ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক: মনমোহনের প্রক্রিয়াকেই এগিয়ে নিলেন মোদি! by এম হুমায়ুন কবির
![]() |
রাষ্ট্রপতির আবদুল হামিদের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা |
ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর নিয়ে যে বিরাট প্রত্যাশা ও
উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল, তার কতটা পূরণ হয়েছে, সে নিয়ে বিতর্ক আছে। ভারতীয়
পার্লামেন্টে স্থলসীমান্ত চুক্তির অনুস্বাক্ষরকে আমরা বিশাল অর্জন বলে দাবি
করছি, শোরগোল তুলছি। কিন্তু এর প্রেক্ষাপট বিচার করলে এতটা শোরগোল
তোলার যুক্তিসংগত কারণ নেই। কেননা, এই সীমান্ত চুক্তিটি সই হয়েছিল ৪১ বছর
আগে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে তখনই এটি অনুমোদন বা অনুস্বাক্ষর করে। এরপর বহু
চড়াই-উতরাই পার হয়ে ২০১১ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন
ঢাকা সফরে আসেন, তখনই এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা ছিল। এমনকি
দুই দেশের মধ্যে প্রটোকল সইও হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দল বিজেপি,
তৃণমূল প্রভৃতি দলের বিরোধিতার মুখে ইউপিএ সরকার চুক্তিটি পার্লামেন্টে
অনুমোদন করাতে ব্যর্থ হয়। এসব সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদি স্থলসীমান্ত চুক্তি
পার্লামেন্টে অনুমোদনের ব্যাপারে যে সক্ষমতা দেখিয়েছেন, তাকে আমরা স্বাগত
জানাই।
তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের চুক্তিটিও সে সময় আটকে গেল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে। চার বছর ধরে বিষয়টি ঝুলে থাকলেও নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে আমরা সুনির্দিষ্ট আশ্বাস পাইনি। বরং গত শনিবার দেওয়া বিবৃতিতে তিনি তিস্তার বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আমাদের মোটেই আশান্বিত করে না। তিনি বলেছেন, ‘আমি আস্থাশীল যে রাজ্য সরকারগুলোর সমর্থনে ফেনী ও তিস্তা সমস্যার ন্যায্য সমাধানে পৌঁছাতে পারব।’ কবে সমাধান হবে তা তিনি বলেননি। দ্বিতীয়ত, তিস্তা ও ফেনীর পানি বণ্টনের বিষয়টি আলাদা হলেও তিনি একসঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। এতে কিছুটা হলেও সংবেদনশীলতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এই সফরের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল কানেক্টিভিটি বা সংযোগ। এ নিয়ে দুই দেশের গণমাধ্যমে প্রচুর কথাবার্তা হয়েছে। এ কথা সত্য যে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ যত বাড়বে, সম্পর্কও তত সুদৃঢ় হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। কিন্তু দেখার বিষয়, এই কানেক্টিভিটির মধ্য দিয়ে দুই পক্ষই সমভাবে লাভবান হতে পারবে কি না। যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে যেসব চুক্তি হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনার দাবি রাখে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ট্রানজিট চুক্তি তিন বছর পর পর নবায়ন হতো, যা ১৯৭২ সাল থেকেই হয়ে আসছে। এবারের চুক্তিতে পাঁচ বছর পর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়নের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে চুক্তি পর্যালোচনার ও মূল্যায়নের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
