কার প্রতিনিধি তুমি শিশু? by জুবাইদা গুলশান আরা
ছবিটা আমাকে ডাক দিলো। সে এক সুতীব্র মমতার তৃষ্ণায় হাতছানি দিলো আমাকে। শিশুটি একটি মুখ নয় শুধু। তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে যে অশ্রু, তা আমার হাত ছুঁয়ে গেল। একেবারে স্পষ্ট চোখের জল, যার স্পর্শে আমি শিউরে উঠলাম। আমার নিজের হৃদয় থেকে ডুকরে উঠল কান্নার হাহাকার। মরুভূমির লু হাওয়া কাঁপিয়ে দিলো আমার অনুভূতি।
হ্যাঁ, সে এই বিশ্বেরই শিশু; কিন্তু বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে তোলার মহৎ প্রতিজ্ঞা আজো অর্জিত হয়নি। রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি, ক্ষমাহীন অধিকারবোধ বিশাল এক যুযুধান লৌহরাক্ষস হয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি স্কুল, হাসপাতাল পর্যন্ত।
একসময় আমরা ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দেখেছি, কী এক বিরূপতা আর ঘৃণার শিকার হয়ে শত শত শিশু এবং মানুষকে হত্যা করে দিলো নাৎসি সেনারা। শুনেছি অসহায় মানবতার গুমরে গুমরে কান্না। ডায়েরি অব অ্যানি ফ্রাঙ্ক নামে একটি বই, দ্য বয় ইন ব্লু পাজামা বইগুলো পড়ে সন্দেহ জাগে, মানুষ কিভাবে কোন কারণে শিশুদের প্রতি এত ভয়ানক নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল? যে হত্যার মহাযজ্ঞ এখন সারা পৃথিবীকে আতঙ্কে ম্রিয়মাণ করেছিল, তার পেছনে ছিল জাতিগত বিদ্বেষ, রাজনৈতিক আকাক্সা এবং ক্ষমতার চূড়ান্ত অহমিকা।
এভাবেই ভয়ঙ্কর ঘৃণা ও নিষ্ঠুর মানুষ হত্যার এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস তখন সৃষ্টি করেছিল নাৎসি বাহিনী, যা ইতিহাসের পাতায় এক মর্মন্তুদ স্মৃতিকাতর অধ্যায় হয়ে আছে। দুঃখের বিষয় এই যে, পৃথিবীতে দেশে দেশে এ ধরনের মৃত্যু ও যুদ্ধের ইতিহাস যুগের পর যুগ ধরে চলেছে। সবচেয়ে দুর্বল ও নাজুক জীবনধারাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে পৃথিবীর যুদ্ধে মেতে ওঠা শক্তিগুলো।
আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডÑ বসনিয়া হারজেগোভিনা, সেব্রেনিৎস্কায় ঘটে গেছে মৃত্যুর তাণ্ডব। চোখের পানি আর রক্ত স্রোতে ভেসে গেছে অগণিত শিশুর প্রাণ। আমরা বিশ্বের মানুষেরা সে অন্যায় মৃত্যু জেনে বিচলিত ও ব্যথিত হয়েছি। কবি, সাহিত্যিক ও সংবেদনশীল মানুষ তাদের লেখনীর মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন অন্যায় মৃত্যুর প্রতিবাদ; কিন্তু পৃথিবীটা মৃত্যুর নির্লজ্জ অনাচার থেকে রক্ষা করতে পারেনি সুন্দর ফুলের মতো শিশুদের। বাঁচাতে পারেনি নিষ্পাপ মানুষের ঘর গেরস্থি।
এই সময়ে আরো মৃত্যুর প্রেতমূর্তি কালো ছায়া ফেলেছে ইরাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে ধর্ম ও বিরুদ্ধতা এসে যোগ দিয়েছে। মানুষকে তার নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার তারা নিষিদ্ধ করে দিতে সর্বদা প্রস্তুত।
