ক্রসফায়ারে ছাত্রদল নেতা নিহত- আমার স্বামীর অপরাধ কি?
কেন
ওরা আমার স্বামীকে হত্যা করলো? কি অপরাধ ছিল আমার স্বামীর? আল্লাহ আমাকে
বিধবা করেছে যারা তুমি তাদের বিচার করো। এভাবে চিৎকার করে কাঁদছিলেন ডিবির
ক্রসফায়ারে নিহত ছাত্রদল নেতা নূরুজ্জামান জনির স্ত্রী মুনিয়া পারভীন
মণীষা। হৃদয়বিদারক দৃশ্য জনির বাড়িতে। স্বজনরাও সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা
হারিয়ে ফেলেছেন। গ্রেপ্তারকৃত ছোট ভাইকে দেখতে সোমবার সকালে কেন্দ্রীয়
কারাগারে যান ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনি। ফিরে এসে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী
মনীষাকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু তার আর ফেরা হয়নি।
ফেরা হবে না আর কোন দিন। তার অনাগত সন্তান কোন দিন পিতার মুখ দেখতে পাবে
না। মনীষা চিৎকার করে বলছিলেন, সে তো সন্ত্রাসী ছিল না। তবে কেন তাকে হত্যা
করা হলো, রাজনীতি করাই কি তার অপরাধ? তাহলে দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক।
প্রধানমন্ত্রী কি আমার স্বামীকে ফেরত দিতে পারবেন! আমার সন্তান তো তার
পিতাকে কোন দিন দেখতে পাবে না। মনীষা জানান, তার স্বামী রাজনীতি করলেও কোন
নাশকতায় জড়িত ছিলেন না। ছাত্রদলের খিলগাঁও থানার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে
থাকার কারণেই তাকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন
তিনি। মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে জনি তাদের জানিয়েছিলেন, খিলগাঁও থানার
বিএনপি-ছাত্রদলের চার-পাঁচজনকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হবে। এরকম একটি
তালিকা তৈরি করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তালিকাভুক্তদের যেখানে
পাওয়া যাবে সেখানেই গুলি করে হত্যা করবে ডিবি। ওই তালিকায় জনির নাম রয়েছে।
জনির মুখে এ কথা শোনার পর উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন স্ত্রী মনীষাসহ পরিবারের
সদস্যরা। রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ার নিজেদের ২০১ নম্বর বাড়ি ছেড়ে তারা
বাসা ভাড়া নেন অন্যত্র। তার পরও রাতে ঘরে থাকতেন না জনি। ধানমন্ডিসহ
বিভিন্ন এলাকায় স্বজনদের বাড়িতে থাকতেন। এত কিছুর পরও বাঁচতে পারেননি তিনি।
মঙ্গলবার রাতে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন ছাত্রদলের এই নেতা।
সোমবার সোয়া ১১টায় মোবাইল ফোনে জনির সঙ্গে কথা হয় মনীষার। জনি তখন জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছোট ভাইকে দেখতে গিয়েছেন তিনি। সঙ্গে আছে ছাত্রদল কর্মী মইন। জনি বলেছিলেন, তিনি জেল গেটের পাশে আছেন। ফিরেই স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাবেন। প্রতীক্ষায় থাকেন মনীষা। বেলা ৩টায় কল দিয়ে জনির ফোন বন্ধ পান তিনি। দুশ্চিন্তায় পড়ে যান মনীষা। ‘কল মি আর্জেন্ট’ লিখে ক্ষুদে বার্তা পাঠান। এটি পৌঁছে সোয়া ৩টায়। তাৎক্ষণিকভাবে জনির ফোনে কল দেন তিনি। কল কেটে দেয়া হয়। তারপর থেকে ফোন বন্ধ। মনটা ছটফট করে মনীষার। আশঙ্কা করছিলেন খারাপ কিছু ঘটেছে। অন্তঃসত্ত্বা এই নারী একাই ছুটে যান কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পান না তার স্বামীকে। সাড়ে ৪টা পর্যন্ত সেখানে ছিলেন তিনি। পরদিন গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টায় তারা জানতে পারেন জনি আর নেই। এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মনীষা। তিনি বলেন, এই দেশে কোন আইন-আদালত কি নেই। আমার স্বামীকে যারা খুন করেছে সেই সন্ত্রাসীদের বিচার কি আমরা পাব না? ২০১২ সালে ২৩শে নভেম্বর নুরুজ্জামান জনির সঙ্গে বিয়ে হয় মুনিয়া পারভিন মনীষার।
