চলুন ঘুরে আসি পৃথিবীর বিচিত্র সব হোটেল থেকে
বিচিত্র এই বিশ্বের মানুষগুলোও বড় বিচিত্র, বিচিত্র তাদের চিন্তাধারা।
নইলে পৃথিবীতে এতো জায়গা থাকতে মানুষ কেনো পানির নিচে হোটেল বানাবে। কিংবা
ইট-বালি-সিমেন্ট থাকতে লবণ দিয়েই বা কেনো হোটেল বানাবে। আসলে মানুষ মাত্রই
নতুনত্বে বিশ্বাসী। পুরনো ধ্যান-ধারণাকে পেছনে ফেলে নতুন নতুন বিষয়
আবিষ্কার করাই এখন মানুষের নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ আমরা বিশ্বের বিচিত্র
হোটেল সম্পর্কে জানবো।
পানির নিচে হোটেল
একবার ভাবুন তো পানির নিচে নরম বিছানায় শুয়ে সমুদ্রের তলদেশের নৈসর্গিক
সৌন্দর্য উপভোগ করার বিষয়টি কেমন হবে। ভাবতেই কেমন ভালোলাগা স্পর্শ করে
যায়। বিশ্বের কয়েকটি দেশে এরকম পানির নিচে তৈরি হোটেল রয়েছে। তবে আধুনিকতা ও
বৈচিত্র্যে সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে ফিজির পসাইডন আন্ডার ওয়াটার
রিসোর্ট। যেতে চান এই হোটেলে? ভিসা ও বিমান খরচ ছাড়াও এই হোটেলে এক রাত
থাকতে বাংলাদেশি টাকায় খরচ করতে হবে প্রায় ১০ লাখ টাকা। তবে টাকা থাকলেই
আপনি যখন তখন এই হোটেলে যেতে পারবেন না। এজন্য আপনাকে বুকিং দিতে হবে ২ মাস
আগে। কেননা সারা বছর জুড়েই এই হোটেলটিতে বোর্ডারদের ভিড় লেগে থাকে।
প্রত্যেকটি কক্ষের আয়তন ১২ বর্গমিটার। আর উচ্চতা মাত্র আট ফুট। অর্থাৎ যখন
কেউ বিছানায় ঘুমিয়ে থাকেন তার আট ফুট উপর দিয়ে পানিতে ভেসে বেড়ায়
বিভিন্ন মাছ ও জলজ প্রাণী।
আফ্রিকার তানজানিয়াতেও রয়েছে এরকম একটি পানির নিচের হোটেল। আফ্রিকার
তানজানিয়ার পেম্বা দ্বীপে এই হোটেলটি অবস্থিত। রিসোর্টটি নিকটবর্তী সমুদ্র
তীর হতে প্রায় ২৫০ মিটার বা ৮০০ ফুট দূরে যার পানির নিচে ৪০ ফুট স্থাপনায়
আছে ১৭টি কক্ষ। এই রিসোর্টের নাম The Manta Resort. সম্পূর্ণ হোটেল পানির
নিচে প্রায় ৩ তলা অবস্থিত যেখানে রয়েছে অতিথিদের জন্য আলাদা বেশ কয়েকটি বেড
রুম, বাথ রুম এবং রান্না ঘর। এছাড়া একদম উপরে রয়েছে ডেক যেখানে অতিথিরা
সরাসরি সাগরেই সাঁতার কাটতে পারবেন। হোটেলটির সব চেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে এর
পানির নিচের বেড রুম সমূহ এসব বেড রুম থেকে আপনি রাতের সুমুদ্রের অসাধারণ
দৃশ্য দেখতে পাবেন। একই সাথে চাঁদের আলো সমুদ্রের পানিতে প্রতিফলিত হয়ে
কাঁচ দিয়ে প্রবেশ করবে আপনার বিছানায় ফলে এটি যে কারোর জন্য একটি অসাধারণ
অনুভূতি বলা চলে। এই হোটেলে আপনাকে দুই জন এক রাত থাকতে খরচ করতে হবে ১৫০০
ডলার বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১,১৬,০০০ টাকা এবং একজনের জন্য ৯০০ ডলার বা
বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৬৯,০০০ টাকা।
দুবাইতে ‘ওয়াটার ডিসকাস’ নামে এরকম আরও একটি হোটেল চালু হতে যাচ্ছে। এই
হোটেলটিতে দুটি প্রধান ডিস্ক থাকবে। একটি সমুদ্রের উপরে এবং অপরটি সমুদ্রের
নীচে। ২১টি স্যুট বিশিষ্ট এই বিস্ময়কর হোটেলটির ডিজাইন করেছে ‘ডীপ ওশেন
টেকনোলজী’ নামক একটি কোম্পানি। এখানে একটি বার ও ডাইভ সেন্টারও থাকবে।
সমুদ্রের তলদেশে যারা বসবাস করতে চান তাদের জন্য বিলাস বহুল এই হোটেলটি সব
ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান করবে। মূল হোটেলটির সঙ্গে যুক্ত থাকবে পাঁচটি