ইতিহাস বলে, ১৯৪০ সালে বিখ্যাত লাহোর প্রস্তাব আসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিষয়ে। ওই সময়ে অবিভক্ত ভারত স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছিল। সেই সাথে মুসলমানের জন্য আলাদা ভূখণ্ড জন্ম নেবে এই আকাক্সা নিয়ে বিশ্বের মুসলিম নেতৃবৃন্দ আলাপ-আলোচনা করছিলেন। প্যালেস্টাইন তথা ফিলিস্তিন নামের মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বিষয়ে পিএলও ও তথা প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফোর্সের প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসির আরাফাত তার জীবনের সবটুকু শক্তি নিয়োজিত করেছিলেন ফিলিস্তিনের জন্য; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আরব দেশগুলো যেমন এ বিষয়ে এগিয়ে আসেনি তেমনই বিশ্বনেতাদের ভিন্ন মতের কারণে ফিলিস্তিনের নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধাবস্থা থেকে মুক্তি পায়নি ফিলিস্তিন। ইসরাইল একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তার স্বীকৃতি পায়নি।
জাতিসঙ্ঘের সহযোগিতা বা বিশ্বকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাজ্যের শর্ত তার কাক্সিত অবস্থানে নিয়ে আসার আগেই ইয়াসির আরাফাত মৃত্যুবরণ করেন। কেন যেন তার স্বপ্ন, যুদ্ধ থেকে মুক্ত একটি স্বাধীন মুসিলম রাষ্ট্রকে তার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ দিতে কেউ দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেনি তার অধিকারের বিষয়টি বরং ১৯৭০ সালে জর্ডানে ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে জর্ডানের সৈন্যরা ভয়াবহ অভিযান চালায়। সেই অভিযানে কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জাতিসঙ্ঘের নির্দেশও মাঝে মধ্যেই উপেক্ষিত হয়। কারণ ইসরাইল গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনের নিশ্চিন্তে নিরাপদ অবস্থানগুলোতে কিছু দিন পরপরই হামলা চালিয়ে আসছে।
সাধারণভাবে দেখা যায়, গাজায় বাস করছে লাখ লাখ মুসলমান; কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই যে, তাদের চিন্তা, কর্মকাণ্ড কোনো কিছুই যেন গ্রহণযোগ্য নয়। ইসরাইলের কাছে অপাঙক্তেয় অর্থহীন। ২০০৯ সালে গাজায় চারজন ইসরাইলি কিশোর নিহত হয়। সাথে সাথে গাজার ওপর নেমে আসে প্রতিশোধের খড়গ। অন্তহীন এ আক্রমণ আজকে ২০১৪ সাল অবধি চলছে। এমনকি জাতিসঙ্ঘের নির্দেশ সত্ত্বেও নয়। এই মৃত্যু ও ধ্বংস অমানবিক হলেও যারা ফিলিস্তিনিদের জীবন চায়, তাদের কাছে অকিঞ্চিৎকর।
কেন এত কষ্ট মানুষের? এই দুঃখজনক প্রশ্নটির উত্তর কে দেবে?
চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফুলের মতো মেয়েটির বেদনা বিষাদে আঁকা মুখ যে শত শত নিরুচ্চারিত প্রশ্ন নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কী উত্তর দেবো ওকে?
