পৌর নির্বাচনের ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান by গোলাম মাওলা রনি
২০১৫ সালের শেষ মাসের শেষ দিকের একটি দিনে হয়ে যাওয়া যজ্ঞটির নাম ছিল পৌর নির্বাচন। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন শুরুর দিকে এমন হম্বিতম্বি শুরু করল, যাতে করে কিছু মানুষের বিশ্বাস জন্ম নিলো- এবার হয়তো যুগান্তকারী কিছু একটা ঘটবে। নির্বাচনের পরে দেখা গেল, সত্যিই যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গেছে। আমাদের রাজনৈতিক দল, গণতান্ত্রিক চেতনা, জনগণের বিশ্বাস এবং আস্থা সর্বোপরি বহির্বিশ্বে সভ্যতার ভাবমূর্তিতে যে ক্ষত সৃষ্টি হলো, তা কাটিয়ে উঠতে কত যুগ অপেক্ষা করতে হবে তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। নির্বাচন-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে কার কতটুকু লাভ কিংবা ক্ষতি হলো, তা নিয়ে কেউ কেউ নিবন্ধ লিখে যেমন পত্রপত্রিকা ভরে ফেলেছেন, তেমনি গলা ফাটানো শব্দসন্ত্রাসে টেলিভিশনগুলোর পর্দায় সর্বনেশে পদ্মার ঢেউয়ের তাণ্ডব চালিয়েছেন অনেকে। আজকের নিবন্ধে আমি অবশ্য ওদিকে পা বাড়াব না- বরং পৌর নির্বাচন নিয়ে ভিন্নতর কিছু উপস্থাপনের চেষ্টা করব।
আমার মতে- সাম্প্রতিক কালের পৌর নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই অনাগত দিনে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে নিয়ে আসবে এবং সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি, দুর্ভোগ ও লাঞ্ছনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। নির্বাচন কমিশন, জনগণ, রাজনৈতিক দল, সুবিধাবাদী গোষ্ঠী, সুশীলসমাজ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে ধর্মীয় নেতারা পর্যন্ত নতুন নতুন বিরূপ পরিস্থিতির কবলে পড়বেন। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে নির্বাচন কমিশন। পত্রপত্রিকায় দেখলাম- কর্নেল অলিসহ আরো অনেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং কমিশনের বড় কর্তাদের আগামী দিনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সর্বোচ্চ কঠোর সাজা দেয়ার কথা বলেছেন। কর্নেল অলির বক্তব্যের বেশ কয়েক দিন আগে সম্ভবত নির্বাচনের দিন সন্ধ্যার দিকে অধ্যাপক আসিফ নজরুল একই আশঙ্কার কথা বলেছিলেন বাংলাভিশনের একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে। তিনি বলেছিলেন, এই নির্বাচন কমিশন গত ৫ জানুয়ারি থেকে আজ অবধি যতগুলো নির্বাচন করেছে এবং সেসব নির্বাচনে এমন সব অদ্ভুত বেআইনি কর্মকাণ্ড করেছে, যা আগামী দিনে তাদেরকে অবশ্যই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। কোন আইনের ভিত্তিতে তারা দায়ী হবেন সে ব্যাখ্যাও অধ্যাপক আসিফ নজরুল করেছেন।
আমাদের দেশে নির্বাচনসংক্রান্ত অনিয়ম ও দুর্নীতি মোটামুটি সব সরকারের আমলেই কম-বেশি হয়েছে। সময়ের বিবর্তনে সংশ্লিষ্ট সরকারের পতনের পর জনরোষ এবং আইনভঙ্গের দায় কেবল রাজনীতিবিদ এবং তাদের দোসরদেরই ভোগ করতে হয়েছে- কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে হুমকির মধ্যে ফেলা হয়নি। কিন্তু বর্তমান কমিশনের কর্মকাণ্ডে সম্ভবত অতীতের সেই ধারাবাহিকতা থাকবে না। আগামী দিনে নির্বাচন কমিশনের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা এবং