউন্ডারির ভুটান সেগমেন্টে দীর্ঘ সময় কোনো বড় ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়নি। তাই ভুটান সেগমেন্টে ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশংকা রয়েছে। এ সেগমেন্টটি সিলেট-ময়মনসিংহ সীমান্ত থেকে ২০০ কিলোমিটার উত্তরে; কিন্তু রংপুর-দিনাজপুর থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে। ওই সেগমেন্টে ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষতির আশংকা আছে। ইন্ডিয়ান-ইউরেশিয়ান প্লেট বাউন্ডারির দক্ষিণে ভারতের শিলিং মালভূমি তথা মেঘালয় রাজ্য অবস্থিত। মেঘালয়ের দক্ষিণে সিলেট অঞ্চলে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বরাবর উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত ২৭০ কিলোমিটার লম্বালম্বি অত্যন্ত সক্রিয় একটি ফাটল রেখা আছে, যা ডাউকি ফাটল বলে পরিচিত। এ ফাটল রেখা ৮ মাত্রারও বেশি ভূমিকম্প সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে।
বাংলাদেশের পূর্ব প্রান্তে ইন্ডিয়ান ও বার্মিজ প্লেট বাউন্ডারি। এ বাউন্ডারিটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত টেকনাফ থেকে উত্তরে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। ওই প্লেট বাউন্ডারির পশ্চিম প্রান্তে বাংলাদেশ সীমানার ভেতরে কয়েকটি সক্রিয় ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা আছে। যেগুলো অতীতে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি করেছে।
চট্টগ্রাম-মিয়ানমার উপকূলে উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত রাখাইন ফাটল রেখা বেশ সক্রিয়। এ ফাটলে দুটি পরস্পর সংঘটিত ভূমিকম্পের মধ্যবর্তী সময়কাল (রেফারেন্স পিরিয়ড) ৩০০-৯০০ বছর। ১৭৬২ সালে রাখাইন ফাটল সর্বশেষ বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি করেছে। সেই হিসাবে এ ফাটল রেখাটি যে কোনো সময় বড় ভূমিকম্পের জন্ম দিতে পারে। ওই প্লেট বাউন্ডারির ত্রিপুরা সেগমেন্ট দীর্ঘ সময় বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি করেনি। তাই এ সেগমেন্টটিও পরবর্তী যে কোনো সময় বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে।
ডাউকি ফাটল রেখায় পরস্পর সংঘটিত দুটি ভূমিকম্পের মধ্যবর্তী সময়কাল ৩৫০ বছর। ১৮৯৭ সালে এ ফাটল রেখায় সর্বশেষ বড় ভূমিকম্প হয়। তাই পরবর্তী ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হতে আরও প্রায় ২৩০ বছর সময় লাগবে। কিন্তু ডাউকি ফাটল রেখার পূর্বাংশ বেশি সক্রিয়। এ অংশ যে কোনো সময় মাঝারি থেকে শক্তিশালী ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। দেশের মধ্যবর্তী মধুপুর ফাটল রেখা সর্বশেষ ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প জন্ম দেয়। এ ফাটল রেখায় পরবর্তী ভূমিকম্প হতেও অনেক দিন বাকি।
চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা পাহাড়ি অঞ্চলে ২০-৬০ কিলোমিটার লম্বা প্রায় ১৩টি ফাটল রেখা আছে। এ ফাটল রেখাগুলোর দুটি ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে শক্তিশালী ভূমিকম্পের জন্ম দিয়েছে। এ ধরনের ভূমিকম্পকে ভাসমান ভূমিকম্প বলে। যে কোনো সময় এ ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। এ ফাটল রেখাগুলোকে কেন্দ্র করে ৬.৬-৭.২ মাত্রার ভূমিকম্প যে কোনো সময় হওয়ার আশংকা আছে। এ ধরনের ভাসমান ভূমিকম্পের রেকারেন্স পিরিয়ড ১০০ বছর।
