তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখের দিন by কাজী আনিস আহমেদ
আমি বন্ধুদের সঙ্গে খুব আশনাই রেখে চলার চেষ্টা কখনো করিনি। তাই আমার কাছে আমজাদের চিঠি এসেছে দেখে একটু অবাকই হলাম। তা-ও আবার সে চিঠি এসেছে তার আত্মহত্যার পর। তার আত্মহত্যার সময় আমি দেশের বাইরে ছিলাম। ফলে কী ঘটেছিল, তা বাদলই বলল, যখন সে চিঠিগুলো আমাকে দিতে এল। বাদল সবারই খোঁজখবর রাখত। বাদল এমনটাই ছিল। এখন মুটিয়ে গিয়েও বেশ কর্মঠ। তবে একটু অগোছাল ও ছটফটে। বাদল আড্ডা জমিয়ে পুরোনো দিনের গল্প করতে বেশ পছন্দ করত। সেই দিনগুলোর গল্প, যখন দিনগুলো বেশ ভালো ছিল। আমার কাছে এসব আড্ডাফাড্ডা একদম বিরক্তিকর মনে হতো। আমি মনে করতাম না আমার সুখের দিনগুলো পেছনে চলে গেছে। আমি তো বরং স্কুল-কলেজের ওই দিনগুলোয় বেশ কষ্টে ছিলাম। টাকা ছিল না, স্বাধীনতা ছিল না। তখন তো মূলত কষ্টই করছিলাম আজকের এই পদস্থ ভালো দিনগুলোর আশায়। আমার ভালো দিনগুলো তো আজকেরগুলো। আমি আজ কাইলার নামের নবাগত একটি বহুজাতিক কোম্পানির মার্কেটিং শাখার জেনারেল ম্যানেজার। আমরা চকলেট ও মিষ্টিদ্রব্য বিপণন করি। আমরা এখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদনও শুরু করেছি। মাঝেমধ্যে আমি কোম্পানির সদর দপ্তর জুরিখে যাই, আবার বম্বে যাই নতুন বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে। লালমাটিয়ায় নিজের ফ্ল্যাটে থাকি আমি। আমার স্ত্রী রিতা সহৃদয়, সুনিপুণ ও সুহাস্যময়। সে একজন চমৎকার গৃহিণী ও চমৎকার মা। আমার পাঁচ বছরের ছেলে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে এবং ড্রাগন নিয়ে ভাবে। আমি কেন হাপিত্যেশ করা একদল মাঝবয়সী লোকের সঙ্গে বসে সময় নষ্ট করতে থাকব আর ভণিতা নিয়ে বলব সুখ তো ছিল সেই স্কুল-পালানো দিনগুলোয়? আমি কেন তাদের সঙ্গে অর্থহীন লং ড্রাইভে যাব কিংবা যার বাসায় লোক নেই, তার বাসায় গিয়ে পর্নো দেখতে বসব?
তার পরও আমি বাদলের আড্ডাগুলোয় মাঝেমধ্যে যেতাম—কখনোবা কোনো নতুন-খোলা রেস্টুরেন্টে আবার কখনোবা নদীতে নৌকায়। বাদল ছিল নাছোড়বান্দা। কখনো বিরক্ত হতো না, কোনো গালমন্দ ওর দাওয়াত আর ফোনকল থামানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। তা ছাড়া অনেক দিন পর পর হলে তাদের সঙ্গে দেখা হতে আমারও খুব খারাপ লাগত না। বাদলের এমন এক আড্ডায়ই আমজাদের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল। দুবাই থেকে আসার পরপরই বাদল একদিন এল খবরটি দিতে। অন্যান্য দিনের মতো ঘামছিলও না, হাঁপাচ্ছিলও না, তবে তাকে একটু বিষণ্ন দেখাচ্ছিল। হাতে একটি শ্রীহীন প্যাকেট বা মোড়ক। সেটিকে টেবিলের এক কোণে রাখল। রাখার পরও কয়েকবার যেন আরও ঠিকমতো রাখার চেষ্টা করল। লোমহর্ষক ঘটনাটি আদ্যোপান্ত বলল—বাস, এয়ারপোর্ট রোড ইত্যাদির পূর্ণ টুকিটাকিসহ। সত্যিকারে এত বিশদ আমি জানতে চাইছিলাম না। আত্মহত্যা হয়তো আত্মহত্যাকারী সম্পর্কে কিছু জানায়। আত্মহত্যাটি কীভাবে হয়েছে, তা কিছুই জানায় বলে আমার মনে হয় না। বারবার বলে হলেও, দেখা গেল পুরো ঘটনা বলায় বাদলের একটা নিপুণতা অর্জিত হয়েছে। মনে হলো বারবার বলে বাদল তার দুঃখটাও একটু লাঘব করতে পেরেছে। একটু বন্ধুত্ব সরিয়ে বলা যায়, বারবার বলার মধ্য দিয়ে বাদল পুরো আখ্যানটির এক বিশ্বস্ত আমানতদারের গুরুত্ব অর্জন করছিল। সে বসেছিল আমার শান্ত এয়ারকন্ডিশন্ড রুমে, আমার টেবিলটার ঠিক আড়াআড়ি সামনে। টেবিলটা ছিল আমার বলিভিয়ান এমডির হলঘরের ঠিক আড়াআড়ি সামনে। আর সেখানে বসে বাদল তার এখনো অব্যাখ্যাত মোড়কটি মাঝেমধ্যেই হাতে নাড়াচাড়া করছিল। বাদল একটু রাগের সঙ্গেই বলল, ‘বুঝতে পারি না, কেন আমজাদ আমাদের কারোর কাছে একবার এল না?’
