বন্ধ করতেই হবে এমন আত্মঘাতী ব্যবসা by ড. বেগম জাহান আরা
ইতিহাস বলে, মানুষ বেচাকেনার ব্যবসাটা বহু পুরনো। কোনো বড় কাজে শ্রম দেয়ার জন্য জনবল না কিনলেই চলত না। অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশের মানুষদের ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহার করেছে আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়া। আরব দেশে ক্রীতদাস দিয়ে কাজ করানোর রেওয়াজ ছিল। চীনে মহাপ্রাচীর নির্মাণের সময় অগুনতি অলিখিত ক্রীতদাস শ্রম দিয়েছে। রোম সাম্রাজ্যের দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার মধ্যে মিশে আছে ক্রীতদাসের শ্রম-ঘাম-অশ্র“। আমেরিকায় নগরায়ণের কাজে ক্রীতদাসের রীতিমতো অংশীদারিত্ব থাকার কথা। ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের ইতিহাসে ভদ্র ক্রীতদাস হিসেবে আমরাও নথিভুক্ত ছিলাম একদা। ইজমের দেশে সর্বহারা নামের কাঙাল মানুষদের ক্রীতদাস ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না আমি। শ্রমের ফসল তারা রাষ্ট্রকে দিতে বাধ্য থাকত। এমনকি আমাদের দেশের পোশাক শ্রমিকরাও তো বলতে গেলে আংশিক ক্রীতদাসই। শ্রমের ফসলে তাদের কোনো অংশীদারিত্ব নেই। আমরা যে গৃহকর্মী
খাটাই, তারাও তো ক্রীতদাসের সমগোত্রীয়ই। পরিবারের ভালো-মন্দে তাদের কোনো ভাগ থাকে না বলা যায়।
তারপরও শ্রমদানের জন্য পাওয়া যায় অজস্র মানুষ। দেদার চলে আদম ব্যবসা। বিদেশে গিয়ে তাদের অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। বিনিময়ে কিছু টাকাও পায় তারা। কপাল খারাপ হলে পড়ে যায় ঠগের পাল্লায়। পেটে-ভাতে খাটে। দেশের নগণ্য সহায়-সম্পদ বিক্রি করে দালালের হাতে তুলে দেয় যে আশায়, তা মাটি হয়ে যায়। ধ্বংস হয়ে যায় পরিবার, জীবন। চোরাপথ ক্রীতদাসত্বের জন্য সমর্পিত জীবনে কখনও জোটে সলিল সমাধি। শোক তাপেরও থাকে না কেউ। আমাদের দেশের প্রায় ৭০-৮০ লাখ (টকশোতে শোনা) লোক বর্তমানে শ্রমদাস। রাজনৈতিক নেতারা তাদের শ্রমদানের টাকার গল্প করেন বুক ফুলিয়ে। তবে কোনো গল্প শোনা যায় না শ্রমদাসদের। কোনো পরিকল্পনার কথাও জানা যায় না তাদের উন্নত মানবিক জীবনযাপন নিয়ে। যেন এটাই স্বাভাবিক!
