পাথর by জয়দীপ দে
চেহারাটা ঠিক বোঝা যায় না। ঘষতি খাওয়া কাচের মধ্য দিয়ে দেখার মতো অস্বচ্ছ। স্পষ্ট কেবল দুটো চোখ। অগ্নিগর্ভের মতো দাউ দাউ করছে। এখনই যেন ছিটকে পড়বে আগুনের গোলা। যাওয়ার আগে একটা মেঘমন্দ্রধ্বনিতে চারিপাশ কাঁপিয়ে গেল: পাথর। অমনি যেন পাথর হতে শুরু করল তার দেহখানি। ধীরে ধীরে নিচ থেকে অসাড় হওয়া। শাহেদ ভয়ে লাফিয়ে ওঠে। বুকটা ধড়ফড় করে। চোখের সামনে খোলা জানালা। ক্ষয়েটে আলোয় অলস মনে দুলছে নারকেলের পাতা। ঘরের ভেতরে আলো-আঁধারির খেলা। জানালা দিয়ে উড়ে আসছে মশার ঝাঁক। ভনভন করছে চারপাশে। শাহেদ মর্মর-মূর্তির মতো চেয়ে থাকে জানালার দিকে। একটা সুস্থসবল মানুষ। পেট ভরে খেতে পারে। ভাবতে পারে আকাশপাতাল। মীরাক্কেল দেখে প্রাণভরে হাসতে পারে। কোনো ব্যথা নেই, বেদনা নেই। নেই কোনো অনুযোগ। অথচ উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটা তার নেই। পারার মধ্যে যা পারে কতগুলো জড়ানো শব্দ চারদিকে ছড়িয়ে দিতে। এখন এটাই তার ভাষা। তার নিজের ভাষা শুনে ভয় লাগে নিজেরই। তাই শব্দ করে না সে। নিজের মধ্যে ডুব দিয়ে কেবল অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে। ইদানীং এই স্বপ্নটা ঘন ঘন দেখছে ও। ইদানীং বলতে মাস তিনেক হবে। ইন্ডিয়া থেকে ফিরে আসার পর থেকে। ছোট্ট একটা সমস্যা নিয়ে ইন্ডিয়া যাওয়া। গলাটা কিছুদিন হয় বসে গিয়েছিল। তারপর এমবিবিএস থেকে স্পেশালিস্ট। বঙ্গবন্ধু থেকে সিআরপি। থেরাপি ওষুধ কিছুতেই যখন আর কাজ হচ্ছে না ডাক্তারই বলল, ‘যান না, একবার ঘুরে আসেন ওপার। গলাটাও দেখালেন, সঙ্গে পুরো শরীর চেকআপ।’
জুন-জুলাইয়ের চাপ শেষে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। পুরো ব্রাঞ্চের চার্জ তার মাথায়। এজিএম ব্রাঞ্চ। আপাতত এসপিও দিয়ে চলছে। সব সময় প্রেশার। তার ওপর মিড ইয়ারের ধাক্কা। কিন্তু দ্রুতই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে লাগল। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে হাতের মুঠোয় ব্রাশটা থাকছে না। মনের ভেতরে কু ডেকে উঠল। সেদিনই সার্কেল অফিসে গিয়ে ডিজিএমকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল। ডিজিএম খিটমিটে মেজাজের লোক। কিন্তু কেন জানি সেদিন খুব আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। তাঁর সহযোগিতায় দিন দশেকের মধ্যে চলে যাওয়া। ডাইরেক্ট এয়ার। একজন প্রফেশনাল পেশেন্ট গাইডকে দেওয়া হলো তাঁর সঙ্গে। নিমহানসে দিন কুড়ি ছিল। চেকআপের সব রিপোর্ট আসার পর ডাক্তার বেশ ইতস্ততার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে একজন নিকটাত্মীয়কে চাইছিল বারবার। শেষমেশ শাহেদ শক্ত হয়ে বলল, ‘প্লিজ টেল মি, আই এম রেডি ফর অল।’ ডাক্তার মিনমিন করে বলল, ‘মটর নিউরন ডিজিস।’ কথার ফাঁকে মুচকি হেসে, ‘রোগটা এই গ্রহের সবচেয়ে মেধাবী মানুষটার হয়েছে। তাঁর নাম জানেন—স্টিফেন হকিংস। কেন এমনটা হয়, আমাদের জানা নেই। এটা প্রগ্রেসিভ ডিজিস। কিউরেবল নয়। কেবল ঠেকিয়ে রাখা যায়।’ আর কিছু তার মাথায় ঢুকছিল না। মাথাটা পাক খাচ্ছিল অদৃশ্য কোনো অক্ষের ওপর। যত দিন অফিসে যাওয়া-আসা ছিল, গুগলে সার্চ দিয়ে দিয়ে দেখত। কোথাও কোনো আশার আলো নেই। রুরিল নামে একটা ওষুধ দিয়েছিল ডাক্তার, তিন মাসের মধ্যে কাজ দেওয়ার কথা। কিছুদিনের জন্য অবসন্নতার আগ্রাসন থমকে যাবে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। এখন হাঁটুর নিচে কিছু আছে বলে মনে হয় না।
অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয়েছে। মশার ঝাঁক তার নিশ্চল হাতে-পায়ে রিগ গাড়ছে। বাপেক্সের ইঞ্জিনিয়ারও এত ক্ষিপ্রতায় কাজ করতে পারে না। শাহেদ অন্ধকারে বসে বসে মশাদের তামশা দেখে। তার অনুভূতির দরজায় তালা দেওয়া। অতএব ব্যথা-বেদনার বালাই নেই। এই সময় রাহেলার আসার কথা। কিন্তু চারপাশে কোনো সাড়াশব্দ নেই। মনে মনে ভীষণ রাগ হয়। ইচ্ছা করে জান্তব আওয়াজগুলো ছড়িয়ে একবার প্রতিবাদ জানাতে। এই অবহেলা তার প্রাপ্য নয়। এই ঘরবাড়ি আসবাব সব তার রক্ত-ঘামে গড়া। এখনো সে বেঁচে আছে। এখনো সে পাথর হয়ে যায়নি। তাকে ইগনোর করার সাহস পায় কী করে এরা? আবার মনের ভেতরের মনটা সরব হয়ে ওঠে। আর কত। আর কত জ্বালাবি এই মহিলাকে। নারকেলের পাতার ফাঁকে ফাঁকে সন্ধ্যাপ্রদীপের মতো তারারা জ্বলে। ধূপছায়া আকাশ। আসন্ন পূর্ণিমার আলোয় ঝলমল করছে দূরের গাছগুলো। এমন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে দলেবলে ছাদে চলে যেত শাহেদ। রাহেলা খালি গলায় ‘আজি জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে...’ গাইত। রাহেলা হুমায়ূনভক্ত। সে পূর্ণিমা উপভোগ করে। সে এইসব দিনরাত্রির টুনির মা হতে চেয়েছিল কৈশোরে। ওপরওয়ালা তার সেই ইচ্ছা পূরণ করেন হয়তো—প্রথম সন্তান হয় কন্যা। পরেরটি পুত্র। রাহেলার সন্তানভাগ্যে তার বোনেরা হিংসায় পুড়ে খাক। ফিজিকসের ছাত্রী রাহেলা ট্রপিক্যাল টুনির মা হতে গিয়ে আর চাকরি-বাকরির ধারেকাছে যায়নি। যে রাহেলা হুমায়ূনের দুঃখবিলাসী উপন্যাস পড়ে রাতদুপুরে কাঁদত, আজ হাজার দুঃখেও নির্বিকার সে; সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টা-দিন—এভাবে তার স্বামীর মৃত্যুর প্রহর গুনছে। মন শক্ত করে স্বামীর সঞ্চয় স্থিতি বুঝে নিচ্ছে। ভাবছে, কোথাও একটা চাকরি ধরবে। সেটা যে ধরনের চাকরিই হোক। মাটির সঙ্গে গড়াগড়ি খাওয়া দুটো বাচ্চার জীবন তাকেই সাজিয়ে দিতে হবে।