অবকাঠামোর বিপদাপন্নতা (Vulnerability) : দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ দুর্যোগঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ১৯৫৪ সালে ঢাকা শহরের আয়তন ছিল ৩৬ বর্গকিলোমিটার। ২০১০ সালে তা ২৬০ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ৫৬ বছরে ৭ গুণেরও বেশি বেড়েছে শহর এলাকা। ১৯৭১ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১২ লাখ, এখন তা দেড় কোটি। ৪৫ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে সাড়ে ১২ গুণ। বাকি বড় শহরগুলোর অবস্থাও অনেকটা একই রকম। নগরমুখী জনসংখ্যার গড় বৃদ্ধির অনুপাতে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশের বেশি মানুষ হবে নগরবাসী। এসব এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্রুত বাড়ছে। এতে নগরীর দুর্যোগ বিপদাপন্নতাও বাড়ছে। আমাদের অবকাঠামো ভূমি ব্যবহার নীতিমালা অনুযায়ী দুর্যোগ সহনীয় করে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস সন্নিবেশিত ভূমি ব্যবহার মানচিত্রও আমাদের নেই।
অবকাঠামোর বিপদাপন্নতা বলতে দালান-কোঠাসহ শহরের গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি, পানি ও রাস্তাঘাটের গুণগত অবস্থাকে বোঝানো হয়। সাধারণত Masonry দালান (ইট-সুরকির দালান), Soft storey (নিচতলা খালি ও পার্কিংয়ের জন্য ব্যবহৃত), Heavy overhang দালান (উপরের তলা অপরিকল্পিভাবে ভারি করে তৈরি করা) এবং Short Column দালান ভূমিকম্পে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। ২০০৯-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় ১৪০ হাজার Masonry building রয়েছে। ৯০ হাজার Soft storey, ৬৯ হাজার Heavy overhang, ৫৮ হাজার Short colum দালান ঢাকায় আছে। চট্টগ্রাম ও সিলেটের চিত্র অনেকটা একই রকম। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে প্রায় ২৩শ’ কিলোমিটার রাস্তা আছে। যার মধ্যে ৭৬ শতাংশের প্রশস্ততা কম হওয়ায় ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি যাতায়াতের যোগ্য নয়। এর মধ্যে ৫১ শতাংশের বেশি রাস্তা বেশ দুর্বল মাটিতে তৈরি করা হয়েছে। গ্যাস লাইনের অবকাঠামোও বেশ দুর্বল। ঢাকায় ৫৬ শতাংশ গ্যাস লাইন দুর্বল liquefiable মাটিতে টানা হয়েছে। পানির লাইনের ক্ষেত্রেও তাই।
উপরন্তু বর্তমান নগরায়ণ হচ্ছে নরম মাটিতে। ঢাকার ক্ষেত্রে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, টঙ্গীখাল ও বালু নদের মাঝে ৩০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৬৫ শতাংশ এলাকার মাটি নরম। সাধারণত নরম মাটিতে ভূমিকম্প তরঙ্গের স্থায়িত্বকাল বেশি এবং নরম মাটি তরঙ্গের বিশেষ অংশের শক্তি বাড়িয়ে দেয়। তাই নরম মাটিতে গড়ে ওঠা স্থাপনার ঝুঁকিও বেশি। অন্যদিকে পুরান ঢাকায় দালানকোঠার বয়স বেশি হওয়ায় সেগুলোও ঝুঁকিতে আছে। অন্যান্য শহরের চিত্রও কমবেশি একই রকম। তাই আপদ ও বিপদের বিচারে বাংলাদেশের শহরগুলো ভূমিকম্পের তীব্র ঝুঁকিতে আছে।
অবকাঠামোগুলোর এ বিপদাপন্ন অবস্থায় এবং শক্তিশালী ভূমিকম্প আপদের সম্ভাবনার কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ছাড়াও দেশের অন্যান্য শহর যেমন- ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর ও রাজশাহীরও ঝুঁকি কম নয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মধুপুর ফাটল রেখায় ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৭২ হাজার বিল্ডিং সম্পূর্ণ ভেঙে পড়তে পারে, যা ঢাকার দালান-কোঠার প্রায় ২৩ শতাংশ। রাখাইন ফাটল রেখায় ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে চট্টগ্রামে ১ লাখ ৪২ হাজার বিল্ডিং ভেঙে পড়তে পারে, যা চট্টগ্রামের দালান-কোঠার প্রায় ৯০ শতাংশ। ডাউকি ফাটল রেখায় ৮.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে সিলেটে ৪১ হাজার দালান-কোঠা ভেঙে পড়তে পারে, যা সিলেটের দালান-কোঠার প্রায় ৭৯ শতাংশ।
প্রস্তুতি : কাঠামোগত বিপদাপন্নতা ভূমিকম্প দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বিল্ডিং কোডের সঠিক ব্যবহার এ দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমন করে। ১৯৯৩ সালে বিল্ডিং কোড প্রণীত হয়। ২০০৬ সালে গেজেটভুক্ত হয়। বর্তমানে এ কোড আবার pdated-এর পথে। যদিও ঢাকায় রাজউককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কোড বাস্তবায়নের জন্য। কিন্তু দেশব্যাপী একই কোড বাস্তবায়নের কোনো নীতিমালা নেই। তাই এখনই প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংস্থা গঠনের।