তবু বাংলাদেশের গ্রামীণ সহজ-সরল মানুষগুলো শ্রমক্রেতাদের ফাঁদে পা দেয় কিছু একটা করে আয়-রোজগারের আশায়। উন্নত জীবনযাপন পরের কথা, খেয়ে-পরে বাঁচতে চায় মানুষগুলো। জনবহুল এ দেশে গিজগিজে মানুষ। ঘাস-লতা-পাতার মতো জন্ম নিচ্ছে অপরিমাণ সংখ্যায়। খেয়ে না খেয়ে অপুষ্টি আর অসুখ-বিসুখের মধ্য দিয়ে এক সময় বড়ও হয়ে উঠছে। শিশু বয়সেই বাবা-মা তাদের ঠেলে দেয় রোজগারের জন্য। না হলে খাবে কী? আমরা দেখি কচি কচি শিশুরা বাজারের মিনতি, গ্যারেজের পিচ্চি, হোটেল-রেস্তোরাঁর পিচ্চি কখনও ফুল, বাদাম বা ভুট্টার খৈ বিক্রি করে। এসবে পেট ভরে কতটুকু, জানি না। তবে দারিদ্র্য জড়িয়ে থাকে তাদের চেহারায় ও পোশাকে। এরা যখন আরেকটু বড় হয় তখন বুঝতে পারে, এভাবে চলবে না। কিছু একটা করতে হবে। দালালরা অপেক্ষা করে থাকে এ সময়টার জন্য। তারা টোপ ফেলে। বিদেশে রোজগারের স্বপ্ন দেখায়। তার পরের কথা সব না হলেও তথ্যপ্রযুক্তির বরাতে আজকাল অনেকটাই জানা যায়। এই যেমন জানা গেল থাই জঙ্গলে বাংলাদেশী ক্রীতদাসের খবর।
প্রায় প্রতিটি দৈনিকে এবং টিভি চ্যানেলের বরাতে জানা গেছে, থাইল্যান্ডের একটি জঙ্গল থেকে ১৩০ বাংলাদেশীকে উদ্ধার করেছে থাই কর্তৃপক্ষ, যাদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রির জন্য সেখানে নেয়া হয়। ওদের ভালো চাকরির প্রলোভন দিয়ে অপহরণের পর জাহাজে করে থাইল্যান্ডে নেয়া হয়। তারপর তারা স্থান পায় নির্জন জঙ্গলে। খাওয়া নেই, ঘুম নেই, পরনে সাধারণ লুঙ্গি, গেঞ্জি, শার্ট। টিভিতে দেখা গেল অসহায়ের মতো তারা কাঁদছে। চরম অনিরাপত্তায় অসহায়বোধ করছে। কেউ কেউ দেশে ফিরে আসতেও চাইছে।
বিবিসির বরাতে জানা যায়, দক্ষিণ থাইল্যান্ডে একটি চক্র রয়েছে, যারা দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের শ্রমিকদের দিয়ে ক্রীতদাসের মতো কাজ করাচ্ছে। কাজের জায়গা হল বিভিন্ন খামার। এসব প্রাণীসদৃশ মানুষকে বাংলাদেশ ছাড়ার পর ওষুধ খাইয়ে, হাত-পা বেঁধে নৌকায় করে থাইল্যান্ড নিয়ে যাওয়া হয়। ওই নৌকায় প্রায় ৩০০ বন্দি ছিল। ওদের থাইল্যান্ডের উপকূলে জঙ্গলের মধ্যে লুকানো কিছু ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিক্রি করে দেয়া হয় দাস শ্রমিক হিসেবে (যাযাদি, ১৯.১০.১৪)। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ধরা পড়েছে ১৩০ বাংলাদেশী। বাকি ১৭০ জন তাহলে কোথায় গেল? দ্বিতীয় প্রশ্ন, বাংলাদেশ ছাড়ার পর কথাটার মানে কী? কোন পয়েন্টে ওরা বাংলাদেশ ছাড়ে? তৃতীয় প্রশ্ন, বাংলাদেশে থাই দাস ক্রেতাদের সহযোগী কারা? নিশ্চয় এ দেশেও আছে সংগঠন বা কোনো চক্র, যারা আদম বিক্রিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে। থাইল্যান্ড থেকে এসে বাংলাদেশের মাটি থেকে শত শত লোক চুরি করে নিয়ে যাওয়া তো সহজ কাজ নয়! অর্থাৎ থাইল্যান্ডে বাংলাদেশী নিরন্ন মানুষদের বিক্রি হওয়ার ঘটনায় এ দেশের দুষ্টচক্রও
নিশ্চয় জড়িত। তারা কারা? শুধু থাই দস্যু এবং মানব ক্রেতাদের কথা সামনে আনলে দাস ব্যবসার পুরো ঘটনা জানা যাবে না। বিবিসি সূত্র বলছে, পাচারকারী চক্রের হোতারা প্রভাবশালী এবং উচ্চ পর্যায়ে তাদের যোগাযোগ খুব ভালো। তারাই বা কারা?