দুই দেশের মধ্যে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা এবং ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ বাড়লেও অধিক সুবিধা পাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ। এত দিন তাদের দীর্ঘ ঘুরপথে কলকাতা বা ভারতের অন্যান্য পথে যেতে হতো। এখন তারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সেসব জায়গায় যেতে পারবে। অন্যদিকে ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস সার্ভিস চালু হওয়ায় উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ বাংলাদেশে বেড়াতে আসবে। এতে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প লাভবান হবে। তবে এই পরিবহনব্যবস্থায় বাংলাদেশ ভাড়া ও মাশুল হিসেবে কী সুবিধা পাবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার। উপকূলীয় পরিবহন দুই দেশের জন্যই লাভজনক হবে বলে আমাদের ধারণা। এতে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের পরিবহন ব্যয় কমবে। কিন্তু চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের যে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তার বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পরিমাণ মাশুল পাবে, সেটিও স্পষ্ট নয়। ভারত চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে নৌ ও সড়ক দুটি পরিবহনই ব্যবহার করতে চাইবে। ইতিমধ্যে সাবরুমে সেতু বানানো হচ্ছে। আমাদেরও দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু এর জন্য উপযুক্ত মাশুল দিতে হবে। উত্তর-পূর্ব ভারতে আগে ঘুরপথে পণ্য পরিবহনে যে বাড়তি খরচ হতো, তার একটা অংশ বাংলাদেশ পেতে পারে। একইভাবে নেপাল ও ভুটান যাতে নেপাল বন্দর ব্যবহার করতে পারে, সেই নিশ্চয়তা ভারতকে দিতে হবে।
এ কথা সত্য যে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ এখন খুবই কম। ভারতীয় বিনিয়োগ বাড়াতে মংলা ও ভেড়ামারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা সঠিক বলেই মনে করি। কিন্তু বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে যেমন দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন, তেমনি দরকার উন্নত অবকাঠামো। কোরিয়ান ইপিজেডের অভিজ্ঞতা ততটা সুখকর নয়। সেখানে সমস্যা চলছে। সত্যিকারভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে সেটি ভারতীয় বা অন্য যেকোনো দেশের হোক না কেন, আমাদের দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে, বিনিয়োগানুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
এবার আসি বিদ্যুৎ প্রসঙ্গে। রিলায়েন্স ও আদানি গ্রুপের সঙ্গে ৪ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে চুক্তি হয়েছে, সেটি ইতিবাচক হলেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। এ ধরনের প্রকল্প প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, বিদেশি কোম্পানিকে দায়মুক্তি দেওয়ার কোনো যুক্তি আছে বলে মনে করি না।
ভারত এবার ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় ১০০ কোটি ডলার দেওয়া হয়েছিল, যার কাজ এখনো শেষ হয়নি। সেই ঋণের বেশির ভাগই দেওয়া হয়েছিল ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয় মাথায় রেখে। এবারও তাই। কিন্তু ঋণের শর্ত হচ্ছে, এসব প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ যন্ত্রপাতি বা কাঁচামাল ভারত থেকে কিনতে হবে। কিন্তু যেসব পণ্যের জোগান বাংলাদেশ নিজেই দিতে পারে, সেগুলো বাইরে থেকে আনবে কেন? ঋণ বা প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিজস্ব অগ্রাধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়টি বরাবরই ভারত গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। আমরাও মনে করি, এ ব্যাপারে আমাদেরও মনোযোগ বাড়াতে হবে। কেউ কেউ মনে করেন, মোদি চীনের কথা মনে রেখে বাংলাদেশকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। আমার সেটি কখনো মনে হয়নি। দুই বৃহৎ প্রতিবেশীই আমাদের বন্ধু এবং প্রধান পণ্যের জোগানদাতাও। বাংলাদেশ ভারত ও চীন উভয় দেশ থেকে সর্বাধিক পণ্য আমদানি করে থাকে। তাই এখানে প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্ন অবান্তর। সম্পর্কের নানা টানাপোড়েন সত্ত্বেও ভারত, চীন ও মিয়ানমার যদি একসঙ্গে গ্যাস প্রকল্পে কাজ করতে পারে, আমরা কেন ভারত ও মিয়ানমারকে নিয়ে কাজ করতে পারব না?
বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছিল এবং অনেকগুলো পণ্যের শুল্ক বাধা দূর হয়েছে। কিন্তু অশুল্ক বাধা রয়েই গেছে। এবার মোদির সফরে এ ক্ষেত্রে একটিই অগ্রগতি, তা হলো পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআই ও ভারতের মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যে চুক্তি সই। এখন থেকে বিএসটিআইয়ের ছাড়পত্র ভারত গ্রহণ করবে। এতে কিছুটা সুবিধা আমরা পাব বলে আশা করি।
তবে এই সফরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ভারত প্রশ্নে বাংলাদেশে বিরল রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সব দলই আগ্রহ প্রকাশ করেছে, আগের মতো পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয়নি। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্কও এগিয়ে যাবে—এটাই সবার প্রত্যাশা হওয়া উচিত।
সব মিলিয়ে মোদির এই সফরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে বড় কিছু অর্জন হয়েছে, তেমনটি মনে হয় না। চার বছর আগে ইউপিএ সরকারপ্রধান মনমোহন সিং যে প্রক্রিয়া শুরু করে গিয়েছিলেন, কোনো ক্ষেত্রে মোদি সেটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারেননি।
এম হুমায়ুন কবির: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের চুক্তিটিও সে সময় আটকে গেল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে। চার বছর ধরে বিষয়টি ঝুলে থাকলেও নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে আমরা সুনির্দিষ্ট আশ্বাস পাইনি। বরং গত শনিবার দেওয়া বিবৃতিতে তিনি তিস্তার বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আমাদের মোটেই আশান্বিত করে না। তিনি বলেছেন, ‘আমি আস্থাশীল যে রাজ্য সরকারগুলোর সমর্থনে ফেনী ও তিস্তা সমস্যার ন্যায্য সমাধানে পৌঁছাতে পারব।’ কবে সমাধান হবে তা তিনি বলেননি। দ্বিতীয়ত, তিস্তা ও ফেনীর পানি বণ্টনের বিষয়টি আলাদা হলেও তিনি একসঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। এতে কিছুটা হলেও সংবেদনশীলতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এই সফরের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল কানেক্টিভিটি বা সংযোগ। এ নিয়ে দুই দেশের গণমাধ্যমে প্রচুর কথাবার্তা হয়েছে। এ কথা সত্য যে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ যত বাড়বে, সম্পর্কও তত সুদৃঢ় হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। কিন্তু দেখার বিষয়, এই কানেক্টিভিটির মধ্য দিয়ে দুই পক্ষই সমভাবে লাভবান হতে পারবে কি না। যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে যেসব চুক্তি হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনার দাবি রাখে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ট্রানজিট চুক্তি তিন বছর পর পর নবায়ন হতো, যা ১৯৭২ সাল থেকেই হয়ে আসছে। এবারের চুক্তিতে পাঁচ বছর পর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়নের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে চুক্তি পর্যালোচনার ও মূল্যায়নের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
দুই দেশের মধ্যে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা এবং ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ বাড়লেও অধিক সুবিধা পাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ। এত দিন তাদের দীর্ঘ ঘুরপথে কলকাতা বা ভারতের অন্যান্য পথে যেতে হতো। এখন তারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সেসব জায়গায় যেতে পারবে। অন্যদিকে ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস সার্ভিস চালু হওয়ায় উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ বাংলাদেশে বেড়াতে আসবে। এতে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প লাভবান হবে। তবে এই পরিবহনব্যবস্থায় বাংলাদেশ ভাড়া ও মাশুল হিসেবে কী সুবিধা পাবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার। উপকূলীয় পরিবহন দুই দেশের জন্যই লাভজনক হবে বলে আমাদের ধারণা। এতে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের পরিবহন ব্যয় কমবে। কিন্তু চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের যে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তার বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পরিমাণ মাশুল পাবে, সেটিও স্পষ্ট নয়। ভারত চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে নৌ ও সড়ক দুটি পরিবহনই ব্যবহার করতে চাইবে। ইতিমধ্যে সাবরুমে সেতু বানানো হচ্ছে। আমাদেরও দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু এর জন্য উপযুক্ত মাশুল দিতে হবে। উত্তর-পূর্ব ভারতে আগে ঘুরপথে পণ্য পরিবহনে যে বাড়তি খরচ হতো, তার একটা অংশ বাংলাদেশ পেতে পারে। একইভাবে নেপাল ও ভুটান যাতে নেপাল বন্দর ব্যবহার করতে পারে, সেই নিশ্চয়তা ভারতকে দিতে হবে।
