বড়ই অসহায় মানবাধিকার কমিশন
আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে মানবাধিকার রক্ষায়
কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই অসহায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
সরকারের কাছে সুপারিশ আর তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া ছাড়া কোনো নির্বাহী ক্ষমতা
নেই এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের। কেউ বা কোনো কর্তৃপক্ষ কমিশনের আদেশ না
মানলে আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ জানাতে পারে
প্রতিষ্ঠানটি। নানা আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে মানবাধিকার রক্ষায় তেমন একটা
ভূমিকা রাখতে না পারলেও কমিশন ধীরে ধীরে সফলতার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে বলে
দাবি এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমানের।
মানবাধিকার কমিশনের অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতার নজির থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো একটি মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় কমিশন প্রতিবেদন চেয়ে পাঠালেও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন সহযোগিতা করা হয় না। একটি প্রতিবেদন পেতে ১৫ থেকে ২০ বার তাগিদ দেয়ার, এমনকি চার বছর ধরে অপেক্ষারও নজির রয়েছে। এ অবস্থায় কমিশনের নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছেন চেয়ারম্যান ড. মিজান।
জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৪ এপ্রিল রাতে সাভারের আমিন বাজার এলাকা থেকে সাদা পোশাকে র্যাব সদস্যরা শহীদুল্লাহ ওরফে সুমন ও তার স্ত্রী রানী আক্তারকে আটক করেন। তাদের র্যাব-৪-এর নবীনগর অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখা হয়। পরের দিন র্যাবের একটি দল রানী আক্তারকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে ছেড়ে দেয়। পরে রানী আক্তার তার স্বামীকে খুঁজতে র্যাব-৪-এর ক্যাম্পে যান। কিন্তু সাদা পোশাকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি অস্বীকার করা হয়। আটকের ১২ দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে শহীদুল্লাহর গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। এ নিয়ে একই বছরের ২৭ এপ্রিল দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে একটি অভিযোগ করে। আইন অনুযায়ী এ অভিযোগের সরাসরি তদন্তের এখতিয়ার কমিশনের নেই। তাই অভিযোগটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য মানবাধিকার কমিশন ২০১০ সালের ২৯ জুন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। এরপর চার বছর কেটে গেছে। কমিশনের পক্ষ থেকে ২০ বার তাগিদ দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ২১ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন পাঠাতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ জরুরি ভিত্তিতে প্রতিবেদন পাওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের প্রতি নির্দেশনা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের হস্তক্ষেপ চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। শুধু এ প্রতিবেদনটিই নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ রকম বহু প্রতিবেদনই দুই থেকে তিন বছরেও পায়নি কমিশন।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের বিভিন্ন অফিস থেকে দীর্ঘসূত্রতার কৌশল অবলম্বন করা হয়। ধরুন, কোনো একটি থানার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু এ অভিযোগের সরাসরি তদন্ত করার এখতিয়ার কমিশনকে দেয়া হয়নি। তদন্ত করতে দিচ্ছি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। আমরা বলে দিচ্ছি তদন্ত করুন, প্রতিবেদন পাঠান। অনেক ক্ষেত্রে আমরা ১২, ১৩, ১৪ বার চিঠি দিয়েছি; কিন্তু প্রতিবেদন পাইনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট থানায় চিঠি পাঠিয়ে বলা হচ্ছে, এখনও প্রতিবেদন পাঠানো হয়নি, প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য নির্দেশক্রমে জানানো হল। সেই নির্দেশনার কপি মন্ত্রণালয় আমাদের কাছেও পাঠিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বিষয়টির নিষ্পত্তি করছে না। ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দিচ্ছে। এর ফলে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, যারা গুরুত্ব দিচ্ছে না, এভাবে ফেলে রাখছে, তাদের সবার তালিকা করে আমরা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে একটি চিঠি লিখব। অনুগ্রহপূর্বক হস্তক্ষেপ করার জন্য। এরপরও যদি না হয়, যে কাজটি এখনও করিনি, আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করার, সেটি করব। আইনে বলা আছে, সুপারিশ বাস্তবায়ন না করলে সেসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির দৃষ্টিতে আনতে হবে। রাষ্ট্রপতি মনে করলে সেটি সংসদে উত্থাপন করবেন।
মানবাধিকার কমিশন আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের কাছে কমিশন থেকে কোনো সুপারিশ পাঠানো হলে তার তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানো ওই ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব বলে বিবেচিত হবে। প্রতিবেদন না পাঠালে বা অপর্যাপ্ত প্রতিবেদন পাঠালে কমিশন ঘটনাটির পূর্ণ বিবরণ রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিল করবে এবং রাষ্ট্রপতি এ ধরনের প্রতিবেদন সংসদে উত্থাপনের ব্যবস্থা করবেন। আইনগত দিক থেকে এরচেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতা মানবাধিকার কমিশনের নেই। এ সীমাবদ্ধতায় কমিশনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। তাই আইনের পরিবর্তন দরকার রয়েছে। বিষয়টি স্বীকার করে ড. মিজানুর রহমান বলেন, কমিশনের অর্জনগুলো ধীরে ধীরে হচ্ছে। রাতারাতি সব পরিবর্তন সম্ভব হবে না। মানবাধিকার কমিশনের কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। কোনো সরকারি অফিসকে কোনো কথা বললে তা ওই অফিসের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। আইনে বাধ্যবাধকতা নেই। নিজস্ব তদন্ত ক্ষমতার জন্য আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন। আর প্রবল রাজনৈতিক ইচ্ছা না থাকলে এটা হবে না।
তিনি আরও বলেন, এ আইনের পরিবর্তন প্রথম থেকে কামনা করলে তা পরিবর্তন হতো না। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, যতটুকু ক্ষমতা আছে ততটুকু প্রয়োগ করি। এটা করে যে কমিশনকে একসময় তোয়াক্কাই করা হতো না তা এখন শ্রদ্ধা ও আস্থার জায়গায় পৌঁছেছে। এটাকে বিরাট অর্জন বলে মনে করি। মানুষ তার অধিকারের জন্য কমিশনে ছুটে আসছে।
এদিকে মানবাধিকার কমিশন আইন অনুযায়ী সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে কমিশন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির পক্ষে সুপ্রিমকোর্টে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করতে পারবে। কিন্তু ১২, ১৩ কিংবা ১৪ বার চিঠি পাঠিয়েও প্রতিবেদন না পাওয়ার পর কমিশন কেন এ সুযোগ গ্রহণ করেননি- এমন প্রশ্নের জবাবে মিজানুর রহমান বলেন, মানবাধিকার রক্ষায় আমাদের যত সুযোগ রয়েছে আমরা কিন্তু সব একবারে ব্যবহার করিনি। ধাপে ধাপে এগোনোর চেষ্টা করেছি। এখন কিন্তু আমরা সে রকম অবস্থা মনে করছি, কারও পক্ষে আইনি লড়াইয়ে যাওয়ার জন্য। তানভীরের পক্ষে তা করা হয়েছে। আগামী ১৪ তারিখের সভায় আরও একজনের পক্ষে আইনি লড়াইয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. মিজান বলেন, যত অভিযোগ আসে, তা পর্যালোচনায় দেখা যায় সিংহভাগই আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে। কারও দ্বারা নিগৃহীত হয়েছে, মামলা করতে যাচ্ছি, অভিযোগ করতে যাচ্ছি, এজাহার নেয়া হচ্ছে না, মামলা নেয়া হচ্ছে না, টাকা চাওয়া হচ্ছে- এ ধরনের বেশিরভাগ অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। খতিয়ে দেখার পরে বেশিরভাগেরই সত্যতা রয়েছে বলে প্রতিভাত হয়। তবে হয়তো যতটা নৃশংসভাবে বলা হয়, ততটা না হলেও মানবাধিকার লংঘন যে হয়, তা সুস্পষ্ট।