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, থাই দালালরা বন্দি মানুষদের শুধু খাওয়া-পরার কষ্টই দেয় না, প্রচণ্ড মারধরও করে। মুক্তি পাওয়া দাসশ্রমিক আবদুর রহিম জানায়, তাদের জঙ্গলে নিয়ে রাখা হয়েছিল এবং ১০ দিন কোনো খাবার দেয়া হয়নি। তারা শুধু গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে ছিল। থাই দালালরা আবদুর রহিমকে এমনভাবে মারধর করেছে যে সে এখন ভালো করে হাঁটতে পারে না। কোনোমতে খুঁড়িয়ে চলে। এমন খবর পত্রিকায় প্রকাশের পর দেশে বা থাইল্যান্ডে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, জানি না। আমার ক্ষমতা থাকলে তাকে বিশেষ প্লেনে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতাম। ওই শ্রমিকের দল থেকে ৬০ জন নিখোঁজ। দুদেশের শাসকদের একটা জবাবদিহি এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই থাকতে হবে। নইলে অভিধান থেকে ফেলে দিতে হবে জবাবদিহি শব্দটি।
থাইল্যান্ডের কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই ছাতা ধরেছে থাইদের মাথায়। থাই দাস ক্রেতার হোতাদের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে চায় না থাই আইনশৃংখলার লোকজন। পাচারের মাধ্যমে আমদানিকৃত বাংলাদেশী ক্রীতদাস আগেও ধরেছে থাই পুলিশ প্রশাসন। তাদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে থাই জেলে পাঠানো হয়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আবার তাদের পাচারকারীদের কাছেই বিক্রি করা হয়েছিল (যাযাদি, ১৯.১৪.১০)। ঘটনাটা কি দাঁড়াল তাহলে? বাংলাদেশী মানুষগুলো থেকেই গেল থাইল্যান্ডে, কখনও জঙ্গলে বন্দি, কখনও জেল, কখনও শ্রমদাস? বাংলাদেশের কোনো মাথাব্যথা নেই ওই অসহায় পাচারকৃত ও বিক্রীত মানুষদের জন্য? কেউ খোঁজ করবে না, ওদের দেশ থেকে পাচার করতে সাহায্য করল কারা বা কেন ওরা নিজেদের জীবন বিক্রি করে দিল? শখে নিশ্চয় নয়? নিশ্চয় দারিদ্র্য? বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতি আবেদন, আপনারা কিছু করুন। মানবতার দরজায় প্রতিকার ও
প্রতিবাদের ডঙ্কা বাজান।
দেশের ভেতরেও দাস ব্যবসা তথা মানুষের শ্রম ঘণ্টা নিঃশর্তভাবে কেনার রেওয়াজ আছে। কয়েক মাস আগে এক টিভি প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে মানুষ বিক্রি হচ্ছে শ্রমদাস হিসেবে। কেউ এক সপ্তাহ, কেউ দুই সপ্তাহ বা এক মাস, কেউ বা আরও বেশি সময়ের জন্য। যারা দাস কিনবে তারা কথা বলছে দাস বিক্রেতাদের সঙ্গে। হবু দাসরা প্রাণীমাত্রের মতো নির্বাক। ওরা কথা বলতে পারে কিনা বোঝা যায়নি। পরনে শার্ট, পাজামা বা প্যান্ট। দাস ক্রেতারা মৌসুমি কোনো কাজের চাপ সামাল দেয়ার জন্য সস্তায় শ্রম কিনতে চায়। আদম ব্যবসায়ীরা নিতান্ত অসহায় মানুষদের জোগাড়ও করছে। গরু-ছাগলের মতোই তাদের প্রকাশ্যে শ্রমবাজারে তুলছে। গলায় দড়ি বাঁধা নেই, এটুকুই তফাত। সন্দেহ নেই, এ সচিত্র টিভি প্রতিবেদন দেখেছেন বহু মানুষ। কিন্তু এ নিয়ে কোনো আলোচনা বা প্রতিবাদ কিছুই হয়নি। যেন বাতাস। যেন নিউমার্কেটের মোড়ে প্রতি সকালে ডালি কোদাল ইত্যাদি নিয়ে বসে থাকা শ্রমজীবী মানুষের ঘটনার মতোই স্বাভাবিক ঘটনা। তাই কি?