আমি বললাম, ‘সে হয়তো বুঝতে পারেনি সমস্যাটি এত মারাত্মক পরিস্থিতিতে তাকে নিয়ে যাবে।’ ‘না বুঝে কেমনে পারে? সে বাসের তলে ঝাঁপ দিল যে!’, আরও রাগের সঙ্গে বলল বাদল। ‘অবশ্যই কোনো তাৎক্ষণিক খেয়ালে ঝাঁপ দেয়নি সে। ধীরে ধীরেই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।’ ‘হয়তো পুরোটাই একটা ডিপ্রেশন। মাঝেমধ্যে কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই এমনটা হয়’, বলতে চাইলাম আমি। ‘তুমি কি করে জানবে? তুমি তো তার কোনো খবরই রাখতে না। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগেও তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তার কোনো ডিপ্রেশন ছিল না’, বাদল জোর দিয়ে বলল। ‘তাহলে তোমার কী মনে হয়?’, আমি জানতে চাইলাম। ‘সেটাই তো সমস্যা। বোঝার কোনো সূত্র নেই। আমজাদ এক নীরব জীবন যাপন করত। তার এমন কী হতে পারে?’, বাদল দিশাহীনের মতো বলল। ‘ওটা কী?’, মোড়কটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি। ‘এটাই হতে পারে এ রহস্যভেদের একমাত্র সূত্র’, বাদল বলল এবং আমার টেবিলের চকচকে কাচের ওপর দিয়ে ঠেলে মোড়কটি সে আমার কাছে দিল। একটা ছোট্ট মোড়ক। লাল-সাদা সুতায় বাঁধা একটি প্রায়-ছেঁড়া বাদামি খাম। এমন জিনিস এখন আর সরকারি অফিস ছাড়া কোথাও দেখা যায় না। আমজাদ এক সরকারি অফিসেই তার নিরানন্দ সময়গুলো পার করেছে। খামটিতে মনে হলো কিছু চিঠিই আছে। দেখে মনে হলো ভেতরে ১০-১২টি কাগজের বেশি থাকার কথা না। ‘এটি খোলোনি কেন?’, জিজ্ঞেস করলাম, কারণ খামের এক কোণে কালো মার্কার দিয়ে লেখা আমার ডাকনামটি তখনো দেখিনি। আমার সে নাম এখন আর আমার বন্ধুরাও খুব একটা ব্যবহার করে না। ‘এটা তো ও তোমাকে পাঠিয়েছে। মোনেম ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। আমরা এমনটাই ভাবতাম। আমাদের চেয়ে মোনেমের সঙ্গেই ওর যোগাযোগটা বেশি দেখতাম। এটা কিন্তু ও মোনেমের জন্য পাঠায়নি। আমার নামেও না। এটায় ও তোমার নামই লিখেছে।’ বাদল এ কথা বলে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল, মনে হলো ও জিজ্ঞেস করছিল কাজটা আমজাদ ঠিক করেছে কি না। বাদল আমার সামনে অনুগতের মতো বসে আছে এবং প্রত্যাশা করছে আমি প্যাকেটটি খুলে তাকে দেখাব ভেতরে কী আছে। কিন্তু আমি মিথ্যে করে বললাম যে, এমডির সঙ্গে আমার জরুরি একটি মিটিং আছে। এই বলে প্যাকেটটি আস্তে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দিলাম আমি। বললাম, এর ভেতরে কোনো ক্লু পাওয়া গেলে আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব। কৌতূহল একটা বিদ্ঘুটে জিনিস। এটি কখনো এগিয়ে নেয় আবার কখনো থামিয়ে দেয়। বেশ কয়েক দিন চলে গেল তার পরও আমি আমজাদের প্যাকেটটি খুললাম না। ব্যাখ্যা করতে পারব না কেন আমি এমনটা করছিলাম। আমি কি ভয় পাচ্ছিলাম যে হয়তো এখান থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বেরিয়ে পড়বে আমার এই বন্ধু সম্পর্কে, যাকে আমি একসময় অনেক আপন জানতাম আর শেষ পর্যন্ত যার খববরও রাখিনি? একটা মারাত্মক কোনো খবর আমার একদম হাতের মুঠোয়, যা আমি যখন খুশি জেনে ফেলতে পারি—এমন একটি অবস্থা আমার স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহকেই যেন নড়িয়ে দিচ্ছিল। আমার ঘুম ভালো হচ্ছিল না। সেলস-সংক্রান্ত মিটিংগুলোয়ও একাগ্রতা ছিল না আমার। আমার স্ত্রীর দৃষ্টি এড়াল না। বললাম, শিগগিরই একটি নতুন প্রোডাক্ট বাজারে ছাড়তে যাচ্ছি, এ নিয়ে একটু চিন্তিত। স্ত্রী বিশ্বাস করল। অফিসে আসা-যাওয়ার পথে যে সময়টায় আগে খবরের কাগজ দেখতাম, সে সময়টায় এখন আমি আমজাদকে নিয়ে ভাবি। আমি জানি আত্মহত্যাগুলোকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যারা