এ কথা সত্য যে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ এখন খুবই কম। ভারতীয় বিনিয়োগ বাড়াতে মংলা ও ভেড়ামারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা সঠিক বলেই মনে করি। কিন্তু বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে যেমন দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন, তেমনি দরকার উন্নত অবকাঠামো। কোরিয়ান ইপিজেডের অভিজ্ঞতা ততটা সুখকর নয়। সেখানে সমস্যা চলছে। সত্যিকারভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে সেটি ভারতীয় বা অন্য যেকোনো দেশের হোক না কেন, আমাদের দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে, বিনিয়োগানুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
এবার আসি বিদ্যুৎ প্রসঙ্গে। রিলায়েন্স ও আদানি গ্রুপের সঙ্গে ৪ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে চুক্তি হয়েছে, সেটি ইতিবাচক হলেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। এ ধরনের প্রকল্প প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, বিদেশি কোম্পানিকে দায়মুক্তি দেওয়ার কোনো যুক্তি আছে বলে মনে করি না।
ভারত এবার ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় ১০০ কোটি ডলার দেওয়া হয়েছিল, যার কাজ এখনো শেষ হয়নি। সেই ঋণের বেশির ভাগই দেওয়া হয়েছিল ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয় মাথায় রেখে। এবারও তাই। কিন্তু ঋণের শর্ত হচ্ছে, এসব প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ যন্ত্রপাতি বা কাঁচামাল ভারত থেকে কিনতে হবে। কিন্তু যেসব পণ্যের জোগান বাংলাদেশ নিজেই দিতে পারে, সেগুলো বাইরে থেকে আনবে কেন? ঋণ বা প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিজস্ব অগ্রাধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়টি বরাবরই ভারত গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। আমরাও মনে করি, এ ব্যাপারে আমাদেরও মনোযোগ বাড়াতে হবে। কেউ কেউ মনে করেন, মোদি চীনের কথা মনে রেখে বাংলাদেশকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। আমার সেটি কখনো মনে হয়নি। দুই বৃহৎ প্রতিবেশীই আমাদের বন্ধু এবং প্রধান পণ্যের জোগানদাতাও। বাংলাদেশ ভারত ও চীন উভয় দেশ থেকে সর্বাধিক পণ্য আমদানি করে থাকে। তাই এখানে প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্ন অবান্তর। সম্পর্কের নানা টানাপোড়েন সত্ত্বেও ভারত, চীন ও মিয়ানমার যদি একসঙ্গে গ্যাস প্রকল্পে কাজ করতে পারে, আমরা কেন ভারত ও মিয়ানমারকে নিয়ে কাজ করতে পারব না?
বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছিল এবং অনেকগুলো পণ্যের শুল্ক বাধা দূর হয়েছে। কিন্তু অশুল্ক বাধা রয়েই গেছে। এবার মোদির সফরে এ ক্ষেত্রে একটিই অগ্রগতি, তা হলো পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআই ও ভারতের মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যে চুক্তি সই। এখন থেকে বিএসটিআইয়ের ছাড়পত্র ভারত গ্রহণ করবে। এতে কিছুটা সুবিধা আমরা পাব বলে আশা করি।
তবে এই সফরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ভারত প্রশ্নে বাংলাদেশে বিরল রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সব দলই আগ্রহ প্রকাশ করেছে, আগের মতো পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয়নি। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্কও এগিয়ে যাবে—এটাই সবার প্রত্যাশা হওয়া উচিত।
সব মিলিয়ে মোদির এই সফরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে বড় কিছু অর্জন হয়েছে, তেমনটি মনে হয় না। চার বছর আগে ইউপিএ সরকারপ্রধান মনমোহন সিং যে প্রক্রিয়া শুরু করে গিয়েছিলেন, কোনো ক্ষেত্রে মোদি সেটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারেননি।
এম হুমায়ুন কবির: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
No comments