অনিশ্চিত জীবন পরিবহন শ্রমিকদের
অবরোধ-হরতালে
অচল সড়ক-মহাসড়ক। চলাচল করছে না বেশির ভাগ যানবাহন। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন
কয়েক লাখ পরিবহন শ্রমিক। চরম দুর্দিন যাচ্ছে তাদের। দেশের পরিবহন খাতে যারা
কাজ করেন তাদের বেশিরভাগই পারিশ্রমিক পান দৈনিক হাজিরা হিসেবে। কাজ না
থাকায় তাদের আয়-রোজগারও বন্ধ। অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে পড়েছেন বিপাকে।
ঢাকা-কুমিল্লা রুটের মেঘনা ডিলাক্স পরিবহনের হেলপার ফেরদৌস। প্রতিদিন তিনি
দায়িত্ব পালন করে আয় করেন ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা। এই আয় দিয়েই চলে তার সংসার।
স্ত্রী আর এক মেয়েকে নিয়েই তার সংসার। কিন্তু সারা দেশে অবরোধ আর হরতাল
থাকায় মালিকরা রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও
দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না তিনি। ফলে টাকার অভাবে একমাত্র মেয়ে সুমাইয়াকে
এখনও স্কুলে ভর্তি করতে পারেননি ফেরদৌস। চলমান লাগাতার হরতাল-অবরোধে এই
দুর্দশা শুধু ফেরদৌসেরই নয়, এ সমস্যা তার মতো লাখো পরিবহন শ্রমিকের। ঢাকা
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনগুলোর
তথ্যানুযায়ী সারা দেশে বাস, ট্রাক, পিকআপ, কার্গো ভ্যান, কাভার্ড ভ্যান,
ডেলিভারি ভ্যান, হিউম্যান হলারসহ বিভিন্ন গণপরিবহনের সঙ্গে প্রায় ২০ লাখ
পরিবহন শ্রমিক জড়িত। তাদের রুটি-রুজির ব্যবস্থাও হয় বিশাল এই খাত থেকে।
কিন্তু গত কয়েক দিনের হরতাল, অবরোধে এসব শ্রমিকদের জীবনযাপন চলছে চরম
অনিশ্চয়তায়।
রাজধানী ঢাকার সায়েদাবাদ, গাবতলী, মহাখালী, তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড এলাকা ঘুরে চালক, সুপারভাইজার ও লাইনম্যানদের সঙ্গে কথা বলে তাদের বর্তমান জীবনযাপনের করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। সায়েদাবাদ টার্মিনালে কথা হয় যাত্রী সেবা পরিবহনের সুপারভাইজার শহীদ খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, দীর্ঘ ৮ বছর ধরে এই পরিবহনে চাকরি করছি। প্রতি মাসের ৫ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে মালিক আমাদের বেতন দিয়ে দেন। কিন্তু এই মাসের অর্ধেকের বেশি চলে গেলেও এখনও বেতন হয়নি। এজন্য চলতি মাসের বাসা ভাড়াও দিতে পারেন নি। ভাড়া দিতে না পারায় মালিক বাসা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। একই টার্মিনালের এনপি পরিবহনের কয়েকজন চালক জানান, অবহেলিত একটি সেক্টর হচ্ছে পরিবহন খাত। এ খাত ঘিরে লাখ লাখ মানুষের রুটি-রুজি নির্ভরশীল হলেও এ পেশার শ্রমিকদের জীবনের নেই কোন নিরাপত্তা। মালিক নিজের ক্ষতির কথা চিন্তা করে রাস্তায় গাড়ি নামান না।
মানিকগঞ্জগামী শুভযাত্রা পরিবহনের চালক সুহেল বলেন, রাজনৈতিক দলের যত দাবি-দাওয়া আমাদের গাড়ির ওপর দিয়ে মিটায়। তাদের দাবি আদায়ের আর কোন মাধ্যম না পেয়ে আগুন দেয় গাড়িতে, ভাঙচুরও চালায় গাড়িতে। আর জীবন দিয়ে এর খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের। সুহেল জানান, অবরোধ চলাকালে সময়ে কাজ নেই। তাই আয়ের পথও বন্ধ। একই কথা শোনালেন হানিফ পরিবহনের নিজাম উদ্দিন। তিনি জানান, স্থানীয় একটি সমিতি থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা তাকে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু অবরোধ শুরু হওয়ার পর আয়ের পথ বন্ধ। তাই চলতি মাসের কিস্তি এখনও জমা দিতে পারেননি তিনি। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, সরকার মালিকদের পরিবহন ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অথচ যারা জীবনের মায়া ত্যাগ করে গাড়ি চালান, সেই চালক-হেলপারদের জন্য কোন ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণা এখনও আসেনি। অথচ আমরা একদিন গাড়ি না চালালে পুরো দেশ অচল হয়ে যায়। রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, বগুড়াসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশ্যে অন্তত ৬শ’ যাত্রীবাহী বাস ছেড়ে যায়। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মহাখালী বাস টার্মিনাল ঘিরে দেখা গেছে, টার্মিনালের চিরাচরিত ব্যস্ততা আর নেই। নেই বাসে যাত্রী ওঠানোর জন্য সুপারভাইজার, লাইনম্যানদের কোন হাঁকডাক, টানা-হেঁচড়া। শ্রমিকরা লুড,ু তাস খেলে ও শুয়ে-বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। অল্প কিছু গাড়ি টার্মিনাল ছেড়ে গেলেও তাতে যাত্রীসংখ্যা ছিল একেবারেই নগন্য। গত ৪ই জানুয়ারি অবরোধের দিন থেকেই এ অবস্থা চলছে বলে জানালেন এখানকার বিভিন্ন পরিবহনের কয়েকজন চালক ও তাদের সহকারী। মহাখালী-বগুড়া রুটের একতা পরিবহনের চালক কোহিনূর মিয়া জানান, অবরোধের আগে বগুড়া ও নওগাঁ রুটে আসা-যাওয়ায় প্রতি দিন দুটি করে ট্রিপ পড়ত। প্রতি ট্রিপে তিনি পান প্রায় ৬শ‘ টাকা। এই টাকায় পুরো সংসার চলে। কিন্তু অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৫ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এই কদিনে মাত্র ৫দিন গাড়ি চালাতে পেরেছেন। বাকি দিন তার আয় বন্ধ। আর যেদিন বন্ধ থাকে সেদিন মালিকের পক্ষ থেকে শুধু খাওয়া খরচ দেয়া হয়। যা নিতান্তই সামান্য। কোহিনূর মিয়া বলেন, অবরোধে যে কদিন গাড়ি চালিয়েছি সেই কদিন পুলিশ প্রহরা ছিল। কিন্তু বাসের সামনে-পেছনে পুলিশ থাকলেও আতঙ্ক আমাদের পিছু ছাড়ে না। কখন গাড়িতে পেট্রলবোমা, ককটেল ছুড়ে মারে, কখন পাথর ছুড়ে দেয় সেই আতঙ্কে থাকি। স্ত্রী, ছেলে মেয়ে না খেয়ে থাকবে। তাই মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও অবরোধের মধ্যে মাঝে মাঝে গাড়ি চালাচ্ছি। একতা পরিবহনের সুপারভাইজার মনির হোসেন বলেন, অবরোধ, হরতালের এই কদিনে মাত্র ৫ দিন তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাকি দিন কাটিয়েছেন শুয়ে-বসে। এই সময়ে তাকে চলতে হয়েছে ধার-দেনা করে। এজন্য গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে পরিবারের কাছেও টাকা পাঠাতে পারেননি তিনি। একতা পরিবহনের লাইনম্যান মান্না জানান, গাড়িতে তাদের দায়িত্ব পালনের পদ্ধতি হলো, কাজ নেই তো, টাকাও নেই। তাই যেদিন দায়িত্ব পালন করেন না সেদিন হাতে কোন টাকা আসে না।
ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের এনা পরিবহনের লাইনম্যান রানা জানান, অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে মাত্র ৪ দিন গাড়ি চলেছে। এই ৪ দিন তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। বাকি দিন কোন আয় ছিল না। ধার-দেনাও পাওয়া যায়নি। ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের সৌখিন পরিবহনের সুপাইরভাইজার পলাশ বলেন, অবরোধে গাড়ি নিয়মিত চলছে না। আজ দুটি ট্রিপ থাকে তো কালকে কোন ট্রিপ নেই। মাঝে মাঝে চালাতে হচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সামনে-পেছনে পুলিশ থাকলেও আমাদের আতঙ্ক এতটুকু কমে না। শুধু আমরাই নই, যেকজন যাত্রী পাওয়া যায় তারাও থাকেন আতঙ্কে। ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটের অনন্যা পরিবহনের সুপারভাইজার মিজান বলেন, মালিক তো তার কোটি টাকার গাড়ি রাস্তায় পুড়তে দিতে চায় না। অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে এভাবেই চলছে। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। গ্রামের বাড়িতেও নিয়মিত টাকা পাঠাতে পারছি না। টাকা পাঠাতে পারি না তাই এক রকম পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ের কাভার্ডভ্যান ও ট্রাকস্ট্যান্ড এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তার দুই পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ডভ্যান। কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ট্রাক কাভার্ডভ্যান নিয়মিত চলছে না। যে কারণে এখানকার শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। যাদের অল্প কিছু সঞ্চয় আছে শুধু তারাই কোনমতে চলতে পারছেন। তারা জানান, এখানকার এমনও পরিবহন আছে এই কদিনে একটি ট্রিপেও যেতে পারেনি। যারা গিয়েছেন তারাও জীবনকে তুচ্ছ করে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। কিন্তু পরদিন আর যাওয়ার সাহস করেননি। ট্রাকের লাইনম্যান তারেক বলেন, আমরা সাধানত লংরুটে গাড়ি চালিয়ে মালামাল বহন করি। কিন্তু গত ১০ দিন ধরে কোন ট্রিপ নেই। তাই রোজগারও নেই। এই কদিনে ধারকর্জ করে চলছি। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায় পরিবারের কাছেও কোন টাকা পাঠাতে পারিনি। পিকআপ চালক ইব্রাহিম বলেন, একদল বলে অবরোধ নাই, আপনারা গাড়ি চালান। আরেক দল বলে অবরোধ চলছে চলবে। কাভার্ড ভ্যান চালক রাজ্জাক বলেন, সরকার বলছে গাড়ি পুড়লে ক্ষতিপূরণ দেবে। কিন্তু আমাদের জীবনটাই যদি পুড়ে কয়লা হয়ে যায় তাহলে তো ক্ষতিপূরণও পাব না। এজন্য গাড়ি নিয়ে বের হই না। দিন চলছে কোন রকমে। পিকআপ চালক ইমরান হোসেন বলেন, এই ১৩ দিনে মাত্র ২টি ট্রিপ পেয়েছি। প্রতি ট্রিপে নিজে পেতাম ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা। আমার হেলপার জাহিদ পেত ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা। এখন সব বন্ধ। দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে। কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাকচালক নুরুন্নবী, শফিকুল, জাফর একই সুরে বললেন, আমাদের সহকর্মীরা চোখের সামনে পেট্রলবোমা ও ককটেলে দগ্ধ হচ্ছে। এ অবস্থা দেখে কে চায় জীবনের ঝুঁকি নিতে। তারা বলেন, আমরা রাজনীতি বুঝি না, রাজনীতি করিওনা। আমরা বুঝি পেটনীতি। কিন্তু বিএনপি, আওয়ামী লীগ কি তা বোঝে। তারা কি আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষের কথা চিন্তা করে কোন সমঝোতায় আসতে পারে না? বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল আলম মন্টু বলেন, শ্রমিকদের পরিস্থিতি এক কথায় বলা যায় ভয়াবহ। তাদের অনেকেই এই কদিনে গাড়ি নিয়ে বেরুতে পারেনি। ফলে তাদের আয়ের পথও বন্ধ। শুধু তাদের নয় মালিক পক্ষেরও এতে ক্ষতি হচ্ছে। তিনি বলেন, এমন দুর্দিন সচরাচর আসেনি। গাড়ি না চলায় ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিকদের অনেকেই বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিকরা এ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
রাজধানী ঢাকার সায়েদাবাদ, গাবতলী, মহাখালী, তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড এলাকা ঘুরে চালক, সুপারভাইজার ও লাইনম্যানদের সঙ্গে কথা বলে তাদের বর্তমান জীবনযাপনের করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। সায়েদাবাদ টার্মিনালে কথা হয় যাত্রী সেবা পরিবহনের সুপারভাইজার শহীদ খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, দীর্ঘ ৮ বছর ধরে এই পরিবহনে চাকরি করছি। প্রতি মাসের ৫ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে মালিক আমাদের বেতন দিয়ে দেন। কিন্তু এই মাসের অর্ধেকের বেশি চলে গেলেও এখনও বেতন হয়নি। এজন্য চলতি মাসের বাসা ভাড়াও দিতে পারেন নি। ভাড়া দিতে না পারায় মালিক বাসা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। একই টার্মিনালের এনপি পরিবহনের কয়েকজন চালক জানান, অবহেলিত একটি সেক্টর হচ্ছে পরিবহন খাত। এ খাত ঘিরে লাখ লাখ মানুষের রুটি-রুজি নির্ভরশীল হলেও এ পেশার শ্রমিকদের জীবনের নেই কোন নিরাপত্তা। মালিক নিজের ক্ষতির কথা চিন্তা করে রাস্তায় গাড়ি নামান না।