তাদের মদদদাতাদের একই কাঠগড়ায় হাজির করানোর বিষয়ে জনমত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সামাজিকভাবেও নির্বাচন কমিশনে কর্মরতদের ভালো চোখে দেখা হচ্ছে না। তাদের নামধাম, কথাবার্তা এবং অঙ্গভঙ্গিকে লোকজন তাদের প্রাত্যহিক জীবনের নানা ক্রীড়া, কৌতুক ও রঙ-তামাশায় উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করছেন। এসব লক্ষণ ইতঃপূর্বে পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে অনাগত দিনগুলোতে ১৭ কোটি মানুষের মন ও মনন, চিন্তা ও চেতনা কিছু মানুষকে ঘৃণা, অশ্রদ্ধা এবং বিরক্তির এমন এক সীমায় নিয়ে যাবে, যা কল্পনা বা চিন্তা করলে শিউরে ওঠা ছাড়া উপায় থাকবে না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনের জয়-পরাজয় নিয়ে কী ভাবছে তা আমার জানা নেই। তবে দলটির নেতৃবৃন্দের কথাবর্তা শুনে মনে হচ্ছে, তারা আত্মবিশ্বাসের চূড়ান্ত শিখরে উঠে গেছেন। তাদের মুচকি মুচকি হাসি, ব্যঙ্গাত্মক কথাবার্তা এবং মিথ্যা দম্ভ দেখে বিবেকবান লোকের বোবা হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। নির্বাচনকে ঘিরে সংঘটিত সব অনিয়ম, অপরাধ, মিথ্যাচার, তাণ্ডব, জালজালিয়াতি প্রভৃতিকে জীবন্ত কবর দিয়ে ক্ষমতাসীনেরা সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন- এ নিয়ে কোনো কথা নয়; নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এবং আমরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছি। তাদের এসব কথাবার্তার প্রতিবাদ করবে কিংবা সামান্যতম প্রতিরোধ করবে এমন শক্তি, সাহস ও স্পর্ধা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কারো নেই। ফলে এত বড় একটি বেইনসাফি কর্মের পরও সারা দেশে আশ্চর্য এক সুমসাম নীরবতা বিরাজ করছে। ফলে সরকারি লোকজনের আত্মবিশ্বাস হিমালয়ের উচ্চতা ছাড়িয়ে নতুন মাত্রার উঁচু জিনিসের খোঁজে ইতিউতি আরম্ভ করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো- সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনের ফলাফলে সরকারি দলের কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে? এ ব্যাপারে জগৎ-সংসারের একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। কোনো পিতা যদি তার সন্তানদের পরিশ্রম করার পরিবর্তে চুরি-ডাকাতি কিংবা রাহাজানি করতে প্রেরণা দেয় এবং পিতার আশকারা পেয়ে সন্তানেরা যদি ওসব মন্দকর্মে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে ফেলে, তবে সময়ের বিবর্তনে পিতা চাইলেও সন্তানেরা মন্দকর্ম পরিহার করে সুপথে ফিরে আসতে পারবে না। মন্দকর্মের দ্বারা অর্জিত সম্পদ সবাইকে নিঃশেষ করে দেয়। তারা অহঙ্কারী ও অত্যাচারী জাহেলে পরিণত হয়। জগৎ-সংসারের কোনো নীতিকথা, মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি তাদেরকে স্পর্শ করে না। তারা আমৃত্যু মানবের পরিবর্তে দানবীয় জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা তাদের আত্মীয়পরিজনকে নিয়ে ধ্বংসের অতলগহ্বরে ডুব দেয়ার আগে তাদের জন্মদাতাদের দুনিয়া ও আখেরাতকে সর্বনাশ করে ছাড়ে। একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা তাদের দলীয় প্রধানের কাছে সন্তানতুল্য বলে বিবেচিত হয়। অন্য দিকে দলটির সাংগঠনিক কাঠামো, নিয়মকানুন, বিধিবিধান