হঠাৎ ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠল। তীব্র আলোয় চোখ দুটো কিছুক্ষণের জন্য ব্ল্যাক আউট হয়ে গেল। রাহেলা দৌড়ে গিয়ে জানালা লাগাল। ‘সরি, দেরি হয়ে গেল।’ পেটমোটা একটা কাচের বোতল টেবিলের ওপর রেখে মসকিউটো ব্যাট হাতে নিল সে। ‘এসব কী আনলে আবার।’ বিজড়িত স্বরে শাহেদ বলল। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি থাকলে হয়তো কিছু বুঝতে পারত না, রাহেলা বুঝল। ‘অল্টারনেটিভ মেডিসিনে নাকি...’ ‘কিচ্ছু হবে না।’ ‘এভাবে বলো না তো। আল্লাহ বিপদ আপদে ফেলে মানুষের ইমান টেস্ট করেন। ইমান ধরে রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
‘ডুমুরিয়া যাওয়ার কী হলো—’
‘ডুমুরিয়া’ শব্দটা ছ্যাৎ করে লাগল রাহেলার বুকে। গত সপ্তাহে নবগ্রহ বাড়ি থেকে এক তান্ত্রিককে নিয়ে এসেছিল রাহেলা। তিনি বিভিন্ন বিচার-বিশ্লেষণ করে রায় দিলেন, ‘রাহুর দশা। তার সঙ্গে একটা পাপ। ভয়াবহ পাপ। সেটা খণ্ডন না করলে কিছুতেই কিছু হবে না।’ রাহেলা রাগে ঝনঝন করে উঠল, ‘কিসের পাপ, অন্ধকারে ঢিল ছুড়লেন, যদি লেগে যায়...আপনার ভিজিট কত, নিয়ে দূর হোন।’
তান্ত্রিক চলে গেল, কিন্তু শাহেদের মনে কথাটা লেগে রইল চোরাকাঁটার মতো। তারপর থেকে শাহেদ তার অতীতকে বারবার রিক্যাপ করে দেখছে। ছোটবেলায় ব্যাঙের ডোবায় ঢিল ছোড়া থেকে শুরু করে জীবনের ছোট-বড় সব অপরাধ নেড়েচেড়ে দেখছে। কই, নিজেকে কখনো বড় কোনো পাপে পাপিষ্ঠ মনে হয়নি। কিন্তু কিছুতেই শাহদের মন থেকে অস্বস্তিটা কাটে না। এ জগতের কোনো মানুষ পাপ-পুণ্যের ঊর্ধ্বে নয়। তার ভুলচুক হতে পারে। তাই বলে ভয়াবহ কোনো পাপ...। সেই থেকে স্বপ্নে-জাগরণে এ নিয়ে ভাবছে সে। একদিন বেদনার্ত জন্তুর মতো কেঁদে উঠল। তারপর অস্ফুট স্বরে কী যেন বলছিল। রাহেলা কিছুই বুঝতে পারেনি। শেষমেশ একটা লেটার–প্যাড এগিয়ে দিলে কাঁপা কাঁপা অক্ষরে সে লিখল, ডুমুরিয়া যাব।
সেই থেকে দিনে কয়েকবার শুধু ডুমুরিয়া ডুমুরিয়া করত শাহেদ। কী আছে ডুমুরিয়ায়? রাহেলা ব্যাপারটা তার বড় বোনকে বললে তিনি তো বিস্ময়ে মুখে হাত দিলেন, ‘কী বলিস! ওখানে ওর কোনো ওয়াইফ-টোয়াইফ নেই তো?’
কথাটা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেল রাহেলা। ও তো এভাবে ভাবেনি!