হ্যাঁ, এ কথা সত্যি যে, ইংল্যান্ডের বড় শহর লন্ডনে ইসরাইলি দূতাবাসের সামনে শত শত মানুষ জমায়েত হয়ে ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। সেখানে সব সমাজের পৃথিবীর সব দেশের মানুষ নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, কবিরা কবিতায় শোনাচ্ছেন নির্যাতিত মানুষের কথা। সর্ব সমাজের মানুষ আজ গাজার মৃত্যুউপত্যকার যন্ত্রণা নিয়ে দাবি করছেন যুদ্ধ বিরতির। ধর্ম বর্ণ জাতির বিভক্তি সত্ত্বেও তাদের দাবি এক। মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধ করা হোক। এক সময়ে মুসলিম দেশগুলো এ বিষয়ে একমত হয়ে এই সবলের অত্যাচার বন্ধ করার কথা জাতিসঙ্ঘে তুলে এনেছিল; কিন্তু কোনো রহস্যজনক কারণে আবার যুদ্ধের তীব্র আক্রমণে ধ্বংস হয় ফিলিস্তিনি জনপদ।
মনে কেবলই প্রশ্ন জাগে, কেন এই আগ্রাসন? এক দিকে স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবি, অন্য দিকে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য না করে নিষ্ঠুর ইসরাইলের আক্রমণ। জানা যায়, এবারের অপ্রতিহত আক্রমণে এক হাজার ৫০০ শিশু এতিম হয়েছে। এটি জাতিসঙ্ঘের হিসাব ও সরকারি হিসাবে ২ হাজার ১৬০ ফিলিস্তিনি নিহত ও ১১ হাজার আহত হয়েছেন। প্রায় অর্ধেক গাজাবাসী বাস্তুহারা হন। হাজার হাজার ঘর, মসজিদ, হাসপাতাল ও সমাধি বিধ্বস্ত হয়।
জাতিসঙ্ঘের পরিসংখ্যান মতে, অপারেশন প্রটেকটিভ এজ নামের অভিযানের ফলে গাজায় নতুন করে ১৫০০ শিশু এতিম হয়।
কিছু দিন আগে সংবাদপত্রে দেখেছি পাঁচ বছরের একটি শিশু ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে দু’হাতে তার ছোট বোনটিকে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করছে। ছয় বছরের মধ্যে তিনবার ইসরাইল গাজায় বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে। গাজার একমাত্র বড় এতিমখানা পরিবার হারানো নিঃসঙ্গ শিশুদের আশ্রয় দিচ্ছে, যতœ নিচ্ছে; কিন্তু সেখানেও হামলা হয়। সে হামলায় একজন নিহত হয়, অন্যজন হয় আহত। আমির হামাদ নামের একটি শিশুর কথা জানতে পারি। চার ভাইবোন ও বাবা-মায়ের সাথে তারা বাস করত। বাবা-মা সকালের নাশতার পরে কফি পান করছিলেন। এমন সময় একটি রকেট এসে পড়ে। আমিরের শিশু ভাইটি রক্তে ভাসছিল। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বাকি কয় ভাইবোন অলৌকিকভাবে রক্ষা পায়। এখন তারা দাদা-দাদীর সাথে বাস করছে। আমির জানে, বাবা-মা আর কোনো দিন ফিরে আসবেন না। তাই বেঁচে থাকার সাথে সাথে ভাইবোনদের কথাও তাকে ভাবতে হবে।