এবং কর্মকাণ্ড সেনাবাহিনীর মতো বিধিবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনীয়। দল চালাতে গিয়ে যদি কোনো অনিয়ম, নীতিবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড এবং অনাচারকে প্রশ্রয় দেয়া হয়, তবে তা শেষ অবধি দলের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা এক সময় গর্ব করে বলত, তারা অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে ক্ষমতায় এসেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা যখন নিজেরাই ওসব কর্ম করছে, তখন তাদের পরিণতি তাবৎ দুনিয়ার অন্যায়কারীদের মতোই হবে। তারা যেসব পদ-পদবি অর্জন করেছে বা অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়ে তুলেছে, তার জন্য কোনো দিন তারা দলের প্রতি বা দলীয় প্রধানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না, তাদের মন্দ অর্জনের সফলতাকে নিত্যনতুন মন্দকর্ম দ্বারা অলঙ্কৃত করবে। অতিরিক্ত ভোগ ও দখলের মনোবৃত্তির কারণে তারা লোভী, স্বার্থপর ও নিষ্কর্মা হয়ে পড়বে। তারা শয়তানের সাথে দোস্তি ও পিশাচের সাথে মাস্তি করার অছিলা তালাশ করবে। দলের প্রয়োজনে কিংবা দলের দুর্দিনে তারা ভয়ানক কৃপণতা ও কাপুরুষতার পরকাষ্ঠা দেখাবে। নিজেদের পদ-পদবি রক্ষার জন্য প্রয়োজনে তারা শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করবে অথবা ধনসম্পদের একটি অংশ নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।
যে পিতা সন্তানদের মিথ্যা বলতে উৎসাহিত করে, মন্দকাজে প্রেরণা জোগায় এবং অসৎ উপার্জন ও অত্যাচারী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে, সেই পিতার দুর্ভাগ্য তাকে কিয়ামত পর্যন্ত তাড়া করে ফেরে। সন্তানেরা তাদের পিতাকে নিজেদের চেয়ে মন্দলোক বলে বিবেচনা করে এবং নিজেদের সব অধঃপতনের জন্য আমৃত্যু জন্মদাতাকে গালাগালি ও অভিশাপ প্রদান করতে থাকে। তারা নিজেদের জীবন থেকে পিতার পরিচয় মুছে ফেলার অবিরত চেষ্টা করে এবং সময় সুযোগমতো নিজেদের সব কুকীর্তির দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার পরাকাষ্ঠা পিতার ওপর প্রয়োগ করার সুবন্দোবস্ত করে থাকে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে অন্তত এক হাজার যোগ্য লোক ছিলেন, যারা যেকোনো পরিস্থিতিতে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার শক্তি ও সাহস দেখাতে পারতেন। অন্য দিকে উপজেলা, পৌরসভা প্রভৃতি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো শক্তিশালী হাজার হাজার নেতাকর্মী ছিলেন। ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন, তার পরের উপজেলা এবং সবশেষের পৌর নির্বাচন নামক যজ্ঞের মাধ্যমে যারা সুবিধাভোগী হয়েছেন, তারা আগামী দিনের প্রতিযোগিতামূলক মাঠে টিকে থাকা তো দূরের কথা- দাঁড়াতেই সাহস পাবেন না। দলের অবশিষ্ট লড়াকু নেতাকর্মীরা বর্তমানের সুবিধাভোগীদের তাপচাপ ও অত্যাচারে গত দুই বছরে এমন পঙ্গুত্ববরণ করেছেন যে, তাদের প্রায় সবাই নিজেদের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। এ অবস্থায় সামান্য বিপত্তি দেখা দিলে কতজনকে মাঠে পাওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে।