ভূমিকম্প ঝুঁকি হ্রাসের জন্য প্রয়োজন আপদপ্রবণ শহরগুলোর ঝুঁকি সন্নিবেশিত ভূমি ব্যবহার মানচিত্র প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। Urban Developments Directorate (UDD) ময়মনসিংহ শহর নিয়ে এ কাজটি শুরু করেছে। প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করে কাজটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া জরুরি।
Command and Coordination, উদ্ধার-অনুসন্ধান ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর অবকাঠামোগুলো ভূমিকম্পের তীব্রতার বিপরীতে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। চঁনষরপ Public Works Department (PWD) ইতিমধ্যে জাইকার সহযোগিতায় এ বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ পেয়েছে। এখন দ্রুতগতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো retrofitting করার কাজে হাত দেয়া প্রয়োজন। জরুরি সাড়া প্রদানকারী ১৩টি সংস্থার জন্য Scenario-ভিত্তিক Contingency পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। প্রয়োজন সেগুলো বাস্তবায়ন করা এবং নিয়মিত মহড়া দিয়ে পরিকল্পনাকে সতেজ রাখা।
Fire Service & Civil Defense, Armed force Division এবং City Corporation-এর জন্য সরকার ইতিপূর্বে ৬৯ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয় করেছে। আরও ১৫৯ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ ক্রয় করার পথে। উদ্ধার ও অনুসন্ধান কাজের জন্য বাংলাদেশ-উপযোগী ক্ষুদ্র ও মাঝারি যন্ত্রপাতি ক্রয় করাকে এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হবে।
৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে ইতিমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় অনুসন্ধান, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আরও ৩২ হাজারকে একই প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সরকারি অর্থায়নে Urban Disaster Preparedness Volunteer কার্যক্রমকে দ্রুত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে।
School Safety & Evacuation drill চালু করার জন্য ঈউগচ উদ্যোগ নিয়েছে। ১০০ স্কুলে drill করার যন্ত্রাংশ দেয়া হয়েছে। এ rill নিয়মিতভাবে দেশব্যাপী কার্যকর করার উদ্যোগ অবিলম্বে নিতে হবে। এর মধ্য দিয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভূমিকম্প দুর্যোগ বিষয়ে সচেতন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বন্যা ও সাইক্লোন দুর্যোগের প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। সুদীর্ঘ সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প দেশটিতে হানা না দেয়ার কারণে এ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সক্ষমতা সীমিত। তবে ইতিমধ্যে এ দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনের জন্য সঠিক পদ্ধতিতে এডহক-ভিত্তিক বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এখন প্রয়োজন এ কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন করা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২-এর বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নগর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা সম্ভব।
অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল : চেয়ারম্যান, দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভূমিকম্পের আপদ (Hazard): দু’ধরনের ভূতাত্ত্বিক কাঠামোতে বেশিরভাগ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। একটি ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা, অন্যটি ভূতাত্ত্বিক প্লেট বাউন্ডারি। বাংলাদেশের উত্তরে নেপাল-ভুটানের দক্ষিণ সীমান্তে পূর্ব-পশ্চিমে ২৭০০ কিলোমিটার বিস্তৃত ইন্ডিয়ান ও ইউরেশিয়ান প্লেট বাউন্ডারি, যেখানে নেপাল সেগমেন্টে গত ২৫ এপ্রিল ও ১২ মে বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছে। ১৯৩৪ সালেও এ প্লেট বাউন্ডারিতে ৮.২ মাত্রার নেপাল-বিহার ভূমিকম্প হয়েছিল। এ প্লেট বাউন্ডারির ভুটান সেগমেন্টে দীর্ঘ সময় কোনো বড় ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়নি। তাই ভুটান সেগমেন্টে ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশংকা রয়েছে। এ সেগমেন্টটি সিলেট-ময়মনসিংহ সীমান্ত থেকে ২০০ কিলোমিটার উত্তরে; কিন্তু রংপুর-দিনাজপুর থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে। ওই সেগমেন্টে ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষতির আশংকা আছে। ইন্ডিয়ান-ইউরেশিয়ান প্লেট বাউন্ডারির দক্ষিণে ভারতের শিলিং মালভূমি তথা মেঘালয় রাজ্য অবস্থিত। মেঘালয়ের দক্ষিণে সিলেট অঞ্চলে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বরাবর উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত ২৭০ কিলোমিটার লম্বালম্বি অত্যন্ত সক্রিয় একটি ফাটল রেখা আছে, যা ডাউকি ফাটল বলে পরিচিত। এ ফাটল রেখা ৮ মাত্রারও বেশি ভূমিকম্প সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে।
বাংলাদেশের পূর্ব প্রান্তে ইন্ডিয়ান ও বার্মিজ প্লেট বাউন্ডারি। এ বাউন্ডারিটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত টেকনাফ থেকে উত্তরে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। ওই প্লেট বাউন্ডারির পশ্চিম প্রান্তে বাংলাদেশ সীমানার ভেতরে কয়েকটি সক্রিয় ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা আছে। যেগুলো অতীতে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি করেছে।
চট্টগ্রাম-মিয়ানমার উপকূলে উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত রাখাইন ফাটল রেখা বেশ সক্রিয়। এ ফাটলে দুটি পরস্পর সংঘটিত ভূমিকম্পের মধ্যবর্তী সময়কাল (রেফারেন্স পিরিয়ড) ৩০০-৯০০ বছর। ১৭৬২ সালে রাখাইন ফাটল সর্বশেষ বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি করেছে। সেই হিসাবে এ ফাটল রেখাটি যে কোনো সময় বড় ভূমিকম্পের জন্ম দিতে পারে। ওই প্লেট বাউন্ডারির ত্রিপুরা সেগমেন্ট দীর্ঘ সময় বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি করেনি। তাই এ সেগমেন্টটিও পরবর্তী যে কোনো সময় বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে।
ডাউকি ফাটল রেখায় পরস্পর সংঘটিত দুটি ভূমিকম্পের মধ্যবর্তী সময়কাল ৩৫০ বছর। ১৮৯৭ সালে এ ফাটল রেখায় সর্বশেষ বড় ভূমিকম্প হয়। তাই পরবর্তী ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হতে আরও প্রায় ২৩০ বছর সময় লাগবে। কিন্তু ডাউকি ফাটল রেখার পূর্বাংশ বেশি সক্রিয়। এ অংশ যে কোনো সময় মাঝারি থেকে শক্তিশালী ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। দেশের মধ্যবর্তী মধুপুর ফাটল রেখা সর্বশেষ ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প জন্ম দেয়। এ ফাটল রেখায় পরবর্তী ভূমিকম্প হতেও অনেক দিন বাকি।
চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা পাহাড়ি অঞ্চলে ২০-৬০ কিলোমিটার লম্বা প্রায় ১৩টি ফাটল রেখা আছে। এ ফাটল রেখাগুলোর দুটি ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে শক্তিশালী ভূমিকম্পের জন্ম দিয়েছে। এ ধরনের ভূমিকম্পকে ভাসমান ভূমিকম্প বলে। যে কোনো সময় এ ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। এ ফাটল রেখাগুলোকে কেন্দ্র করে ৬.৬-৭.২ মাত্রার ভূমিকম্প যে কোনো সময় হওয়ার আশংকা আছে। এ ধরনের ভাসমান ভূমিকম্পের রেকারেন্স পিরিয়ড ১০০ বছর।