আশ্চর্য বিষয় এই যে, যে শিশুদের নিয়ে বিশ্বমানবতা স্বপ্ন দেখায় এবং স্বপ্ন দেখে, সেই শিশুদের নিয়ে ইসরাইলের নিষ্ঠুরতা অীচন্তনীয়। প্রতি মুহূর্ত মৃত্যুই তাদের নিকটতম প্রতিবেশী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের সহায়তা দিতে এগিয়ে আসেন যারা, তাদেরও জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কতটুকু? মানুষের পৃথিবীর মূল যুদ্ধ কী নিয়ে? ক্ষমতার লড়াই। আর সেই যুদ্ধকে উপলক্ষ করেই এক পক্ষ অন্য পক্ষকে উচ্ছেদ করতে যুদ্ধ লাগায়। এর পেছনে জোরালো যুক্তি কেবল তাদেরই হাতে। শক্তির প্রদর্শন। তা না হলে কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উপলক্ষ করে হিরোসিমা-নাগাসাকির ঘটনা ঘটত? কিন্তু মানুষের মনে যদি ঘৃণা আর ক্ষমতার এত তীব্র ও তীè সহাবস্থান না থাকত, তবে এত রক্তস্রোতে ভাসত না দুর্বল দেশগুলো। সম্প্রতি আবারো প্রতিবেশী দুর্বল দেশগুলো এভাবেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে চলেছে আর তার শিকার বিশেষ করে শিশুরা। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীজুড়ে শিশু অধিকার বজায় রাখার পক্ষে এত সমাবেশ, এত সহানুভূতি, এত আয়োজন তার অংশীদার হিসেবে যেকোনো দেশ গর্বিত হতে পারে; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সত্য স্বীকার করার সততা যদি থাকে, তাহলে নির্মম নিষ্ঠুরতার বহু চিত্রই বেরিয়ে আসবে, যা লক্ষ্য করে হৃদয়বান মানুষ হতবাক হয়ে যাবেন।
যুদ্ধাবস্থা অথবা শান্তির সময়েও আমরা জাতিসঙ্ঘকে পাই সঙ্কট নিরসনের সহায়ক হিসেবে। যেমনটি ঘটছে গাজা উপত্যকায়। জাতিসঙ্ঘের সহায়তায় এতিম শিশুদের জন্য আশ্রয় ও বড় হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে জাতিসঙ্ঘ। মিডল ইস্ট মনিটর থেকে জানা যায়, বিসান দাবের নামে আট বছরবয়সী শিশুটি জানে না তার অপরাধ কী। তবুও সে এক আক্রমণে সবাইকে হারায়। শিশুটি বলে, আমাদের কাছে রকেট ছিল না। তবু আমার মা-বাবা ও সব ভাইবোন বেহেশতে চলে গেছেন। ইসরাইলি হামলার পরে সে ছয় ঘণ্টা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়েছিল। হাসপাতালকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারি, এই শিশুটিও সবাইকে হারিয়েছে। ব্যাপারটা এমনভাবে ঘটেছে যে, শোকদীর্ণ শিশুরা কাঁদে না, চিৎকার করে না। নিরাসক্তভাবে ঘটনাটা শ্রোতাকে বর্ণনা করে। থেকে থেকে ভয়ে-আতঙ্কে তার ভেতরটা কেঁপে ওঠে। তার মতো কয়েক লাখ শিশু এখন গাজায়। মা-বাবা হারানো এই এতিমদের বোবা কান্নায় আকাশও যেন ভারী হয়ে আছে।
