দুর্ভোগ
রাস্তায় হাঁটু সমান পানি। যানবাহনের
দীর্ঘ সারি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। পানি-কাদা মাড়িয়ে হেঁটে গন্তব্যে
পৌঁছা। যানজট আর জলজটে স্থবির রাজধানীতে গতকাল দিনভর ছিল এ চিত্র। মওসুমের
প্রথম ভারি বৃষ্টিতে তপ্ত আবহাওয়া শীতল পরশ লাগলেও তা রাজধানীবাসীর জন্য
নিয়ে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। সকাল থেকে ভারি বর্ষণে সড়কে পানি জমে জলাবদ্ধতা
তৈরি হওয়ায় শুরু হয় যানজট। এছাড়া কয়েকটি সড়কে ট্রাফিক পুলিশ যান চলাচল বন্ধ
করে দেয়ায় যানজটের এ দুর্ভোগের মাত্রা বাড়ে। দিনের বেশির ভাগ সময় নগরীর
ব্যস্ততম সব রাস্তা প্রায় স্থবির অবস্থায় ছিল। এছাড়া জলজটের কারণে
গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়কে সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আবহাওয়া
অধিদপ্তরের হিসাবে গতকাল সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ঢাকায় ৫৯ মিলিমিটার
বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে রাজধানীর মতিঝিল, গুলিস্তান, মগবাজার, মৌচাক,
মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী, নিউমার্কেট, শান্তিনগর, গ্রীনরোড, খিলগাঁও, বনশ্রী,
গোড়ান, মাদারটেক, মাতুয়াইল, ডেমরা, দনিয়া, শ্যামপুর, জুরাইন, বাসাবো,
মিরপুর, পল্লবীসহ বিভিন্ন এলাকা প্রায় হাঁটু পরিমাণ পানি জমে যায়। তলিয়ে
যায় এসব এলাকার রাস্তাঘাট। কোন কোন বাড়ির নিচতলায় প্রবেশ করেছে পানি। এছাড়া
গতকাল সকালের বৃষ্টি স্বস্তির চেয়ে বেশি দুর্ভোগে ফেলে অফিস ও
স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গামী নগরবাসীকে। গতকাল সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে
ভোরের আলো চোখ মেলেছে বৃষ্টিতে ভিজে। সকাল ৯টা থেকে সোয়া ৯টার দিকে বৃষ্টি
অনেকটাই কমে যায়। সাড়ে ৯টার দিকে কালো মেঘে পুরো আকাশ ছেয়ে যায়। এ সময়
যাত্রাবাড়ীতে আড়তের দোকানিরা বাতি জ্বালিয়ে দেন। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ
ফ্লাইওভার দিয়ে ছুটে চলা যানবাহনে হেডলাইট জ্বলছে। শুরু হয় বৃষ্টি। পৌনে
১০টার মধ্যে বৃষ্টি থেমে যায়। আকাশ পরিষ্কার হতে থাকে। তবে মাত্র কয়েক
মিনিট পরই আবার মেঘে মেঘে যেন সন্ধ্যা নেমে আসে। ১০টার দিকে আবার শুরু হয়
তুমুল বৃষ্টি সঙ্গে জোরালো বাতাস। ফ্লাইওভার দিয়ে এসে গুলিস্তান নামা
যাত্রীদের দৌড়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। গুলিস্তান শপিং
কমপ্লেক্সের নিচতলা, গুলিস্তান পাতাল মার্কেট ছিল লোকে-লোকারণ্য। সাড়ে
১০টার দিকে বৃষ্টি অনেকটা কমে যায়। ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে আবার অন্ধকার হয়ে
যায় চারপাশ, আবার জোরালো বৃষ্টি। সাড়ে ১১টার মধ্যে সে বৃষ্টিও থেমে যায়।
কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকার বিভন্ন সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। মগবাজার,
শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক এলাকার সড়কে কোথাও কোথাও কোমর সমান পানি জমে
যায়। এসব এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলায় বৃষ্টির পানিতে কাদা পানি
একাকার হয়ে যায়। এতে দিনভর ওসব রাস্তায় যানবাহন আটকে তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট।
ছোটখাত দুর্ঘটনাও ঘটে। মতিঝিল, পুরান ঢাকার বিভিন্ন সড়কেও যানজট আর জলজটে
একাকার হয়ে যায়। দুপুরে সড়ক পরিস্থিতি দেখতে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকায়
কর্মকর্তাদের নিয়ে হাজির হন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন।
তখন রাস্তায় হাঁটু সমান পানি। পানি ডিঙিয়ে মেয়র ওই এলাকার রাস্তা পরিদর্শন
করেন। এ সময় তিনি উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, অপরিকল্পিত সড়ক এবং
ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে এই জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে সিটি
করপোরেশন কাজ শুরু করেছে।
এদিকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অসহনীয় যানজটের কবলে পড়েন নগরবাসী। স্থবির
হয়ে পড়ে নগরজীবন। যানজটের কবলে পড়ে নগরের কর্মব্যস্ত বেশির ভাগ মানুষেরাই
নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে যেতে পারেননি। আবার এরাই বিকালে সময়মতো পৌঁছতে
পারেননি নিজ ঘরে। গতকাল রাজধানীর ফার্মগেট, কাওরানবাজার, বাংলামোটর,
মগবাজার, শাহবাগ, মৎস্য ভবন, পুরানা পল্টন, গুলিস্তান এলাকাগুলো ঘুরে দেখা
গেছে যানজটের ভয়াবহ চিত্র। যানজট ছড়িয়ে পড়ে কাকরাইল, নয়াপল্টন,
সায়েন্সল্যাবরটরি, নিউমার্কেট, গুলশান বনানী এলাকায়ও। নগরীর বিভিন্ন এলাকায়
দেখা যায়, যানজটে বিরক্ত অনেক যাত্রী যানবাহন থেকে নেমে পায়ে হেঁটে জল
কাদা মাড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছান।