শাখা। মাঝখানে থাকবে ওঠা-নামা করার সিঁড়ি এবং লিফট। পানির নিচের অংশটি
সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১০ মিটার নিচে ডুবে থাকবে। এতে থাকবে ২১টি ডাবল কক্ষ।
থাকবে ডাইব সেন্টার ও একটি বার। প্রতিটি কক্ষই পানির নিচে এমনভাবে সাজানো,
যা থেকে সমুদ্রের ভেতরের দৃশ্য উপভোগ করা যাবে। 'ওয়াটার ডিসকাস' হোটেলটি
পরিবেশগত বা অর্থনৈতিক কোনো সমস্যায় অন্যত্রও সরিয়ে নেওয়া যাবে। এর উপরিভাগ
পানির ওপরে ভেসে থাকবে এবং প্রয়োজনে মূল কাঠামো থেকে সরিয়ে নেওয়া যাবে।
এমনকি যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপরিভাগ লাইফবোট হিসেবে কাজ করবে।
তবে সবগুলোকে ছাপিয়ে যাবে মালদ্বীপের পানির নিচের হোটেলটি। এটি হবে পানির
নিচের তৈরি হওয়া হোটেলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। এই হোটেলটির আকৃতি হবে
স্পেসশীপ এর মতো। বিলাসবহুল হোটেলটি দুটি বিশাল ডিস্ক আকৃতির লাউঞ্জ নিয়ে
গঠিত। এর একটি পানি থেকে সাত মিটার উপরে পাঁচ টি পিলার এর উপরে অবস্থিত।
গ্লাস টানেল দিয়ে পানির তলদেশে অপরটি তে যাবার ব্যবস্থা আছে। উপরের ভাগে
রেস্টুরেন্ট, স্পা করার ব্যবস্থা, হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং প্যাড, বাগান রাখা
হয়েছে। অতিথিরা উপর থেকে ভৌগোলিক আবহাওয়ার স্বাদ নিতে পারবেন আবার একই
সাথে পানির তলদেশের বিচিত্র অভিজ্ঞতাও উপভোগ করতে পারবেন।
এবার চলুন আকাশে ঘুরে আসি:
কাজের প্রয়োজনে আমরা প্লেনে চড়ে এক স্থান থেকে আরেক দেশে যাই এটা
স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু আপনি রাত কাটাতে একটি হোটেলে রুম বুকিং
দিয়েছেন এবং সেই হোটেলটি মাটিতে নয় আকাশের ভাসমান তাহলে কেমন হবে? পৃথিবী
থেকে ৫১৫ কিলোমিটার উঁচুতে যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসের উপরে ছুটে চলেছে এই
হোটেলটি। এখানকার প্রত্যেক গ্রাহককেই যেতে হয় নভোচারীর প্রস্তুতি নিয়ে।
হোটেলের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে হয় সব গ্রাহককেও। ঘণ্টায় প্রায় ২৮ হাজার
কিলোমিটার বেগে নিজ অরবিটারে ঘূর্ণায়মান এই “স্কাইওয়াকার”। “স্কাইওয়াকার”
নামক এই হোটেলটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। স্থলভাগের তারকা হোটেলের সব
সুযোগ সুবিধাই থাকছে এই হোটেলটিতে। তবে সব সুবিধাই আপনার চারপাশে শূন্যে
ঘুরে বেড়াবে। আপনার যেটি প্রয়োজন সেটি হাট বাড়িয়ে ধরতে হবে। তবে কম্পিউটার,
টেলিভিশন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো স্থায়ীভাবে আটকে রাখা হয়েছে।
ফ্রান্সেও রয়েছে এরকম একটি উড়ন্ত হোটেল। নিচ থেকে দেখলে মনে হবে, আকাশে
ভেসে বেড়াচ্ছে কোনো নভোযান। দোল খেলছে ভাসমান মেঘের সঙ্গে। চমকে যাওয়ার
মতো সবকিছুতেই ঠাসা এই উড়ন্ত হোটেল। “ম্যানড ক্লাউড” নামের এই হোটেলটি
ঘণ্টায় ১৭০ কিলোমিটার বেগে আকাশে উড়ে বেড়ায়। প্রায় ৪০ জন যাত্রী নিয়ে
আকাশে বিচরণকারী এই হোটেলে আছে একটি প্রকাণ্ড জিমনেসিয়াম, সুপরিসর
লাইব্রেরি, বড় ডাইনিং রুম, মিনি বারান্দা এবং একটি স্পা সেন্টার।
চলুন বরফের রাজ্যে হারিয়ে যাই:
নেদারল্যান্ডে
অবস্থিত এই হোটেলটি বরফের তৈরি। এটিই ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম বরফের