জীবনের প্রতি পর্বে সুখী ও সফল তাদের আত্মহত্যাগুলো একটি রহস্য। আর যাদের জীবন ডিপ্রেশনের এবং বঞ্চনার, তাদের আত্মহত্যাগুলো জীবন থেকে পালানোর এক চরম চেষ্টা। আমজাদকে এই দুই ভাগের কোনোটিতেই ফেলা যাচ্ছিল না। তার এই চলে যাওয়ার ধরনের ওপর দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে আসলে আমি তাকে চিনতামই না। এভাবে ভাবাটাও অবশ্য ঠিক না। আমি তাকে সেই বয়সে ততখানিই চিনতাম, যতখানি একজন বন্ধু আরেক বন্ধুকে চিনতে পারে। মানুষ পাল্টায়। সে পাল্টিয়ে কোন মানুষটি হয়েছিল, সেটিই আমি জানতে পারিনি। তবে আমি মনে করি না বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, ঋণ ইত্যাকার সুনির্দিষ্ট প্রদর্শনযোগ্য কোনো কারণে সে আত্মহত্যাটি করেছে। এটা ছিল অবশ্যই অন্য কিছু। সেই অন্য কিছুটাই শুধু বুঝতে পারছিলাম না। অফিস থেকে আমি সবার শেষেই যেতাম, অবশ্য আমার পিয়নের আগে। এক সন্ধ্যায় যখন সবাই চলে গেল, আমার টেবিলে বসে ড্রয়ার থেকে আমজাদের খামটি বের করলাম আমি। ভেতরে দশটা বা বারোটা কাগজ। কাগজের ধরন ও আকারের বিভিন্নতা দেখে এবং কোনোটা ফ্রেশ আর কোনোটা ক্ষয়ে যাওয়া দেখে মনে হলো এগুলো দীর্ঘ বিরতিতে বিভিন্ন সময়ে লেখা। কোনো কাগজেই কোনো তারিখ নেই, কোনো কাগজেই পৃষ্ঠাজুড়ে লেখা নেই। লেখার ধরন দেখে মনে হচ্ছিল হয় কবিতা, নয় উদ্ধৃতি। প্রথম কাগজটিতে লেখা ছিল: ‘গত সপ্তাহে অফিস থেকে ফেরার সময় খেয়াল চাপল বাসে যাব না। বাসে না উঠে নদীর উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলাম। নদীটা কতদূর এবং কোন পথে, তা পুরোটা জানা ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে শহরের এমন একটা জায়গায় হাজির হলাম যেটা একেবারেই চেনা কোনো জায়গা নয়। আকাশটা অন্ধকার হয়ে এল, রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠল। জীবনে প্রথমবার অনুভব হলো আমি হারিয়ে গেছি। অনেক বাস-স্কুটার বদলিয়ে মধ্যরাতেরও পরে বাসায় পৌঁছালাম। মনে হলো সারা রাত বাইরে থাকলেই তো মজা হতো। হারানো অবস্থায় যে কয়টা ঘণ্টা আমি ছিলাম, একটি একতলা দালানের জানালার লিন্টেলের ওপর বসে দেখছিলাম রাস্তা দিয়ে মানুষগুলো আসছে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে অনেক দিন ধরে এমন সুখের সময় আমার আর যায়নি।’ লেখাগুলো এত বেখাপ্পা ও বেহুদা মনে হলো, পুরোটা না পড়ে আমি লাফিয়ে লাফিয়ে এগোলাম কাজের কোনো তথ্য পাওয়ার আশায়। কিছুই পেলাম না। সবটাই ডায়েরিকথা অথবা নিজের কাছে নিজের চিঠি কিংবা খেয়ালখুশির কাহিনি। সব লেখারই বিষয় আমজাদের নিজের জীবন থেকে নেওয়া কিছু অদ্ভুত মুহূর্ত, যে মুহূর্তগুলোতে এক ঝুলে থাকা অন্ধকার থেকে সে নিজেকে মুক্ত ভেবেছে। আমি কখনো ভাবিনি আমজাদের ভেতরে এমন অবদমিত কষ্টবোধ ছিল। আমার মনে হয়, অন্য কেউও ভাবেনি। লেখাগুলোয় কোথাও তার বউ-বাচ্চার কোনো উল্লেখ নেই। নিজের কীর্তিকর্মের কোনো উল্লেখ নেই। কীর্তিকর্ম তার খুব ছিল না। তবে গ্র্যাজুয়েশন, চাকরি, প্রোমোশন ইত্যাদি তো ছিল। মনে আছে সে একবার মাদ্রাজ গিয়েছিল এবং আমার জন্য খোদাইচিত্র এনেছিল। এ জাতীয় কোনো ভ্রমণ বা অবসরযাপনের কথা লেখাগুলোয় নেই। কোনো বিশেষ দিন যেমন বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন কিংবা কোনো দুর্যোগের দিন ইত্যাদিরও কোনো উল্লেখ লেখাগুলোয় নেই। জীবনের যেটুকু সে দেখতে চেয়েছে, তাতে এসবের কোনো স্থান ছিল না। জীবনের উত্থান-পতনের পরিচিত খানাখন্দগুলো সে যথেষ্ট বেখেয়ালের সঙ্গেই পার করেছে। তার খেয়াল ছিল অন্যদিকে। যা কিছুর দিকে তার খেয়াল, যেটুকু তার সাধনা; স্পষ্টতই সেটুকু সে পায়নি। সেটুকু কী ছিল, তা সবাইকে বাদ দিয়ে আমাকে কেন খুঁজতে হচ্ছে?