এক আত্মীয় বলল, গ্রামাঞ্চলে শস্য সংগ্রহের মৌসুমে শ্রমদাস কেনা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কথাটা আমিও শুনেছি কয়েকবার। ঘরবাড়ি, সংসার, সন্তান রেখে মানুষ দাস হয়ে চলে যায় মালিকের এলাকায়। টলস্টয়ের উপন্যাসেও পেয়েছি, জমিদাররা শস্য কাটার মৌসুমে শ্রমদাস জোগাড় করত। মাঠেই তাদের কাজ, খাওয়া-দাওয়া এবং রাতের ঘুম খড়ের ওপর। সোমত্ত বা সন্তানবতী মেয়েদের শরীরও তাদের দখলে থাকত। দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে সতীত্ব-মাতৃত্ব-নারীরত্ব মিশে যেত নগণ্য ধূলিকণার সঙ্গে। সেই দিনকাল তো চলে গেছে। গেছে জমিদারি ও জমিদারদের দাপট। কিন্তু যায়নি মানবতার অপমান-লাঞ্ছনা আর নির্লজ্জ শোষণ। এখনও নাকি সচ্ছল গৃহস্থ ধানপানের মৌসুমে চুক্তি বিয়ে করে বউ আনে ঘরে। আসলে আনে শ্রমদাসী। এসব কথা তো মোটামুটি সবাই জানে। কিন্তু প্রতিকার বা প্রতিবাদের পথে পা রাখে না কেউ। না রাজনীতির নেতারা, না মানবাধিকার কর্মীরা, না শিক্ষিত বুঝমান সুশীল সমাজের ভণ্ড লোকজন। কারণ, যে দেশে অর্ধেকেরও বেশি লোক অশিক্ষার আঁধারে প্রাণীমাত্রের জীবনযাপন করে, যে দেশের কোটি কোটি শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বলে, তাদের জন্য কর্মশূন্য, মমতাশূন্য মানবতার কথা শোনাতে যাওয়ায় সাহসই নেই কারও। তাই সব জেনেও আমরা ভোন্দাগাজী সেজে বসে থাকি। হজম করি নিজেদের প্রতি নিজেদের বঞ্চনা।
পত্রপত্রিকার পাতা খুললে দেখি, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। জিডিপি বাড়ছে। ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে মানুষের। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। জিপিএ-পাঁচ পাওয়া কিশোরদের মেধার প্লাবনে ভাসছে দেশ। অবশ্যই আলোকিত মানুষেরা এমন সব ইতিবাচক প্রাপ্তিতে খুশি। তাই বলে ডিজিটাল নকল, প্রশ্ন ফাঁস, কোচিংয়ের রমরমা ব্যবসা, নগরে প্রতিদিন কয়েক কোটি শ্রমঘণ্টার নিশ্চিত অপচয় জ্যামের কারণে, হাইওয়েতে নিত্য মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনা এবং পথচারীর অপঘাত মৃত্যুকে না দেখে থাকা যায় না। লোভজনিত দুর্নীতি, খুন, অপরাধীর সাজা না হওয়া, নারী নির্যাতন, হতাশালগ্ন পারিবারিক খুন, কিশোর অপরাধ, নেশা বা ড্রাগ সম্পর্কিত অপরাধ, মানি লন্ডারিং ইত্যাদিকে ম্লান করে দিয়েছে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বন্দি অসহায় ক্রীতদাসদের পরিস্থিতি। মানবতার এমন অপমান একুশ শতকে কী করে হতে পারে?
