সাংঘর্ষিক রাজনীতি পরিহারে সংলাপের বিকল্প নেই by ড. মাহবুব উল্লাহ্
বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের
সমাধান কোন পথে আসবে সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে
সুধীজনদের বড় অংশের অভিমত হল সংলাপ বা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সংকট
নিরসন করা সম্ভব। এ সংকটের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে সেই সম্পর্কে বড় দুটি দলের
ভিন্নমুখী বক্তব্য থাকলেও সাধারণ মানুষ এবং আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিষ্ঠিত
মতটি ৫ জানুয়ারি ২০১৪ যে নির্বাচন হয়েছে, সেটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এটা
উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এটি হল নিয়ম রক্ষার
নির্বাচন। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এ নির্বাচন করতে হয়েছে।
প্রয়োজনে আরও একটি নির্বাচন হতে পারে।’ এরপর এক বছর কেটে গেছে। নির্বাচনের
প্রশ্নে শাসক দল তাদের অবস্থান ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন করে ফেলেছে। তারা এখন
বলছে, মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে
২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কী কারণে তারা তাদের অবস্থানে এ
পরিবর্তন ঘটালেন, তার কোনো যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা তারা দেননি। তারা তাদের
পরিবর্তিত অবস্থানের পক্ষে কিছু শিশুসুলভ যুক্তি দিচ্ছেন, যেগুলো মেনে নেয়া
কঠিন।
গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা হয় প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের মাধ্যমে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের সব শর্ত পূরণ করে না। সাচ্চা গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন হয় জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা। একটি সরকার নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর তার কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিদিন কীভাবে জনগণের মুখোমুখি হবে, সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ কারণেই এখন অনেকে বলতে শুরু করেছেন, নির্বাচনী গণতন্ত্রে থেমে থাকলে চলবে না। গণতন্ত্রকে হতে সব দিক থেকে অর্থপূর্ণ। নির্বাচনী ম্যান্ডেট কোনো সরকারকে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার স্বাধীনতা দেয় না। সাচ্চা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। গণতন্ত্র একটি প্রক্রিয়া আর প্রক্রিয়া মানেই হল আদর্শ স্থানে পৌঁছানোর জন্য নিরন্তর প্রয়াস। পশ্চিমা দেশগুলো যে ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে এখন দাঁড়িয়ে আছে, সেই অবস্থায় পৌঁছাতেও তাদের বহু চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করতে হয়েছে। এরপরও পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই তাদের নিজ নিজ দেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে সমালোচনায়মুখর। আসলে গণতন্ত্রের আদর্শ রূপ সম্পর্কে শেষ কথা বলার সময় এখনও হয়নি। বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের হোঁচট খাওয়া গণতন্ত্র আবার খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে। নির্যাতন, নিপীড়ন, জেল, জুলুম ও মামলা-হামলার পথে বিদ্যমান সংকটের কোনো সমাধান হবে না। তাই ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে অবস্থানে ছিলেন, সে অবস্থানে ফিরে যাওয়াই আমাদের সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে। জেদাজেদির চর্চা কারোর জন্যই মঙ্গলজনক নয়। কারণ বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিকভাবে প্রধান দুটি অংশে বিভক্ত। এ বিভক্তি এতই প্রকট যে, অনেকে এ বিভক্তিকে পারস্পরিক হননের রাজনীতি বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল এক পক্ষ অন্য পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে না। এর জন্য সহঅবস্থানের পথ বেছে নেয়াই সঙ্গত। গত ৪৩ বছরে অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোকে বড় করে দেখিয়ে সমাধানের পথ পাশ কাটিয়ে যাওয়া কোনোক্রমেই যুক্তিসঙ্গত নয়। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে দুটি পরাশক্তি ছিল। সমর সম্ভারের দিক থেকে কেউ অন্যের তুলনায় কম ছিল না। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়ে ছিল, তারা তাদের মারণাস্ত্র প্রয়োগ করে একে অপরকে মুহূর্তের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারত। কিন্তু সে পথে তারা হাঁটেনি। তারা পরস্পরের মধ্যে অবিশ্বাস দূর করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ধ্বংস পরিস্থিতি এড়ানো গেছে। দুটি পক্ষ যদি সমান শক্তির অধিকারী হয়, তাহলে মারাত্মক ধরনের সংঘাত এড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশে রাজনৈতিক শক্তির দিক থেকে দুটি পক্ষ কেউ কারোর তুলনায় দুর্বল নয়। ক্ষমতাসীনরা মনে করতে পারে তাদের হাতে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র রয়েছে সেহেতু তারা তাদের প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে ফেলতে পারবে। এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা অবাস্তব। কারণ শেষ বিচারে জনগণই ইতিহাসের গতি নির্ধারণ করে। জনগণের প্রতি আস্থা থাকলে সব পক্ষেরই উচিত জনগণের কাছে ফিরে যাওয়া। এ ফিরে যাওয়া কেবল একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমেই সম্ভব। কীভাবে এবং কী প্রক্রিয়ায় একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা যায় সেটাই হওয়া উচিত আলোচনা বা সংলাপের মূল বিষয়বস্তু। এ পথে না গিয়ে তরবারি শানানোর পথ মানুষ পছন্দ করে না। বক্তৃতা, বিবৃতি দিয়ে কিংবা অশালীন উক্তি করে জয়লাভ করা সম্ভব নয়।
আলোচনা একবার শুরু হলে টেবিলে বসে এক পক্ষ আরেক পক্ষের অবস্থান সম্পর্কে সম্যক অবগত হতে পারবে। প্রয়োজনে এ আলোচনা বেশ ক’দিন ধরে চলতে পারে। আলোচনাকে ফলপ্রসূ করতে হলে এমন একটি বিন্দুতে এসে উপনীত হতে হবে যাতে প্রতীয়মান হয়, কোনো একটি পক্ষ জয়ী কিংবা পরাজিত হয়নি। একেই বলে সমঝোতা। এরকম ফলাফল অর্জন সম্ভব হলে শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে জনগণ। আমরা বিশ্বাস করতে চাই শত বিরোধ সত্ত্বেও উভয় পক্ষ জনগণকেই বিজয়ী দেখতে চায়।
এ ধরনের একটি আলোচনা শুরু করার জন্য সরকার পক্ষকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এ কথা মনে করারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, সব পক্ষেই কিছু অপরিণামদর্শী লোকজন থাকে, যারা বলতে চাইবে আলোচনার প্রস্তাব দেয়াই পরাজয় স্বীকার করার শামিল। কিন্তু এ ধরনের অপরিণামদর্শী ব্যক্তিরা বুঝতে চান না, গণতন্ত্র একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
এ প্রক্রিয়া কাউকে চিরদিনের জন্য জয়ী কিংবা পরাজিত করে না। যে কোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকাকেই জয় বলে গণ্য করা গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের পর জনগণ কোনো দলকেই একাদিক্রমে দু’দফা দেশ পরিচালনার সুযোগ দেয়নি। কারণ যারাই ক্ষমতাসীন হয়েছে তারাই বেশ কিছু অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ড করেছে। এজন্য জনগণ তাদের প্রদত্ত ম্যান্ডেটের মাধ্যমে বিচ্যুতি ও ভুল-ভ্রান্তি ধরিয়ে দেয়ার জন্য নির্বাচনী সুযোগটিকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু মানুষকে বাধাহীনভাবে সেই সুযোগ ব্যবহার করতে না দিলে পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটতে পারে। আপস-সমঝোতায় উপনীত হওয়ার ব্যর্থতা যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, সেই পরিস্থিতিতে চরমপন্থীরাই সুযোগ পায়। এটা কারোর জন্য বিশেষ করে গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়। তাই সবাইকে ধীরস্থিরভাবে ভাবতে হবে সংঘাত-সংঘর্ষের পথ এড়িয়ে কীভাবে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়। দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণ না থাকলে অংশগ্রহণবঞ্চিত পক্ষ বিচ্ছিন্নবোধে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। এ বোধ থেকেই চরমপন্থার