তার পরও আমি বাদলের আড্ডাগুলোয় মাঝেমধ্যে যেতাম—কখনোবা কোনো নতুন-খোলা রেস্টুরেন্টে আবার কখনোবা নদীতে নৌকায়। বাদল ছিল নাছোড়বান্দা। কখনো বিরক্ত হতো না, কোনো গালমন্দ ওর দাওয়াত আর ফোনকল থামানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। তা ছাড়া অনেক দিন পর পর হলে তাদের সঙ্গে দেখা হতে আমারও খুব খারাপ লাগত না। বাদলের এমন এক আড্ডায়ই আমজাদের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল। দুবাই থেকে আসার পরপরই বাদল একদিন এল খবরটি দিতে। অন্যান্য দিনের মতো ঘামছিলও না, হাঁপাচ্ছিলও না, তবে তাকে একটু বিষণ্ন দেখাচ্ছিল। হাতে একটি শ্রীহীন প্যাকেট বা মোড়ক। সেটিকে টেবিলের এক কোণে রাখল। রাখার পরও কয়েকবার যেন আরও ঠিকমতো রাখার চেষ্টা করল। লোমহর্ষক ঘটনাটি আদ্যোপান্ত বলল—বাস, এয়ারপোর্ট রোড ইত্যাদির পূর্ণ টুকিটাকিসহ। সত্যিকারে এত বিশদ আমি জানতে চাইছিলাম না। আত্মহত্যা হয়তো আত্মহত্যাকারী সম্পর্কে কিছু জানায়। আত্মহত্যাটি কীভাবে হয়েছে, তা কিছুই জানায় বলে আমার মনে হয় না। বারবার বলে হলেও, দেখা গেল পুরো ঘটনা বলায় বাদলের একটা নিপুণতা অর্জিত হয়েছে। মনে হলো বারবার বলে বাদল তার দুঃখটাও একটু লাঘব করতে পেরেছে। একটু বন্ধুত্ব সরিয়ে বলা যায়, বারবার বলার মধ্য দিয়ে বাদল পুরো আখ্যানটির এক বিশ্বস্ত আমানতদারের গুরুত্ব অর্জন করছিল। সে বসেছিল আমার শান্ত এয়ারকন্ডিশন্ড রুমে, আমার টেবিলটার ঠিক আড়াআড়ি সামনে। টেবিলটা ছিল আমার বলিভিয়ান এমডির হলঘরের ঠিক আড়াআড়ি সামনে। আর সেখানে বসে বাদল তার এখনো অব্যাখ্যাত মোড়কটি মাঝেমধ্যেই হাতে নাড়াচাড়া করছিল। বাদল একটু রাগের সঙ্গেই বলল, ‘বুঝতে পারি না, কেন আমজাদ আমাদের কারোর কাছে একবার এল না?’