কমিশনের সফলতার প্রশ্নে তিনি বলেন, সফলতা-ব্যর্থতা বিচার করবে সাধারণ মানুষ। তবে দুটো জায়গাতে অন্তত সফল হয়েছি। তার একটা হচ্ছে, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী কোনো একটি বিশেষ বাহিনীকে এক রকম এরোগেন্স লক্ষ্য করা গিয়েছিল। মনে করা হতো যে তারা আইনের ঊর্ধ্বে, তাদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। সে অবস্থা থেকে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে দায়বদ্ধতার একটা জায়গায় কিন্তু নিয়ে আসতে পেরেছি। দ্বিতীয়ত, আমাদের দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত মানবাধিকার বলতে এদেশে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে বোঝানো হতো। পুলিশ কাউকে লাথি মারছে কিনা, সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে কিনা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হচ্ছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু দরিদ্র মানুষের যে অধিকার, চাষী, শ্রমিকের যে অধিকার, শিক্ষা, চিকিৎসার যে অধিকার তা মানবাধিকার কিনা সেটা বিবেচনায় আনা হতো না। এটা পরিবর্তন করতে কমিশন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে বলে আমি মনে করি।
র্যাবের হাতে গুলিবিদ্ধ লিমন ও সাগর-রুনি হত্যা মামলায় দীর্ঘ ২৭ মাস ধরে বিনা বিচারে আটক থাকা তানভীর রহমানের বিষয় উল্লেখ করে মিজানুর রহমান বলেন, লিমনের ঘটনায় রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত মিথ্যা, বানোয়াট ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এ জন্য রাষ্ট্র শুধু লজ্জায় পড়েছে তা নয়, রাষ্ট্র যে নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে সেটিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই সাগর-রুনীর হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার হোক। কিন্তু দীর্ঘ ২৭ মাসে তানভীরের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও আনতে পারল না, অথচ কারাগারে আটক রইল। আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে তাকে কারামুক্তির ব্যবস্থা করেছি।
বিভিন্ন জায়গায় যান, আবেগময়ী বক্তব্য দেন, কার্যত কোনো ফলাফল দেখতে পান না বলে জনসাধারণের মধ্যে ধারণা রয়েছে- এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, প্রত্যাশা যখন আকাশচুম্বী হয়, প্রাপ্তি ততটা না হলে তখনই মনে হয় কথাবার্তায় লাভ কিছু নেই। শুধু হম্বিতম্বি করে বেড়াচ্ছে- এর বাইরে কিছু নয়। ম্যাক্রো লেভেলে দৃশ্যমান নয়, মাইক্রো লেভেলে আসেন। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, রাঙ্গামাটিতে গিয়ে শিশুসদনে দেখলাম পরিচারিকার পদ নেই। ছোট ছোট বাচ্চাদের রান্না করতে হয়। একদিকে শিশু অধিকারের কথা বলছি, অন্যদিকে সেই ছোট্ট শিশুরা কাজ করছে। ফিরে এসে তৎকালীন মহিলা ও শিশু প্রতিমন্ত্রী বর্তমানে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে বলেছি। আমার বিশ্বাসও হচ্ছিল না এত দ্রুত পরিবর্তন হবে। এখন দুজন করে পরিচারিকা দেয়া হয়েছে। মাইক্রো লেভেলে পরিবর্তন হচ্ছে। দৃশ্যমান না হলেও কাজ হচ্ছে।
মানবাধিকার কমিশনের অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতার নজির থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো একটি মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় কমিশন প্রতিবেদন চেয়ে পাঠালেও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন সহযোগিতা করা হয় না। একটি প্রতিবেদন পেতে ১৫ থেকে ২০ বার তাগিদ দেয়ার, এমনকি চার বছর ধরে অপেক্ষারও নজির রয়েছে। এ অবস্থায় কমিশনের নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছেন চেয়ারম্যান ড. মিজান।
জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৪ এপ্রিল রাতে সাভারের আমিন বাজার এলাকা থেকে সাদা পোশাকে র্যাব সদস্যরা শহীদুল্লাহ ওরফে সুমন ও তার স্ত্রী রানী আক্তারকে আটক করেন। তাদের র্যাব-৪-এর নবীনগর অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখা হয়। পরের দিন র্যাবের একটি দল রানী আক্তারকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে ছেড়ে দেয়। পরে রানী আক্তার তার স্বামীকে খুঁজতে র্যাব-৪-এর ক্যাম্পে যান। কিন্তু সাদা পোশাকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি অস্বীকার করা হয়। আটকের ১২ দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে শহীদুল্লাহর গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। এ নিয়ে একই বছরের ২৭ এপ্রিল দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে একটি অভিযোগ করে। আইন অনুযায়ী এ অভিযোগের সরাসরি তদন্তের এখতিয়ার কমিশনের নেই। তাই অভিযোগটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য মানবাধিকার কমিশন ২০১০ সালের ২৯ জুন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। এরপর চার বছর কেটে গেছে। কমিশনের পক্ষ থেকে ২০ বার তাগিদ দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ২১ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন পাঠাতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ জরুরি ভিত্তিতে প্রতিবেদন পাওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের প্রতি নির্দেশনা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের হস্তক্ষেপ চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। শুধু এ প্রতিবেদনটিই নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ রকম বহু প্রতিবেদনই দুই থেকে তিন বছরেও পায়নি কমিশন।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের বিভিন্ন অফিস থেকে দীর্ঘসূত্রতার কৌশল অবলম্বন করা হয়। ধরুন, কোনো একটি থানার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু এ অভিযোগের সরাসরি তদন্ত করার এখতিয়ার কমিশনকে দেয়া হয়নি। তদন্ত করতে দিচ্ছি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। আমরা বলে দিচ্ছি তদন্ত করুন, প্রতিবেদন পাঠান। অনেক ক্ষেত্রে আমরা ১২, ১৩, ১৪ বার চিঠি দিয়েছি; কিন্তু প্রতিবেদন পাইনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট থানায় চিঠি পাঠিয়ে বলা হচ্ছে, এখনও প্রতিবেদন পাঠানো হয়নি, প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য নির্দেশক্রমে জানানো হল। সেই নির্দেশনার কপি মন্ত্রণালয় আমাদের কাছেও পাঠিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বিষয়টির নিষ্পত্তি করছে না। ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দিচ্ছে। এর ফলে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, যারা গুরুত্ব দিচ্ছে না, এভাবে ফেলে রাখছে, তাদের সবার তালিকা করে আমরা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে একটি চিঠি লিখব। অনুগ্রহপূর্বক হস্তক্ষেপ করার জন্য। এরপরও যদি না হয়, যে কাজটি এখনও করিনি, আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করার, সেটি করব। আইনে বলা আছে, সুপারিশ বাস্তবায়ন না করলে সেসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির দৃষ্টিতে আনতে হবে। রাষ্ট্রপতি মনে করলে সেটি সংসদে উত্থাপন করবেন।
মানবাধিকার কমিশন আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের কাছে কমিশন থেকে কোনো সুপারিশ পাঠানো হলে তার তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানো ওই ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব বলে বিবেচিত হবে। প্রতিবেদন না পাঠালে বা অপর্যাপ্ত প্রতিবেদন পাঠালে কমিশন ঘটনাটির পূর্ণ বিবরণ রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিল করবে এবং রাষ্ট্রপতি এ ধরনের প্রতিবেদন সংসদে উত্থাপনের ব্যবস্থা করবেন। আইনগত দিক থেকে এরচেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতা মানবাধিকার কমিশনের নেই। এ সীমাবদ্ধতায় কমিশনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। তাই আইনের পরিবর্তন দরকার রয়েছে। বিষয়টি স্বীকার করে ড. মিজানুর রহমান বলেন, কমিশনের অর্জনগুলো ধীরে ধীরে হচ্ছে। রাতারাতি সব পরিবর্তন সম্ভব হবে না। মানবাধিকার কমিশনের কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। কোনো সরকারি অফিসকে কোনো কথা বললে তা ওই অফিসের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। আইনে বাধ্যবাধকতা নেই। নিজস্ব তদন্ত ক্ষমতার জন্য আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন। আর প্রবল রাজনৈতিক ইচ্ছা না থাকলে এটা হবে না।
তিনি আরও বলেন, এ আইনের পরিবর্তন প্রথম থেকে কামনা করলে তা পরিবর্তন হতো না। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, যতটুকু ক্ষমতা আছে ততটুকু প্রয়োগ করি। এটা করে যে কমিশনকে একসময় তোয়াক্কাই করা হতো না তা এখন শ্রদ্ধা ও আস্থার জায়গায় পৌঁছেছে। এটাকে বিরাট অর্জন বলে মনে করি। মানুষ তার অধিকারের জন্য কমিশনে ছুটে আসছে।