ভিত্তি রচিত হয়। এখন দায়িত্বশীল মহলকে ভাবতে হবে তারা চরমপন্থার উত্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবেন কিনা। শুধু আবেগ কিংবা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি কোনোক্রমেই কাম্য নয়। গত কয়েক বছর ধরে লক্ষ করা গেছে, কেউ কেউ খুব জোরালো কণ্ঠে বলতে চাচ্ছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে সেটা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সঙ্গে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিকে চূড়ান্তভাবে নির্মূল করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এটাকে এরা শেষ এবং চূড়ান্ত লড়াই হিসেবে গণ্য করছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিকে এরকম প্রবল ভাবা আসলে আমাদের স্বাধীনতাকেই দুর্বল বলে প্রতিপন্ন করে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের ৯৯ শতাংশ কিংবা আরও বেশি মানুষের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছিল। ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী এর বিরোধিতা করেছিল সত্য। আজ এত বছর পর কেন ওই শক্তিটিকে পরাক্রমশালী ভাবতে হবে। আসলে এ ধরনের ভাবনা আমাদের স্বাধীনতাকে ম্লান করে দেয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের বয়স ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের বয়সের প্রায় দ্বিগুণ সময় ইতোমধ্যেই অতিক্রম করেছে। সুতরাং বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অত ঠুনকো মনে করার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ তার জনগণের অসীম সৃজনশীলতার শক্তিতে অনন্তকাল টিকে থাকবে। জনগণের সৃজনশীলতার এ ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজন সমঝোতার রাজনীতি, সংঘাতের রাজনীতি নয়। যারা একথা-ওকথা বলে সংঘাতকে জিইয়ে রাখতে চায় তারা কেউই বাংলাদেশের হিতাকাক্সক্ষী হতে পারে না। যে কারণে এ মুহূর্তে আমরা সংঘাত-সংঘর্ষমূলক রাজনীতি প্রত্যক্ষ করছি, তার মূলের দিকেই দৃষ্টি নিবন্ধ করতে হবে। যদি মূল কারণটি চিহ্নিত করার প্রশ্নে একমত হওয়া যায় তাহলেই আমরা দেখব দেশ থেকে মুহূর্তের মধ্যেই সব সংঘাত-সংঘর্ষের অবসান ঘটেছে। সেই মুহূর্তে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমাদের দায়িত্ব হবে গণতন্ত্রকে অর্থপূর্ণ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে সহায়তা করা। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়া এবং দেশের উন্নয়নের জন্য সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণের দাবি তোলা এবং চাপ প্রয়োগ করা। এরকম অঙ্গীকার প্রদানে রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধ্য করার জন্য প্রবল গণচাপ সৃষ্টি করতে পারলে বাংলাদেশে একটি জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা হয় প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের মাধ্যমে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের সব শর্ত পূরণ করে না। সাচ্চা গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন হয় জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা। একটি সরকার নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর তার কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিদিন কীভাবে জনগণের মুখোমুখি হবে, সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ কারণেই এখন অনেকে বলতে শুরু করেছেন, নির্বাচনী গণতন্ত্রে থেমে থাকলে চলবে না। গণতন্ত্রকে হতে সব দিক থেকে অর্থপূর্ণ। নির্বাচনী ম্যান্ডেট কোনো সরকারকে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার স্বাধীনতা দেয় না। সাচ্চা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। গণতন্ত্র একটি প্রক্রিয়া আর প্রক্রিয়া মানেই হল আদর্শ স্থানে পৌঁছানোর জন্য নিরন্তর প্রয়াস। পশ্চিমা দেশগুলো যে ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে এখন দাঁড়িয়ে আছে, সেই অবস্থায় পৌঁছাতেও তাদের বহু চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করতে