এবার পৌর নির্বাচনে অংশ নেয়া অন্য দলগুলো সম্পর্কে কিছু বলি। আমি মনে করি, বিরোধী দলের যেসব প্রার্থী জয়ী হয়েছেন কিংবা হেরেছেন, তারা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং আগামী দিনে আরো হবেন। জয়ী ব্যক্তিরা যদি সরকারের সাথে মিশে যেতে পারেন, তবে তারা দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেন এবং নিজেরা নতুন এক অনৈতিক জীবন ও জীবিকার ফাঁদে পড়বেন। অন্য দিকে যারা সরকারের সাথে হাত মেলাবেন না তারা মামলা-হামলা ও হয়রানির শিকার হয়ে নিজেদের এবং আত্মীয়পরিজনকে নতুন করে বিপদে ফেলবেন। অনেকে বহিষ্কারাদেশের কবলে পড়বেন এবং জেলে গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করবেন। যারা নির্বাচনে গিয়ে রামধরা খেয়েছেন এবং চোখের সামনে বিজয়ী হওয়ার নাটক দেখে পরাজিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন, তারা আগামী দিনে মনোবল হারিয়ে ফেলবেন। তথাকথিত অবমাননাকর পরাজয়, বিজয়ীর দম্ভ, আর্থিক ক্ষতি, অপমান এবং নিকটজনের ধিক্কার তাকে যারপরনাই বিষাদগ্রস্ত বানিয়ে ফেলবে। ফলে আগামী দিনে নতুন একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো যোগ্যতাই হয়তো আর অবশিষ্ট থাকবে না। দলের প্রতি তার একটা অভিমান পয়দা হয়ে যাবে এবং অনেক কিছু থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়ার প্রবণতার কারণে তিনি দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নীরবে দূরে সরে যাবেন। ফলে দল লড়াকু কর্মীর অভাবে দিনকে দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়বে।
দেশের সংবাদপত্র শিল্প এবং সুশীলসমাজ এবারের পৌর নির্বাচন দ্বারা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ১০-১২ বছর ধরে যেসব পত্রপত্রিকা তার পাঠকদের কাছে মোটামুটি গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিল, এবারের নির্বাচন নিয়ে তাদের সৃষ্ট প্রতিবেদন পরিবেশনার জন্য তারা মানুষজনের ধিক্কারের পাত্রে পরিণত হয়েছে। তাদের অতীতের সাহস-শক্তি এবং কৌশল আজ কেবলই স্মৃতি। তাদের বর্তমান কর্মকাণ্ড, লোভলালসা ও আত্মসমর্পণ করার গতিপ্রকৃতি দেখে স্বয়ং ক্ষমতাবানেরা আশ্চর্য হয়ে বলাবলি করছেন- ওরা এত সহজে এতটা নিচে নামতে পারে, তা তো আগে জানতাম না। আমরা অযথাই ইঁদুরকে বিড়াল ভেবেছিলুম- আর বিড়ালকে ভেবেছিলুম বাঘ। অন্য দিকে, সুশীলদের চিন্তা ও চেতনায় এবারের পৌর নির্বাচন নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। তারা সবাই হাশরের ময়দানের থিওরিতে বিশ্বাস স্থাপন করে নির্বাচনের দিন থেকেই ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি জিকির আরম্ভ করে দিয়েছেন। তারা কনফুসিয়াসের তত্ত্বের ভিত্তিতে নিজ নিজ কর্ম এবং নিজ নিজ জীবন ও সংসারের প্রতি অতি মাত্রায় যত্নশীল হয়ে পড়েছেন।
সবশেষে বলছি জনগণের কথা। পৌর নির্বাচনের ডামাডোল এবং ফলাফলের সাতকাহনে জনগণ রীতিমতো পরশপাথর বনে গেছেন। তারা সরকারকে এই বলে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন যে, সরকার দয়া করে ভোটার তালিকায় তাদের নাম ও ছবিটি রেখেছে। যদি তালিকায় নামধামই না থাকত তাহলে কী-ই বা করার ছিল, তারা নির্বাচন কমিশনের প্রতি কায়মনোবাক্যে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন এই বলে যে- আহা, কী সুন্দর ব্যবস্থা! আগের রাইতেই সব ফকফকা- ও মানিক কী বাতি লাগাইছিলি!!