আমি বললাম, ‘সে হয়তো বুঝতে পারেনি সমস্যাটি এত মারাত্মক পরিস্থিতিতে তাকে নিয়ে যাবে।’ ‘না বুঝে কেমনে পারে? সে বাসের তলে ঝাঁপ দিল যে!’, আরও রাগের সঙ্গে বলল বাদল। ‘অবশ্যই কোনো তাৎক্ষণিক খেয়ালে ঝাঁপ দেয়নি সে। ধীরে ধীরেই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।’ ‘হয়তো পুরোটাই একটা ডিপ্রেশন। মাঝেমধ্যে কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই এমনটা হয়’, বলতে চাইলাম আমি। ‘তুমি কি করে জানবে? তুমি তো তার কোনো খবরই রাখতে না। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগেও তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তার কোনো ডিপ্রেশন ছিল না’, বাদল জোর দিয়ে বলল। ‘তাহলে তোমার কী মনে হয়?’, আমি জানতে চাইলাম। ‘সেটাই তো সমস্যা। বোঝার কোনো সূত্র নেই। আমজাদ এক নীরব জীবন যাপন করত। তার এমন কী হতে পারে?’, বাদল দিশাহীনের মতো বলল। ‘ওটা কী?’, মোড়কটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি। ‘এটাই হতে পারে এ রহস্যভেদের একমাত্র সূত্র’, বাদল বলল এবং আমার টেবিলের চকচকে কাচের ওপর দিয়ে ঠেলে মোড়কটি সে আমার কাছে দিল। একটা ছোট্ট মোড়ক। লাল-সাদা সুতায় বাঁধা একটি প্রায়-ছেঁড়া বাদামি খাম। এমন জিনিস এখন আর সরকারি অফিস ছাড়া কোথাও দেখা যায় না। আমজাদ এক সরকারি অফিসেই তার নিরানন্দ সময়গুলো পার করেছে। খামটিতে মনে হলো কিছু চিঠিই আছে। দেখে মনে হলো ভেতরে ১০-১২টি কাগজের বেশি থাকার কথা না। ‘এটি খোলোনি কেন?’, জিজ্ঞেস করলাম, কারণ খামের এক কোণে কালো মার্কার দিয়ে লেখা আমার ডাকনামটি তখনো দেখিনি। আমার সে নাম এখন আর আমার বন্ধুরাও খুব একটা ব্যবহার করে না। ‘এটা তো ও তোমাকে পাঠিয়েছে। মোনেম ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। আমরা এমনটাই ভাবতাম। আমাদের চেয়ে মোনেমের সঙ্গেই ওর যোগাযোগটা বেশি দেখতাম। এটা কিন্তু ও মোনেমের জন্য পাঠায়নি। আমার নামেও না। এটায় ও তোমার নামই লিখেছে।’ বাদল এ কথা বলে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল, মনে হলো ও জিজ্ঞেস করছিল কাজটা আমজাদ ঠিক করেছে কি না। বাদল আমার সামনে অনুগতের মতো বসে আছে এবং প্রত্যাশা করছে আমি প্যাকেটটি খুলে তাকে দেখাব ভেতরে কী আছে। কিন্তু আমি মিথ্যে করে বললাম যে, এমডির সঙ্গে আমার জরুরি একটি মিটিং আছে। এই বলে প্যাকেটটি আস্তে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দিলাম আমি। বললাম, এর ভেতরে কোনো ক্লু পাওয়া গেলে আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব। কৌতূহল একটা বিদ্ঘুটে জিনিস। এটি কখনো এগিয়ে নেয় আবার কখনো থামিয়ে দেয়। বেশ কয়েক দিন চলে গেল তার পরও আমি আমজাদের প্যাকেটটি খুললাম না। ব্যাখ্যা করতে পারব না কেন আমি এমনটা করছিলাম। আমি কি ভয় পাচ্ছিলাম যে হয়তো এখান থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বেরিয়ে পড়বে আমার এই বন্ধু সম্পর্কে, যাকে আমি একসময় অনেক আপন জানতাম আর শেষ পর্যন্ত যার খববরও রাখিনি? একটা মারাত্মক কোনো খবর আমার একদম হাতের মুঠোয়, যা আমি যখন খুশি জেনে ফেলতে পারি—এমন একটি অবস্থা আমার স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহকেই যেন নড়িয়ে দিচ্ছিল। আমার ঘুম ভালো হচ্ছিল না। সেলস-সংক্রান্ত মিটিংগুলোয়ও একাগ্রতা ছিল না আমার। আমার স্ত্রীর দৃষ্টি এড়াল না। বললাম, শিগগিরই একটি নতুন প্রোডাক্ট বাজারে ছাড়তে যাচ্ছি, এ নিয়ে একটু চিন্তিত। স্ত্রী বিশ্বাস করল। অফিসে আসা-যাওয়ার পথে যে সময়টায় আগে খবরের কাগজ দেখতাম, সে সময়টায় এখন আমি আমজাদকে নিয়ে ভাবি। আমি জানি আত্মহত্যাগুলোকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যারা