এসব শিশু যখন সময়ের নিয়মে বড় হয়ে উঠবে, তখন কি তার ভেতরে এক ভীত, আতঙ্কিত একজন মানুষ জন্ম নেবে না? কোনো দিন কি এই শিশুরা প্রতিশোধস্পৃহায় ফুঁসে উঠবে না? সে কি প্রশ্ন করবে না, স্বাধীন দেশের জন্য আশা আর স্বপ্ন তৈরি করা কি অপরাধ? আমার মনে পড়ে ছেলেবেলায় মহররমের মিছিলে শিয়া সম্প্রদায় বিশাল শোকমিছিল বের করত। দুই হাতের অস্ত্র দিয়ে নিজেদের গায়ে আঘাত করত। সাথে থাকত দুলদুল ঘোড়া, যার সারা গায়ে আঁকা হতো অসংখ্য তীর। ইমাম হাসান, ইমাম হোসেন রাসূলুল্লাহ সা:-এর দৌহিত্র। দুই শহীদ ভাইয়ের স্মরণে এই তাজিয়া মিছিলে লোকের মাতম উঠত। ইতিহাসের এক দূরপনেয় কলঙ্কিত বেদনাবিধূর কাহিনীর স্মরণে মানুষ আহাজারি তোলে আজো। মূল কথা হলো, ক্ষমতার লড়াইয়ে নিষ্পাপ দুই তরুণ ভাইয়ের মৃত্যু মানুষ চিরকাল স্মরণ করে। অমর করে রেখে আজো শোকার্ত স্মৃতির কাছে মানুষকে ফিরিয়ে আনে।
এই মুহূর্তে ইতিহাসকে উপেক্ষা করে গাজায় ঘটে চলেছে হত্যার উৎসব। আমাদের হৃদয় যত আঘাতে বিদীর্ণ হোক, হত্যাকারীর হৃদয় তাতে দ্বিধাগ্রস্ত হবে না। শিশু হত্যার বিক্ষোভে ফেটে পড়লেও ইতিহাসের তাতে ভ্রƒক্ষেপ নেই। ‘শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা’,বলে কবির কলম যতই ফুঁসে উঠুক, ফেলানীর মৃত্যুর মতোই তার সুবিচার পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘকাল।
আজ তাই বিশ্ববিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখতে হয়Ñ কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন? সোনার শিশুদের এতিম করে ‘রোখে মানুষের দাবি’ এর উত্তর খুঁজে পাই না। তবু শিশুদের অশ্রু লাঞ্ছিত অসহায় মৃত্যু, অসহায় আত্মসমর্পণ থেকে একদিন হয়তো গর্জে উঠবে প্রতিশোধের আগুনে পোড়া এক হিংস্র নবীন জনপদ। তারা মোকাবেলা করবে নিষ্ঠুরতার সাথে নিষ্ঠুরতার অস্ত্র নিয়ে। অথবা মার খেতে খেতে প্রতিরোধহীন অসহায় মানবিকবোধ থেকে জেগে উঠবে ঘৃণার অস্ত্র। মানুষ ও সভ্যতার নিত্যনতুন অহমিকার মুখোমুখি দাঁড়াবে সে। বলবে, ‘যদি আমার কবিতা পরিশ্রমী শ্রমিকের হাতে হাতুড়ি এবং মুজাহিদের মুঠোয় বোমা হয়ে যায়।’ (ফিলিস্তিনি কবি দারবিশের লেখা থেকে নেয়া)
পৃথিবীতে যুগে যুগে, হাজার হাজার বছর ধরে সভ্যতা এসেছে রক্তস্রোত ও অগ্নিদাহকে ক্ষমতার সঙ্গী করে। গাজার নির্মম ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই ইতিহাস, যা মুখে বলেÑ ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ আর অসহায় মানুষ তাদের হাতেই মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। তাই বলতে হয়, সারা বিশ্ব কি ক্ষমা করবে এই হন্তারকদের, যারা মানবসভ্যতার সবচেয়ে অসহায় প্রজাতিকে হাসতে হাসতে তুলে দেয় মৃত্যুর হাতে? এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবার পবিত্র অঙ্গীকারকে পরিহাস করে?
কামনা করি, জেগে উঠকু বিবেক, মানুষ যেন বলতে পারে, ‘আমরা চোখ মেলে আর শিশুহত্যার নারকীয়তা দেখতে চাই না। ওরা কেন ওদের অজান্তে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ভোগ করবে?
