দেশে আইনের শাসন অনুপস্থিত -প্রথম আলোকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান by মানসুরা হোসাইন
দেশে বর্তমানে আইনের শাসন কতটুকু প্রতিষ্ঠিত? মানবাধিকার পরিস্থিতিই বা কেমন? গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোর
সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ ব্যাপারে অনেক কথাই বলেছেন জাতীয় মানবাধিকার
কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান | এ সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ এখানে
তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক মানসুরা হোসাইন...
প্রথম আলো: দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন বলে আপনি মনে করেন?
মিজানুর রহমান: দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন, তা নিয়ে একবাক্যে কোনো উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। আর আমি যেভাবেই উত্তর দিই না কেন, তার কিন্তু অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে। মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন কেমন, তা বলতে গেলে অতীতের সঙ্গে তুলনা করতে হবে। আমি তো বলব, ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটেছে। তা অনেক সন্তোষজনক। ২০১৩ সালে দেশে যে সহিংসতা ছিল, তা মানুষের নিরাপত্তাকে প্রকট করে তুলেছিল। নিরাপত্তাহীনতা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। সেই অবস্থা থেকে বের হতে পারা একটি শুভ লক্ষণ।
প্রথম আলো: দেশে আইনের শাসন কোন পর্যায়ে আছে বলে আপনি মনে করেন?
মিজানুর রহমান: আমি বলব, আইনের শাসনের জায়গাটি আমাদের দেশে বরাবরই দুর্বল ছিল। আইনের শাসন এখনো যে খুব একটা উন্নতি সাধন করেছে বা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, তা বলাটা কষ্টকর। কেননা আইনের শাসনের কিন্তু বহুমাত্রিকতা আছে। আমরা জানি, খুব সাধারণভাবে একটি কথা প্রচলিত, তা হচ্ছে আমাদের এখনকার বিচারব্যবস্থা ধনীবান্ধব। দরিদ্র মানুষ মনে করেন আদালতপাড়া তাঁর জন্য নিষিদ্ধ। কেননা তিনি সেখানে গিয়ে কিছু পাবেন না। বিচারব্যবস্থাটা যেন ধনীর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এ কথাগুলো সমাজে প্রচলিত থাকার অর্থই হচ্ছে দেশে আইনের শাসন অনুপস্থিত রয়েছে। আমরা এটাও লক্ষ করি অনেক ক্ষেত্রে যেখানে ন্যায়বিচারের স্বার্থেই আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার, সেখানে অনেক সময় তদন্ত দীর্ঘসূত্রতায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ‘জাস্টিস ডিলেড, জাস্টিস ডিনাই’ কথাটি সত্য প্রমাণিত হয়। একটি উদাহরণ দিই। সাগর-রুনি চাঞ্চল্যকর একটি ঘটনা যেখানে আপনারা, সাংবাদিক গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট। এর পরও প্রকৃত খুনি কে, তা কি বের করতে পেরেছেন? ‘কেষ্ট বেটাই চোর’ এটা বানাতে গিয়ে নিরীহ, যাদের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই, তাদের সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে। আইনের শাসনের ওপর এর চেয়ে বড় আঘাত আর কী হতে পারে? এগুলো তো আমরা অহরহ দেখছি। তাহলে আমরা কী করে বলব যে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? তবে আমরা সবাই প্রত্যাশা করি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক।
প্রথম আলো: আইনের শাসনের অনুপস্থিতি ও মানবাধিকারের সম্পর্ক যদি একটু স্পষ্ট করেন...