জীবনের প্রতি পর্বে সুখী ও সফল তাদের আত্মহত্যাগুলো একটি রহস্য। আর যাদের জীবন ডিপ্রেশনের এবং বঞ্চনার, তাদের আত্মহত্যাগুলো জীবন থেকে পালানোর এক চরম চেষ্টা। আমজাদকে এই দুই ভাগের কোনোটিতেই ফেলা যাচ্ছিল না। তার এই চলে যাওয়ার ধরনের ওপর দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে আসলে আমি তাকে চিনতামই না। এভাবে ভাবাটাও অবশ্য ঠিক না। আমি তাকে সেই বয়সে ততখানিই চিনতাম, যতখানি একজন বন্ধু আরেক বন্ধুকে চিনতে পারে। মানুষ পাল্টায়। সে পাল্টিয়ে কোন মানুষটি হয়েছিল, সেটিই আমি জানতে পারিনি। তবে আমি মনে করি না বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, ঋণ ইত্যাকার সুনির্দিষ্ট প্রদর্শনযোগ্য কোনো কারণে সে আত্মহত্যাটি করেছে। এটা ছিল অবশ্যই অন্য কিছু। সেই অন্য কিছুটাই শুধু বুঝতে পারছিলাম না। অফিস থেকে আমি সবার শেষেই যেতাম, অবশ্য আমার পিয়নের আগে। এক সন্ধ্যায় যখন সবাই চলে গেল, আমার টেবিলে বসে ড্রয়ার থেকে আমজাদের খামটি বের করলাম আমি। ভেতরে দশটা বা বারোটা কাগজ। কাগজের ধরন ও আকারের বিভিন্নতা দেখে এবং কোনোটা ফ্রেশ আর কোনোটা ক্ষয়ে যাওয়া দেখে মনে হলো এগুলো দীর্ঘ বিরতিতে বিভিন্ন সময়ে লেখা। কোনো কাগজেই কোনো তারিখ নেই, কোনো কাগজেই পৃষ্ঠাজুড়ে লেখা নেই। লেখার ধরন দেখে মনে হচ্ছিল হয় কবিতা, নয় উদ্ধৃতি। প্রথম কাগজটিতে লেখা ছিল: ‘গত সপ্তাহে অফিস থেকে ফেরার সময় খেয়াল চাপল বাসে যাব না। বাসে না উঠে নদীর উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলাম। নদীটা কতদূর এবং কোন পথে, তা পুরোটা জানা ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে শহরের এমন একটা জায়গায় হাজির হলাম যেটা একেবারেই চেনা কোনো জায়গা নয়। আকাশটা অন্ধকার হয়ে এল, রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠল। জীবনে প্রথমবার অনুভব হলো আমি হারিয়ে গেছি। অনেক বাস-স্কুটার বদলিয়ে মধ্যরাতেরও পরে বাসায় পৌঁছালাম। মনে হলো সারা রাত বাইরে থাকলেই তো মজা হতো। হারানো অবস্থায় যে কয়টা ঘণ্টা আমি ছিলাম, একটি একতলা দালানের জানালার লিন্টেলের ওপর বসে দেখছিলাম রাস্তা দিয়ে মানুষগুলো আসছে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে অনেক দিন ধরে এমন সুখের সময় আমার আর যায়নি।’ লেখাগুলো এত বেখাপ্পা ও বেহুদা মনে হলো, পুরোটা না পড়ে আমি লাফিয়ে লাফিয়ে এগোলাম কাজের কোনো তথ্য পাওয়ার আশায়। কিছুই পেলাম না। সবটাই ডায়েরিকথা অথবা নিজের কাছে নিজের চিঠি কিংবা খেয়ালখুশির কাহিনি। সব লেখারই বিষয় আমজাদের নিজের জীবন থেকে নেওয়া কিছু অদ্ভুত মুহূর্ত, যে মুহূর্তগুলোতে এক ঝুলে থাকা অন্ধকার থেকে সে নিজেকে মুক্ত ভেবেছে। আমি কখনো ভাবিনি আমজাদের ভেতরে এমন অবদমিত কষ্টবোধ ছিল। আমার মনে হয়, অন্য কেউও ভাবেনি। লেখাগুলোয় কোথাও তার বউ-বাচ্চার কোনো উল্লেখ নেই। নিজের কীর্তিকর্মের কোনো উল্লেখ নেই। কীর্তিকর্ম তার খুব ছিল না। তবে গ্র্যাজুয়েশন, চাকরি, প্রোমোশন ইত্যাদি তো ছিল। মনে আছে সে একবার মাদ্রাজ গিয়েছিল এবং আমার জন্য খোদাইচিত্র এনেছিল। এ জাতীয় কোনো ভ্রমণ বা অবসরযাপনের কথা লেখাগুলোয় নেই। কোনো বিশেষ দিন যেমন বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন কিংবা কোনো দুর্যোগের দিন ইত্যাদিরও কোনো উল্লেখ লেখাগুলোয় নেই। জীবনের যেটুকু সে দেখতে চেয়েছে, তাতে এসবের কোনো স্থান ছিল না। জীবনের উত্থান-পতনের পরিচিত খানাখন্দগুলো সে যথেষ্ট বেখেয়ালের সঙ্গেই পার করেছে। তার খেয়াল ছিল অন্যদিকে। যা কিছুর দিকে তার খেয়াল, যেটুকু তার সাধনা; স্পষ্টতই সেটুকু সে পায়নি। সেটুকু কী ছিল, তা সবাইকে বাদ দিয়ে আমাকে কেন খুঁজতে হচ্ছে?
