প্রতিদিনই হোক মানবাধিকার দিবস by আবদুল লতিফ মন্ডল
এ বছর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য
বিষয় হল হিউম্যান রাইটস ৩৬৫। অর্থাৎ বছরের ৩৬৫ দিনই মানবাধিকার দিবস।
প্রত্যেক মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৮ সালের ১০
ডিসেম্বর জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে ঘোষিত হয় The Universal
Declaration of Human Rights বা সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা। তবে ১৯৫০ সালের
৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এক রেজুলেশনের মাধ্যমে ১০
ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা পায়। ১০ ডিসেম্বর
বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে মানবাধিকার দিবস হিসেবে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে
দিবসটি পালিত না হলেও মানবাধিকার সংস্থাগুলোসহ অনেক বেসরকারি সংগঠন দিবসটি
পালন করবে।
মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ৩০টি অনুচ্ছেদে মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা, মানুষের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার ঘোষণা রয়েছে। আলোচনার সুবিধার্থে এখানে এর কয়েকটি উল্লেখ করছি। বলা হয়েছে, বন্ধনহীন অবস্থায় এবং সমমর্যাদা ও অধিকারাদি নিয়ে সব মানুষই জন্মগ্রহণ করে। বুদ্ধি ও বিবেক তাদের অর্পণ করা হয়েছে; অতএব ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে তাদের একে অন্যের প্রতি আচরণ করা উচিত। প্রত্যেকেরই জীবন ধারণ, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। কাউকে নির্যাতন অথবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক অথবা অবমাননাকর আচরণ অথবা শাস্তি ভোগে বাধ্য করা চলবে না। আইনের সমক্ষে প্রত্যেকেরই সর্বত্র ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের অধিকার রয়েছে। আইনের কাছে সবাই সমান এবং কোনোরূপ বৈষম্য ব্যতিরেকে সবারই আইনের দ্বারা সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। কাউকে খেয়ালখুশি মতো গ্রেফতার, আটক অথবা নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে না। কাউকেই যথেচ্ছভাবে তার জাতীয়তা থেকে অথবা তাকে তার জাতীয়তা পরিবর্তনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা চলবে না। প্রত্যেকেরই চিন্তা, বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। প্রত্যেকেরই মতামত প্রকাশের স্বাধিকার রয়েছে; বিনা হস্তক্ষেপে মতামত পোষণ এবং যেকোনো উপায়ে এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে তথ্য ও মতামত সন্ধান, গ্রহণ এবং জ্ঞাত করার স্বাধীনতা এ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
মানবাধিকার সনদে এসব ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার পদে পদে লুণ্ঠিত হচ্ছে। ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রে উদ্বাস্তু হিসেবে বসবাস করছে। আর যারা ভূমি কামড়ে পড়ে আছে, তারা ইসরাইলি বর্বরতার শিকার হয়ে সর্বদা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বসবাস করছে। ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতকে ইসরাইলিরা গোপনে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মিয়ানমারে বছরের পর বছর রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চলছে। রোহিঙ্গারা আজ তাদের আদি নিবাসে বহিরাগত। মানবাধিকার সনদের ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জাতীয়তা সংক্রান্ত ঘোষণার প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশটির সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পুনর্বহাল করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে দেশটির সরকার। কয়েক লাখ নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হাজার হাজার রোহিঙ্গা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে পালিয়ে যাচ্ছে।
প্রত্যেকেরই মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে- মানবাধিকার সনদে এ ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও অনেক দেশে, বিশেষ করে গণতন্ত্রহীন রাজতান্ত্রিক দেশে মানুষের মত প্রকাশের কোনো অধিকার নেই। নেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। অনুরূপভাবে উত্তর কোরিয়ার মতো একনায়কতান্ত্রিক দেশে মত প্রকাশের ও বাকস্বাধীনতার কোনো অধিকার নেই জনসাধারণের।
