হারিয়ে যাচ্ছে রাখাইন সম্প্রদায় by এমএ সাইদ খোকন
হারিয়ে
যাচ্ছে বরগুনা-পটুয়াখালীর আদিবাসী রাখাইন সম্প্রদায়। তবে এখনও যারা আছেন,
তারা চেষ্টা করছেন বাঙালিদের সঙ্গে সমন্বয় করে নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমুন্নত
রেখে বসবাস করতে। রাখাইনদের সংস্কৃতি ছিল অন্যদের চেয়ে সমৃদ্ধ এবং ভিন্নতর।
প্রতিটি আচার-আচরণে ভিন্নতা ছিল। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল
মনের রাখার মতো। কিশোর-কিশোরীদের জলকেলি, বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল
বর্ণাঢ্য। এখন তা হলেও সেটি পূর্বের ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। কারণ তাদের
সংখ্যা কমে যাওয়া, দারিদ্রতা এবং ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। বরগুনার
তালতলী থানার রাখাইন নেতা মংতাহান বলেন, ১৯৬০, ৬৫ ও ’৭০-এর বন্যায় অনেক
পাড়া ধ্বংস হয়ে গেছে। ওই এলাকার রাখাইন সম্প্রদায় অনেকটা বিলুপ্ত এখন।
তাছাড়া বাঙালিদের সঙ্গে জমিজমার বিরোধ, মামলার দীর্ঘসূত্রতা, আইন থাকলেও
কার্যকারিতা না থাকা, নিজস্ব সংস্কৃতিতে কাজ করতে না পারায় আস্তে আস্তে
রাখাইন সম্প্রদায় এ অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে। তবে তালতলীর প্রবীণ ও
সমাজসেবক মো. ফজলুল হক জমাদ্দার এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, এ অঞ্চলের
রাখাইনরা এক সময় অনেক জমির মালিক ছিল। কিন্তু তারা কর্মক্ষেত্রে ছিল অলস।
যার কারণে লেখাপড়াও করতো না এবং কোন কাজ না করে জমি বিক্রি করে সংসার
চালাতো। অনেকে ৩০-৪০ বছর আগে জমি বিক্রি করে গেছে। এখন আবার এখানে ফিরে এসে
বিক্রি করা জমি দাবি করায় বাঙালিদের সঙ্গে মামলা-হামলাসহ বিভিন্ন ঝামেলা
হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাখাইন ও বাঙালি উভয়েই দায়ী। তবে রাখাইন সম্প্রদায়ের
নিজেদের মধ্যেও বিরোধ রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। বর্তমানে রাখাইনরা আগের
চেয়ে কর্মঠ এবং লেখাপড়ায় মনযোগী হয়েছে বলেও তিনি জানান। সূত্রমতে, ১৭৮৪
থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত বৃটিশ শাসনামলে বরগুনা সদর থানা, আমতলী এবং
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানা ও গলাচিপা থানায় ২শ’ ৩৭টি পাড়ায় ৫০ হাজারের
বেশি রাখাইন পরিবার ছিল। ১৯০০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত বৃটিশ শাসন ও
পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব মুহূর্তকাল পর্যন্ত ১শ’ ৬৮টি পাড়ায় ৫ হাজার ১৯০টি
বাড়িতে ৩৫ হাজার (আনুমানিক) রাখাইন বসবাস করছিলেন। এরপর ১৯৪৮-১৯৯১
পাকিস্তান শাসনামল ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তরকালে ৪৭টি পাড়ায় ৫শ’ ১৫টি
বাড়িতে ৩ হাজার ৫০০ লোক ছিল। ১৯৯১-২০১১ পর্যন্ত ৪৭টি পাড়ায় ৬শ’ ১৭টি বাড়িতে
৪ হাজার ৫০০ রাখাইন বসবাস করছেন। দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা সমুদ্রস্নাত
বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলাদ্বয়ের রাখাইন জনপদ গড়ে ওঠে আকর্ষণীয় ধর্মীয়
সামাজিক এক ভিন্নধারা সংস্কৃতির জীবন্তরূপ। ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখার জন্য তারা কালজয়ী
বৌদ্ধমন্দির ও বৌদ্ধ মূর্তিসহ স্থাপন করে রেখে গেছেন। রাখাইন সম্প্রদায়ের
মাতৃভাষায় অস্তিত্ব আজ হুমকির মূখে। এ প্রজন্মের আদিবাসী রাখাইন শিশুরা
মায়ের মুখ ও তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে শুধু মাতৃভাষায় কথা বলতে
পারলেও লিখতে ও পড়তে পাড়ছে না। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও আর্থিক দৈন্যতার কারণে
তাদের মাতৃভাষায় লেখা ও পড়া শেখানোর বিদ্যালয়গুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছে।
স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৭৮৪ সালে রাখাইনদের
মাতৃভূমি বার্মার মিয়ানমারে আরাকান রাজ্য সৃষ্টি হলে সেখান থেকে ১৫০টি
পরিবার নৌকাযোগে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। ওই সময় তারা সমুদ্র উপকূলবর্তী
কলাপাড়া, রাঙ্গাবালি, গলাচিপা,ও বরগুনা জেলার তালতলী থানাকে বসবাসের স্থান
হিসেবে বেছে নেয়। ওই রাখাইন পরিবারগুলোতে জন্ম নেয়া শিশুরা মা ও পরিবারের
অন্য সদস্যদের কাছ থেকে মাতৃভাষায় কথা বলতে শেখে। এজন্য প্রায় প্রতিটি
পাড়ায় একটি করে রাখাইন ভাষায় পরিচালিত বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ওই সময় পটুয়াখালী ও
বরগুনা জেলায় প্রায় ৫০টি বিদ্যালয় পরিচালিত হতো তাদের নিজস্ব অর্থায়নে।
রাখাইন শিশুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে
মাতৃভাষা শিখতে রাখাইন বিদ্যালয়ে যেত। বিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হতো রাখাইন
ভাষার বর্ণমালা, রাখাইন, সংখ্যা সাতবার ও বারো মাসের নামসহ রাখাইন ভাষার
বিভিন্ন ধরনের ছড়া আর কবিতা। এ ব্যাপারে আদিবাসী রাখাইন নেতা উসুয়ে হালদার
জানান, রাখাইন ভাষায় শিক্ষাদানের শিক্ষকের অভাব, দেশে পাঠ্যপুস্তক ছাপা না
হওয়ায় বই সঙ্কট ছাড়াও বই প্রকাশ এবং সরকারের সহযোগিতার অভাবে পিছিয়ে পড়ে
রাখাইন শিক্ষা বিদ্যালয়গুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে নতুন
প্রজন্মের রাখাইন শিশুরা মাতৃভাষায় কথা বলতে পারলেও লিখতে ও পড়তে পারছে না।
বিগত সরকার রাখাইনদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য কুয়াকাটায় রাখাইন
কালচারাল একাডেমির জন্য একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করে স্থানীয় রাখাইন আবাসিক
হোটেল হিসেবে কুয়াকাটায় আগত দর্শনার্থীদের ভাড়া দেয়া হয়।
No comments