বিশ্বাস করি, দ্বান্দ্বিকতা শুধু কোনো দার্শনিক তত্ত্বের কথা নয় বা কোনো ইজমের একচেটিয়া জ্ঞানচর্চার বিষয় নয়, জীবনের সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দই সব দ্বান্দ্বিকতার মূল। আরও বিশ্বাস করি, দেশটা সত্যিই সোনার দেশ। কী নেই এ দেশে? বিলাসের হ্যাংলামি আর দুঃখবোধের অযথা ন্যাকামি বাদ দিতে পারলেই সাধারণ এই আমরা খেয়ে-পরে মোটামুটি ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারব। পারব ভালো-মন্দের দ্বান্দ্বিকতা নিয়েই এগিয়ে যেতে। শুধু চাই সুশাসন। চাই দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। তখন সাধ্য কী এ দেশের জনসম্পদরূপী মানুষকে কেউ ক্রীতদাস হিসেবে বাজারে বিক্রি করে? আমরা ক্রীতদাস ব্যবসা চক্রে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই। আর চাই, থাইল্যান্ডের ক্রীতদাসদের দেশে ফেরত এনে পুনর্বাসনের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা। দেশেই তো কত কাজ! প্রয়োজন শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। শোষণ-বঞ্চনা নির্মূল করা। মানবতার প্রতি মানুষকে সচেতন করে তোলা। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করা। আমাদের দেশের মানুষ আমাদেরই দেশজ আত্মীয়, অন্য দেশের ক্রীতদাস হয়ে ইতর জীবনযাপন করতে পারে না কিছুতেই। বন্ধ করতেই হবে এমন হীন আত্মঘাতী ব্যবসা।
ড. বেগম জাহান আরা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, গবেষক
খাটাই, তারাও তো ক্রীতদাসের সমগোত্রীয়ই। পরিবারের ভালো-মন্দে তাদের কোনো ভাগ থাকে না বলা যায়।
তারপরও শ্রমদানের জন্য পাওয়া যায় অজস্র মানুষ। দেদার চলে আদম ব্যবসা। বিদেশে গিয়ে তাদের অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। বিনিময়ে কিছু টাকাও পায় তারা। কপাল খারাপ হলে পড়ে যায় ঠগের পাল্লায়। পেটে-ভাতে খাটে। দেশের নগণ্য সহায়-সম্পদ বিক্রি করে দালালের হাতে তুলে দেয় যে আশায়, তা মাটি হয়ে যায়। ধ্বংস হয়ে যায় পরিবার, জীবন। চোরাপথ ক্রীতদাসত্বের জন্য সমর্পিত জীবনে কখনও জোটে সলিল সমাধি। শোক তাপেরও থাকে না কেউ। আমাদের দেশের প্রায় ৭০-৮০ লাখ (টকশোতে শোনা) লোক বর্তমানে শ্রমদাস। রাজনৈতিক নেতারা তাদের শ্রমদানের টাকার গল্প করেন বুক ফুলিয়ে। তবে কোনো গল্প শোনা যায় না শ্রমদাসদের। কোনো পরিকল্পনার কথাও জানা যায় না তাদের উন্নত মানবিক জীবনযাপন নিয়ে। যেন এটাই স্বাভাবিক!