জনগণ বেশখানিকটা অবাক হয়ে টিভিতে দেখলেন যে, দশ-বারো বছরের ছেলেমেয়েরা ভোট দেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সাংবাদিকেরা যখন ওই সব সোনামণিকে জিজ্ঞেস করলেন- মনুরা, তোমাগো বাপের নাম কী? তখন তারা বাপের নামটি ভুলে গেল- কেউ কেউ আবার নিজের নামটি পর্যন্ত ভুলে বসল। বিকেলের দিকে নির্বাচনের ফলাফল দেখে জনগণ প্রচণ্ড আবেগ ও কৃতজ্ঞতায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন- আমরা হীরক রাজার দেশের বাসিন্দা নই- আমরা কোনো যন্তরমন্তর কামরায় ঢুকিনি- আমরা সত্য বলছি- ‘নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে’। কারণ, আমাদের সত্যবাদী প্রধান নির্বাচন কমিশনার মহাক্ষমতাধর কর্তা কাজী রকীবউদ্দিন মহোদয় জীবনসায়াহ্নে এসে আল্লাহ ও রাসূল সা:কে সাক্ষী রেখে দেশবাসীর সামনে বীরদর্পে ঘোষণা করেছেন- ‘নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে’। তার কথার ওপর কথা বলা যাবে না- তার সব বক্তব্যকে সমস্বরে সমর্থন জানাতে হবে এবং আগামী দিনে আরো সুন্দর ও ভয়ঙ্কর নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি যেন শতায়ু লাভ করেন, এমন দোয়া পাঠান্তে ঘুমোতে যাওয়ার প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা করার শক্তি এ দেশের জনগণ লাভ করেছেন সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনের মাধ্যমে। জনগণের এই নতুন প্রাপ্তি তাদের ভাগ্যকে কতটা রঞ্জিত করে, এটাই এখন দেখার বিষয়।
আমার মতে- সাম্প্রতিক কালের পৌর নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই অনাগত দিনে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে নিয়ে আসবে এবং সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি, দুর্ভোগ ও লাঞ্ছনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। নির্বাচন কমিশন, জনগণ, রাজনৈতিক দল, সুবিধাবাদী গোষ্ঠী, সুশীলসমাজ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে ধর্মীয় নেতারা পর্যন্ত নতুন নতুন বিরূপ পরিস্থিতির কবলে পড়বেন। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে নির্বাচন কমিশন। পত্রপত্রিকায় দেখলাম- কর্নেল অলিসহ আরো অনেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং কমিশনের বড় কর্তাদের আগামী দিনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সর্বোচ্চ কঠোর সাজা দেয়ার কথা বলেছেন। কর্নেল অলির বক্তব্যের বেশ কয়েক দিন আগে সম্ভবত নির্বাচনের দিন সন্ধ্যার দিকে অধ্যাপক আসিফ নজরুল একই আশঙ্কার কথা বলেছিলেন বাংলাভিশনের একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে। তিনি বলেছিলেন, এই নির্বাচন কমিশন গত ৫ জানুয়ারি থেকে আজ অবধি যতগুলো নির্বাচন করেছে এবং সেসব নির্বাচনে এমন সব অদ্ভুত বেআইনি কর্মকাণ্ড করেছে, যা আগামী দিনে তাদেরকে অবশ্যই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। কোন আইনের ভিত্তিতে তারা দায়ী হবেন সে ব্যাখ্যাও অধ্যাপক আসিফ নজরুল করেছেন।
আমাদের দেশে নির্বাচনসংক্রান্ত অনিয়ম ও দুর্নীতি মোটামুটি সব সরকারের আমলেই কম-বেশি হয়েছে। সময়ের বিবর্তনে সংশ্লিষ্ট সরকারের পতনের পর জনরোষ এবং আইনভঙ্গের দায় কেবল রাজনীতিবিদ এবং তাদের দোসরদেরই ভোগ করতে হয়েছে- কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে হুমকির মধ্যে ফেলা হয়নি। কিন্তু বর্তমান কমিশনের কর্মকাণ্ডে সম্ভবত অতীতের সেই ধারাবাহিকতা থাকবে না। আগামী দিনে নির্বাচন কমিশনের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা এবং তাদের মদদদাতাদের একই কাঠগড়ায় হাজির করানোর বিষয়ে জনমত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সামাজিকভাবেও নির্বাচন কমিশনে কর্মরতদের