জনির সঙ্গে তার মা নিলুফা বেগমের কথা হয় সোমবার দুপুর ১টায়। জনি জেল গেটে জেনে তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাকে সেখান থেকে সরে যেতে বলেন। জনি বলেছিল, চিন্তা করো না। আমি বাইরে আছি, কিছু হবে না। এসব কথা বলতে গিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন নিলুফা বেগম। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পাইলে জানতে চাইতাম, আমার ছেলে কি সন্ত্রাসী, তাকে কেন ডিবি মেরে ফেললো? জনির ফুফু মাবিয়া খাতুন সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, লেখালেখি করে কি হবে, আপনারা কি ন্যায় বিচার করতে পারবেন, আমরা কোথায় বিচার চাইবো? দক্ষিণ গোড়ানের নিহত জনির এক আত্মীয়ের বাড়িতে যখন তাদের সঙ্গে কথা হয় তখন আশপাশে বিপুলসংখ্যক মানুষ জড়ো হন। তারা সবাই ডিবির সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত জনির মৃত্যুর সঠিক তদন্ত দাবি করেন।
জনির স্বজনদের অভিযোগ, সোমবার কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক থেকে তাকে আটক করে ডিবি পুলিশ। তারপর পরিকল্পিতভাবে মঙ্গলবার রাত ৩টার দিকে জোড়াপুকুর বালুর মাঠ এলাকায় গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। তিনি কোন নাশকতায় জড়িত ছিলেন না বলে দাবি পরিবারের। রাজনীতি করার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। নিহত জনির বুকে, পিঠে, কোমরে ও পায়ে ১৬টি গুলির ছিদ্র পাওয়া গেছে। তবে পুলিশের দাবি, জনিকে নিয়ে সহযোগীদের ধরতে গেলে সহযোগীরা পুলিশের ওপর ককটেল নিক্ষেপ ও গুলি ছুড়ে। এসময় জানমাল রক্ষায় পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়ে। এসময় সহযোগীদের ছোড়া গুলিতে জনির মৃত্যু হয়। জনির সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী দাবি করেছেন কোন অপরাধ ছাড়াই তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে।
গতকাল দুপুরে সরজমিন জোড়াপুকুর এলাকায় গেলে, রাতে অনেকেই গুলির শব্দ শুনেছেন বলে জানান। জোড়াপুকুর বালুর মাঠের যে গলিতে জনির লাশ পাওয়া গেছে সেখানে অবস্থিত মেট্রোপলিটন এ্যাজমা অ্যান্ড এলার্জি সেন্টারে গেলে কথা হয় নিরাপত্তাকর্মী সোলেমান মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, রাতে অনেকগুলো গুলির শব্দ পেয়েছেন। তবে ভয়ে তিনি বাইরে বের হননি। একই কথা বলেন ওই এলাকার সি ব্লকের বাসিন্দা লাভলী বেগম। রাতে কান্নার শব্দ শুনেছেন বলে জানান এ ব্লকের বাসিন্দা সাইফুদ্দিনের স্ত্রী সানজিদা আক্তার সেতু। তিনি জানান, রাত ৩টার দিকে ‘ও মাগো, মা, মা... বলে কয়েক বার চিৎকার শুনেছেন তিনি। তার কিছু সময় পরেই গুলির শব্দ শুনেন তিনি। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তারা জানতে পারেন জোড়াপুকুর মাঠের পাশে ছাত্রদল নেতা জনির গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে। ঠিক ওই সময়েই জনির সঙ্গে নিখোঁজ হওয়া ছাত্রদলকর্মী মইনের বড় ভাই মনির ফোনে জনির স্ত্রী মুনিয়া পারভিন মনিষাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিতে বলেন। ঢামেকের মর্গে গিয়ে দেখতে পান গুলিতে ক্ষতবিক্ষত জনির নিথর দেহ। জনির পিতা ইয়াকুব আলী অভিযোগ করেন, ছাত্রদল করার কারণেই তার ছেলেকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। ছাত্রদলের খিলগাঁও থানার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার কারণে ওই এলাকায় নাশকতা হলেই তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হতো। তিনি বলেন, জনি কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল না। তবু কেন তাকে হত্যা করা হলো? জনির পরিবারের সদস্যরা জানান, কয়েকদিন ধরেই জনিকে খুঁজছিলো ডিবি পুলিশ। জনিকে আটক করার জন্য গত শুক্রবার তাদের তিলপাপাড়ার বাসায় অভিযান চালায় ডিবি। এসময় জনিকে না পেয়ে তার ছোট ভাই মনিরুজ্জামান হিরাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। সোমবার হিরাকে দেখতে ছাত্রদল কর্মী মইন হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে যান জনি। সেখান থেকেই জনি ও মইনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। প্রত্যক্ষদর্শী এক যুবক জানান, জেল গেট সংলগ্ন মাজারের পাশ থেকে জনি ও মইনকে আটক করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যায় ডিবি। এরপর থেকে জনি ও মইনকে ফোনে পাচ্ছিলেন না তাদের স্বজনরা। জনির মামা দেলোয়ার হোসেন জানান, জনিকে না পেয়ে তারা খিলগাঁও থানা ও ডিবি অফিসে খোঁজ নেন। কিন্তু সবাই জানান, এই নামে কাউকে তারা আটক করেননি। সকালে তারা জানতে পারেন জনি ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছেন। খবর পেয়ে জনির পিতা-মাতা ও স্বজনরা ঢামেকের মর্গে ছুটে যান। সেখানে তারা জনির লাশ শনাক্ত করেন। জনির মামাতো ভাই মাসুদ রানা জানান, জনির বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে পুলিশের দেয়া মামলা ছাড়া আর কোন মামলা ছিল না। নিহত নুরুজ্জামান জনি খিলগাঁও থানার তিলপাপাড়ার এ ব্লকের ২০১ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে জনি ছিলেন বড়। ২০১২ সালের ২৩শে নভেম্বর তিনি বিয়ে করেন। জনির স্ত্রী সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তার নাম মুনিরা পারভিন মনিষা।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাজধানীর চকবাজারের নাজিম উদ্দিন সড়ক থেকে নুরুজ্জামান জনি ও মইন হোসেনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। গ্রেপ্তারের পর জনির দেয়া তথ্য অনুসারে নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য জনিকে নিয়ে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৩টায় জোড়াপুকুর বালুর মাঠ সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালায় ডিবি। এসময় সন্ত্রাসীরা ডিবিকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। একই সঙ্গে হাতবোমা ও পেট্রলবোমাও নিক্ষেপ করে। পুলিশও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। উভয়পক্ষের গুলি বর্ষণকালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে জনি গুলিবিদ্ধ হয়। জনিকে চিকিৎসার জন্য দ্রুত ঢামেক হাসপাতালে প্রেরণ করলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সন্ত্রাসীদের গুলি ও বোমার আঘাতে কনস্টেবল সোলায়মান হোসেন ও আবু ছায়েদ আহত হলে তাদের রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
জনির দেহে ১৬ গুলির ছিদ্র: ঢামেক হাসপাতালের মর্গে গিয়ে নিহতের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ সাদিয়া তাজনিন। সুরতহাল প্রতিবেদন অনুসারে জানা গেছে, নিহত জনির কোমরের উপরের দিকে বাম পায়ে একটি, বুকের মাঝ বরাবর তিনটি, বুকের বাম পাশে তিনটি, ডান পাশে তিনটি, পিঠের বামপাশে দুটি, পিঠের বাম পাশে উপরের দিকে দুটি, ডান পায়ে দুটি ক্ষতচিহ্ণ পাওয়া গেছে। এসময় তার পরনে ছিল জিন্সের প্যান্ট। পায়ে মোজা ও কেডস ছিল। তার হাতের তালুতে ছিদ্রযুক্ত জখম, হাতের কনুইয়ে ছিলা জখম পাওয়া গেছে। নিহতের হাত দুটি শরীরের সঙ্গে লাগানো ছিল।