অবকাঠামোর বিপদাপন্নতা (Vulnerability) : দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ দুর্যোগঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ১৯৫৪ সালে ঢাকা শহরের আয়তন ছিল ৩৬ বর্গকিলোমিটার। ২০১০ সালে তা ২৬০ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ৫৬ বছরে ৭ গুণেরও বেশি বেড়েছে শহর এলাকা। ১৯৭১ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১২ লাখ, এখন তা দেড় কোটি। ৪৫ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে সাড়ে ১২ গুণ। বাকি বড় শহরগুলোর অবস্থাও অনেকটা একই রকম। নগরমুখী জনসংখ্যার গড় বৃদ্ধির অনুপাতে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশের বেশি মানুষ হবে নগরবাসী। এসব এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্রুত বাড়ছে। এতে নগরীর দুর্যোগ বিপদাপন্নতাও বাড়ছে। আমাদের অবকাঠামো ভূমি ব্যবহার নীতিমালা অনুযায়ী দুর্যোগ সহনীয় করে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস সন্নিবেশিত ভূমি ব্যবহার মানচিত্রও আমাদের নেই।
অবকাঠামোর বিপদাপন্নতা বলতে দালান-কোঠাসহ শহরের গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি, পানি ও রাস্তাঘাটের গুণগত অবস্থাকে বোঝানো হয়। সাধারণত Masonry দালান (ইট-সুরকির দালান), Soft storey (নিচতলা খালি ও পার্কিংয়ের জন্য ব্যবহৃত), Heavy overhang দালান (উপরের তলা অপরিকল্পিভাবে ভারি করে তৈরি করা) এবং Short Column দালান ভূমিকম্পে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। ২০০৯-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় ১৪০ হাজার Masonry building রয়েছে। ৯০ হাজার Soft storey, ৬৯ হাজার Heavy overhang, ৫৮ হাজার Short colum দালান ঢাকায় আছে। চট্টগ্রাম ও সিলেটের চিত্র অনেকটা একই রকম। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে প্রায় ২৩শ’ কিলোমিটার রাস্তা আছে। যার মধ্যে ৭৬ শতাংশের প্রশস্ততা কম হওয়ায় ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি যাতায়াতের যোগ্য নয়। এর মধ্যে ৫১ শতাংশের বেশি রাস্তা বেশ দুর্বল মাটিতে তৈরি করা হয়েছে। গ্যাস লাইনের অবকাঠামোও বেশ দুর্বল। ঢাকায় ৫৬ শতাংশ গ্যাস লাইন দুর্বল liquefiable মাটিতে টানা হয়েছে। পানির লাইনের ক্ষেত্রেও তাই।
উপরন্তু বর্তমান নগরায়ণ হচ্ছে নরম মাটিতে। ঢাকার ক্ষেত্রে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, টঙ্গীখাল ও বালু নদের মাঝে ৩০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৬৫ শতাংশ এলাকার মাটি নরম। সাধারণত নরম মাটিতে ভূমিকম্প তরঙ্গের স্থায়িত্বকাল বেশি এবং নরম মাটি তরঙ্গের বিশেষ অংশের শক্তি বাড়িয়ে দেয়। তাই নরম মাটিতে গড়ে ওঠা স্থাপনার ঝুঁকিও বেশি। অন্যদিকে পুরান ঢাকায় দালানকোঠার বয়স বেশি হওয়ায় সেগুলোও ঝুঁকিতে আছে। অন্যান্য শহরের চিত্রও কমবেশি একই রকম। তাই আপদ ও বিপদের বিচারে বাংলাদেশের শহরগুলো ভূমিকম্পের তীব্র ঝুঁকিতে আছে।
অবকাঠামোগুলোর এ বিপদাপন্ন অবস্থায় এবং শক্তিশালী ভূমিকম্প আপদের সম্ভাবনার কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ছাড়াও দেশের অন্যান্য শহর যেমন- ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর ও রাজশাহীরও ঝুঁকি কম নয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মধুপুর ফাটল রেখায় ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৭২ হাজার বিল্ডিং সম্পূর্ণ ভেঙে পড়তে পারে, যা ঢাকার দালান-কোঠার প্রায় ২৩ শতাংশ। রাখাইন ফাটল রেখায় ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে চট্টগ্রামে ১ লাখ ৪২ হাজার বিল্ডিং ভেঙে পড়তে পারে, যা চট্টগ্রামের দালান-কোঠার প্রায় ৯০ শতাংশ। ডাউকি ফাটল রেখায় ৮.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে সিলেটে ৪১ হাজার দালান-কোঠা ভেঙে পড়তে পারে, যা সিলেটের দালান-কোঠার প্রায় ৭৯ শতাংশ।