ভালো চোখে দেখা হচ্ছে না। তাদের নামধাম, কথাবার্তা এবং অঙ্গভঙ্গিকে লোকজন তাদের প্রাত্যহিক জীবনের নানা ক্রীড়া, কৌতুক ও রঙ-তামাশায় উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করছেন। এসব লক্ষণ ইতঃপূর্বে পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে অনাগত দিনগুলোতে ১৭ কোটি মানুষের মন ও মনন, চিন্তা ও চেতনা কিছু মানুষকে ঘৃণা, অশ্রদ্ধা এবং বিরক্তির এমন এক সীমায় নিয়ে যাবে, যা কল্পনা বা চিন্তা করলে শিউরে ওঠা ছাড়া উপায় থাকবে না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনের জয়-পরাজয় নিয়ে কী ভাবছে তা আমার জানা নেই। তবে দলটির নেতৃবৃন্দের কথাবর্তা শুনে মনে হচ্ছে, তারা আত্মবিশ্বাসের চূড়ান্ত শিখরে উঠে গেছেন। তাদের মুচকি মুচকি হাসি, ব্যঙ্গাত্মক কথাবার্তা এবং মিথ্যা দম্ভ দেখে বিবেকবান লোকের বোবা হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। নির্বাচনকে ঘিরে সংঘটিত সব অনিয়ম, অপরাধ, মিথ্যাচার, তাণ্ডব, জালজালিয়াতি প্রভৃতিকে জীবন্ত কবর দিয়ে ক্ষমতাসীনেরা সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন- এ নিয়ে কোনো কথা নয়; নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এবং আমরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছি। তাদের এসব কথাবার্তার প্রতিবাদ করবে কিংবা সামান্যতম প্রতিরোধ করবে এমন শক্তি, সাহস ও স্পর্ধা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কারো নেই। ফলে এত বড় একটি বেইনসাফি কর্মের পরও সারা দেশে আশ্চর্য এক সুমসাম নীরবতা বিরাজ করছে। ফলে সরকারি লোকজনের আত্মবিশ্বাস হিমালয়ের উচ্চতা ছাড়িয়ে নতুন মাত্রার উঁচু জিনিসের খোঁজে ইতিউতি আরম্ভ করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো- সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনের ফলাফলে সরকারি দলের কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে? এ ব্যাপারে জগৎ-সংসারের একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। কোনো পিতা যদি তার সন্তানদের পরিশ্রম করার পরিবর্তে চুরি-ডাকাতি কিংবা রাহাজানি করতে প্রেরণা দেয় এবং পিতার আশকারা পেয়ে সন্তানেরা যদি ওসব মন্দকর্মে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে ফেলে, তবে সময়ের বিবর্তনে পিতা চাইলেও সন্তানেরা মন্দকর্ম পরিহার করে সুপথে ফিরে আসতে পারবে না। মন্দকর্মের দ্বারা অর্জিত সম্পদ সবাইকে নিঃশেষ করে দেয়। তারা অহঙ্কারী ও অত্যাচারী জাহেলে পরিণত হয়। জগৎ-সংসারের কোনো নীতিকথা, মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি তাদেরকে স্পর্শ করে না। তারা আমৃত্যু মানবের পরিবর্তে দানবীয় জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা তাদের আত্মীয়পরিজনকে নিয়ে ধ্বংসের অতলগহ্বরে ডুব দেয়ার আগে তাদের জন্মদাতাদের দুনিয়া ও আখেরাতকে সর্বনাশ করে ছাড়ে। একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা তাদের দলীয় প্রধানের কাছে সন্তানতুল্য বলে বিবেচিত হয়। অন্য দিকে দলটির সাংগঠনিক কাঠামো, নিয়মকানুন, বিধিবিধান এবং কর্মকাণ্ড সেনাবাহিনীর মতো বিধিবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনীয়। দল চালাতে গিয়ে যদি কোনো অনিয়ম, নীতিবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড এবং অনাচারকে প্রশ্রয় দেয়া হয়, তবে তা শেষ অবধি দলের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা এক সময় গর্ব করে বলত, তারা অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে ক্ষমতায় এসেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা যখন নিজেরাই ওসব কর্ম করছে, তখন তাদের পরিণতি তাবৎ দুনিয়ার