মিজানুর রহমান: আইনের শাসনের সঙ্গে মানবাধিকারের নিবিড় সম্পর্ক আছে। আপনি যদি একটি অপরাধ করেন, কিন্তু আপনার নানা ধরনের প্রভাবের কারণে বা রাষ্ট্রের সঙ্গে নানাবিধ সম্পর্কের কারণে রাষ্ট্র যদি ব্যবস্থা নিতে অপারগতা প্রকাশ করে বা অনিচ্ছুক হয় বা অন্য কোনো অপকৌশল ব্যবহার করে, আপনাকে আইনের স্পর্শ থেকে দূরে রাখতে চায়, তাহলে সেখানে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়। তখন আর আইনের শাসন থাকছে না। আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর প্রভাবটি মানবাধিকারের ওপর পড়ে। এ রকম ঘটনা যে এখানে ঘটছে না, তা বলতে পারব না। যেমন ধরুন, একজন দরিদ্র মানুষ, তিনি তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেরে ফেলল। তারা একটু পয়সাওয়ালা হলে থানায় বিষয়টিকে হত্যা মামলা হিসেবে অভিযোগই নেবে না। অভিযোগ নিলেও তদন্ত শেষে একটা চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে দেবে যে এটা হত্যা মামলা নয়। আপনারা মাহজাবীনের (চিকিৎসক শামারুখ মাহজাবীন) কেসটা একটু দেখেন। তাঁর বাবা প্রকৌশলী। কিন্তু রাজনৈতিক এক ধরনের প্রভাবে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাল্টে যাচ্ছে। আমরা গণমাধ্যম থেকে যতটুকু জানতে পেরেছি, এতে মনে হচ্ছে পোস্টমর্টেম রিপোর্টটি একটি অসত্য রিপোর্ট। চিকিৎসকই দিয়েছেন এ রিপোর্ট। তার মানে কী? টাকার কাছে সবাই বিকিয়ে যাচ্ছে। ফলে ন্যায়বিচার হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকছে না।
প্রথম আলো: মাহজাবীনের কেসটার ক্ষেত্রে কমিশন কী ধরনের ভূমিকা পালন করছে?
মিজানুর রহমান: যখন মামলা বিচারাধীন, তখন কমিশনের পক্ষে করার কিছু থাকে না। তবে অনেক সময় আমরা আইনকে উপেক্ষা করে হলেও কিছু পদক্ষেপ নিই। তবে তা বিচারে প্রভাব ফেলবে সেই ধরনের তদন্ত করি না। ন্যায়বিচারের স্বার্থে তখন আমরা দাবি করি এমন একজন চিকিৎসক বা বোর্ডকে দিয়ে পোস্টমর্টেম করানো হোক, যাতে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে, সেটি চাওয়া নিশ্চয়ই আইনের লঙ্ঘন নয়। আমরা সাধারণত সেই কাজ করছি। মাহজাবীনের কেসে তেমন কিছু করেছি কি না, মনে করতে পারছি না। তবে জান্নাতি নামের মেয়েটির বেলায় করার চেষ্টা চলছে। মেয়েটি নিজেই দুর্ঘটনার শিকার। এখন তাঁকে হত্যাকারী বা হত্যায় সহায়তাকারী হিসেবে দেখানোর যে অপচেষ্টা চলছে তা জানাতে তাঁর পরিবারের সদস্যরা এসেছিলেন কমিশনের কাছে। সামনে কমিশনের সভায় সিদ্ধান্ত হবে। কমিশনের পক্ষ থেকে এ মামলাটি নিয়ে লড়াই করার সিদ্ধান্ত এলে তাঁর হয়ে আমরা আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হব।
প্রথম আলো: কমিশনের এ পর্যন্ত যত অর্জন, তা কি যথেষ্ট বলে মনে করেন?
মিজানুর রহমান: এ ক্ষেত্রে আমি গর্ব করেই বলতে পারি সীমাবদ্ধতা, জনবলের সংকট, আর্থিক সংকট, লজিস্টিক সাপোর্টের স্বল্পতার পরও আমরা যা করেছি, তা অন্য আর কারও পক্ষে করা সম্ভব না। কমিশনকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছি, যেখানে সাধারণ মানুষ যদি কোনো সংস্থার ওপর আস্থা রাখে, তো সে হচ্ছে মানবাধিকার কমিশন। তারা জানে, এখানে তাদের হয়রানি হতে হবে না। হেনস্তা হতে হবে না। পয়সা খরচ করতে হবে না। এখানে দুর্নীতির কোনো স্থান নেই। এটি সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বলেই কমিশনে অভিযোগপ্রাপ্তির সংখ্যা ৩০০ ভাগের বেশি হয়ে গেছে। অন্য কোথাও গিয়ে তারা প্রতিকার পাচ্ছে না বা প্রতিকার পাওয়ার সম্ভাবনা এতটাই ক্ষীণ যে, তারা কমিশনের কাছে অভিযোগ জানাতে বেশি স্বস্তিকর মনে করছে। একটা পরিবর্তন, তফাৎ আনতে সক্ষম হয়েছি। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সরকারি অফিস ও কর্মকর্তারাও কমিশনকে শ্রদ্ধার চোখে দেখছে। এই শ্রদ্ধার জায়গাটিকে মজবুত করতে হবে। যেন আমাদের কোনো সুপারিশ শুধু সুপারিশ হিসেবেই না থাকে। সুপারিশটা যে তাদের প্রতিপালন করতে হবে, সে জায়গাটা তৈরি করতে হবে। এখনো অনেকে ভাবছে, কমিশন বলেছে, তা আমরা করলাম না। মানলাম না।
প্রথম আলো: কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা কালক্ষেপণ করলে তা রাষ্ট্রপতিকে জানাতে পারে কমিশন...