এবার বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির দিকে নজর দেয়া যাক। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর আমাদের এমন একটি সংবিধান (মূল সংবিধান বলে অভিহিত) উপহার দেন, যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলোর আওতায় প্রজাতন্ত্রকে একটি গণতন্ত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়, নিশ্চয়তা দেয়া হয় মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার। মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। নিশ্চয়তা দেয়া হয় সব নাগরিকের সুযোগের সমতার। কর্মকে অধিকার ও কর্তব্যরূপে স্বীকৃতি দেয়া হয়। মৌলিক অধিকারগুলোর আওতায় যেসব বিধান করা হয় সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল- সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের আশ্রয়লাভে সবার সমান অধিকার; ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্য না প্রদর্শন; আইনানুযায়ী ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে তার জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত না করা; গ্রেফতারকৃত কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কারণ না জানিয়ে আটক নিষিদ্ধ এবং ওই ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত না করা; জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ; প্রত্যেক নাগরিকের চলাফেরা, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের প্রায় সব ঘোষণার প্রতিফলন ঘটেছে আমাদের মূল সংবিধানে।
চিন্তা, বিবেক ও মতামত প্রকাশের যে স্বাধীনতার অধিকারের ঘোষণা সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ এবং আমাদের মূল সংবিধানে রয়েছে, তাতে প্রথম বাধা আসে মূল সংবিধান গৃহীত হওয়ার ১ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। ১৯৭৩ সালে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধানাবলী সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে জরুরি অবস্থা বিদ্যমান থাকাকালীন জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো হরণ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর কমবেশি ১০ বছর সামরিক শাসনামলে এবং ২০০৭-০৮ সময়কালে সেনাসমর্থিত নির্দলীয় সরকারের আমলে জনগণ এ জরুরি বিধানাবলীর শিকার হয়ে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত থাকেন। ভবিষ্যতেও যে তারা এরূপ বঞ্চনার শিকার হবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মূল সংবিধানে প্রজাতন্ত্র হবে গণতন্ত্র মর্মে যে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তা হোঁচট খায়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্থলে প্রতিষ্ঠিত হয় একদলীয় শাসন। প্রত্যক্ষভাবে বা অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশের সরকারে অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে মর্মে সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যেমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ সম্পর্কিত বিধানটুকু বিলুপ্ত করা হয়। বিচার বিভাগ তার অনেক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পরপরই ৪টি ছাড়া অন্যসব দৈনিক পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। জনগণের বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় সম্প্র্রচার নীতিমালা-২০১৪-এর কঠোর সমালোচনা করেছেন সম্পাদক পরিষদ, গণমাধ্যম কর্মীসহ অনেকে। বলা হয়েছে, এই নীতিমালা গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করবে, গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে।
১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ, ২০০৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত দি ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিসাপিয়ারেন্সেস (আইসিপিপিইডি) এবং আমাদের সংবিধানের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে ঘটানো হচ্ছে আটকাবস্থায় খুন, আইনবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ। আটকাবস্থায় খুন ও আইনবহির্ভূত হত্যা আগেও সংঘটিত হলেও গুমের ব্যাপকতা লক্ষ করা গেছে সাম্প্র্রতিক সময়ে। বলতে গেলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমল থেকে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ১৫০ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। ৩১ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে দেশে ২২৯ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৪ সালের রিপোর্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে এক নেতিবাচক চিত্র ফুটে উঠেছে। এতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সরকারের নির্যাতন ও দমননীতির বিশদ বিবরণ রয়েছে।
দেশে একটি মানবাধিকার কমিশন রয়েছে। জনগণের কাছে এটির পরিচয় নখদন্তহীন বাঘ হিসেবে। সুশীল সমাজ ও জনগণের অভিযোগ, কমিশন আইন অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মানবাধিকার লংঘন প্রতিরোধে নেয়নি কোনো উদ্যোগ। নির্বিকার থেকে এটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করছে।