সারা বিশ্বের শিশুদের কথা আজ নতুন করে ভাবতে হবে।
শত্রুর হাতে জীবনধ্বংসী যে অভিশাপ এই নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করছে, সারা বিশ্বের শিশুদের কথা মনে রেখে কামনা করিÑ আর নয় হিরোশিমা, আর নয় নাগাসাকি, আর নয় হত্যার মহোৎসব। শিশুদের কথা মনে রেখে গড়ে তুলি নতুন বিশ্ব, যেখানে ওরা মানুষ হওয়ার জন্য জায়গা পাবে। আজ জেগে উঠুক বিশ্বমানবতা। প্রতিরোধ সৃষ্টি করুক অন্যায় নরধম যজ্ঞের বিরুদ্ধে।
হ্যাঁ, সে এই বিশ্বেরই শিশু; কিন্তু বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে তোলার মহৎ প্রতিজ্ঞা আজো অর্জিত হয়নি। রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি, ক্ষমাহীন অধিকারবোধ বিশাল এক যুযুধান লৌহরাক্ষস হয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি স্কুল, হাসপাতাল পর্যন্ত।
একসময় আমরা ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দেখেছি, কী এক বিরূপতা আর ঘৃণার শিকার হয়ে শত শত শিশু এবং মানুষকে হত্যা করে দিলো নাৎসি সেনারা। শুনেছি অসহায় মানবতার গুমরে গুমরে কান্না। ডায়েরি অব অ্যানি ফ্রাঙ্ক নামে একটি বই, দ্য বয় ইন ব্লু পাজামা বইগুলো পড়ে সন্দেহ জাগে, মানুষ কিভাবে কোন কারণে শিশুদের প্রতি এত ভয়ানক নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল? যে হত্যার মহাযজ্ঞ এখন সারা পৃথিবীকে আতঙ্কে ম্রিয়মাণ করেছিল, তার পেছনে ছিল জাতিগত বিদ্বেষ, রাজনৈতিক আকাক্সা এবং ক্ষমতার চূড়ান্ত অহমিকা।
এভাবেই ভয়ঙ্কর ঘৃণা ও নিষ্ঠুর মানুষ হত্যার এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস তখন সৃষ্টি করেছিল নাৎসি বাহিনী, যা ইতিহাসের পাতায় এক মর্মন্তুদ স্মৃতিকাতর অধ্যায় হয়ে আছে। দুঃখের বিষয় এই যে, পৃথিবীতে দেশে দেশে এ ধরনের মৃত্যু ও যুদ্ধের ইতিহাস যুগের পর যুগ ধরে চলেছে। সবচেয়ে দুর্বল ও নাজুক জীবনধারাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে পৃথিবীর যুদ্ধে মেতে ওঠা শক্তিগুলো।
আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডÑ বসনিয়া হারজেগোভিনা, সেব্রেনিৎস্কায় ঘটে গেছে মৃত্যুর তাণ্ডব। চোখের পানি আর রক্ত স্রোতে ভেসে গেছে অগণিত শিশুর প্রাণ। আমরা বিশ্বের মানুষেরা সে অন্যায় মৃত্যু জেনে বিচলিত ও ব্যথিত হয়েছি। কবি, সাহিত্যিক ও সংবেদনশীল মানুষ তাদের লেখনীর মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন অন্যায় মৃত্যুর প্রতিবাদ; কিন্তু পৃথিবীটা মৃত্যুর নির্লজ্জ অনাচার থেকে রক্ষা করতে পারেনি সুন্দর ফুলের মতো শিশুদের। বাঁচাতে পারেনি নিষ্পাপ মানুষের ঘর গেরস্থি।
এই সময়ে আরো মৃত্যুর প্রেতমূর্তি কালো ছায়া ফেলেছে ইরাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে ধর্ম ও বিরুদ্ধতা এসে যোগ দিয়েছে। মানুষকে তার নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার তারা নিষিদ্ধ করে দিতে সর্বদা প্রস্তুত।