মিজানুর রহমান: কমিশন এখন পর্যন্ত এ হাতিয়ারটি ব্যবহার করেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি বিষয়ে আমরা ১৯ বার তাগাদা দিয়েছি। এখন ক্যাবিনেট সেক্রেটারিকে লেখা হবে। সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। তার পরও যদি কাজ না হয়, তখন আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করব। আমরা ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছি। কৌশলগতভাবে কাজ করার চেষ্টা চালাচ্ছি।
প্রথম আলো: কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে আপনি প্রথম দিকে সরকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যে ভাষায় সমালোচনা করতেন, এখন আর আমরা তা দেখতে পাচ্ছি না। আপনি কী কোনো চাপের মুখে আছেন?
মিজানুর রহমান: (হেসে) সরকারের সমালোচনা করাই কমিশনের একমাত্র কাজ নয়। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ, আবার রাষ্ট্রকে আস্থায় নিয়েই কাজ আদায় করতে হয়। বিচিত্র ও অদ্ভুত ধরনের সম্পর্ক। শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক তৈরি করে পৃথিবীর কোথাও কোনো কমিশন কাজ করতে সফল হয়নি। তবে যখন সরকারের সমালোচনা করা প্রয়োজন, সাধুবাদ জানানো প্রয়োজন—সবই করা হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে আমরা এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারি না, যা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদকে উসকে দিতে পারে; যা মানবাধিকারের ক্ষেত্রে আরও বেশি হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। তাই আমাদের নানাবিধ কৌশল সামনে রেখে কাজ করতে হয়। এ ছাড়া কোনো মন্ত্রী বক্তব্য বা বক্তৃতায় আমাকে নিয়ে কিছু বললে তাঁকে আমি চাপ মনে করি না। নির্ভেজাল সত্য, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বা রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে কখনোই কোনো রকম নির্দেশ, আদেশ, অনুরোধ বা উপদেশ দিয়ে কোনো বার্তা পাঠানো হয়নি। অন্তত আমার কাছে দেয়া হয়নি; বরং উল্টোটি হয়েছে। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, আমার কাজে কেউ হস্তক্ষেপ করলে তা যেন তাঁকে জানাই। যখন দু-একজন মন্ত্রী আমার নামে মন্তব্য করেছেন, তা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, মন্ত্রীরা যেভাবে মন্তব্য করছেন, তা কমিশন বা সরকারের জন্য শুভবার্তা বহন করছে না। এতে অনেকেই মনে করতে পারেন আমাদের কাজে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। বিদেশের কাছেও ভুল বার্তা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বলেছেন, ‘মিজান, আমি কি কিছু বলেছি?’ আমি বলেছি, ‘না?’ তখন তিনি বলেছেন, ‘তুমি তোমার মতো করে কাজ চালিয়ে যাও।’ প্রধানমন্ত্রী বোঝেন, কমিশনের স্বাধীনতা কেমন থাকা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যেই তিনি লাইসেন্স দিয়েছেন। তবে জনবল সংকট, অর্থ খরচের সীমাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন বিষয় সমাধান না করে সরকার আমাদের কাজে ইনডাইরেক্টভাবে বাধা দিচ্ছে বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, তা তো বলাই যায়। তবে জনবল সংকট খুব শিগগির দূর হবে বলে আশা করছি। ২০১৫ সালে কমিশনের কাজের গতি আরও বাড়বে।
প্রথম আলো: কমিশনের বা আপনার সামনে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনটি?
মিজানুর রহমান: আমার বড় ইচ্ছা ও স্বপ্ন ছিল আমার মেয়াদেই যেন দেশব্যাপী মানবাধিকার কৃষ্টি প্রতিষ্ঠার অন্তত প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করতে পারি। এ কাজটি করতে দেশব্যাপী যে পরিমাণ সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন ছিল, তা করতে পারিনি। আমরা এখন পর্যন্ত প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি ঘরে পৌঁছাতে পারিনি। এটিই কমিশন ও আমার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রথম আলো: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মিজানুর রহমান: প্রথম আলোকেও অনেক ধন্যবাদ। গণমাধ্যমের সহায়তা ছাড়া কমিশন খুব বেশি কিছু করতে পারবে না।
প্রথম আলো: দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন বলে আপনি মনে করেন?