তৈরি হোটেল। ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডায় কারও হাড়ে কাঁপন ধরে যেতে
পারে। তবে এর ভেতরের তাপমাত্রা অবশ্যই শূন্য ডিগ্রির কিছুটা ওপর। কারণ
কৃত্রিমভাবে এর ভেতরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। দর্শনার্থীর সংখ্যার
ওপর ভিত্তি করে তাপমাত্রা ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা
করানো হয়। নেদারল্যান্ডসের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর জৌলে দেশের প্রথম
বরফের হোটেল তৈরি করা হয়েছে। বরফের ভাস্কর্য তৈরির একটি উৎসবের অংশ হিসেবে
হিমায়িত এক গুদামের ভেতর তৈরি হয়েছে তিন রুমের বিশেষ এই হোটেলটি।
স্থানীয় একটি হোটেল এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই হোটেলের কক্ষগুলোর দেয়াল
প্রায় এক মিটার পুরু বরফ কেটে তৈরি করা হয়েছে। দরজা লাগানোর ব্যবস্থা না
থাকায় দরজায় ভারী একটি পর্দা ঝুলিয়ে আড়ালের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রুমের
ভেতর বরফ কেটে যে বিছানা তৈরি করা হয়েছে সেটিকে নীল, সবুজ ও গোলাপি রংয়ের
আলোয় আলোকিত করে তোলা হয়েছে। তবে বিছানায় যাওয়ার আগে গোসল করতে পারবেন না।
এতে আপনার চুলগুলোও বরফ হয়ে যেতে পারে। আর যাদের ঠান্ডাজনিত সমস্যা রয়েছে
তারা এই হোটেলটিতে থাকতে পারবেন না। আর যাদের এই ধরনের সমস্যা নেই তাদেরকে
হাতমোজা, টুপি, সোয়েটার ও মোটা প্যান্ট নিয়ে যেতে হবে। দুই ব্যক্তির জন্য
সকালের নাস্তাসহ এক রাতের খরচ পড়বে ১৯৯ ইউরো। তবে বিল মেটানোর পর কেউ যদি
সেখানে অস্বস্তি বোধ করেন কিংবা ঠাণ্ডায় জমে যায়, তাহলে স্বাভাবিক একটি
হোটেল কক্ষ দেওয়া হয়।
এবার আসুন লবণের দিকে যাই:
‘হোটেল
ডি সাল’ নামে বলিভিয়ায় লবণের তৈরি একটি হোটেল রয়েছে। বাইরে থেকে বোঝা না
গেলেও ভিতরে গিয়ে চক্ষু ছানাবড়া হওয়া ছাড়া উপায় নেই। বলিভিয়ার রাজধানী থেকে
৩৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমতল লবণ ক্ষেত্রে এই হোটেলটি
অবস্থিত। বলিভিয়ার পর্যটক আকর্ষণী স্থানগুলোর মধ্যে এই লবণক্ষেত্র অন্যতম।
বলিবিয়া কেউ বেড়াতে এলে অবশ্যই এই স্থানটিতে একবার ঢুঁ মেরে যান। তাদের
জন্যই ব্যতিক্রমধর্মী এই হোটেলটি তৈরি করা হয়েছে। এর ভেতরের আসবাবপত্র থেকে
শুরু করে বিছানা, দরজা জানালাগুলোও তৈরি জমাট লবণ ব্লকে। পুরো হোটেল ভবনটি
বানাতে ৩৫ সেন্টিমিটার পুরু ১০ লাখ লবণের ব্লক লেগেছে। মোট ১৫টি ঘর আছে এই
এখানে। এ ছাড়া স্টাইল রুম, রেস্তোরাঁ, বারসহ সব রকমের আধুনিক
সুযোগ-সুবিধাও আছে হোটেলটিতে।
এছাড়া “হোটেল ডি সাল প্লায়া” নামে বলিভিয়াতে আরও একটি লবণের তৈরি হোটেল
রয়েছে। বলিভিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উইউনি লবণ পলিতে এটি অবস্থিত। ১৫টি
বেডরুম, একটি ডাইনিং রুম, একটি লিভিং রুম ও একটি বার রয়েছে। শুধু যে
হোটেলটি লবণ দিয়ে নির্মিত তা নয়, হোটেলটির চেয়ার, টেবিল, খাট এমনকি বার
পর্যন্ত লবণ দিয়ে নির্মিত।
সারা বিশ্বে আরও এরকম ছোট বড় অনেক বিচিত্র হোটেল রয়েছে। যেমন – মরুভূমির
বালির নিচে হোটেল, পয়:নিষ্কাশন পাইপের মধ্যে হোটেল, বেলুনের মধ্যে হোটেল
প্রভৃতি।
>>>অনলাইন ঢাকা গাইড>>online-dhaka
No comments