হয়েছে। এরপরও পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই তাদের নিজ নিজ দেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে সমালোচনায়মুখর। আসলে গণতন্ত্রের আদর্শ রূপ সম্পর্কে শেষ কথা বলার সময় এখনও হয়নি। বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের হোঁচট খাওয়া গণতন্ত্র আবার খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে। নির্যাতন, নিপীড়ন, জেল, জুলুম ও মামলা-হামলার পথে বিদ্যমান সংকটের কোনো সমাধান হবে না। তাই ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে অবস্থানে ছিলেন, সে অবস্থানে ফিরে যাওয়াই আমাদের সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে। জেদাজেদির চর্চা কারোর জন্যই মঙ্গলজনক নয়। কারণ বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিকভাবে প্রধান দুটি অংশে বিভক্ত। এ বিভক্তি এতই প্রকট যে, অনেকে এ বিভক্তিকে পারস্পরিক হননের রাজনীতি বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল এক পক্ষ অন্য পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে না। এর জন্য সহঅবস্থানের পথ বেছে নেয়াই সঙ্গত। গত ৪৩ বছরে অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোকে বড় করে দেখিয়ে সমাধানের পথ পাশ কাটিয়ে যাওয়া কোনোক্রমেই যুক্তিসঙ্গত নয়। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে দুটি পরাশক্তি ছিল। সমর সম্ভারের দিক থেকে কেউ অন্যের তুলনায় কম ছিল না। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়ে ছিল, তারা তাদের মারণাস্ত্র প্রয়োগ করে একে অপরকে মুহূর্তের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারত। কিন্তু সে পথে তারা হাঁটেনি। তারা পরস্পরের মধ্যে অবিশ্বাস দূর করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ধ্বংস পরিস্থিতি এড়ানো গেছে। দুটি পক্ষ যদি সমান শক্তির অধিকারী হয়, তাহলে মারাত্মক ধরনের সংঘাত এড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশে রাজনৈতিক শক্তির দিক থেকে দুটি পক্ষ কেউ কারোর তুলনায় দুর্বল নয়। ক্ষমতাসীনরা মনে করতে পারে তাদের হাতে যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র রয়েছে সেহেতু তারা তাদের প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে ফেলতে পারবে। এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা অবাস্তব। কারণ শেষ বিচারে জনগণই ইতিহাসের গতি নির্ধারণ করে। জনগণের প্রতি আস্থা থাকলে সব পক্ষেরই উচিত জনগণের কাছে ফিরে যাওয়া। এ ফিরে যাওয়া কেবল একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমেই সম্ভব। কীভাবে এবং কী প্রক্রিয়ায় একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা যায় সেটাই হওয়া উচিত আলোচনা বা সংলাপের মূল বিষয়বস্তু। এ পথে না গিয়ে তরবারি শানানোর পথ মানুষ পছন্দ করে না। বক্তৃতা, বিবৃতি দিয়ে কিংবা অশালীন উক্তি করে জয়লাভ করা সম্ভব নয়।
আলোচনা একবার শুরু হলে টেবিলে বসে এক পক্ষ আরেক পক্ষের অবস্থান সম্পর্কে সম্যক অবগত হতে পারবে। প্রয়োজনে এ আলোচনা বেশ ক’দিন ধরে চলতে পারে। আলোচনাকে ফলপ্রসূ করতে হলে এমন একটি বিন্দুতে এসে উপনীত হতে হবে যাতে প্রতীয়মান হয়, কোনো একটি পক্ষ জয়ী কিংবা পরাজিত হয়নি। একেই বলে সমঝোতা। এরকম ফলাফল অর্জন সম্ভব হলে শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে জনগণ। আমরা বিশ্বাস করতে চাই শত বিরোধ সত্ত্বেও উভয় পক্ষ জনগণকেই বিজয়ী দেখতে চায়।
এ ধরনের একটি আলোচনা শুরু করার জন্য সরকার পক্ষকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এ কথা মনে করারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, সব পক্ষেই কিছু অপরিণামদর্শী লোকজন থাকে, যারা বলতে চাইবে আলোচনার প্রস্তাব দেয়াই পরাজয় স্বীকার করার শামিল। কিন্তু এ ধরনের অপরিণামদর্শী ব্যক্তিরা বুঝতে চান না, গণতন্ত্র একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