‘দূর, এসব কী বলো বড়পা।’
‘শুন, ব্যাটা মানুষে কোনো বিশ্বাস নাই।’
তারপর থেকে রাহেলাই চায় ব্যাপারটা চেপে যেতে। এমনিতেই তো শাহেদের মৃত্যু ঠেকানো যাবে না, শেষ মুহূর্তে একটা কেলেঙ্কারি। সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারার ঝামেলা। বুদ্ধিটা অবশ্য বড় আপারই দেওয়া।
রাহেলার অনুৎসাহে ব্যাপারটা কিছুদিন চাপা পড়ে ছিল। আজ আবার ডুমুরিয়ার কথা তুলল শাহেদ। রাহেলা ভাবল, এই একটা সুযোগ। বাচ্চারা বাসায় নেই। বড় খালা নিয়ে গেছে তাদের বিবাহবার্ষিকীর পার্টিতে। এখন যদি জেনে নেওয়া যায় বিষয়টা।
‘কেন ডুমুরিয়া যেতে চাও তুমি? আমাকে বলবা।’ পরম মমতায় শাহেদের হাতে হাত রাখে রাহেলা।
এখন শাহেদের সঙ্গে তার দীর্ঘ কথোপকথনগুলো হয় লেখার মাধ্যমে। কাঁপা কাঁপা অক্ষরে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে শাহেদ।
শাহেদ বিছানার কোনা থেকে কোনো প্রকারে লেটার–প্যাডটা টেনে আনল। দুটো আঙুলে কলমটা জড়িয়ে নিয়ে লিখল, শুনবা?
‘বলো।’ ‘চাকরির বছর খানেকের মাথায় একটা ব্রাঞ্চের চার্জ পেয়ে গেলাম। মনে মনে একটা রোমাঞ্চ। চ্যালেঞ্জও বটে। ডুমুরিয়া ছোট্ট ব্রাঞ্চ। সব মিলিয়ে ছয়জন স্টাফ। ট্রানজেকশন খুব একটা নেই। গরিব এলাকা। ছোটখাটো ঋণ-টিন নেয়, এই আর কি। চেয়ারে বসার পরের মাসেই এজিএম স্যার হিসাব চেয়ে পাঠালেন। তিনি জানালেন, এভাবে লোকসান দিয়ে ব্রাঞ্চ চালানো যাবে না। ইয়াং লোক পোস্টিং দেওয়ার উদ্দেশ্যই হলো লোন রিকভার করা।’ ‘এ জন্য তুমি কারও ওপর জুলুম-টুলুম করো নাই তো?’ রাহেলা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল। ‘প্রশ্নই আসে না। আমি নিয়মমতো ক্লাসিফায়েড লোন হোল্ডারদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করতে লাগলাম। চিঠি পাঠালাম। খুব একটা সাড়া মিলল না। তারপর এজিএম স্যারের নির্দেশে মামলার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। উকিল নোটিশ হলো। যারা সময় চাইল, তাদের সময়ও দিলাম। একসময় বিষয়টা আদালতে গড়াল।’ ‘ও।’ রাহেলা ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইল শাহেদের লেখার দিকে। একদিন দুপুরে চেম্বারে বসে কাজ করছি। এক রোগা সিরিঙ্গে টাইপের লোক এসে ঢুকলেন রুমে। জানালেন তাঁর পরিচয়—স্থানীয় হাই স্কুলের শিক্ষক। লাখ দুয়েক টাকা কনজিউমার লোন নিয়েছিলেন ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর জন্য। ছেলেটা মালয়েশিয়ায় আছে। একটু রুজিরোজগার শুরু করলে আস্তে আস্তে সব শোধ করে দেবেন। আমি বললাম, ‘এত দিন পর এলেন কেন? এখন তো বিষয়টা আর আমার হাতে নেই, আদালতে চলে গেছে।’ ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা। বারবার বলছেন, ‘আপনি চাইলে আমার ইজ্জতটা বাঁচে। সামনে মেয়ের বিয়ে। কথা পাকা হয়ে আছে। বেশ ধারকর্জ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। এখন যদি কিছু একটা হয়, বিয়েটা ভেস্তে যাবে।’ মামলাধীন বিষয়ে আমার অপারগতার কথা বললাম। কিন্তু ঘুরেফিরে তিনি বলছিলেন সেই একই কথা। বিরাট এক সংকটের মধ্যে পড়লাম আমি। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। নমনীয়তা দেখানোর কোনো উপায় নেই; জানাজানি হয়ে গেলে আর লোন রিকভারি করা হবে না। একসময় অসহিষ্ণু হয়ে বললাম, ‘যা বলার আদালতে গিয়ে বলুন।’ নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই চমকে গেলাম। কেমন পুলিশি পুলিশি আওয়াজ। ভদ্রলোক হঠাৎ কান্না জুড়ে দেন। কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরেন আমার পা দুটি। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলাম আমি। মনে হলো, আমার দুটো পা অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে। এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে গিয়ে ছাড়িয়ে নিলাম তাঁকে। চেয়ারে বসিয়ে আশ্বস্ত করলাম, এসব নিয়ে আর ভাবতে হবে না। চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন ভদ্রলোক। তবে জানো রাহেলা, আমি কিছুই করতে পারিনি। কোনো কিছুই আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। সেই স্যারকে আদালতে যেতে হয়েছিল। মেয়ের বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। এমনকি...’ কান্নায় ভেঙে পড়ে শাহেদ। রাহেলা জড়িয়ে ধরে তাকে, ‘নিজেকে শুধু শুধু অপরাধী ভাবছ, এখানে তোমার কীই-বা করার ছিল?’ সেই স্যারের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়েছিল একদিন। লজ্জায় দ্রুত পাশ কেটে যাচ্ছিলাম। তিনি পাশ থেকেই সালাম দিয়ে বললেন, ‘বড্ড পাথর মানুষ গো আপনে—’
সেই পাথর শব্দটা এখনো আমার কানে বাজে।
জুন-জুলাইয়ের চাপ শেষে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। পুরো ব্রাঞ্চের চার্জ তার মাথায়। এজিএম ব্রাঞ্চ। আপাতত এসপিও দিয়ে চলছে। সব সময় প্রেশার। তার ওপর মিড ইয়ারের ধাক্কা। কিন্তু দ্রুতই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে লাগল। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে হাতের মুঠোয় ব্রাশটা থাকছে না। মনের ভেতরে কু ডেকে উঠল। সেদিনই সার্কেল অফিসে গিয়ে ডিজিএমকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল। ডিজিএম খিটমিটে মেজাজের লোক। কিন্তু কেন জানি সেদিন খুব আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। তাঁর সহযোগিতায় দিন দশেকের মধ্যে চলে যাওয়া। ডাইরেক্ট এয়ার। একজন প্রফেশনাল পেশেন্ট গাইডকে দেওয়া হলো তাঁর সঙ্গে। নিমহানসে দিন কুড়ি ছিল। চেকআপের সব রিপোর্ট আসার পর ডাক্তার বেশ ইতস্ততার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে একজন নিকটাত্মীয়কে চাইছিল বারবার। শেষমেশ শাহেদ শক্ত হয়ে বলল, ‘প্লিজ টেল মি, আই এম রেডি ফর অল।’ ডাক্তার মিনমিন করে বলল, ‘মটর নিউরন ডিজিস।’ কথার ফাঁকে মুচকি হেসে, ‘রোগটা এই গ্রহের সবচেয়ে মেধাবী মানুষটার হয়েছে। তাঁর নাম জানেন—স্টিফেন হকিংস। কেন এমনটা হয়, আমাদের জানা নেই। এটা প্রগ্রেসিভ ডিজিস। কিউরেবল নয়। কেবল ঠেকিয়ে রাখা যায়।’ আর কিছু তার মাথায় ঢুকছিল না। মাথাটা পাক খাচ্ছিল অদৃশ্য কোনো অক্ষের ওপর। যত দিন অফিসে যাওয়া-আসা ছিল, গুগলে সার্চ দিয়ে দিয়ে দেখত। কোথাও কোনো আশার আলো নেই। রুরিল নামে একটা ওষুধ দিয়েছিল ডাক্তার, তিন মাসের মধ্যে কাজ দেওয়ার কথা। কিছুদিনের জন্য অবসন্নতার আগ্রাসন থমকে যাবে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। এখন হাঁটুর নিচে কিছু আছে বলে মনে হয় না।
অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয়েছে। মশার ঝাঁক তার নিশ্চল হাতে-পায়ে রিগ গাড়ছে। বাপেক্সের ইঞ্জিনিয়ারও এত ক্ষিপ্রতায় কাজ করতে পারে না। শাহেদ অন্ধকারে বসে বসে মশাদের তামশা দেখে। তার অনুভূতির দরজায় তালা দেওয়া। অতএব ব্যথা-বেদনার বালাই নেই। এই সময় রাহেলার আসার কথা। কিন্তু চারপাশে কোনো সাড়াশব্দ নেই। মনে মনে ভীষণ রাগ হয়। ইচ্ছা করে জান্তব আওয়াজগুলো ছড়িয়ে একবার প্রতিবাদ জানাতে। এই অবহেলা তার প্রাপ্য নয়। এই ঘরবাড়ি আসবাব সব তার রক্ত-ঘামে গড়া। এখনো সে বেঁচে আছে। এখনো সে পাথর হয়ে যায়নি। তাকে ইগনোর করার সাহস পায় কী করে এরা? আবার মনের ভেতরের মনটা সরব হয়ে ওঠে। আর কত। আর কত জ্বালাবি এই মহিলাকে। নারকেলের পাতার ফাঁকে ফাঁকে সন্ধ্যাপ্রদীপের মতো তারারা জ্বলে। ধূপছায়া আকাশ। আসন্ন পূর্ণিমার আলোয় ঝলমল করছে দূরের গাছগুলো। এমন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে দলেবলে ছাদে চলে যেত শাহেদ। রাহেলা খালি গলায় ‘আজি জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে...’ গাইত। রাহেলা হুমায়ূনভক্ত। সে পূর্ণিমা উপভোগ করে। সে এইসব দিনরাত্রির টুনির মা হতে চেয়েছিল কৈশোরে। ওপরওয়ালা তার সেই ইচ্ছা পূরণ করেন হয়তো—প্রথম সন্তান হয় কন্যা। পরেরটি পুত্র। রাহেলার সন্তানভাগ্যে তার বোনেরা হিংসায় পুড়ে খাক। ফিজিকসের ছাত্রী রাহেলা ট্রপিক্যাল টুনির মা হতে গিয়ে আর চাকরি-বাকরির ধারেকাছে যায়নি। যে রাহেলা হুমায়ূনের দুঃখবিলাসী উপন্যাস পড়ে রাতদুপুরে কাঁদত, আজ হাজার দুঃখেও নির্বিকার সে; সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টা-দিন—এভাবে তার স্বামীর মৃত্যুর প্রহর গুনছে। মন শক্ত করে স্বামীর সঞ্চয় স্থিতি বুঝে নিচ্ছে। ভাবছে, কোথাও একটা চাকরি ধরবে। সেটা যে ধরনের চাকরিই হোক। মাটির সঙ্গে গড়াগড়ি খাওয়া দুটো বাচ্চার জীবন তাকেই সাজিয়ে দিতে হবে।
হঠাৎ ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠল। তীব্র আলোয় চোখ দুটো কিছুক্ষণের জন্য ব্ল্যাক আউট হয়ে গেল। রাহেলা দৌড়ে গিয়ে জানালা লাগাল। ‘সরি, দেরি হয়ে গেল।’ পেটমোটা একটা কাচের বোতল টেবিলের ওপর রেখে মসকিউটো ব্যাট হাতে নিল সে। ‘এসব কী আনলে আবার।’ বিজড়িত স্বরে শাহেদ বলল। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি থাকলে হয়তো কিছু বুঝতে পারত না, রাহেলা বুঝল। ‘অল্টারনেটিভ মেডিসিনে নাকি...’ ‘কিচ্ছু হবে না।’ ‘এভাবে বলো না তো। আল্লাহ বিপদ আপদে ফেলে মানুষের ইমান টেস্ট করেন। ইমান ধরে রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