এদিকে মানবাধিকার কমিশন আইন অনুযায়ী সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে কমিশন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির পক্ষে সুপ্রিমকোর্টে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করতে পারবে। কিন্তু ১২, ১৩ কিংবা ১৪ বার চিঠি পাঠিয়েও প্রতিবেদন না পাওয়ার পর কমিশন কেন এ সুযোগ গ্রহণ করেননি- এমন প্রশ্নের জবাবে মিজানুর রহমান বলেন, মানবাধিকার রক্ষায় আমাদের যত সুযোগ রয়েছে আমরা কিন্তু সব একবারে ব্যবহার করিনি। ধাপে ধাপে এগোনোর চেষ্টা করেছি। এখন কিন্তু আমরা সে রকম অবস্থা মনে করছি, কারও পক্ষে আইনি লড়াইয়ে যাওয়ার জন্য। তানভীরের পক্ষে তা করা হয়েছে। আগামী ১৪ তারিখের সভায় আরও একজনের পক্ষে আইনি লড়াইয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. মিজান বলেন, যত অভিযোগ আসে, তা পর্যালোচনায় দেখা যায় সিংহভাগই আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে। কারও দ্বারা নিগৃহীত হয়েছে, মামলা করতে যাচ্ছি, অভিযোগ করতে যাচ্ছি, এজাহার নেয়া হচ্ছে না, মামলা নেয়া হচ্ছে না, টাকা চাওয়া হচ্ছে- এ ধরনের বেশিরভাগ অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। খতিয়ে দেখার পরে বেশিরভাগেরই সত্যতা রয়েছে বলে প্রতিভাত হয়। তবে হয়তো যতটা নৃশংসভাবে বলা হয়, ততটা না হলেও মানবাধিকার লংঘন যে হয়, তা সুস্পষ্ট।
কমিশনের সফলতার প্রশ্নে তিনি বলেন, সফলতা-ব্যর্থতা বিচার করবে সাধারণ মানুষ। তবে দুটো জায়গাতে অন্তত সফল হয়েছি। তার একটা হচ্ছে, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী কোনো একটি বিশেষ বাহিনীকে এক রকম এরোগেন্স লক্ষ্য করা গিয়েছিল। মনে করা হতো যে তারা আইনের ঊর্ধ্বে, তাদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। সে অবস্থা থেকে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে দায়বদ্ধতার একটা জায়গায় কিন্তু নিয়ে আসতে পেরেছি। দ্বিতীয়ত, আমাদের দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত মানবাধিকার বলতে এদেশে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে বোঝানো হতো। পুলিশ কাউকে লাথি মারছে কিনা, সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে কিনা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হচ্ছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু দরিদ্র মানুষের যে অধিকার, চাষী, শ্রমিকের যে অধিকার, শিক্ষা, চিকিৎসার যে অধিকার তা মানবাধিকার কিনা সেটা বিবেচনায় আনা হতো না। এটা পরিবর্তন করতে কমিশন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে বলে আমি মনে করি।
র্যাবের হাতে গুলিবিদ্ধ লিমন ও সাগর-রুনি হত্যা মামলায় দীর্ঘ ২৭ মাস ধরে বিনা বিচারে আটক থাকা তানভীর রহমানের বিষয় উল্লেখ করে মিজানুর রহমান বলেন, লিমনের ঘটনায় রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত মিথ্যা, বানোয়াট ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এ জন্য রাষ্ট্র শুধু লজ্জায় পড়েছে তা নয়, রাষ্ট্র যে নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে সেটিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই সাগর-রুনীর হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার হোক। কিন্তু দীর্ঘ ২৭ মাসে তানভীরের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও আনতে পারল না, অথচ কারাগারে আটক রইল। আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে তাকে কারামুক্তির ব্যবস্থা করেছি।
বিভিন্ন জায়গায় যান, আবেগময়ী বক্তব্য দেন, কার্যত কোনো ফলাফল দেখতে পান না বলে জনসাধারণের মধ্যে ধারণা রয়েছে- এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, প্রত্যাশা যখন আকাশচুম্বী হয়, প্রাপ্তি ততটা না হলে তখনই মনে হয় কথাবার্তায় লাভ কিছু নেই। শুধু হম্বিতম্বি করে বেড়াচ্ছে- এর বাইরে কিছু নয়। ম্যাক্রো লেভেলে দৃশ্যমান নয়, মাইক্রো লেভেলে আসেন। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, রাঙ্গামাটিতে গিয়ে শিশুসদনে দেখলাম পরিচারিকার পদ নেই। ছোট ছোট বাচ্চাদের রান্না করতে হয়। একদিকে শিশু অধিকারের কথা বলছি, অন্যদিকে সেই ছোট্ট শিশুরা কাজ করছে। ফিরে এসে তৎকালীন মহিলা ও শিশু প্রতিমন্ত্রী বর্তমানে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে বলেছি। আমার বিশ্বাসও হচ্ছিল না এত দ্রুত পরিবর্তন হবে। এখন দুজন করে পরিচারিকা দেয়া হয়েছে। মাইক্রো লেভেলে পরিবর্তন হচ্ছে। দৃশ্যমান না হলেও কাজ হচ্ছে।
No comments