এ প্রক্রিয়া কাউকে চিরদিনের জন্য জয়ী কিংবা পরাজিত করে না। যে কোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকাকেই জয় বলে গণ্য করা গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের পর জনগণ কোনো দলকেই একাদিক্রমে দু’দফা দেশ পরিচালনার সুযোগ দেয়নি। কারণ যারাই ক্ষমতাসীন হয়েছে তারাই বেশ কিছু অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ড করেছে। এজন্য জনগণ তাদের প্রদত্ত ম্যান্ডেটের মাধ্যমে বিচ্যুতি ও ভুল-ভ্রান্তি ধরিয়ে দেয়ার জন্য নির্বাচনী সুযোগটিকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু মানুষকে বাধাহীনভাবে সেই সুযোগ ব্যবহার করতে না দিলে পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটতে পারে। আপস-সমঝোতায় উপনীত হওয়ার ব্যর্থতা যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, সেই পরিস্থিতিতে চরমপন্থীরাই সুযোগ পায়। এটা কারোর জন্য বিশেষ করে গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়। তাই সবাইকে ধীরস্থিরভাবে ভাবতে হবে সংঘাত-সংঘর্ষের পথ এড়িয়ে কীভাবে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়। দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণ না থাকলে অংশগ্রহণবঞ্চিত পক্ষ বিচ্ছিন্নবোধে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। এ বোধ থেকেই চরমপন্থার ভিত্তি রচিত হয়। এখন দায়িত্বশীল মহলকে ভাবতে হবে তারা চরমপন্থার উত্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবেন কিনা। শুধু আবেগ কিংবা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি কোনোক্রমেই কাম্য নয়। গত কয়েক বছর ধরে লক্ষ করা গেছে, কেউ কেউ খুব জোরালো কণ্ঠে বলতে চাচ্ছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে সেটা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সঙ্গে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিকে চূড়ান্তভাবে নির্মূল করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এটাকে এরা শেষ এবং চূড়ান্ত লড়াই হিসেবে গণ্য করছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিকে এরকম প্রবল ভাবা আসলে আমাদের স্বাধীনতাকেই দুর্বল বলে প্রতিপন্ন করে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের ৯৯ শতাংশ কিংবা আরও বেশি মানুষের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছিল। ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী এর বিরোধিতা করেছিল সত্য। আজ এত বছর পর কেন ওই শক্তিটিকে পরাক্রমশালী ভাবতে হবে। আসলে এ ধরনের ভাবনা আমাদের স্বাধীনতাকে ম্লান করে দেয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের বয়স ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের বয়সের প্রায় দ্বিগুণ সময় ইতোমধ্যেই অতিক্রম করেছে। সুতরাং বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অত ঠুনকো মনে করার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ তার জনগণের অসীম সৃজনশীলতার শক্তিতে অনন্তকাল টিকে থাকবে। জনগণের সৃজনশীলতার এ ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজন সমঝোতার রাজনীতি, সংঘাতের রাজনীতি নয়। যারা একথা-ওকথা বলে সংঘাতকে জিইয়ে রাখতে চায় তারা কেউই বাংলাদেশের হিতাকাক্সক্ষী হতে পারে না। যে কারণে এ মুহূর্তে আমরা সংঘাত-সংঘর্ষমূলক রাজনীতি প্রত্যক্ষ করছি, তার মূলের দিকেই দৃষ্টি নিবন্ধ করতে হবে। যদি মূল কারণটি চিহ্নিত করার প্রশ্নে একমত হওয়া যায় তাহলেই আমরা দেখব দেশ থেকে মুহূর্তের মধ্যেই সব সংঘাত-সংঘর্ষের অবসান ঘটেছে। সেই মুহূর্তে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমাদের দায়িত্ব হবে গণতন্ত্রকে অর্থপূর্ণ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে সহায়তা করা। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়া এবং দেশের উন্নয়নের জন্য সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণের দাবি তোলা এবং চাপ প্রয়োগ করা। এরকম অঙ্গীকার প্রদানে রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধ্য করার জন্য প্রবল গণচাপ সৃষ্টি করতে পারলে বাংলাদেশে একটি জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
No comments