তবু বাংলাদেশের গ্রামীণ সহজ-সরল মানুষগুলো শ্রমক্রেতাদের ফাঁদে পা দেয় কিছু একটা করে আয়-রোজগারের আশায়। উন্নত জীবনযাপন পরের কথা, খেয়ে-পরে বাঁচতে চায় মানুষগুলো। জনবহুল এ দেশে গিজগিজে মানুষ। ঘাস-লতা-পাতার মতো জন্ম নিচ্ছে অপরিমাণ সংখ্যায়। খেয়ে না খেয়ে অপুষ্টি আর অসুখ-বিসুখের মধ্য দিয়ে এক সময় বড়ও হয়ে উঠছে। শিশু বয়সেই বাবা-মা তাদের ঠেলে দেয় রোজগারের জন্য। না হলে খাবে কী? আমরা দেখি কচি কচি শিশুরা বাজারের মিনতি, গ্যারেজের পিচ্চি, হোটেল-রেস্তোরাঁর পিচ্চি কখনও ফুল, বাদাম বা ভুট্টার খৈ বিক্রি করে। এসবে পেট ভরে কতটুকু, জানি না। তবে দারিদ্র্য জড়িয়ে থাকে তাদের চেহারায় ও পোশাকে। এরা যখন আরেকটু বড় হয় তখন বুঝতে পারে, এভাবে চলবে না। কিছু একটা করতে হবে। দালালরা অপেক্ষা করে থাকে এ সময়টার জন্য। তারা টোপ ফেলে। বিদেশে রোজগারের স্বপ্ন দেখায়। তার পরের কথা সব না হলেও তথ্যপ্রযুক্তির বরাতে আজকাল অনেকটাই জানা যায়। এই যেমন জানা গেল থাই জঙ্গলে বাংলাদেশী ক্রীতদাসের খবর।
প্রায় প্রতিটি দৈনিকে এবং টিভি চ্যানেলের বরাতে জানা গেছে, থাইল্যান্ডের একটি জঙ্গল থেকে ১৩০ বাংলাদেশীকে উদ্ধার করেছে থাই কর্তৃপক্ষ, যাদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রির জন্য সেখানে নেয়া হয়। ওদের ভালো চাকরির প্রলোভন দিয়ে অপহরণের পর জাহাজে করে থাইল্যান্ডে নেয়া হয়। তারপর তারা স্থান পায় নির্জন জঙ্গলে। খাওয়া নেই, ঘুম নেই, পরনে সাধারণ লুঙ্গি, গেঞ্জি, শার্ট। টিভিতে দেখা গেল অসহায়ের মতো তারা কাঁদছে। চরম অনিরাপত্তায় অসহায়বোধ করছে। কেউ কেউ দেশে ফিরে আসতেও চাইছে।
বিবিসির বরাতে জানা যায়, দক্ষিণ থাইল্যান্ডে একটি চক্র রয়েছে, যারা দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের শ্রমিকদের দিয়ে ক্রীতদাসের মতো কাজ করাচ্ছে। কাজের জায়গা হল বিভিন্ন খামার। এসব প্রাণীসদৃশ মানুষকে বাংলাদেশ ছাড়ার পর ওষুধ খাইয়ে, হাত-পা বেঁধে নৌকায় করে থাইল্যান্ড নিয়ে যাওয়া হয়। ওই নৌকায় প্রায় ৩০০ বন্দি ছিল। ওদের থাইল্যান্ডের উপকূলে জঙ্গলের মধ্যে লুকানো কিছু ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিক্রি করে দেয়া হয় দাস শ্রমিক হিসেবে (যাযাদি, ১৯.১০.১৪)। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ধরা পড়েছে ১৩০ বাংলাদেশী। বাকি ১৭০ জন তাহলে কোথায় গেল? দ্বিতীয় প্রশ্ন, বাংলাদেশ ছাড়ার পর কথাটার মানে কী? কোন পয়েন্টে ওরা বাংলাদেশ ছাড়ে? তৃতীয় প্রশ্ন, বাংলাদেশে থাই দাস ক্রেতাদের সহযোগী কারা? নিশ্চয় এ দেশেও আছে সংগঠন বা কোনো চক্র, যারা আদম বিক্রিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে। থাইল্যান্ড থেকে এসে বাংলাদেশের মাটি থেকে শত শত লোক চুরি করে নিয়ে যাওয়া তো সহজ কাজ নয়! অর্থাৎ থাইল্যান্ডে বাংলাদেশী নিরন্ন মানুষদের বিক্রি হওয়ার ঘটনায় এ দেশের দুষ্টচক্রও
নিশ্চয় জড়িত। তারা কারা? শুধু থাই দস্যু এবং মানব ক্রেতাদের কথা সামনে আনলে দাস ব্যবসার পুরো ঘটনা জানা যাবে না। বিবিসি সূত্র বলছে, পাচারকারী চক্রের হোতারা প্রভাবশালী এবং উচ্চ পর্যায়ে তাদের যোগাযোগ খুব ভালো। তারাই বা কারা?
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, থাই দালালরা বন্দি মানুষদের শুধু খাওয়া-পরার কষ্টই দেয় না, প্রচণ্ড মারধরও করে। মুক্তি পাওয়া দাসশ্রমিক আবদুর রহিম জানায়, তাদের জঙ্গলে নিয়ে রাখা হয়েছিল এবং ১০ দিন কোনো খাবার দেয়া হয়নি। তারা শুধু গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে ছিল। থাই দালালরা আবদুর রহিমকে এমনভাবে মারধর করেছে যে সে এখন ভালো করে হাঁটতে পারে না। কোনোমতে খুঁড়িয়ে চলে। এমন খবর পত্রিকায় প্রকাশের পর দেশে বা থাইল্যান্ডে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, জানি না। আমার ক্ষমতা থাকলে তাকে বিশেষ প্লেনে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতাম। ওই শ্রমিকের দল থেকে ৬০ জন নিখোঁজ। দুদেশের শাসকদের একটা জবাবদিহি এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই থাকতে হবে। নইলে অভিধান থেকে ফেলে দিতে হবে জবাবদিহি শব্দটি।
থাইল্যান্ডের কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই ছাতা ধরেছে থাইদের মাথায়। থাই দাস ক্রেতার হোতাদের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে চায় না থাই আইনশৃংখলার লোকজন। পাচারের মাধ্যমে আমদানিকৃত বাংলাদেশী ক্রীতদাস আগেও ধরেছে থাই পুলিশ প্রশাসন। তাদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে থাই জেলে পাঠানো হয়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আবার তাদের পাচারকারীদের কাছেই বিক্রি করা হয়েছিল (যাযাদি, ১৯.১৪.১০)। ঘটনাটা কি দাঁড়াল তাহলে? বাংলাদেশী মানুষগুলো থেকেই গেল থাইল্যান্ডে, কখনও জঙ্গলে বন্দি, কখনও জেল, কখনও শ্রমদাস? বাংলাদেশের কোনো মাথাব্যথা নেই ওই অসহায় পাচারকৃত ও বিক্রীত মানুষদের জন্য? কেউ খোঁজ করবে না, ওদের দেশ থেকে পাচার করতে সাহায্য করল কারা বা কেন ওরা নিজেদের জীবন বিক্রি করে দিল? শখে নিশ্চয় নয়? নিশ্চয় দারিদ্র্য? বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতি আবেদন, আপনারা কিছু করুন। মানবতার দরজায় প্রতিকার ও
প্রতিবাদের ডঙ্কা বাজান।
দেশের ভেতরেও দাস ব্যবসা তথা মানুষের শ্রম ঘণ্টা নিঃশর্তভাবে কেনার রেওয়াজ আছে। কয়েক মাস আগে এক টিভি প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে মানুষ বিক্রি হচ্ছে শ্রমদাস হিসেবে। কেউ এক সপ্তাহ, কেউ দুই সপ্তাহ বা এক মাস, কেউ বা আরও বেশি সময়ের জন্য। যারা দাস কিনবে তারা কথা বলছে দাস বিক্রেতাদের সঙ্গে। হবু দাসরা প্রাণীমাত্রের মতো নির্বাক। ওরা কথা বলতে পারে কিনা বোঝা যায়নি। পরনে শার্ট, পাজামা বা প্যান্ট। দাস ক্রেতারা মৌসুমি কোনো কাজের চাপ সামাল দেয়ার জন্য সস্তায় শ্রম কিনতে চায়। আদম ব্যবসায়ীরা নিতান্ত অসহায় মানুষদের জোগাড়ও করছে। গরু-ছাগলের মতোই তাদের প্রকাশ্যে শ্রমবাজারে তুলছে। গলায় দড়ি বাঁধা নেই, এটুকুই তফাত। সন্দেহ নেই, এ সচিত্র টিভি প্রতিবেদন দেখেছেন বহু মানুষ। কিন্তু এ নিয়ে কোনো আলোচনা বা প্রতিবাদ কিছুই হয়নি। যেন বাতাস। যেন নিউমার্কেটের মোড়ে প্রতি সকালে ডালি কোদাল ইত্যাদি নিয়ে বসে থাকা শ্রমজীবী মানুষের ঘটনার মতোই স্বাভাবিক ঘটনা। তাই কি?