সকালে ফার্মগেট এলাকায় দেখা যায় বৃষ্টির মধ্যেই শত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে
গণপরিবহনে ওঠার অপেক্ষায়। এদের কেউ কেউ আধঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও
কোন বাসে উঠতে পারেননি। উত্তরা, মহাখালী থেকে গাড়িগুলো আসতেই হুমড়ি খেয়ে
পড়েছে লোকজন। মতিঝিলের বাসের অপেক্ষায় থাকা কর্মজীবী কাকলী বেগম বলেন,
প্রায় আধাঘণ্টা ধরে বৃষ্টির মধ্যে অপেক্ষায় আছি। কিন্তু কোন বাসেই উঠতে
পারিনি। আবদুল্লাহপুর থেকে গুলিস্তান রুটের সুপারভাইজার জামাল বলেন, বনানী
সিগন্যাল পার হতে গিয়ে আধঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। সময় বাঁচাতে ফার্মগেট,
শাহবাগ অভিমুখী অনেক গাড়ি মহাখালী ফ্লাইওভার দিয়ে আসার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আবার বিজয় সরণি সিগন্যালেও অনেক সময় ধরে অপেক্ষায়
থাকতে হয়েছে। যে কারণে কোন গাড়িই সঠিক সময়ে গুলিস্তান পৌঁছতে পারেনি।
ফার্মগেট এলাকার একাধিক ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিয়ন্ত্রণে তাদের গলদঘর্ম
অবস্থার কথা জানিয়ে এজন্য বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতাকে দায়ী করেন। দুপুরে
হাতিরঝিল-সংলগ্ন পুলিশ প্লাজা কনকর্ড ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যান
প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠান ঘিরে আশপাশ এলাকায় তৈরি হয় তীব্র যানজট। এ সময়
ফার্মগেট থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে দুপাশে আটকে
থাকা যানবাহনের চাপ পড়ে আশপাশের সড়কগুলোতেও। বিশেষ করে গুলশান, মগবাজার,
হাতিরঝিল-সংলগ্ন এলাকায় যানজট চরম আকার ধারণ করে। এতে দুর্ভোগ পোহান
যাত্রীরা। প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান ঘিরে হাতির ঝিলের রাস্তাগুলোও বন্ধ রাখা
হয় দীর্ঘ। এ কারণে আশপাশের সড়কে দেখা দেয় যানজট। একাধিক ট্্রাফিক
কর্মকর্তা জানান, সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ি ও
গণপরিবহন বেশি থাকে। তার ওপর সকাল থেকে টানা বৃষ্টির কারণে কোথাও কোথাও
সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। এতে বিভিন্ন সড়কে পানি জমেছে। মূলত এসব কারণেই
যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। বেলা তিনটায় শাহবাগ এলাকায় দেখা যায়, মৎস্য ভবন
থেকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে শাহবাগ শিশুপার্ক
পর্যন্ত শ’ শ’ গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে। কখনও তা একটু এগিয়েই আবার থেমে যায়।
ত্যক্ত বিরক্ত যাত্রী ও গাড়ির স্টাফদের অনেকেই জানান, এই সিগন্যাল পার হতে
আধা ঘণ্টা থেকে একঘণ্টা সময় লাগছে। পুরানা পল্টন মোড়ে গিয়ে দেখা যায়,
গুলিস্তান ও মতিঝিল অভিমুখী গাড়িগুলো যেন আর এগোয় না। গাড়ির সারি চলে আসে
প্রেস ক্লাবের অপর পাশের সড়ক হয়ে হাইকোর্টের সামনের সড়ক পর্যন্ত। মিরপুর টু
সদরঘাট রুটের ইউনাইটেড পরিবহনের যাত্রী মুজিবুর রহমান বলেন, প্রায় দেড়
ঘণ্টা লেগেছে পল্টন আসতে। যানজটের কারণে অনেক যাত্রী পায়ে হাঁটা ধরেছে।
চিড়িয়াখানা থেকে সদরঘাট অভিমুখী তানজিল পরিবহনের সুপারভাইজার মামুন বলেন,
প্রতিদিন যেখানে সাত থেকে ৮টি ট্রিপ পড়ে আজ (গতকাল) সকাল থেকে তিনটি ট্রিপ
পড়েনি। কিন্তু মালিককে ঠিকই তার পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে।
এদিকে আহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী গতকাল সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে সিলেটে
১৪৬ মিলিমিটার। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৩৭ দশমিক ২ ডিগ্রি
সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রাজধানীতে সকাল ৬টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ৫৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
তবে আজ থেকে এমন ভারি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবহাওয়া অধিদফতরের
পরিচালক মো. শাহ্ আলম বলেন, ‘বর্ষাকাল চলে এসেছে, এখন মাঝে মাঝেই বৃষ্টি
হবে। তবে সহসা এমন ভারি বৃষ্টি হবে না। তাপমাত্রা এক থেকে ৩ ডিগ্রি কমতে
পারে। গতকাল সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা
হয়েছে, রংপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রাজশাহী,
খুলনা ও বরিশাল বিভাগের দুইএক জায়গায় অস্থায়ী দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা
থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে ঢাকা,
চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণ
হতে পারে। রাজশাহী, পাবনা, যশোর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের উপর দিয়ে মৃদু তাপ
প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা হ্রাস পেতে পারে। সারা দেশে দিন ও রাতের
তাপমাত্রা এক থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমতে পারে।
No comments