ইতিহাস বলে, ১৯৪০ সালে বিখ্যাত লাহোর প্রস্তাব আসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিষয়ে। ওই সময়ে অবিভক্ত ভারত স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছিল। সেই সাথে মুসলমানের জন্য আলাদা ভূখণ্ড জন্ম নেবে এই আকাক্সা নিয়ে বিশ্বের মুসলিম নেতৃবৃন্দ আলাপ-আলোচনা করছিলেন। প্যালেস্টাইন তথা ফিলিস্তিন নামের মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বিষয়ে পিএলও ও তথা প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফোর্সের প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসির আরাফাত তার জীবনের সবটুকু শক্তি নিয়োজিত করেছিলেন ফিলিস্তিনের জন্য; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আরব দেশগুলো যেমন এ বিষয়ে এগিয়ে আসেনি তেমনই বিশ্বনেতাদের ভিন্ন মতের কারণে ফিলিস্তিনের নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধাবস্থা থেকে মুক্তি পায়নি ফিলিস্তিন। ইসরাইল একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তার স্বীকৃতি পায়নি।
জাতিসঙ্ঘের সহযোগিতা বা বিশ্বকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাজ্যের শর্ত তার কাক্সিত অবস্থানে নিয়ে আসার আগেই ইয়াসির আরাফাত মৃত্যুবরণ করেন। কেন যেন তার স্বপ্ন, যুদ্ধ থেকে মুক্ত একটি স্বাধীন মুসিলম রাষ্ট্রকে তার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ দিতে কেউ দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেনি তার অধিকারের বিষয়টি বরং ১৯৭০ সালে জর্ডানে ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে জর্ডানের সৈন্যরা ভয়াবহ অভিযান চালায়। সেই অভিযানে কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জাতিসঙ্ঘের নির্দেশও মাঝে মধ্যেই উপেক্ষিত হয়। কারণ ইসরাইল গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনের নিশ্চিন্তে নিরাপদ অবস্থানগুলোতে কিছু দিন পরপরই হামলা চালিয়ে আসছে।
সাধারণভাবে দেখা যায়, গাজায় বাস করছে লাখ লাখ মুসলমান; কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই যে, তাদের চিন্তা, কর্মকাণ্ড কোনো কিছুই যেন গ্রহণযোগ্য নয়। ইসরাইলের কাছে অপাঙক্তেয় অর্থহীন। ২০০৯ সালে গাজায় চারজন ইসরাইলি কিশোর নিহত হয়। সাথে সাথে গাজার ওপর নেমে আসে প্রতিশোধের খড়গ। অন্তহীন এ আক্রমণ আজকে ২০১৪ সাল অবধি চলছে। এমনকি জাতিসঙ্ঘের নির্দেশ সত্ত্বেও নয়। এই মৃত্যু ও ধ্বংস অমানবিক হলেও যারা ফিলিস্তিনিদের জীবন চায়, তাদের কাছে অকিঞ্চিৎকর।
কেন এত কষ্ট মানুষের? এই দুঃখজনক প্রশ্নটির উত্তর কে দেবে?
চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফুলের মতো মেয়েটির বেদনা বিষাদে আঁকা মুখ যে শত শত নিরুচ্চারিত প্রশ্ন নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কী উত্তর দেবো ওকে?
হ্যাঁ, এ কথা সত্যি যে, ইংল্যান্ডের বড় শহর লন্ডনে ইসরাইলি দূতাবাসের সামনে শত শত মানুষ জমায়েত হয়ে ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। সেখানে সব সমাজের পৃথিবীর সব দেশের মানুষ নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, কবিরা কবিতায় শোনাচ্ছেন নির্যাতিত মানুষের কথা। সর্ব সমাজের মানুষ আজ গাজার মৃত্যুউপত্যকার যন্ত্রণা নিয়ে দাবি করছেন যুদ্ধ বিরতির। ধর্ম বর্ণ জাতির বিভক্তি সত্ত্বেও তাদের দাবি এক। মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধ করা হোক। এক সময়ে মুসলিম দেশগুলো এ বিষয়ে একমত হয়ে এই সবলের অত্যাচার বন্ধ করার কথা জাতিসঙ্ঘে তুলে এনেছিল; কিন্তু কোনো রহস্যজনক কারণে আবার যুদ্ধের তীব্র আক্রমণে ধ্বংস হয় ফিলিস্তিনি জনপদ।