প্রস্তুতি : কাঠামোগত বিপদাপন্নতা ভূমিকম্প দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বিল্ডিং কোডের সঠিক ব্যবহার এ দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমন করে। ১৯৯৩ সালে বিল্ডিং কোড প্রণীত হয়। ২০০৬ সালে গেজেটভুক্ত হয়। বর্তমানে এ কোড আবার pdated-এর পথে। যদিও ঢাকায় রাজউককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কোড বাস্তবায়নের জন্য। কিন্তু দেশব্যাপী একই কোড বাস্তবায়নের কোনো নীতিমালা নেই। তাই এখনই প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংস্থা গঠনের।
ভূমিকম্প ঝুঁকি হ্রাসের জন্য প্রয়োজন আপদপ্রবণ শহরগুলোর ঝুঁকি সন্নিবেশিত ভূমি ব্যবহার মানচিত্র প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। Urban Developments Directorate (UDD) ময়মনসিংহ শহর নিয়ে এ কাজটি শুরু করেছে। প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করে কাজটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া জরুরি।
Command and Coordination, উদ্ধার-অনুসন্ধান ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর অবকাঠামোগুলো ভূমিকম্পের তীব্রতার বিপরীতে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। চঁনষরপ Public Works Department (PWD) ইতিমধ্যে জাইকার সহযোগিতায় এ বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ পেয়েছে। এখন দ্রুতগতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো retrofitting করার কাজে হাত দেয়া প্রয়োজন। জরুরি সাড়া প্রদানকারী ১৩টি সংস্থার জন্য Scenario-ভিত্তিক Contingency পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। প্রয়োজন সেগুলো বাস্তবায়ন করা এবং নিয়মিত মহড়া দিয়ে পরিকল্পনাকে সতেজ রাখা।
Fire Service & Civil Defense, Armed force Division এবং City Corporation-এর জন্য সরকার ইতিপূর্বে ৬৯ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয় করেছে। আরও ১৫৯ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ ক্রয় করার পথে। উদ্ধার ও অনুসন্ধান কাজের জন্য বাংলাদেশ-উপযোগী ক্ষুদ্র ও মাঝারি যন্ত্রপাতি ক্রয় করাকে এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হবে।
৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে ইতিমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় অনুসন্ধান, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আরও ৩২ হাজারকে একই প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সরকারি অর্থায়নে Urban Disaster Preparedness Volunteer কার্যক্রমকে দ্রুত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে।
School Safety & Evacuation drill চালু করার জন্য ঈউগচ উদ্যোগ নিয়েছে। ১০০ স্কুলে drill করার যন্ত্রাংশ দেয়া হয়েছে। এ rill নিয়মিতভাবে দেশব্যাপী কার্যকর করার উদ্যোগ অবিলম্বে নিতে হবে। এর মধ্য দিয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভূমিকম্প দুর্যোগ বিষয়ে সচেতন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বন্যা ও সাইক্লোন দুর্যোগের প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। সুদীর্ঘ সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প দেশটিতে হানা না দেয়ার কারণে এ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সক্ষমতা সীমিত। তবে ইতিমধ্যে এ দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনের জন্য সঠিক পদ্ধতিতে এডহক-ভিত্তিক বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এখন প্রয়োজন এ কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন করা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২-এর বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নগর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা সম্ভব।
অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল : চেয়ারম্যান, দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments