সমাবর্তন মনে করিয়ে দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরগৌরবের দিনগুলো by ড. সুকোমল বড়ুয়া
আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯তম সমাবর্তন। ১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠার পর ১৯২৩ সালে প্রথম সমাবর্তন হয়। ওই সমাবর্তনে প্রথম চ্যান্সেলর
বক্তৃতা দেন এজে আর বুলওয়ার লিটন। আজকের সমাবর্তনের বক্তা হলেন ওয়ার্ল্ড
ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. ফ্রান্সিস
গ্যারি।
মূলত পূর্ব বাংলার পশ্চাৎপদ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের লক্ষ্যেই এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ নয় দশক পার করে এ বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছে এ উপমহাদেশ ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে। শিক্ষার্থীদের জন্য সনদও বিতরণ করেছে অনেক। মেধা, গবেষণা ও কৃতিত্বের কারণে বহু পদকও পেয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এবারের সমাবর্তনে মোট ৬ হাজার ১০৪ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করবে। তাদের মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ৪২, এমফিল ২০, স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ২৯, এমডি ও এমএস ৪৯, অনার্স (স্নাতক) ৩ হাজার ১৬০ এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ৫৬৫ জন।
সমাবর্তন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্ট ও একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় সচল থাকে। বিদ্যা ও জ্ঞানমুখী সাধনায় নিবিষ্ট থাকার জন্য শিক্ষার্থীরা প্রেরণা পায় এবং পাঠের প্রতি উৎসাহ জোগায়। সমাবর্তনের দিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের পদচারণায় মুখরিত হয়। পরিবেশও হয় বর্ণাঢ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষণার পাশাপাশি এদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা অসামান্য অবদান রেখেছেন। নেতৃত্বও দিয়েছে অসাধারণ। এ কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এত নামডাক। অর্জনও অনেক। গবেষণার পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধির চর্চা, নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে।
বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট নামে প্রথমে পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের দাবি ওঠে। ১৯১২ সালের ২৭ মে বেঙ্গল গভর্নমেন্ট কর্তৃক গঠিত রবার্ট নাথান কমিটির সদস্যদের মাধ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি তৈরি হয়। এর প্রস্তাবক ছিলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ও শেরেবাংলা একে ফজলুল হক।
ঢাকার রমনা সিভিল স্টেশন এলাকার প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির পরিমাণ ২৭৫.০৮৩ একর। সুখের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে উইল করা প্রখ্যাত দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেবের (জিসি দেব) জমিটিও সম্প্রতি কোর্টের রায়ে উদ্ধার করা হয়েছে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। দীর্ঘদিন পরে হলেও এটিকে একটি ভালো কাজ বলা যায়। এরকম আরও নানা জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি রয়েছে। এগুলো উদ্ধার করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর আরও বিস্তৃত করা যাবে। যেহেতু যুগের চাহিদায় নতুন নতুন বিভাগ, ফ্যাকাল্টি ও গবেষণা সেন্টার খোলা হচ্ছে, সেহেতু এ নিয়ে আমাদের এখনই ভাবতে হবে। সেজন্য চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে আণবিক শক্তি কমিশনের পূর্বদিক পর্যন্ত অর্থাৎ টিএসসির পূর্ব পাশের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কিছু অংশ এখন থেকে নিতে না পারলে আগামী দেড়শ-দুশ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণের জন্য আর কোনো জায়গা পাওয়া যাবে না। এমনকি বর্তমান আণবিক শক্তি কমিশনের জায়গাটিও আমাদের নিয়ে নিতে হবে।
স্মর্তব্য, এ উপমহাদেশের প্রাচীনতম ও খ্যাতিমান নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটাকে গড়ে তোলা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, ছাত্র-শিক্ষক কাছাকাছি থেকে বিদ্যা ও পাঠ গ্রহণ এবং পারস্পরিক জ্ঞানের আদান-প্রদান
করবে। এমনকি শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলে থেকে জ্ঞানার্জনের নানা প্রয়োজনে লাইব্রেরিসহ শিক্ষকের সাহচর্য লাভ করবে। প্রাচীন ভারতবর্ষের বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞানার্জনের ধরনও ছিল সে রকম। এ কারণে বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞানদানে নালন্দার এত গৌরব ও এত খ্যাতি ছিল।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান ও বিদ্যাচর্চার নিরিখে এ উপমহাদেশে একটি শ্রেষ্ঠ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত লাভ করে। অক্সফোর্ডের আদলে এর পঠন-পাঠন ও শিক্ষাদান কার্যক্রম পদ্ধতি পরিচালিত হয়েছিল বলেই এটাকে বলা হতো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। এছাড়াও ঐতিহাসিক নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের গর্বিত অংশীদার হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম উপাচার্য ছিলেন স্যার পিজে হার্টজ। প্রথম চ্যান্সেলর ছিলেন লরেন্স জন লামলে ডানডাস (১৯২১-১৯২২)। প্রথম রেজিস্ট্রার ছিলেন খান বাহাদুর নাজির উদ্দিন আহমদ (১০.০৪.২১ থেকে ৩০.০৬.৪৪)। মনোগ্রাম পরিবর্তন হয় চারবার। প্রথম ১৯২১-১৯৫২, দ্বিতীয় ১৯৫২-৭২, তৃতীয় ১৯৭২-১৯৭৩, চতুর্থ ১৯৭৩ থেকে চলমান।
প্রথমে কলা, বিজ্ঞান ও আইন এ তিনটি অনুষদ নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে কলা অনুষদে ছিল সংস্কৃত, বাংলা, উর্দু, ফার্সি, আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ ইত্যাদি বিষয়। ইতিহাস, ইংরেজি, দর্শন, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও শিক্ষা বিভাগও ছিল। বিজ্ঞান অনুষদে ছিল গণিত, পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন। আইন অনুষদে ছিল শুধু আইন বিভাগ। সর্বমোট বিভাগ ছিল ১২টি। প্রথমে বিএ, বিএসসি অনার্স এবং এমএ ও এমএসসি সব মিলিয়ে ৮৫০ ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয়েছিল। আবাসিক হল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা হল, জগন্নাথ হল ও মুসলিম হল।
সে সময় কোনো ছাত্রী হল ছিল না। সব বিভাগে পড়ানোর জন্য শিক্ষক ছিলেন মাত্র ৬০ জন। কলা অনুষদে ২৮, বিজ্ঞানে ১৭, আর আইনে ১৫ জন। প্রথম দিকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পাঠদান করতেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিশ্ববরেণ্য পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, সত্যেন বসু, হরিদাস ভট্টাচার্য, জিএইচ ল্যাংলি, রাধা গোবিন্দ বসাক, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, বিএম সেনগুপ্ত, গণেশচরণ বসু, রাজেন্দ্র চন্দ্র হাজরা, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ খ্যাতিমান পণ্ডিত।
বর্তমানে অনুষদের সংখ্যা ১৩, বিভাগ ৭৬, ইন্সটিটিউট ১৩, গবেষণা ব্যুরো ও কেন্দ্র ৪৬, আবাসিক হল ২০; তন্মধ্যে ৫টি ছাত্রী হল। ছাত্রীদের জন্য একটি বর্ধিত হল। হোস্টেল সংখ্যা ৪। বর্তমানে শিক্ষক সংখ্যা ১ হাজার ৮৮৫, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৪২ হাজার ৬৪, সান্ধ্যকালীন শিক্ষার্থী ৫ হাজার ৩০৮। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ৯৭৩, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী ১ হাজার ৯৫, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ২ হাজার ১৮৪। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ ও ইন্সটিটিউট রয়েছে ৮৮টি।
শিক্ষার্থীদের অধিক বিদ্যা ও জ্ঞানমুখী করার লক্ষ্যে এবং নৈতিক আদর্শে গড়ে তোলার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া উচিত। কারণ শিক্ষা মানুষের চেতনাকে শানিত, অনুভূতিকে গভীর ও আত্মোপলব্ধিকে সমৃদ্ধ করে। প্রকৃত শিক্ষা ব্যক্তিকে অন্ধবিশ্বাস ও পশ্চাৎমুখিনতা থেকে মুক্ত করে, ভ্রান্ত দর্শন বা আদর্শ থেকে তাকে রক্ষা করে বিশুদ্ধ চিন্তায় আলোকিত করে। বিশ্ববিদ্যালয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে কোনো ধরনের পণ্য-বিজ্ঞাপন থাকা উচিত নয়। সব ধরনের অনৈতিক, অনাদর্শ ও অসামাজিক কাজকর্ম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত রাখতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে কোথাও কোনো দৃশ্যমান গেট নেই। শাহবাগ, ঢাকা মেডিকেল, পলাশী মোড়, হাইকোর্ট ও নীলক্ষেতের প্রধান প্রধান প্রবেশদ্বারে গেট থাকা উচিত। তবে নীলক্ষেতে একটি তৈরি হচ্ছে অনেক বলার পর। এটা সাধুবাদযোগ্য। বাইরের দর্শনার্থীরা যেন বাইরে থেকে দেখে অথবা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে বুঝতে পারে সত্যিকার অর্থে এটি দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা এবং প্রধান স্থাপনা ও ফটকগুলোতে, এমনকি চারুকলার মতো নিজ নিজ ফ্যাকাল্টির সামনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতী শিক্ষক, দেশের বরেণ্য কিংবা বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিন্তাবিদদের ছবি ও বাণী থাকলে ভালো হয়। বাংলার প্রখ্যাত পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও কিছু করা গেল না, এটা দুঃখের বিষয়। তার নামে কিছু একটা করা উচিত।
পরিশেষে বলি, এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর আগের গৌরব নেই। বিদ্যাচর্চা, গবেষণা ও পঠন-পাঠনের গতিধারায় বেশ ভাটা পড়েছে। নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা আজ অনেক কমে গেছে। সর্বত্রই যেন অনৈতিকতা ও শৃংখলার অভাব। ছাত্র-শিক্ষকের একটি বড় অংশ জ্ঞানচর্চা ভুলে গিয়ে অর্থ, পদমর্যাদা ও বিত্ত-বৈভবের দিকে বেশি মনোযোগী হয়েছে। এজন্যই আগের তুলনায় মেধার বিকাশ কম হচ্ছে। শিক্ষার মান নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে।
তারপরও বলতে হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এদেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় পঠন-পাঠন, জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অনেক অগ্রসরমান।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া : সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন-বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
মূলত পূর্ব বাংলার পশ্চাৎপদ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের লক্ষ্যেই এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ নয় দশক পার করে এ বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছে এ উপমহাদেশ ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে। শিক্ষার্থীদের জন্য সনদও বিতরণ করেছে অনেক। মেধা, গবেষণা ও কৃতিত্বের কারণে বহু পদকও পেয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এবারের সমাবর্তনে মোট ৬ হাজার ১০৪ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করবে। তাদের মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ৪২, এমফিল ২০, স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ২৯, এমডি ও এমএস ৪৯, অনার্স (স্নাতক) ৩ হাজার ১৬০ এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ৫৬৫ জন।
সমাবর্তন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্ট ও একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় সচল থাকে। বিদ্যা ও জ্ঞানমুখী সাধনায় নিবিষ্ট থাকার জন্য শিক্ষার্থীরা প্রেরণা পায় এবং পাঠের প্রতি উৎসাহ জোগায়। সমাবর্তনের দিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের পদচারণায় মুখরিত হয়। পরিবেশও হয় বর্ণাঢ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষণার পাশাপাশি এদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা অসামান্য অবদান রেখেছেন। নেতৃত্বও দিয়েছে অসাধারণ। এ কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এত নামডাক। অর্জনও অনেক। গবেষণার পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধির চর্চা, নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে।
বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট নামে প্রথমে পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের দাবি ওঠে। ১৯১২ সালের ২৭ মে বেঙ্গল গভর্নমেন্ট কর্তৃক গঠিত রবার্ট নাথান কমিটির সদস্যদের মাধ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি তৈরি হয়। এর প্রস্তাবক ছিলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ও শেরেবাংলা একে ফজলুল হক।
ঢাকার রমনা সিভিল স্টেশন এলাকার প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির পরিমাণ ২৭৫.০৮৩ একর। সুখের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে উইল করা প্রখ্যাত দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেবের (জিসি দেব) জমিটিও সম্প্রতি কোর্টের রায়ে উদ্ধার করা হয়েছে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। দীর্ঘদিন পরে হলেও এটিকে একটি ভালো কাজ বলা যায়। এরকম আরও নানা জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি রয়েছে। এগুলো উদ্ধার করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর আরও বিস্তৃত করা যাবে। যেহেতু যুগের চাহিদায় নতুন নতুন বিভাগ, ফ্যাকাল্টি ও গবেষণা সেন্টার খোলা হচ্ছে, সেহেতু এ নিয়ে আমাদের এখনই ভাবতে হবে। সেজন্য চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে আণবিক শক্তি কমিশনের পূর্বদিক পর্যন্ত অর্থাৎ টিএসসির পূর্ব পাশের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কিছু অংশ এখন থেকে নিতে না পারলে আগামী দেড়শ-দুশ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণের জন্য আর কোনো জায়গা পাওয়া যাবে না। এমনকি বর্তমান আণবিক শক্তি কমিশনের জায়গাটিও আমাদের নিয়ে নিতে হবে।
স্মর্তব্য, এ উপমহাদেশের প্রাচীনতম ও খ্যাতিমান নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটাকে গড়ে তোলা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, ছাত্র-শিক্ষক কাছাকাছি থেকে বিদ্যা ও পাঠ গ্রহণ এবং পারস্পরিক জ্ঞানের আদান-প্রদান
করবে। এমনকি শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলে থেকে জ্ঞানার্জনের নানা প্রয়োজনে লাইব্রেরিসহ শিক্ষকের সাহচর্য লাভ করবে। প্রাচীন ভারতবর্ষের বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞানার্জনের ধরনও ছিল সে রকম। এ কারণে বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞানদানে নালন্দার এত গৌরব ও এত খ্যাতি ছিল।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান ও বিদ্যাচর্চার নিরিখে এ উপমহাদেশে একটি শ্রেষ্ঠ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত লাভ করে। অক্সফোর্ডের আদলে এর পঠন-পাঠন ও শিক্ষাদান কার্যক্রম পদ্ধতি পরিচালিত হয়েছিল বলেই এটাকে বলা হতো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। এছাড়াও ঐতিহাসিক নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের গর্বিত অংশীদার হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম উপাচার্য ছিলেন স্যার পিজে হার্টজ। প্রথম চ্যান্সেলর ছিলেন লরেন্স জন লামলে ডানডাস (১৯২১-১৯২২)। প্রথম রেজিস্ট্রার ছিলেন খান বাহাদুর নাজির উদ্দিন আহমদ (১০.০৪.২১ থেকে ৩০.০৬.৪৪)। মনোগ্রাম পরিবর্তন হয় চারবার। প্রথম ১৯২১-১৯৫২, দ্বিতীয় ১৯৫২-৭২, তৃতীয় ১৯৭২-১৯৭৩, চতুর্থ ১৯৭৩ থেকে চলমান।
প্রথমে কলা, বিজ্ঞান ও আইন এ তিনটি অনুষদ নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে কলা অনুষদে ছিল সংস্কৃত, বাংলা, উর্দু, ফার্সি, আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ ইত্যাদি বিষয়। ইতিহাস, ইংরেজি, দর্শন, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও শিক্ষা বিভাগও ছিল। বিজ্ঞান অনুষদে ছিল গণিত, পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন। আইন অনুষদে ছিল শুধু আইন বিভাগ। সর্বমোট বিভাগ ছিল ১২টি। প্রথমে বিএ, বিএসসি অনার্স এবং এমএ ও এমএসসি সব মিলিয়ে ৮৫০ ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয়েছিল। আবাসিক হল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা হল, জগন্নাথ হল ও মুসলিম হল।
সে সময় কোনো ছাত্রী হল ছিল না। সব বিভাগে পড়ানোর জন্য শিক্ষক ছিলেন মাত্র ৬০ জন। কলা অনুষদে ২৮, বিজ্ঞানে ১৭, আর আইনে ১৫ জন। প্রথম দিকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পাঠদান করতেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিশ্ববরেণ্য পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, সত্যেন বসু, হরিদাস ভট্টাচার্য, জিএইচ ল্যাংলি, রাধা গোবিন্দ বসাক, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, বিএম সেনগুপ্ত, গণেশচরণ বসু, রাজেন্দ্র চন্দ্র হাজরা, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ খ্যাতিমান পণ্ডিত।
বর্তমানে অনুষদের সংখ্যা ১৩, বিভাগ ৭৬, ইন্সটিটিউট ১৩, গবেষণা ব্যুরো ও কেন্দ্র ৪৬, আবাসিক হল ২০; তন্মধ্যে ৫টি ছাত্রী হল। ছাত্রীদের জন্য একটি বর্ধিত হল। হোস্টেল সংখ্যা ৪। বর্তমানে শিক্ষক সংখ্যা ১ হাজার ৮৮৫, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৪২ হাজার ৬৪, সান্ধ্যকালীন শিক্ষার্থী ৫ হাজার ৩০৮। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ৯৭৩, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী ১ হাজার ৯৫, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ২ হাজার ১৮৪। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ ও ইন্সটিটিউট রয়েছে ৮৮টি।
শিক্ষার্থীদের অধিক বিদ্যা ও জ্ঞানমুখী করার লক্ষ্যে এবং নৈতিক আদর্শে গড়ে তোলার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া উচিত। কারণ শিক্ষা মানুষের চেতনাকে শানিত, অনুভূতিকে গভীর ও আত্মোপলব্ধিকে সমৃদ্ধ করে। প্রকৃত শিক্ষা ব্যক্তিকে অন্ধবিশ্বাস ও পশ্চাৎমুখিনতা থেকে মুক্ত করে, ভ্রান্ত দর্শন বা আদর্শ থেকে তাকে রক্ষা করে বিশুদ্ধ চিন্তায় আলোকিত করে। বিশ্ববিদ্যালয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে কোনো ধরনের পণ্য-বিজ্ঞাপন থাকা উচিত নয়। সব ধরনের অনৈতিক, অনাদর্শ ও অসামাজিক কাজকর্ম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত রাখতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে কোথাও কোনো দৃশ্যমান গেট নেই। শাহবাগ, ঢাকা মেডিকেল, পলাশী মোড়, হাইকোর্ট ও নীলক্ষেতের প্রধান প্রধান প্রবেশদ্বারে গেট থাকা উচিত। তবে নীলক্ষেতে একটি তৈরি হচ্ছে অনেক বলার পর। এটা সাধুবাদযোগ্য। বাইরের দর্শনার্থীরা যেন বাইরে থেকে দেখে অথবা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে বুঝতে পারে সত্যিকার অর্থে এটি দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা এবং প্রধান স্থাপনা ও ফটকগুলোতে, এমনকি চারুকলার মতো নিজ নিজ ফ্যাকাল্টির সামনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতী শিক্ষক, দেশের বরেণ্য কিংবা বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিন্তাবিদদের ছবি ও বাণী থাকলে ভালো হয়। বাংলার প্রখ্যাত পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও কিছু করা গেল না, এটা দুঃখের বিষয়। তার নামে কিছু একটা করা উচিত।
পরিশেষে বলি, এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর আগের গৌরব নেই। বিদ্যাচর্চা, গবেষণা ও পঠন-পাঠনের গতিধারায় বেশ ভাটা পড়েছে। নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা আজ অনেক কমে গেছে। সর্বত্রই যেন অনৈতিকতা ও শৃংখলার অভাব। ছাত্র-শিক্ষকের একটি বড় অংশ জ্ঞানচর্চা ভুলে গিয়ে অর্থ, পদমর্যাদা ও বিত্ত-বৈভবের দিকে বেশি মনোযোগী হয়েছে। এজন্যই আগের তুলনায় মেধার বিকাশ কম হচ্ছে। শিক্ষার মান নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে।
তারপরও বলতে হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এদেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় পঠন-পাঠন, জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অনেক অগ্রসরমান।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া : সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন-বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
No comments