জনির বিরুদ্ধে ছয় মামলা: নিহত ছাত্রদল নেতা জনির বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। এরমধ্যে ২০১৩ সালের ২৯শে আগস্ট ও একই বছরের ২৬শে সেপ্টেম্বর দায়েরকৃত দুটি মামলার এজাহারে তার নাম নেই। বাকি চারটি মামলার মধ্যে গত বছরের ২৫শে মে, ২৪শে এপ্রিল ও তার আগের বছরের ২৯শে আগস্ট দায়েরকৃত তিনটি মামলা বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া, গত বছরের ৩১শে মে সহিংসতার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে। খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়া মোহাম্মদ মোস্তাফিজ জানান, নিহত জনি সহিংসতা, নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। এছাড়া, সোমবার রাতের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় জনির সহযোগীদের আসামি করে ডিবি মামলা দায়ের করেছে বলে জানান তিনি।
সোমবার সোয়া ১১টায় মোবাইল ফোনে জনির সঙ্গে কথা হয় মনীষার। জনি তখন জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছোট ভাইকে দেখতে গিয়েছেন তিনি। সঙ্গে আছে ছাত্রদল কর্মী মইন। জনি বলেছিলেন, তিনি জেল গেটের পাশে আছেন। ফিরেই স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাবেন। প্রতীক্ষায় থাকেন মনীষা। বেলা ৩টায় কল দিয়ে জনির ফোন বন্ধ পান তিনি। দুশ্চিন্তায় পড়ে যান মনীষা। ‘কল মি আর্জেন্ট’ লিখে ক্ষুদে বার্তা পাঠান। এটি পৌঁছে সোয়া ৩টায়। তাৎক্ষণিকভাবে জনির ফোনে কল দেন তিনি। কল কেটে দেয়া হয়। তারপর থেকে ফোন বন্ধ। মনটা ছটফট করে মনীষার। আশঙ্কা করছিলেন খারাপ কিছু ঘটেছে। অন্তঃসত্ত্বা এই নারী একাই ছুটে যান কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পান না তার স্বামীকে। সাড়ে ৪টা পর্যন্ত সেখানে ছিলেন তিনি। পরদিন গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টায় তারা জানতে পারেন জনি আর নেই। এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মনীষা। তিনি বলেন, এই দেশে কোন আইন-আদালত কি নেই। আমার স্বামীকে যারা খুন করেছে সেই সন্ত্রাসীদের বিচার কি আমরা পাব না? ২০১২ সালে ২৩শে নভেম্বর নুরুজ্জামান জনির সঙ্গে বিয়ে হয় মুনিয়া পারভিন মনীষার।
জনির সঙ্গে তার মা নিলুফা বেগমের কথা হয় সোমবার দুপুর ১টায়। জনি জেল গেটে জেনে তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাকে সেখান থেকে সরে যেতে বলেন। জনি বলেছিল, চিন্তা করো না। আমি বাইরে আছি, কিছু হবে না। এসব কথা বলতে গিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন নিলুফা বেগম। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পাইলে জানতে চাইতাম, আমার ছেলে কি সন্ত্রাসী, তাকে কেন ডিবি মেরে ফেললো? জনির ফুফু মাবিয়া খাতুন সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, লেখালেখি করে কি হবে, আপনারা কি ন্যায় বিচার করতে পারবেন, আমরা কোথায় বিচার চাইবো? দক্ষিণ গোড়ানের নিহত জনির এক আত্মীয়ের বাড়িতে যখন তাদের সঙ্গে কথা হয় তখন আশপাশে বিপুলসংখ্যক মানুষ জড়ো হন। তারা সবাই ডিবির সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত জনির মৃত্যুর সঠিক তদন্ত দাবি করেন।