একটি কাগজে সে লিখেছে: ‘মাঝেমধ্যে আমি ভাবি, আমার বন্ধুদের কাছে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখী দিনটি সম্পর্কে জানতে চাইব। অবশ্য তারা বলবে বলে মনে হয় না।’ এই প্রশ্ন নিয়েই কি সে মাঝেমধ্যে আমার অফিসে আসত? কী হাস্যকর! আমরা আধুনিক বাস্তববাদী মানুষ। আমাদের আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই এগুলো আসার নয়। জীবনের মান-অপমান ও রাগ-বিরক্তি নিয়ে আমরা কথা বলি, জীবনের বড় আঘাতগুলোতে দুঃখ প্রকাশে আমাদের মুখস্থ তেজস্বী ভাষা আছে। কথা বলায় আমরা প্রতিষ্ঠিত রীতির বাইরে যাই না। বেশ বিরক্তির সঙ্গেই টেবিলের ওপর প্যাকেটটি প্রায় ছুড়ে মারলাম আমি। এই চিঠি আমজাদ কী অধিকারে আমার কাছে পাঠাল? এমন মারাত্মক একটি ঘটনার ক্লু হিসেবে এক পুরোনো বন্ধুর জন্য এমন অর্থহীন সব কাগজ রেখে যাওয়া একটি মশকরা, একটি অভদ্রতা। বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে ঠান্ডা পানির ছিটা দিলাম। নিচে নেমে ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে দিলাম। ভাবলাম নিজেই গাড়ি চালাব। রাস্তায় উঠে বাসার দিকে যেতে ইচ্ছা হলো না। লক্ষ্যহীনভাবে গাড়ি চালাতে লাগলাম শহরের যে দিকটায় ভিড় কম সেদিকে। পুরো শহর ছেড়ে বেরোতে সাহস হলো না। আমি জানি অকারণে বাসায় যেতে দেরি করলে রিতা কতটা মন খারাপ করে। তার পরও গাড়ির কাচ নামিয়ে, গলার টাই খুলে, অক্টোবরের মৃদু বাতাসে চুল উড়িয়ে অনেকক্ষণ গাড়ি চালালাম। বাদলকে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে এড়িয়ে চলেছি। দেখা হলে কী বলব সেটিই ঠিক করতে পারছিলাম না। আমি চিঠিগুলো আবার পড়েছি। দ্বিতীয়বার পড়ার সময় আমজাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বিষয়ে অনেক কিছু মনে পড়েছে। আমজাদ, মোনেম ও আমি অন্যদের চেয়ে একটু বেশি চিন্তাশীল ছিলাম। ওই বয়সে ছেলেরা যে বইগুলো পড়ে আমরাও তার কিছু পড়েছি এবং পড়া শেষে একে অপরের কাছে জানতে চেয়েছি: কী জিনিস একটি জীবনকে সুন্দর কিংবা অর্থময় করে তোলে? একটি সুখী জীবন কি একই সঙ্গে অর্থময়? বিষয় দুটো কি দুমুখো? বেশির ভাগ সামলে নেওয়া বয়স্কদের মতোই আমিও এ প্রশ্নগুলো পেছনে ফেলে আসতে পেরেছি। আমজাদ পারেনি। বাদল একদিন আমাকে ঠিকই অফিসে ধরে ফেলতে পারল। বেগুনি জামার হাতায় কপাল মুছতে মুছতে সে বলল, ‘তোমার তো নাগালটিই পাওয়া যায় না’। আমরা নিজেদের কাজকর্ম নিয়ে কথা বলছিলাম। কথাগুলো অবশ্য কেটে কেটে যাচ্ছিল। বাদল বলছিল সে উজবেকিস্তান থেকে একটি নাচের দল আনবে। ব্যাপারটি দারুণ হিট করবে, তার ভাবনা। শীতকালটা সে এই মারাত্মক আয়োজন দিয়ে শুরু করবে। আধঘণ্টা কথাবার্তায়ও আমি আমজাদ প্রসঙ্গ না টানায় ধৈর্যের পরীক্ষায় ফেল করে বাদলকেই শেষ অবধি বলতে হলো, ‘ওই বেকুব স্বার্থপর হারামজাদা শেষ পর্যন্ত কী লিখে রেখে গেল?’
ধৈর্যের পরীক্ষার এই অকৃতকার্যতায় ও রাগে অবশ্য বাদলকে দোষ দেওয়া যায় না। আমজাদের বিধবা স্ত্রীকে আমজাদের উত্তরাধিকার থেকে খারিজ করার আইনি ঝামেলা থেকে উদ্ধার করতে প্রয়োজনীয় অর্থ বাদলই জোগাড় করেছিল। আমি বললাম, ‘না, তেমন কিছুই না। ওগুলো ডায়েরিকথার কিছু টুকরা। কোনো ক্লু তার মধ্যে নেই।’
‘আমি কি একটু দেখতে পারি?’
আমি মিথ্যা করে বললাম, ‘না, তার সুযোগ নেই। ওগুলো পড়ার পরে ও পুড়িয়ে ফেলতে বলেছে।’ বাদল কিছুটা হতাশার সঙ্গেই বলল, ‘কীসব লিখে গেছে, যার চার আনারও কোনো উপযোগ নেই।’ ‘একেবারে ঠিক বলেছ’, আমি বললাম। বাদল উঠে দাঁড়াল। আমি ওর সঙ্গে দরজা পর্যন্ত গেলাম। দরজার পাশে হঠাৎ আমি ওর হাতটা চেপে ধরলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা বাদল, তুমি কি সুখী?’
হা হা করে হেসে উঠল বাদল, ‘আরে, একের পর এক যা ব্যস্ততা তাতে সুখী না অসুখী, তা দেখার সময় আছে? কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন? তুমি ঠিক আছ তো?’
আমি হাতের চাপটা হালকা করে বললাম, ‘আরে কি বলো? আমি ঠিক থাকব না কেন?’