মিজানুর রহমান: দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন, তা নিয়ে একবাক্যে কোনো উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। আর আমি যেভাবেই উত্তর দিই না কেন, তার কিন্তু অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে। মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন কেমন, তা বলতে গেলে অতীতের সঙ্গে তুলনা করতে হবে। আমি তো বলব, ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটেছে। তা অনেক সন্তোষজনক। ২০১৩ সালে দেশে যে সহিংসতা ছিল, তা মানুষের নিরাপত্তাকে প্রকট করে তুলেছিল। নিরাপত্তাহীনতা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। সেই অবস্থা থেকে বের হতে পারা একটি শুভ লক্ষণ।
প্রথম আলো: দেশে আইনের শাসন কোন পর্যায়ে আছে বলে আপনি মনে করেন?
মিজানুর রহমান: আমি বলব, আইনের শাসনের জায়গাটি আমাদের দেশে বরাবরই দুর্বল ছিল। আইনের শাসন এখনো যে খুব একটা উন্নতি সাধন করেছে বা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, তা বলাটা কষ্টকর। কেননা আইনের শাসনের কিন্তু বহুমাত্রিকতা আছে। আমরা জানি, খুব সাধারণভাবে একটি কথা প্রচলিত, তা হচ্ছে আমাদের এখনকার বিচারব্যবস্থা ধনীবান্ধব। দরিদ্র মানুষ মনে করেন আদালতপাড়া তাঁর জন্য নিষিদ্ধ। কেননা তিনি সেখানে গিয়ে কিছু পাবেন না। বিচারব্যবস্থাটা যেন ধনীর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এ কথাগুলো সমাজে প্রচলিত থাকার অর্থই হচ্ছে দেশে আইনের শাসন অনুপস্থিত রয়েছে। আমরা এটাও লক্ষ করি অনেক ক্ষেত্রে যেখানে ন্যায়বিচারের স্বার্থেই আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার, সেখানে অনেক সময় তদন্ত দীর্ঘসূত্রতায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ‘জাস্টিস ডিলেড, জাস্টিস ডিনাই’ কথাটি সত্য প্রমাণিত হয়। একটি উদাহরণ দিই। সাগর-রুনি চাঞ্চল্যকর একটি ঘটনা যেখানে আপনারা, সাংবাদিক গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট। এর পরও প্রকৃত খুনি কে, তা কি বের করতে পেরেছেন? ‘কেষ্ট বেটাই চোর’ এটা বানাতে গিয়ে নিরীহ, যাদের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই, তাদের সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে। আইনের শাসনের ওপর এর চেয়ে বড় আঘাত আর কী হতে পারে? এগুলো তো আমরা অহরহ দেখছি। তাহলে আমরা কী করে বলব যে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? তবে আমরা সবাই প্রত্যাশা করি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক।
প্রথম আলো: আইনের শাসনের অনুপস্থিতি ও মানবাধিকারের সম্পর্ক যদি একটু স্পষ্ট করেন...
মিজানুর রহমান: আইনের শাসনের সঙ্গে মানবাধিকারের নিবিড় সম্পর্ক আছে। আপনি যদি একটি অপরাধ করেন, কিন্তু আপনার নানা ধরনের প্রভাবের কারণে বা রাষ্ট্রের সঙ্গে নানাবিধ সম্পর্কের কারণে রাষ্ট্র যদি ব্যবস্থা নিতে অপারগতা প্রকাশ করে বা অনিচ্ছুক হয় বা অন্য কোনো অপকৌশল ব্যবহার করে, আপনাকে আইনের স্পর্শ থেকে দূরে রাখতে চায়, তাহলে সেখানে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়। তখন আর আইনের শাসন থাকছে না। আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর প্রভাবটি মানবাধিকারের ওপর পড়ে। এ রকম ঘটনা যে এখানে ঘটছে না, তা বলতে পারব না। যেমন ধরুন, একজন দরিদ্র মানুষ, তিনি তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেরে ফেলল। তারা একটু পয়সাওয়ালা হলে থানায় বিষয়টিকে হত্যা মামলা হিসেবে অভিযোগই নেবে না। অভিযোগ নিলেও তদন্ত শেষে একটা চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে দেবে যে এটা হত্যা মামলা নয়। আপনারা মাহজাবীনের (চিকিৎসক শামারুখ মাহজাবীন) কেসটা একটু দেখেন। তাঁর বাবা প্রকৌশলী। কিন্তু রাজনৈতিক এক ধরনের প্রভাবে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাল্টে যাচ্ছে। আমরা গণমাধ্যম থেকে যতটুকু জানতে পেরেছি, এতে মনে হচ্ছে পোস্টমর্টেম রিপোর্টটি একটি অসত্য রিপোর্ট। চিকিৎসকই দিয়েছেন এ রিপোর্ট। তার মানে কী? টাকার কাছে সবাই বিকিয়ে যাচ্ছে। ফলে ন্যায়বিচার হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকছে না।
প্রথম আলো: মাহজাবীনের কেসটার ক্ষেত্রে কমিশন কী ধরনের ভূমিকা পালন করছে?
মিজানুর রহমান: যখন মামলা বিচারাধীন, তখন কমিশনের পক্ষে করার কিছু থাকে না। তবে অনেক সময় আমরা আইনকে উপেক্ষা করে হলেও কিছু পদক্ষেপ নিই। তবে তা বিচারে প্রভাব ফেলবে সেই ধরনের তদন্ত করি না। ন্যায়বিচারের স্বার্থে তখন আমরা দাবি করি এমন একজন চিকিৎসক বা বোর্ডকে দিয়ে পোস্টমর্টেম করানো হোক, যাতে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে, সেটি চাওয়া নিশ্চয়ই আইনের লঙ্ঘন নয়। আমরা সাধারণত সেই কাজ করছি। মাহজাবীনের কেসে তেমন কিছু করেছি কি না, মনে করতে পারছি না। তবে জান্নাতি নামের মেয়েটির বেলায় করার চেষ্টা চলছে। মেয়েটি নিজেই দুর্ঘটনার শিকার। এখন তাঁকে হত্যাকারী বা হত্যায় সহায়তাকারী হিসেবে দেখানোর যে অপচেষ্টা চলছে তা জানাতে তাঁর পরিবারের সদস্যরা এসেছিলেন কমিশনের কাছে। সামনে কমিশনের সভায় সিদ্ধান্ত হবে। কমিশনের পক্ষ থেকে এ মামলাটি নিয়ে লড়াই করার সিদ্ধান্ত এলে তাঁর হয়ে আমরা আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হব।
প্রথম আলো: কমিশনের এ পর্যন্ত যত অর্জন, তা কি যথেষ্ট বলে মনে করেন?
মিজানুর রহমান: এ ক্ষেত্রে আমি গর্ব করেই বলতে পারি সীমাবদ্ধতা, জনবলের সংকট, আর্থিক সংকট, লজিস্টিক সাপোর্টের স্বল্পতার পরও আমরা যা করেছি, তা অন্য আর কারও পক্ষে করা সম্ভব না। কমিশনকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছি, যেখানে সাধারণ মানুষ যদি কোনো সংস্থার ওপর আস্থা রাখে, তো সে হচ্ছে মানবাধিকার কমিশন। তারা জানে, এখানে তাদের হয়রানি হতে হবে না। হেনস্তা হতে হবে না। পয়সা খরচ করতে হবে না। এখানে দুর্নীতির কোনো স্থান নেই। এটি সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বলেই কমিশনে অভিযোগপ্রাপ্তির সংখ্যা ৩০০ ভাগের বেশি হয়ে গেছে। অন্য কোথাও গিয়ে তারা প্রতিকার পাচ্ছে না বা প্রতিকার পাওয়ার সম্ভাবনা এতটাই ক্ষীণ যে, তারা কমিশনের কাছে অভিযোগ জানাতে বেশি স্বস্তিকর মনে করছে। একটা পরিবর্তন, তফাৎ আনতে সক্ষম হয়েছি। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সরকারি অফিস ও কর্মকর্তারাও কমিশনকে শ্রদ্ধার চোখে দেখছে। এই শ্রদ্ধার জায়গাটিকে মজবুত করতে হবে। যেন আমাদের কোনো সুপারিশ শুধু সুপারিশ হিসেবেই না থাকে। সুপারিশটা যে তাদের প্রতিপালন করতে হবে, সে জায়গাটা তৈরি করতে হবে। এখনো অনেকে ভাবছে, কমিশন বলেছে, তা আমরা করলাম না। মানলাম না।
প্রথম আলো: কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা কালক্ষেপণ করলে তা রাষ্ট্রপতিকে জানাতে পারে কমিশন...