অন্যায়কারীদের মতোই হবে। তারা যেসব পদ-পদবি অর্জন করেছে বা অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়ে তুলেছে, তার জন্য কোনো দিন তারা দলের প্রতি বা দলীয় প্রধানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না, তাদের মন্দ অর্জনের সফলতাকে নিত্যনতুন মন্দকর্ম দ্বারা অলঙ্কৃত করবে। অতিরিক্ত ভোগ ও দখলের মনোবৃত্তির কারণে তারা লোভী, স্বার্থপর ও নিষ্কর্মা হয়ে পড়বে। তারা শয়তানের সাথে দোস্তি ও পিশাচের সাথে মাস্তি করার অছিলা তালাশ করবে। দলের প্রয়োজনে কিংবা দলের দুর্দিনে তারা ভয়ানক কৃপণতা ও কাপুরুষতার পরকাষ্ঠা দেখাবে। নিজেদের পদ-পদবি রক্ষার জন্য প্রয়োজনে তারা শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করবে অথবা ধনসম্পদের একটি অংশ নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।
যে পিতা সন্তানদের মিথ্যা বলতে উৎসাহিত করে, মন্দকাজে প্রেরণা জোগায় এবং অসৎ উপার্জন ও অত্যাচারী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে, সেই পিতার দুর্ভাগ্য তাকে কিয়ামত পর্যন্ত তাড়া করে ফেরে। সন্তানেরা তাদের পিতাকে নিজেদের চেয়ে মন্দলোক বলে বিবেচনা করে এবং নিজেদের সব অধঃপতনের জন্য আমৃত্যু জন্মদাতাকে গালাগালি ও অভিশাপ প্রদান করতে থাকে। তারা নিজেদের জীবন থেকে পিতার পরিচয় মুছে ফেলার অবিরত চেষ্টা করে এবং সময় সুযোগমতো নিজেদের সব কুকীর্তির দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার পরাকাষ্ঠা পিতার ওপর প্রয়োগ করার সুবন্দোবস্ত করে থাকে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে অন্তত এক হাজার যোগ্য লোক ছিলেন, যারা যেকোনো পরিস্থিতিতে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার শক্তি ও সাহস দেখাতে পারতেন। অন্য দিকে উপজেলা, পৌরসভা প্রভৃতি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো শক্তিশালী হাজার হাজার নেতাকর্মী ছিলেন। ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন, তার পরের উপজেলা এবং সবশেষের পৌর নির্বাচন নামক যজ্ঞের মাধ্যমে যারা সুবিধাভোগী হয়েছেন, তারা আগামী দিনের প্রতিযোগিতামূলক মাঠে টিকে থাকা তো দূরের কথা- দাঁড়াতেই সাহস পাবেন না। দলের অবশিষ্ট লড়াকু নেতাকর্মীরা বর্তমানের সুবিধাভোগীদের তাপচাপ ও অত্যাচারে গত দুই বছরে এমন পঙ্গুত্ববরণ করেছেন যে, তাদের প্রায় সবাই নিজেদের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। এ অবস্থায় সামান্য বিপত্তি দেখা দিলে কতজনকে মাঠে পাওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে।
এবার পৌর নির্বাচনে অংশ নেয়া অন্য দলগুলো সম্পর্কে কিছু বলি। আমি মনে করি, বিরোধী দলের যেসব প্রার্থী জয়ী হয়েছেন কিংবা হেরেছেন, তারা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং আগামী দিনে আরো হবেন। জয়ী ব্যক্তিরা যদি সরকারের সাথে মিশে যেতে পারেন, তবে তারা দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেন এবং নিজেরা নতুন এক অনৈতিক জীবন ও জীবিকার ফাঁদে পড়বেন। অন্য দিকে যারা সরকারের সাথে হাত মেলাবেন না তারা মামলা-হামলা ও হয়রানির শিকার হয়ে নিজেদের এবং আত্মীয়পরিজনকে নতুন করে বিপদে ফেলবেন। অনেকে বহিষ্কারাদেশের কবলে পড়বেন এবং জেলে গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করবেন। যারা নির্বাচনে গিয়ে রামধরা খেয়েছেন এবং চোখের সামনে বিজয়ী হওয়ার নাটক দেখে পরাজিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন, তারা আগামী দিনে মনোবল হারিয়ে ফেলবেন। তথাকথিত অবমাননাকর পরাজয়, বিজয়ীর দম্ভ, আর্থিক ক্ষতি, অপমান এবং নিকটজনের ধিক্কার তাকে যারপরনাই বিষাদগ্রস্ত বানিয়ে ফেলবে। ফলে আগামী দিনে নতুন একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো যোগ্যতাই হয়তো আর অবশিষ্ট থাকবে না। দলের প্রতি তার একটা অভিমান পয়দা হয়ে যাবে এবং অনেক কিছু থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়ার প্রবণতার কারণে তিনি দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নীরবে দূরে সরে যাবেন। ফলে দল লড়াকু কর্মীর অভাবে দিনকে দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়বে।