‘ডুমুরিয়া যাওয়ার কী হলো—’
‘ডুমুরিয়া’ শব্দটা ছ্যাৎ করে লাগল রাহেলার বুকে। গত সপ্তাহে নবগ্রহ বাড়ি থেকে এক তান্ত্রিককে নিয়ে এসেছিল রাহেলা। তিনি বিভিন্ন বিচার-বিশ্লেষণ করে রায় দিলেন, ‘রাহুর দশা। তার সঙ্গে একটা পাপ। ভয়াবহ পাপ। সেটা খণ্ডন না করলে কিছুতেই কিছু হবে না।’ রাহেলা রাগে ঝনঝন করে উঠল, ‘কিসের পাপ, অন্ধকারে ঢিল ছুড়লেন, যদি লেগে যায়...আপনার ভিজিট কত, নিয়ে দূর হোন।’
তান্ত্রিক চলে গেল, কিন্তু শাহেদের মনে কথাটা লেগে রইল চোরাকাঁটার মতো। তারপর থেকে শাহেদ তার অতীতকে বারবার রিক্যাপ করে দেখছে। ছোটবেলায় ব্যাঙের ডোবায় ঢিল ছোড়া থেকে শুরু করে জীবনের ছোট-বড় সব অপরাধ নেড়েচেড়ে দেখছে। কই, নিজেকে কখনো বড় কোনো পাপে পাপিষ্ঠ মনে হয়নি। কিন্তু কিছুতেই শাহদের মন থেকে অস্বস্তিটা কাটে না। এ জগতের কোনো মানুষ পাপ-পুণ্যের ঊর্ধ্বে নয়। তার ভুলচুক হতে পারে। তাই বলে ভয়াবহ কোনো পাপ...। সেই থেকে স্বপ্নে-জাগরণে এ নিয়ে ভাবছে সে। একদিন বেদনার্ত জন্তুর মতো কেঁদে উঠল। তারপর অস্ফুট স্বরে কী যেন বলছিল। রাহেলা কিছুই বুঝতে পারেনি। শেষমেশ একটা লেটার–প্যাড এগিয়ে দিলে কাঁপা কাঁপা অক্ষরে সে লিখল, ডুমুরিয়া যাব।
সেই থেকে দিনে কয়েকবার শুধু ডুমুরিয়া ডুমুরিয়া করত শাহেদ। কী আছে ডুমুরিয়ায়? রাহেলা ব্যাপারটা তার বড় বোনকে বললে তিনি তো বিস্ময়ে মুখে হাত দিলেন, ‘কী বলিস! ওখানে ওর কোনো ওয়াইফ-টোয়াইফ নেই তো?’
কথাটা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেল রাহেলা। ও তো এভাবে ভাবেনি!
‘দূর, এসব কী বলো বড়পা।’
‘শুন, ব্যাটা মানুষে কোনো বিশ্বাস নাই।’
তারপর থেকে রাহেলাই চায় ব্যাপারটা চেপে যেতে। এমনিতেই তো শাহেদের মৃত্যু ঠেকানো যাবে না, শেষ মুহূর্তে একটা কেলেঙ্কারি। সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারার ঝামেলা। বুদ্ধিটা অবশ্য বড় আপারই দেওয়া।
রাহেলার অনুৎসাহে ব্যাপারটা কিছুদিন চাপা পড়ে ছিল। আজ আবার ডুমুরিয়ার কথা তুলল শাহেদ। রাহেলা ভাবল, এই একটা সুযোগ। বাচ্চারা বাসায় নেই। বড় খালা নিয়ে গেছে তাদের বিবাহবার্ষিকীর পার্টিতে। এখন যদি জেনে নেওয়া যায় বিষয়টা।
‘কেন ডুমুরিয়া যেতে চাও তুমি? আমাকে বলবা।’ পরম মমতায় শাহেদের হাতে হাত রাখে রাহেলা।
এখন শাহেদের সঙ্গে তার দীর্ঘ কথোপকথনগুলো হয় লেখার মাধ্যমে। কাঁপা কাঁপা অক্ষরে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে শাহেদ।
শাহেদ বিছানার কোনা থেকে কোনো প্রকারে লেটার–প্যাডটা টেনে আনল। দুটো আঙুলে কলমটা জড়িয়ে নিয়ে লিখল, শুনবা?