‘তো, আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না। আমি ধারের মাথায় কখনো যাব না। তুমিও আবার হঠাৎ রওনা দিয়ো না। এক মৌসুমে একজনই কি যথেষ্ট নয়?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, যথেষ্টর চেয়েও বেশি’, বাদলের সঙ্গে হাসতে হাসতে বললাম আমি। বাদল জোরে বেরিয়ে গেল হয়তো আমার মতোই অন্য কারোর কাছে। ওই দিনও অনেক রাতে বাসায় ফিরলাম। আমি আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। এটি এখন আমার প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। আমি জানি না কেন রিতাকে বিষয়টি আমি বলছিলাম না। আমি দোষের তো কিছু করছিলাম না। আমি যখন বাসায় ফিরলাম, জানতাম সবাই ঘুমিয়ে গেছে। আমার রাতের খাবার ঢাকা আছে এবং পাশে লেখা আছে ‘খেয়ে নিয়ো’। জানতাম এটা আমার জন্য কষ্টের। আমি মোজা পায়েই আমাদের বেডরুমের দিকে গেলাম। দেখলাম সেখানে রিতা নেই। দেখলাম রিতা তার ছেলের রুমে ছেলেকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। দরজা থেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম নীল ডিমলাইটের নিচে দুটি মানুষের মতো শরীর গভীর ঘুমে। শ্বাস নিচ্ছে আর শরীরটাও একটু উঠছে নামছে। আমি জানতাম এরা আমার ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু তার পরও, সব ভালোবাসা সত্ত্বেও, ওই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল, এদের কি আমি চিনি?
কাজী আনিস আহমেদের গুড নাইট মি. কিসিঞ্জার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ গল্পগ্রন্থ থেকে ‘দ্য হ্যাপিনেস ডে অব হিস লাইফ’ গল্পের সংক্ষেপিত অনুবাদ
অনুবাদ: মুহম্মদ মুহসিন
ধৈর্যের পরীক্ষার এই অকৃতকার্যতায় ও রাগে অবশ্য বাদলকে দোষ দেওয়া যায় না। আমজাদের বিধবা স্ত্রীকে আমজাদের উত্তরাধিকার থেকে খারিজ করার আইনি ঝামেলা থেকে উদ্ধার করতে প্রয়োজনীয় অর্থ বাদলই জোগাড় করেছিল। আমি বললাম, ‘না, তেমন কিছুই না। ওগুলো ডায়েরিকথার কিছু টুকরা। কোনো ক্লু তার মধ্যে নেই।’
‘আমি কি একটু দেখতে পারি?’
আমি মিথ্যা করে বললাম, ‘না, তার সুযোগ নেই। ওগুলো পড়ার পরে ও পুড়িয়ে ফেলতে বলেছে।’ বাদল কিছুটা হতাশার সঙ্গেই বলল, ‘কীসব লিখে গেছে, যার চার আনারও কোনো উপযোগ নেই।’ ‘একেবারে ঠিক বলেছ’, আমি বললাম। বাদল উঠে দাঁড়াল। আমি ওর সঙ্গে দরজা পর্যন্ত গেলাম। দরজার পাশে হঠাৎ আমি ওর হাতটা চেপে ধরলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা বাদল, তুমি কি সুখী?’
হা হা করে হেসে উঠল বাদল, ‘আরে, একের পর এক যা ব্যস্ততা তাতে সুখী না অসুখী, তা দেখার সময় আছে? কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন? তুমি ঠিক আছ তো?’
আমি হাতের চাপটা হালকা করে বললাম, ‘আরে কি বলো? আমি ঠিক থাকব না কেন?’
‘তো, আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না। আমি ধারের মাথায় কখনো যাব না। তুমিও আবার হঠাৎ রওনা দিয়ো না। এক মৌসুমে একজনই কি যথেষ্ট নয়?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, যথেষ্টর চেয়েও বেশি’, বাদলের সঙ্গে হাসতে হাসতে বললাম আমি। বাদল জোরে বেরিয়ে গেল হয়তো আমার মতোই অন্য কারোর কাছে। ওই দিনও অনেক রাতে বাসায় ফিরলাম। আমি আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। এটি এখন আমার প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। আমি জানি না কেন রিতাকে বিষয়টি আমি বলছিলাম না। আমি দোষের তো কিছু করছিলাম না। আমি যখন বাসায় ফিরলাম, জানতাম সবাই ঘুমিয়ে গেছে। আমার রাতের খাবার ঢাকা আছে এবং পাশে লেখা আছে ‘খেয়ে নিয়ো’। জানতাম এটা আমার জন্য কষ্টের। আমি মোজা পায়েই আমাদের বেডরুমের দিকে গেলাম। দেখলাম সেখানে রিতা নেই। দেখলাম রিতা তার ছেলের রুমে ছেলেকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। দরজা থেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম নীল ডিমলাইটের নিচে দুটি মানুষের মতো শরীর গভীর ঘুমে। শ্বাস নিচ্ছে আর শরীরটাও একটু উঠছে নামছে। আমি জানতাম এরা আমার ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু তার পরও, সব ভালোবাসা সত্ত্বেও, ওই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল, এদের কি আমি চিনি?
কাজী আনিস আহমেদের গুড নাইট মি. কিসিঞ্জার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ গল্পগ্রন্থ থেকে ‘দ্য হ্যাপিনেস ডে অব হিস লাইফ’ গল্পের সংক্ষেপিত অনুবাদ
অনুবাদ: মুহম্মদ মুহসিন
No comments