ব্যাংকের সিএসআরে ১৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন by হামিদ বিশ্বাস
ব্যাংকগুলোর করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে চলছে বেপরোয়া ব্যয়। গত সাড়ে ৬ বছরে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ব্যাংকগুলো। এসব ব্যয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোন নিয়ম মানা হয়নি। বরং নেয়া হয়েছে জালিয়াতির আশ্রয়। এ কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকে সাময়িক সিএসআর ব্যয় স্থগিত করে অর্থ মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে সে সময় বিরোধে জড়িয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবুল বারকাত। একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারও করেন। তবে শিগগিরই সে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এদিকে সিএসআর নিয়ে দেশের বড় মাপের অর্থনীতিবিদরাও মুখ খুলেছেন। বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সিএসআর না রাখার পক্ষে মত দেন। বলেন, যে ব্যাংক নিজে লোকসানে সে আবার অন্যের প্রতি দয়া, সাহায্য, সহযোগিতা করার অধিকার পেলো কি করে? যদি এ সব ব্যাংক লোকসান ঘুচিয়ে নিতে পারে তবেই তারা সিএসআরে অর্থ ব্যয়ে যোগ্য বিবেচিত হবে বলে মনে করেন তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো ২০০৮ সালে ৪১ কোটি, ২০০৯ সালে ৫৫ কোটি, ২০১০ সালে ২৩৩ কোটি, ২০১১ সালে ২১৯ কোটি, ২০১২ সালে ৩০৪ কোটি ও ২০১৩ সালে ৪৪৭ টাকা ব্যয় করে। এছাড়া চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যয় করা হয় আরও শত কোটি টাকার কাছাকাছি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান মানবজমিনকে জানান, দেশে সিএসআরের সঠিক ব্যবহার হয় না। আর সরকারি ব্যাংক সিএসআর বাবদ অর্থ ব্যয়ে কোন অধিকারই রাখে না। কারণ সিএসআর ব্যয় করবে তারা, যারা লাভে আছে। সরকারি ব্যাংক তো লোকসানে, কিছু দিন পরপর সরকার থেকে টাকা নিয়ে চলে। সুতরাং তাদের সিএসআর খাতে অর্থ ব্যয়ে কোন যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। প্রায় অভিন্ন কথা বললেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপর উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা মো. আজিজুল ইসলামও। তিনি মানবজমিনকে জানান, ৬ বছরে ১৩০০ কোটি টাকা বেশি নয়, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে ব্যয়ের প্রক্রিয়া নিয়ে। যেভাবে ব্যয় হচ্ছে তা তো সঠিক নয়। সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। তবে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের জন্য পৃথক নীতিমালার পক্ষে তিনি। সরকারি ব্যাংক লাভে না আসা পর্যন্ত সিএসআর তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, তা নীতিমালায় উল্লেখ থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি। অভিযোগ উঠেছে- স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবে এ খাতের বেশির ভাগ অর্থ রাজনৈতিক তদ্বিরে ব্যয় হচ্ছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ এ অর্থ ব্যাংকের পরিচালকদের মনোতুষ্টিতে নির্দিষ্ট অঞ্চল ও প্রভাবশালীদের খেয়ালখুশিমতো ব্যয় করা হয়। আর তহবিল ব্যয়ে কোন নিয়ম-নীতি না থাকায় বারবার সতর্ক করেও পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে যে উদ্দেশ্যে সিএসআর কর্মসূচি শুরু করা হয়েছিল, তা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতার তহবিল ব্যয়ে ব্যাপক হারে রাজনীতিকরণ চলছে। সেই সঙ্গে লোকদেখানো বা ব্যক্তিগত প্রচারণায় সিএসআরের অর্থ ব্যয় করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত ব্যাংকের প্রভাবশালীরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এখানে ব্যাপক হারে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। এতে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা তুলনামূলক কম উপকৃত হচ্ছেন। তিনি জনগণের অর্থের অপব্যবহার ঠেকাতে সিএসআর ব্যয়ে আরও জবাবদিহি ও কাঠামো সুসংহত করার আহ্বান জানান। সঙ্গে এও বলেন, প্রয়োজনে সরকারি ব্যাংকে সিএসআর বন্ধ করা যায়। কারণ, তারা ধার-কর্জে চলে। সিএসআর দেয়ার প্রয়োজন নিয়ে প্রশ্ন তুলেন তিনি। তবে তাদের ভাল অবস্থা ফিরে এলে আবার চালু হতে পারে। ড. সালেহ উদ্দিন আরও বলেন, সিএসআর ব্যয়ে স্বচ্ছতা রাখতে হবে, নিয়মিত অডিট করতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলো খুবই উদাসীন। সিএসআর তহবিল ব্যয়ে খাতভিত্তিক সীমা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি নীতিমালা করার পরামর্শও দেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সালে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, দারিদ্র্য বিমোচনকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যাংকিং খাতে সিএসআর যাত্রা শুরু করা হয়েছিল। এ খাতের আওতায় শুধু অনুদান নয় বরং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে স্বল্পসুদে ঋণ বিতরণের কর্মসূচি নেয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের প্রভাবশালীরা এ তহবিলকে নিজের খেয়ালখুশিমতো ব্যবহার করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ফেলেছেন। সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংক সিএসআরের নামে ভ্রমণ, পাঁচতারা হোটেলের আপ্যায়ন বিল, পত্রিকার বিজ্ঞাপন বিল, উদ্দেশ্যমূলক পুরস্কার বিতরণ প্রভৃতিতে ব্যয় করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমনও দেখা গেছে, তিন লাখ টাকা শিক্ষাবৃত্তি বিতরণের অনুষ্ঠান বিলাসবহুল হোটেলে আয়োজনের জন্য ১৬ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা যায়, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক সিএসআর কার্যক্রমের নামে যে ধরনের কাজে অর্থ দিয়েছে সেগুলোর অনেকটাই সিএসআর খাতভুক্ত নয়। বিশেষত দেশে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কয়েকটি জেলা সমিতিকে প্রদত্ত অনুদান, ব্যাংকের সিবিএ’র বার্ষিক বনভোজনে ব্যয়িত অর্থ, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চকে দেয়া অর্থ এবং ব্যাংকের দৈনন্দিন কল্যাণমূলক ও বিজ্ঞাপন ব্যয় সিএসআর খাতে দেখানো হয়েছে। সিএসআর খাতভুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও হাতিরঝিল প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় (স্পন্সর) অর্থ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দেয়া অনুদান এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন, শহীদ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ, গণকবর সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়ন প্রভৃতি কমিটিকে দেয়া টাকার সদ্ব্যবহার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশয় রয়েছে। পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, অগ্রণী ব্যাংকের ইসলামী উইং পরিচালনার জন্য ইসলামী শরিয়াহ বোর্ডকে অর্থ দেয়া হয়েছে, অথচ তা সিএসআরভুক্ত নয়। আবার বিভিন্ন প্রচার কার্যক্রমে ব্যয়ের অর্থও সিএসআর খাতে দেখানো হচ্ছে। জনতা ব্যাংক বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠনকে প্রচারের জন্য দেয়া অর্থ এ খাতে দেখিয়েছে। এ বিষয়ে এক অনুষ্ঠানে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেছিলেন, দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের সিএসআর কার্যক্রমের টাকা ভিন্ন খাতে চলে যাচ্ছে। এ টাকার একটি বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে ব্যাংকটির সিবিএ নেতাদের কল্যাণে। ২০১৩ সালের সিএসআর কার্যক্রমের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শনে দেখা যায়, বেশির ভাগ ব্যাংক সিএসআর খাতে ইচ্ছামতো ব্যয় করছে। মোট সিএসআর ব্যয়ের ৩০ শতাংশ শিক্ষা উপখাতে ব্যয় করার নির্দেশনা থাকলেও বেশির ভাগ ব্যাংক শিক্ষায় অর্ধেকও ব্যয় করছে না। শিক্ষা খাতে ব্যাংকের প্রত্যক্ষ অনুদান অনেক কম। অর্থাৎ সিএসআরের একটি মূল উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সমাজের সুবিধা-বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উপকৃত হচ্ছে না। গত পাঁচ বছরে সিএসআর খাতে ব্যাংকগুলোর ব্যয় বেড়েছে আট গুণ। ২০০৮ সাল শেষে এ খাতে মোট ব্যয় হয়েছিল মাত্র ৪১ কোটি টাকা। ২০১৩ সাল শেষে ব্যাংকগুলোর ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪৭ কোটি টাকা। বিস্ময়করভাবে লোকসানে থাকা ব্যাংকগুলোও সিএসআর খাতে যথেচ্ছ ব্যয় করে যাচ্ছে। অনেক সময় উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর কাড়া এবং পরিচালকদের মনোতুষ্টি। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা কোন ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা প্রভাবশালী পরিচালকের এলাকায় বেশি পরিমাণে সিএসআর অর্থ দিচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির কারণে সরকার ৪১০০ কোটি টাকা মূলধন যোগান দিয়েছে। এদিকে নীতিমালা না থাকায় এমনটা হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশিষ্ট বিভাগের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, নিট মুনাফা থেকেই সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। তবে নীতিমালা না থাকায় লোকসানে থাকা ব্যাংকও এ কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। তিনি জানান, নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে- যাতে লোকসানে থাকা ব্যাংক সিএসআর কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে না বলে উল্লেখ থাকবে। তবে অনুমতি নিয়ে লোকসানে থাকা ব্যাংক ছোট আকারে সিএসআর কার্যক্রম চালাতে পারবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ক্রীড়া-সংস্কৃতি ও পরিবেশ উন্নয়নে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতা রয়েছে। মানবিক তাগিদে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের যেকোন দুর্যোগে ব্যাংকগুলোকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানায়। ব্যাংকগুলো রাষ্ট্রের ত্রাণ তহবিলসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফান্ডে অর্থ দিয়ে আসছে। তবে ব্যাংকের প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তিরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো অর্থ ব্যয় করছেন। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সিএসআর কর্মসূচির আওতায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিট মুনাফার আড়াই শতাংশ ব্যয়ের একটি নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মানবজমিনকে জানান, সিএসআর নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। মানুষের মনে বিষয়টি যথেষ্ট সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষেত্রে দু’টো করণীয় হতে পারে। প্রথমত বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত এ খাতে যত টাকা ব্যয় হয়েছে তার ওপর একটা তদন্ত চালাতে পারে। তাতে নির্ণয় হবে প্রকৃত সিএসআর। দ্বিতীয়ত সিপিডিসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান খাতটির ওপর গবেষণা চালাতে পারে। যা গবেষণার একটা উত্তম বিষয় বলে মনে করেন তিনি। এতে সিএসআর খরচের নানা দিক, প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি বেরিয়ে আসবে। তিনি বলেন, খাতটির মাধ্যমে শুধু যে অনিয়ম হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়, বরং এর ভাল দিকও রয়েছে। অনেক ব্যাংক শিক্ষা খাতেও খরচ করেছে। সব মিলিয়ে অনিয়মের অংশটুকু বাদ দিলে এ খাতে ভাল সুফলও দেখছেন তিনি।
No comments