‘বলো।’ ‘চাকরির বছর খানেকের মাথায় একটা ব্রাঞ্চের চার্জ পেয়ে গেলাম। মনে মনে একটা রোমাঞ্চ। চ্যালেঞ্জও বটে। ডুমুরিয়া ছোট্ট ব্রাঞ্চ। সব মিলিয়ে ছয়জন স্টাফ। ট্রানজেকশন খুব একটা নেই। গরিব এলাকা। ছোটখাটো ঋণ-টিন নেয়, এই আর কি। চেয়ারে বসার পরের মাসেই এজিএম স্যার হিসাব চেয়ে পাঠালেন। তিনি জানালেন, এভাবে লোকসান দিয়ে ব্রাঞ্চ চালানো যাবে না। ইয়াং লোক পোস্টিং দেওয়ার উদ্দেশ্যই হলো লোন রিকভার করা।’ ‘এ জন্য তুমি কারও ওপর জুলুম-টুলুম করো নাই তো?’ রাহেলা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল। ‘প্রশ্নই আসে না। আমি নিয়মমতো ক্লাসিফায়েড লোন হোল্ডারদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করতে লাগলাম। চিঠি পাঠালাম। খুব একটা সাড়া মিলল না। তারপর এজিএম স্যারের নির্দেশে মামলার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। উকিল নোটিশ হলো। যারা সময় চাইল, তাদের সময়ও দিলাম। একসময় বিষয়টা আদালতে গড়াল।’ ‘ও।’ রাহেলা ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইল শাহেদের লেখার দিকে। একদিন দুপুরে চেম্বারে বসে কাজ করছি। এক রোগা সিরিঙ্গে টাইপের লোক এসে ঢুকলেন রুমে। জানালেন তাঁর পরিচয়—স্থানীয় হাই স্কুলের শিক্ষক। লাখ দুয়েক টাকা কনজিউমার লোন নিয়েছিলেন ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর জন্য। ছেলেটা মালয়েশিয়ায় আছে। একটু রুজিরোজগার শুরু করলে আস্তে আস্তে সব শোধ করে দেবেন। আমি বললাম, ‘এত দিন পর এলেন কেন? এখন তো বিষয়টা আর আমার হাতে নেই, আদালতে চলে গেছে।’ ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা। বারবার বলছেন, ‘আপনি চাইলে আমার ইজ্জতটা বাঁচে। সামনে মেয়ের বিয়ে। কথা পাকা হয়ে আছে। বেশ ধারকর্জ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। এখন যদি কিছু একটা হয়, বিয়েটা ভেস্তে যাবে।’ মামলাধীন বিষয়ে আমার অপারগতার কথা বললাম। কিন্তু ঘুরেফিরে তিনি বলছিলেন সেই একই কথা। বিরাট এক সংকটের মধ্যে পড়লাম আমি। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। নমনীয়তা দেখানোর কোনো উপায় নেই; জানাজানি হয়ে গেলে আর লোন রিকভারি করা হবে না। একসময় অসহিষ্ণু হয়ে বললাম, ‘যা বলার আদালতে গিয়ে বলুন।’ নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই চমকে গেলাম। কেমন পুলিশি পুলিশি আওয়াজ। ভদ্রলোক হঠাৎ কান্না জুড়ে দেন। কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরেন আমার পা দুটি। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলাম আমি। মনে হলো, আমার দুটো পা অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে। এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে গিয়ে ছাড়িয়ে নিলাম তাঁকে। চেয়ারে বসিয়ে আশ্বস্ত করলাম, এসব নিয়ে আর ভাবতে হবে না। চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন ভদ্রলোক। তবে জানো রাহেলা, আমি কিছুই করতে পারিনি। কোনো কিছুই আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। সেই স্যারকে আদালতে যেতে হয়েছিল। মেয়ের বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। এমনকি...’ কান্নায় ভেঙে পড়ে শাহেদ। রাহেলা জড়িয়ে ধরে তাকে, ‘নিজেকে শুধু শুধু অপরাধী ভাবছ, এখানে তোমার কীই-বা করার ছিল?’ সেই স্যারের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়েছিল একদিন। লজ্জায় দ্রুত পাশ কেটে যাচ্ছিলাম। তিনি পাশ থেকেই সালাম দিয়ে বললেন, ‘বড্ড পাথর মানুষ গো আপনে—’
সেই পাথর শব্দটা এখনো আমার কানে বাজে।
No comments