মিজানুর রহমান: কমিশন এখন পর্যন্ত এ হাতিয়ারটি ব্যবহার করেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি বিষয়ে আমরা ১৯ বার তাগাদা দিয়েছি। এখন ক্যাবিনেট সেক্রেটারিকে লেখা হবে। সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। তার পরও যদি কাজ না হয়, তখন আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করব। আমরা ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছি। কৌশলগতভাবে কাজ করার চেষ্টা চালাচ্ছি।
প্রথম আলো: কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে আপনি প্রথম দিকে সরকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যে ভাষায় সমালোচনা করতেন, এখন আর আমরা তা দেখতে পাচ্ছি না। আপনি কী কোনো চাপের মুখে আছেন?
মিজানুর রহমান: (হেসে) সরকারের সমালোচনা করাই কমিশনের একমাত্র কাজ নয়। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ, আবার রাষ্ট্রকে আস্থায় নিয়েই কাজ আদায় করতে হয়। বিচিত্র ও অদ্ভুত ধরনের সম্পর্ক। শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক তৈরি করে পৃথিবীর কোথাও কোনো কমিশন কাজ করতে সফল হয়নি। তবে যখন সরকারের সমালোচনা করা প্রয়োজন, সাধুবাদ জানানো প্রয়োজন—সবই করা হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে আমরা এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারি না, যা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদকে উসকে দিতে পারে; যা মানবাধিকারের ক্ষেত্রে আরও বেশি হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। তাই আমাদের নানাবিধ কৌশল সামনে রেখে কাজ করতে হয়। এ ছাড়া কোনো মন্ত্রী বক্তব্য বা বক্তৃতায় আমাকে নিয়ে কিছু বললে তাঁকে আমি চাপ মনে করি না। নির্ভেজাল সত্য, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বা রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে কখনোই কোনো রকম নির্দেশ, আদেশ, অনুরোধ বা উপদেশ দিয়ে কোনো বার্তা পাঠানো হয়নি। অন্তত আমার কাছে দেয়া হয়নি; বরং উল্টোটি হয়েছে। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, আমার কাজে কেউ হস্তক্ষেপ করলে তা যেন তাঁকে জানাই। যখন দু-একজন মন্ত্রী আমার নামে মন্তব্য করেছেন, তা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, মন্ত্রীরা যেভাবে মন্তব্য করছেন, তা কমিশন বা সরকারের জন্য শুভবার্তা বহন করছে না। এতে অনেকেই মনে করতে পারেন আমাদের কাজে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। বিদেশের কাছেও ভুল বার্তা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বলেছেন, ‘মিজান, আমি কি কিছু বলেছি?’ আমি বলেছি, ‘না?’ তখন তিনি বলেছেন, ‘তুমি তোমার মতো করে কাজ চালিয়ে যাও।’ প্রধানমন্ত্রী বোঝেন, কমিশনের স্বাধীনতা কেমন থাকা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যেই তিনি লাইসেন্স দিয়েছেন। তবে জনবল সংকট, অর্থ খরচের সীমাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন বিষয় সমাধান না করে সরকার আমাদের কাজে ইনডাইরেক্টভাবে বাধা দিচ্ছে বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, তা তো বলাই যায়। তবে জনবল সংকট খুব শিগগির দূর হবে বলে আশা করছি। ২০১৫ সালে কমিশনের কাজের গতি আরও বাড়বে।
প্রথম আলো: কমিশনের বা আপনার সামনে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনটি?
মিজানুর রহমান: আমার বড় ইচ্ছা ও স্বপ্ন ছিল আমার মেয়াদেই যেন দেশব্যাপী মানবাধিকার কৃষ্টি প্রতিষ্ঠার অন্তত প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করতে পারি। এ কাজটি করতে দেশব্যাপী যে পরিমাণ সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন ছিল, তা করতে পারিনি। আমরা এখন পর্যন্ত প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি ঘরে পৌঁছাতে পারিনি। এটিই কমিশন ও আমার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রথম আলো: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মিজানুর রহমান: প্রথম আলোকেও অনেক ধন্যবাদ। গণমাধ্যমের সহায়তা ছাড়া কমিশন খুব বেশি কিছু করতে পারবে না।
No comments