জনির স্বজনদের অভিযোগ, সোমবার কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক থেকে তাকে আটক করে ডিবি পুলিশ। তারপর পরিকল্পিতভাবে মঙ্গলবার রাত ৩টার দিকে জোড়াপুকুর বালুর মাঠ এলাকায় গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। তিনি কোন নাশকতায় জড়িত ছিলেন না বলে দাবি পরিবারের। রাজনীতি করার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। নিহত জনির বুকে, পিঠে, কোমরে ও পায়ে ১৬টি গুলির ছিদ্র পাওয়া গেছে। তবে পুলিশের দাবি, জনিকে নিয়ে সহযোগীদের ধরতে গেলে সহযোগীরা পুলিশের ওপর ককটেল নিক্ষেপ ও গুলি ছুড়ে। এসময় জানমাল রক্ষায় পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়ে। এসময় সহযোগীদের ছোড়া গুলিতে জনির মৃত্যু হয়। জনির সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী দাবি করেছেন কোন অপরাধ ছাড়াই তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে।
গতকাল দুপুরে সরজমিন জোড়াপুকুর এলাকায় গেলে, রাতে অনেকেই গুলির শব্দ শুনেছেন বলে জানান। জোড়াপুকুর বালুর মাঠের যে গলিতে জনির লাশ পাওয়া গেছে সেখানে অবস্থিত মেট্রোপলিটন এ্যাজমা অ্যান্ড এলার্জি সেন্টারে গেলে কথা হয় নিরাপত্তাকর্মী সোলেমান মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, রাতে অনেকগুলো গুলির শব্দ পেয়েছেন। তবে ভয়ে তিনি বাইরে বের হননি। একই কথা বলেন ওই এলাকার সি ব্লকের বাসিন্দা লাভলী বেগম। রাতে কান্নার শব্দ শুনেছেন বলে জানান এ ব্লকের বাসিন্দা সাইফুদ্দিনের স্ত্রী সানজিদা আক্তার সেতু। তিনি জানান, রাত ৩টার দিকে ‘ও মাগো, মা, মা... বলে কয়েক বার চিৎকার শুনেছেন তিনি। তার কিছু সময় পরেই গুলির শব্দ শুনেন তিনি। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তারা জানতে পারেন জোড়াপুকুর মাঠের পাশে ছাত্রদল নেতা জনির গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে। ঠিক ওই সময়েই জনির সঙ্গে নিখোঁজ হওয়া ছাত্রদলকর্মী মইনের বড় ভাই মনির ফোনে জনির স্ত্রী মুনিয়া পারভিন মনিষাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিতে বলেন। ঢামেকের মর্গে গিয়ে দেখতে পান গুলিতে ক্ষতবিক্ষত জনির নিথর দেহ। জনির পিতা ইয়াকুব আলী অভিযোগ করেন, ছাত্রদল করার কারণেই তার ছেলেকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। ছাত্রদলের খিলগাঁও থানার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার কারণে ওই এলাকায় নাশকতা হলেই তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হতো। তিনি বলেন, জনি কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল না। তবু কেন তাকে হত্যা করা হলো? জনির পরিবারের সদস্যরা জানান, কয়েকদিন ধরেই জনিকে খুঁজছিলো ডিবি পুলিশ। জনিকে আটক করার জন্য গত শুক্রবার তাদের তিলপাপাড়ার বাসায় অভিযান চালায় ডিবি। এসময় জনিকে না পেয়ে তার ছোট ভাই মনিরুজ্জামান হিরাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। সোমবার হিরাকে দেখতে ছাত্রদল কর্মী মইন হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে যান জনি। সেখান থেকেই জনি ও মইনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। প্রত্যক্ষদর্শী এক যুবক জানান, জেল গেট সংলগ্ন মাজারের পাশ থেকে জনি ও মইনকে আটক করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যায় ডিবি। এরপর থেকে জনি ও মইনকে ফোনে পাচ্ছিলেন না তাদের স্বজনরা। জনির মামা দেলোয়ার হোসেন জানান, জনিকে না পেয়ে তারা খিলগাঁও থানা ও ডিবি