এক আত্মীয় বলল, গ্রামাঞ্চলে শস্য সংগ্রহের মৌসুমে শ্রমদাস কেনা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কথাটা আমিও শুনেছি কয়েকবার। ঘরবাড়ি, সংসার, সন্তান রেখে মানুষ দাস হয়ে চলে যায় মালিকের এলাকায়। টলস্টয়ের উপন্যাসেও পেয়েছি, জমিদাররা শস্য কাটার মৌসুমে শ্রমদাস জোগাড় করত। মাঠেই তাদের কাজ, খাওয়া-দাওয়া এবং রাতের ঘুম খড়ের ওপর। সোমত্ত বা সন্তানবতী মেয়েদের শরীরও তাদের দখলে থাকত। দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে সতীত্ব-মাতৃত্ব-নারীরত্ব মিশে যেত নগণ্য ধূলিকণার সঙ্গে। সেই দিনকাল তো চলে গেছে। গেছে জমিদারি ও জমিদারদের দাপট। কিন্তু যায়নি মানবতার অপমান-লাঞ্ছনা আর নির্লজ্জ শোষণ। এখনও নাকি সচ্ছল গৃহস্থ ধানপানের মৌসুমে চুক্তি বিয়ে করে বউ আনে ঘরে। আসলে আনে শ্রমদাসী। এসব কথা তো মোটামুটি সবাই জানে। কিন্তু প্রতিকার বা প্রতিবাদের পথে পা রাখে না কেউ। না রাজনীতির নেতারা, না মানবাধিকার কর্মীরা, না শিক্ষিত বুঝমান সুশীল সমাজের ভণ্ড লোকজন। কারণ, যে দেশে অর্ধেকেরও বেশি লোক অশিক্ষার আঁধারে প্রাণীমাত্রের জীবনযাপন করে, যে দেশের কোটি কোটি শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বলে, তাদের জন্য কর্মশূন্য, মমতাশূন্য মানবতার কথা শোনাতে যাওয়ায় সাহসই নেই কারও। তাই সব জেনেও আমরা ভোন্দাগাজী সেজে বসে থাকি। হজম করি নিজেদের প্রতি নিজেদের বঞ্চনা।
পত্রপত্রিকার পাতা খুললে দেখি, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। জিডিপি বাড়ছে। ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে মানুষের। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। জিপিএ-পাঁচ পাওয়া কিশোরদের মেধার প্লাবনে ভাসছে দেশ। অবশ্যই আলোকিত মানুষেরা এমন সব ইতিবাচক প্রাপ্তিতে খুশি। তাই বলে ডিজিটাল নকল, প্রশ্ন ফাঁস, কোচিংয়ের রমরমা ব্যবসা, নগরে প্রতিদিন কয়েক কোটি শ্রমঘণ্টার নিশ্চিত অপচয় জ্যামের কারণে, হাইওয়েতে নিত্য মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনা এবং পথচারীর অপঘাত মৃত্যুকে না দেখে থাকা যায় না। লোভজনিত দুর্নীতি, খুন, অপরাধীর সাজা না হওয়া, নারী নির্যাতন, হতাশালগ্ন পারিবারিক খুন, কিশোর অপরাধ, নেশা বা ড্রাগ সম্পর্কিত অপরাধ, মানি লন্ডারিং ইত্যাদিকে ম্লান করে দিয়েছে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বন্দি অসহায় ক্রীতদাসদের পরিস্থিতি। মানবতার এমন অপমান একুশ শতকে কী করে হতে পারে?
বিশ্বাস করি, দ্বান্দ্বিকতা শুধু কোনো দার্শনিক তত্ত্বের কথা নয় বা কোনো ইজমের একচেটিয়া জ্ঞানচর্চার বিষয় নয়, জীবনের সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দই সব দ্বান্দ্বিকতার মূল। আরও বিশ্বাস করি, দেশটা সত্যিই সোনার দেশ। কী নেই এ দেশে? বিলাসের হ্যাংলামি আর দুঃখবোধের অযথা ন্যাকামি বাদ দিতে পারলেই সাধারণ এই আমরা খেয়ে-পরে মোটামুটি ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারব। পারব ভালো-মন্দের দ্বান্দ্বিকতা নিয়েই এগিয়ে যেতে। শুধু চাই সুশাসন। চাই দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। তখন সাধ্য কী এ দেশের জনসম্পদরূপী মানুষকে কেউ ক্রীতদাস হিসেবে বাজারে বিক্রি করে? আমরা ক্রীতদাস ব্যবসা চক্রে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই। আর চাই, থাইল্যান্ডের ক্রীতদাসদের দেশে ফেরত এনে পুনর্বাসনের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা। দেশেই তো কত কাজ! প্রয়োজন শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। শোষণ-বঞ্চনা নির্মূল করা। মানবতার প্রতি মানুষকে সচেতন করে তোলা। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করা। আমাদের দেশের মানুষ আমাদেরই দেশজ আত্মীয়, অন্য দেশের ক্রীতদাস হয়ে ইতর জীবনযাপন করতে পারে না কিছুতেই। বন্ধ করতেই হবে এমন হীন আত্মঘাতী ব্যবসা।
ড. বেগম জাহান আরা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, গবেষক
No comments