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষা সেদিনই সম্ভব হবে, যেদিন নিজ নিজ দেশের সরকার সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ, দি ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব আল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিসাপিয়ারেন্সেস এবং নিজ নিজ দেশের সংবিধান অনুযায়ী তাদের নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষায় আন্তরিক হবে। শুধু ১০ ডিসেম্বর নয়, বছরের অন্যসব দিন হোক মানবাধিকার দিবস। মানবাধিকার দিবস পালন সেদিনই সার্থক হবে, যেদিন বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা আর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ৩০টি অনুচ্ছেদে মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা, মানুষের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার ঘোষণা রয়েছে। আলোচনার সুবিধার্থে এখানে এর কয়েকটি উল্লেখ করছি। বলা হয়েছে, বন্ধনহীন অবস্থায় এবং সমমর্যাদা ও অধিকারাদি নিয়ে সব মানুষই জন্মগ্রহণ করে। বুদ্ধি ও বিবেক তাদের অর্পণ করা হয়েছে; অতএব ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে তাদের একে অন্যের প্রতি আচরণ করা উচিত। প্রত্যেকেরই জীবন ধারণ, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। কাউকে নির্যাতন অথবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক অথবা অবমাননাকর আচরণ অথবা শাস্তি ভোগে বাধ্য করা চলবে না। আইনের সমক্ষে প্রত্যেকেরই সর্বত্র ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের অধিকার রয়েছে। আইনের কাছে সবাই সমান এবং কোনোরূপ বৈষম্য ব্যতিরেকে সবারই আইনের দ্বারা সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। কাউকে খেয়ালখুশি মতো গ্রেফতার, আটক অথবা নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে না। কাউকেই যথেচ্ছভাবে তার জাতীয়তা থেকে অথবা তাকে তার জাতীয়তা পরিবর্তনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা চলবে না। প্রত্যেকেরই চিন্তা, বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। প্রত্যেকেরই মতামত প্রকাশের স্বাধিকার রয়েছে; বিনা হস্তক্ষেপে মতামত পোষণ এবং যেকোনো উপায়ে এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে তথ্য ও মতামত সন্ধান, গ্রহণ এবং জ্ঞাত করার স্বাধীনতা এ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
মানবাধিকার সনদে এসব ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার পদে পদে লুণ্ঠিত হচ্ছে। ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রে উদ্বাস্তু হিসেবে বসবাস করছে। আর যারা ভূমি কামড়ে পড়ে আছে, তারা ইসরাইলি বর্বরতার শিকার হয়ে সর্বদা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বসবাস করছে। ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতকে ইসরাইলিরা গোপনে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মিয়ানমারে বছরের পর বছর রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চলছে। রোহিঙ্গারা আজ তাদের আদি নিবাসে বহিরাগত। মানবাধিকার সনদের ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জাতীয়তা সংক্রান্ত ঘোষণার প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশটির সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পুনর্বহাল করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে দেশটির সরকার। কয়েক লাখ নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হাজার হাজার রোহিঙ্গা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে পালিয়ে যাচ্ছে।
প্রত্যেকেরই মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে- মানবাধিকার সনদে এ ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও অনেক দেশে, বিশেষ করে গণতন্ত্রহীন রাজতান্ত্রিক দেশে মানুষের মত প্রকাশের কোনো অধিকার নেই। নেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। অনুরূপভাবে উত্তর কোরিয়ার মতো একনায়কতান্ত্রিক দেশে মত প্রকাশের ও বাকস্বাধীনতার কোনো অধিকার নেই জনসাধারণের।
এবার বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির দিকে নজর দেয়া যাক। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর আমাদের এমন একটি সংবিধান (মূল সংবিধান বলে অভিহিত) উপহার দেন, যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলোর আওতায় প্রজাতন্ত্রকে একটি গণতন্ত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়, নিশ্চয়তা দেয়া হয় মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার। মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। নিশ্চয়তা দেয়া হয় সব নাগরিকের সুযোগের সমতার। কর্মকে অধিকার ও কর্তব্যরূপে স্বীকৃতি দেয়া হয়। মৌলিক অধিকারগুলোর আওতায় যেসব বিধান করা হয় সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল- সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের আশ্রয়লাভে সবার সমান অধিকার; ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্য না প্রদর্শন; আইনানুযায়ী ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে তার জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত না করা; গ্রেফতারকৃত কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কারণ না জানিয়ে আটক নিষিদ্ধ এবং ওই ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত না করা; জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ; প্রত্যেক নাগরিকের চলাফেরা, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের প্রায় সব ঘোষণার প্রতিফলন ঘটেছে আমাদের মূল সংবিধানে।