দেশের সংবাদপত্র শিল্প এবং সুশীলসমাজ এবারের পৌর নির্বাচন দ্বারা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ১০-১২ বছর ধরে যেসব পত্রপত্রিকা তার পাঠকদের কাছে মোটামুটি গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিল, এবারের নির্বাচন নিয়ে তাদের সৃষ্ট প্রতিবেদন পরিবেশনার জন্য তারা মানুষজনের ধিক্কারের পাত্রে পরিণত হয়েছে। তাদের অতীতের সাহস-শক্তি এবং কৌশল আজ কেবলই স্মৃতি। তাদের বর্তমান কর্মকাণ্ড, লোভলালসা ও আত্মসমর্পণ করার গতিপ্রকৃতি দেখে স্বয়ং ক্ষমতাবানেরা আশ্চর্য হয়ে বলাবলি করছেন- ওরা এত সহজে এতটা নিচে নামতে পারে, তা তো আগে জানতাম না। আমরা অযথাই ইঁদুরকে বিড়াল ভেবেছিলুম- আর বিড়ালকে ভেবেছিলুম বাঘ। অন্য দিকে, সুশীলদের চিন্তা ও চেতনায় এবারের পৌর নির্বাচন নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। তারা সবাই হাশরের ময়দানের থিওরিতে বিশ্বাস স্থাপন করে নির্বাচনের দিন থেকেই ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি জিকির আরম্ভ করে দিয়েছেন। তারা কনফুসিয়াসের তত্ত্বের ভিত্তিতে নিজ নিজ কর্ম এবং নিজ নিজ জীবন ও সংসারের প্রতি অতি মাত্রায় যত্নশীল হয়ে পড়েছেন।
সবশেষে বলছি জনগণের কথা। পৌর নির্বাচনের ডামাডোল এবং ফলাফলের সাতকাহনে জনগণ রীতিমতো পরশপাথর বনে গেছেন। তারা সরকারকে এই বলে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন যে, সরকার দয়া করে ভোটার তালিকায় তাদের নাম ও ছবিটি রেখেছে। যদি তালিকায় নামধামই না থাকত তাহলে কী-ই বা করার ছিল, তারা নির্বাচন কমিশনের প্রতি কায়মনোবাক্যে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন এই বলে যে- আহা, কী সুন্দর ব্যবস্থা! আগের রাইতেই সব ফকফকা- ও মানিক কী বাতি লাগাইছিলি!!
জনগণ বেশখানিকটা অবাক হয়ে টিভিতে দেখলেন যে, দশ-বারো বছরের ছেলেমেয়েরা ভোট দেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সাংবাদিকেরা যখন ওই সব সোনামণিকে জিজ্ঞেস করলেন- মনুরা, তোমাগো বাপের নাম কী? তখন তারা বাপের নামটি ভুলে গেল- কেউ কেউ আবার নিজের নামটি পর্যন্ত ভুলে বসল। বিকেলের দিকে নির্বাচনের ফলাফল দেখে জনগণ প্রচণ্ড আবেগ ও কৃতজ্ঞতায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন- আমরা হীরক রাজার দেশের বাসিন্দা নই- আমরা কোনো যন্তরমন্তর কামরায় ঢুকিনি- আমরা সত্য বলছি- ‘নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে’। কারণ, আমাদের সত্যবাদী প্রধান নির্বাচন কমিশনার মহাক্ষমতাধর কর্তা কাজী রকীবউদ্দিন মহোদয় জীবনসায়াহ্নে এসে আল্লাহ ও রাসূল সা:কে সাক্ষী রেখে দেশবাসীর সামনে বীরদর্পে ঘোষণা করেছেন- ‘নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে’। তার কথার ওপর কথা বলা যাবে না- তার সব বক্তব্যকে সমস্বরে সমর্থন জানাতে হবে এবং আগামী দিনে আরো সুন্দর ও ভয়ঙ্কর নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি যেন শতায়ু লাভ করেন, এমন দোয়া পাঠান্তে ঘুমোতে যাওয়ার প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা করার শক্তি এ দেশের জনগণ লাভ করেছেন সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনের মাধ্যমে। জনগণের এই নতুন প্রাপ্তি তাদের ভাগ্যকে কতটা রঞ্জিত করে, এটাই এখন দেখার বিষয়।
No comments