মানিকগঞ্জগামী শুভযাত্রা পরিবহনের চালক সুহেল বলেন, রাজনৈতিক দলের যত দাবি-দাওয়া আমাদের গাড়ির ওপর দিয়ে মিটায়। তাদের দাবি আদায়ের আর কোন মাধ্যম না পেয়ে আগুন দেয় গাড়িতে, ভাঙচুরও চালায় গাড়িতে। আর জীবন দিয়ে এর খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের। সুহেল জানান, অবরোধ চলাকালে সময়ে কাজ নেই। তাই আয়ের পথও বন্ধ। একই কথা শোনালেন হানিফ পরিবহনের নিজাম উদ্দিন। তিনি জানান, স্থানীয় একটি সমিতি থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা তাকে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু অবরোধ শুরু হওয়ার পর আয়ের পথ বন্ধ। তাই চলতি মাসের কিস্তি এখনও জমা দিতে পারেননি তিনি। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, সরকার মালিকদের পরিবহন ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অথচ যারা জীবনের মায়া ত্যাগ করে গাড়ি চালান, সেই চালক-হেলপারদের জন্য কোন ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণা এখনও আসেনি। অথচ আমরা একদিন গাড়ি না চালালে পুরো দেশ অচল হয়ে যায়। রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, বগুড়াসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশ্যে অন্তত ৬শ’ যাত্রীবাহী বাস ছেড়ে যায়। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মহাখালী বাস টার্মিনাল ঘিরে দেখা গেছে, টার্মিনালের চিরাচরিত ব্যস্ততা আর নেই। নেই বাসে যাত্রী ওঠানোর জন্য সুপারভাইজার, লাইনম্যানদের কোন হাঁকডাক, টানা-হেঁচড়া। শ্রমিকরা লুড,ু তাস খেলে ও শুয়ে-বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। অল্প কিছু গাড়ি টার্মিনাল ছেড়ে গেলেও তাতে যাত্রীসংখ্যা ছিল একেবারেই নগন্য। গত ৪ই জানুয়ারি অবরোধের দিন থেকেই এ অবস্থা চলছে বলে জানালেন এখানকার বিভিন্ন পরিবহনের কয়েকজন চালক ও তাদের সহকারী। মহাখালী-বগুড়া রুটের একতা পরিবহনের চালক কোহিনূর মিয়া জানান, অবরোধের আগে বগুড়া ও নওগাঁ রুটে আসা-যাওয়ায় প্রতি দিন দুটি করে ট্রিপ পড়ত। প্রতি ট্রিপে তিনি পান প্রায় ৬শ‘ টাকা। এই টাকায় পুরো সংসার চলে। কিন্তু অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৫ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এই কদিনে মাত্র ৫দিন গাড়ি চালাতে পেরেছেন। বাকি দিন তার আয় বন্ধ। আর যেদিন বন্ধ থাকে সেদিন মালিকের পক্ষ থেকে শুধু খাওয়া খরচ দেয়া হয়। যা নিতান্তই সামান্য। কোহিনূর মিয়া বলেন, অবরোধে যে কদিন গাড়ি চালিয়েছি সেই কদিন পুলিশ প্রহরা ছিল। কিন্তু বাসের সামনে-পেছনে পুলিশ থাকলেও আতঙ্ক আমাদের পিছু ছাড়ে না। কখন গাড়িতে পেট্রলবোমা, ককটেল ছুড়ে মারে, কখন পাথর ছুড়ে দেয় সেই আতঙ্কে থাকি। স্ত্রী, ছেলে মেয়ে না খেয়ে থাকবে। তাই মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও অবরোধের মধ্যে মাঝে মাঝে গাড়ি চালাচ্ছি। একতা পরিবহনের সুপারভাইজার মনির হোসেন বলেন, অবরোধ, হরতালের এই কদিনে মাত্র ৫ দিন তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাকি দিন কাটিয়েছেন শুয়ে-বসে। এই সময়ে তাকে চলতে হয়েছে ধার-দেনা করে। এজন্য গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে পরিবারের কাছেও টাকা পাঠাতে পারেননি তিনি। একতা পরিবহনের লাইনম্যান মান্না জানান, গাড়িতে তাদের দায়িত্ব পালনের পদ্ধতি হলো, কাজ নেই তো, টাকাও নেই। তাই যেদিন দায়িত্ব পালন করেন না সেদিন হাতে কোন টাকা আসে না।
ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের এনা পরিবহনের লাইনম্যান রানা জানান, অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে মাত্র ৪ দিন গাড়ি চলেছে। এই ৪ দিন তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। বাকি দিন কোন আয় ছিল না। ধার-দেনাও পাওয়া যায়নি। ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের সৌখিন পরিবহনের সুপাইরভাইজার পলাশ বলেন, অবরোধে গাড়ি নিয়মিত চলছে না। আজ দুটি ট্রিপ থাকে তো কালকে কোন ট্রিপ নেই। মাঝে মাঝে চালাতে হচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সামনে-পেছনে পুলিশ থাকলেও আমাদের আতঙ্ক এতটুকু কমে না। শুধু আমরাই নই, যেকজন যাত্রী পাওয়া যায় তারাও থাকেন আতঙ্কে। ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটের অনন্যা পরিবহনের সুপারভাইজার মিজান বলেন, মালিক তো তার কোটি টাকার গাড়ি রাস্তায় পুড়তে দিতে চায় না। অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে এভাবেই চলছে। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। গ্রামের বাড়িতেও নিয়মিত টাকা পাঠাতে পারছি না। টাকা পাঠাতে পারি না তাই এক রকম পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ের কাভার্ডভ্যান ও ট্রাকস্ট্যান্ড এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তার দুই পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ডভ্যান। কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ট্রাক কাভার্ডভ্যান নিয়মিত চলছে না। যে কারণে এখানকার শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। যাদের অল্প কিছু সঞ্চয় আছে শুধু তারাই কোনমতে চলতে পারছেন। তারা জানান, এখানকার এমনও পরিবহন আছে এই কদিনে একটি ট্রিপেও যেতে পারেনি। যারা গিয়েছেন তারাও জীবনকে তুচ্ছ করে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। কিন্তু পরদিন আর যাওয়ার সাহস করেননি। ট্রাকের লাইনম্যান তারেক বলেন, আমরা সাধানত লংরুটে গাড়ি চালিয়ে মালামাল বহন করি। কিন্তু গত ১০ দিন ধরে কোন ট্রিপ নেই। তাই রোজগারও নেই। এই কদিনে ধারকর্জ করে চলছি। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায় পরিবারের কাছেও কোন টাকা পাঠাতে পারিনি। পিকআপ চালক ইব্রাহিম বলেন, একদল বলে অবরোধ নাই, আপনারা গাড়ি চালান। আরেক দল বলে অবরোধ চলছে চলবে। কাভার্ড ভ্যান চালক রাজ্জাক বলেন, সরকার বলছে গাড়ি পুড়লে ক্ষতিপূরণ দেবে। কিন্তু আমাদের জীবনটাই যদি পুড়ে কয়লা হয়ে যায় তাহলে তো ক্ষতিপূরণও পাব না। এজন্য গাড়ি নিয়ে বের হই না। দিন চলছে কোন রকমে। পিকআপ চালক ইমরান হোসেন বলেন, এই ১৩ দিনে মাত্র ২টি ট্রিপ পেয়েছি। প্রতি ট্রিপে নিজে পেতাম ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা। আমার হেলপার জাহিদ পেত ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা। এখন সব বন্ধ। দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে। কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাকচালক নুরুন্নবী, শফিকুল, জাফর একই সুরে বললেন, আমাদের সহকর্মীরা চোখের সামনে পেট্রলবোমা ও ককটেলে দগ্ধ হচ্ছে। এ অবস্থা দেখে কে চায় জীবনের ঝুঁকি নিতে। তারা বলেন, আমরা রাজনীতি বুঝি না, রাজনীতি করিওনা। আমরা বুঝি পেটনীতি। কিন্তু বিএনপি, আওয়ামী লীগ কি তা বোঝে। তারা কি আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষের কথা চিন্তা করে কোন সমঝোতায় আসতে পারে না? বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল আলম মন্টু বলেন, শ্রমিকদের পরিস্থিতি এক কথায় বলা যায় ভয়াবহ। তাদের অনেকেই এই কদিনে গাড়ি নিয়ে বেরুতে পারেনি। ফলে তাদের আয়ের পথও বন্ধ। শুধু তাদের নয় মালিক পক্ষেরও এতে ক্ষতি হচ্ছে। তিনি বলেন, এমন দুর্দিন সচরাচর আসেনি। গাড়ি না চলায় ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিকদের অনেকেই বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিকরা এ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
No comments