চিন্তা, বিবেক ও মতামত প্রকাশের যে স্বাধীনতার অধিকারের ঘোষণা সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ এবং আমাদের মূল সংবিধানে রয়েছে, তাতে প্রথম বাধা আসে মূল সংবিধান গৃহীত হওয়ার ১ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। ১৯৭৩ সালে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধানাবলী সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে জরুরি অবস্থা বিদ্যমান থাকাকালীন জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো হরণ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর কমবেশি ১০ বছর সামরিক শাসনামলে এবং ২০০৭-০৮ সময়কালে সেনাসমর্থিত নির্দলীয় সরকারের আমলে জনগণ এ জরুরি বিধানাবলীর শিকার হয়ে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত থাকেন। ভবিষ্যতেও যে তারা এরূপ বঞ্চনার শিকার হবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মূল সংবিধানে প্রজাতন্ত্র হবে গণতন্ত্র মর্মে যে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তা হোঁচট খায়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্থলে প্রতিষ্ঠিত হয় একদলীয় শাসন। প্রত্যক্ষভাবে বা অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশের সরকারে অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে মর্মে সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যেমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ সম্পর্কিত বিধানটুকু বিলুপ্ত করা হয়। বিচার বিভাগ তার অনেক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পরপরই ৪টি ছাড়া অন্যসব দৈনিক পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। জনগণের বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় সম্প্র্রচার নীতিমালা-২০১৪-এর কঠোর সমালোচনা করেছেন সম্পাদক পরিষদ, গণমাধ্যম কর্মীসহ অনেকে। বলা হয়েছে, এই নীতিমালা গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করবে, গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে।
১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ, ২০০৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত দি ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিসাপিয়ারেন্সেস (আইসিপিপিইডি) এবং আমাদের সংবিধানের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে ঘটানো হচ্ছে আটকাবস্থায় খুন, আইনবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ। আটকাবস্থায় খুন ও আইনবহির্ভূত হত্যা আগেও সংঘটিত হলেও গুমের ব্যাপকতা লক্ষ করা গেছে সাম্প্র্রতিক সময়ে। বলতে গেলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমল থেকে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ১৫০ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। ৩১ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে দেশে ২২৯ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৪ সালের রিপোর্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে এক নেতিবাচক চিত্র ফুটে উঠেছে। এতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সরকারের নির্যাতন ও দমননীতির বিশদ বিবরণ রয়েছে।
দেশে একটি মানবাধিকার কমিশন রয়েছে। জনগণের কাছে এটির পরিচয় নখদন্তহীন বাঘ হিসেবে। সুশীল সমাজ ও জনগণের অভিযোগ, কমিশন আইন অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মানবাধিকার লংঘন প্রতিরোধে নেয়নি কোনো উদ্যোগ। নির্বিকার থেকে এটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করছে।
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষা সেদিনই সম্ভব হবে, যেদিন নিজ নিজ দেশের সরকার সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ, দি ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব আল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিসাপিয়ারেন্সেস এবং নিজ নিজ দেশের সংবিধান অনুযায়ী তাদের নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষায় আন্তরিক হবে। শুধু ১০ ডিসেম্বর নয়, বছরের অন্যসব দিন হোক মানবাধিকার দিবস। মানবাধিকার দিবস পালন সেদিনই সার্থক হবে, যেদিন বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা আর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
No comments