অফিসে খোঁজ নেন। কিন্তু সবাই জানান, এই নামে কাউকে তারা আটক করেননি। সকালে তারা জানতে পারেন জনি ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছেন। খবর পেয়ে জনির পিতা-মাতা ও স্বজনরা ঢামেকের মর্গে ছুটে যান। সেখানে তারা জনির লাশ শনাক্ত করেন। জনির মামাতো ভাই মাসুদ রানা জানান, জনির বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে পুলিশের দেয়া মামলা ছাড়া আর কোন মামলা ছিল না। নিহত নুরুজ্জামান জনি খিলগাঁও থানার তিলপাপাড়ার এ ব্লকের ২০১ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে জনি ছিলেন বড়। ২০১২ সালের ২৩শে নভেম্বর তিনি বিয়ে করেন। জনির স্ত্রী সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তার নাম মুনিরা পারভিন মনিষা।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাজধানীর চকবাজারের নাজিম উদ্দিন সড়ক থেকে নুরুজ্জামান জনি ও মইন হোসেনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। গ্রেপ্তারের পর জনির দেয়া তথ্য অনুসারে নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য জনিকে নিয়ে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৩টায় জোড়াপুকুর বালুর মাঠ সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালায় ডিবি। এসময় সন্ত্রাসীরা ডিবিকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। একই সঙ্গে হাতবোমা ও পেট্রলবোমাও নিক্ষেপ করে। পুলিশও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। উভয়পক্ষের গুলি বর্ষণকালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে জনি গুলিবিদ্ধ হয়। জনিকে চিকিৎসার জন্য দ্রুত ঢামেক হাসপাতালে প্রেরণ করলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সন্ত্রাসীদের গুলি ও বোমার আঘাতে কনস্টেবল সোলায়মান হোসেন ও আবু ছায়েদ আহত হলে তাদের রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
জনির দেহে ১৬ গুলির ছিদ্র: ঢামেক হাসপাতালের মর্গে গিয়ে নিহতের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ সাদিয়া তাজনিন। সুরতহাল প্রতিবেদন অনুসারে জানা গেছে, নিহত জনির কোমরের উপরের দিকে বাম পায়ে একটি, বুকের মাঝ বরাবর তিনটি, বুকের বাম পাশে তিনটি, ডান পাশে তিনটি, পিঠের বামপাশে দুটি, পিঠের বাম পাশে উপরের দিকে দুটি, ডান পায়ে দুটি ক্ষতচিহ্ণ পাওয়া গেছে। এসময় তার পরনে ছিল জিন্সের প্যান্ট। পায়ে মোজা ও কেডস ছিল। তার হাতের তালুতে ছিদ্রযুক্ত জখম, হাতের কনুইয়ে ছিলা জখম পাওয়া গেছে। নিহতের হাত দুটি শরীরের সঙ্গে লাগানো ছিল।
জনির বিরুদ্ধে ছয় মামলা: নিহত ছাত্রদল নেতা জনির বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। এরমধ্যে ২০১৩ সালের ২৯শে আগস্ট ও একই বছরের ২৬শে সেপ্টেম্বর দায়েরকৃত দুটি মামলার এজাহারে তার নাম নেই। বাকি চারটি মামলার মধ্যে গত বছরের ২৫শে মে, ২৪শে এপ্রিল ও তার আগের বছরের ২৯শে আগস্ট দায়েরকৃত তিনটি মামলা বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া, গত বছরের ৩১শে মে সহিংসতার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে। খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়া মোহাম্মদ মোস্তাফিজ জানান, নিহত জনি সহিংসতা, নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। এছাড়া, সোমবার রাতের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় জনির সহযোগীদের আসামি করে ডিবি মামলা দায়ের করেছে বলে জানান তিনি।
No comments