মনে কেবলই প্রশ্ন জাগে, কেন এই আগ্রাসন? এক দিকে স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবি, অন্য দিকে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য না করে নিষ্ঠুর ইসরাইলের আক্রমণ। জানা যায়, এবারের অপ্রতিহত আক্রমণে এক হাজার ৫০০ শিশু এতিম হয়েছে। এটি জাতিসঙ্ঘের হিসাব ও সরকারি হিসাবে ২ হাজার ১৬০ ফিলিস্তিনি নিহত ও ১১ হাজার আহত হয়েছেন। প্রায় অর্ধেক গাজাবাসী বাস্তুহারা হন। হাজার হাজার ঘর, মসজিদ, হাসপাতাল ও সমাধি বিধ্বস্ত হয়।
জাতিসঙ্ঘের পরিসংখ্যান মতে, অপারেশন প্রটেকটিভ এজ নামের অভিযানের ফলে গাজায় নতুন করে ১৫০০ শিশু এতিম হয়।
কিছু দিন আগে সংবাদপত্রে দেখেছি পাঁচ বছরের একটি শিশু ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে দু’হাতে তার ছোট বোনটিকে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করছে। ছয় বছরের মধ্যে তিনবার ইসরাইল গাজায় বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে। গাজার একমাত্র বড় এতিমখানা পরিবার হারানো নিঃসঙ্গ শিশুদের আশ্রয় দিচ্ছে, যতœ নিচ্ছে; কিন্তু সেখানেও হামলা হয়। সে হামলায় একজন নিহত হয়, অন্যজন হয় আহত। আমির হামাদ নামের একটি শিশুর কথা জানতে পারি। চার ভাইবোন ও বাবা-মায়ের সাথে তারা বাস করত। বাবা-মা সকালের নাশতার পরে কফি পান করছিলেন। এমন সময় একটি রকেট এসে পড়ে। আমিরের শিশু ভাইটি রক্তে ভাসছিল। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বাকি কয় ভাইবোন অলৌকিকভাবে রক্ষা পায়। এখন তারা দাদা-দাদীর সাথে বাস করছে। আমির জানে, বাবা-মা আর কোনো দিন ফিরে আসবেন না। তাই বেঁচে থাকার সাথে সাথে ভাইবোনদের কথাও তাকে ভাবতে হবে।
আশ্চর্য বিষয় এই যে, যে শিশুদের নিয়ে বিশ্বমানবতা স্বপ্ন দেখায় এবং স্বপ্ন দেখে, সেই শিশুদের নিয়ে ইসরাইলের নিষ্ঠুরতা অীচন্তনীয়। প্রতি মুহূর্ত মৃত্যুই তাদের নিকটতম প্রতিবেশী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের সহায়তা দিতে এগিয়ে আসেন যারা, তাদেরও জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কতটুকু? মানুষের পৃথিবীর মূল যুদ্ধ কী নিয়ে? ক্ষমতার লড়াই। আর সেই যুদ্ধকে উপলক্ষ করেই এক পক্ষ অন্য পক্ষকে উচ্ছেদ করতে যুদ্ধ লাগায়। এর পেছনে জোরালো যুক্তি কেবল তাদেরই হাতে। শক্তির প্রদর্শন। তা না হলে কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উপলক্ষ করে হিরোসিমা-নাগাসাকির ঘটনা ঘটত? কিন্তু মানুষের মনে যদি ঘৃণা আর ক্ষমতার এত তীব্র ও তীè সহাবস্থান না থাকত, তবে এত রক্তস্রোতে ভাসত না দুর্বল দেশগুলো। সম্প্রতি আবারো প্রতিবেশী দুর্বল দেশগুলো এভাবেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে চলেছে আর তার শিকার বিশেষ করে শিশুরা। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীজুড়ে শিশু অধিকার বজায় রাখার পক্ষে এত সমাবেশ, এত সহানুভূতি, এত আয়োজন তার অংশীদার হিসেবে যেকোনো দেশ গর্বিত হতে পারে; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সত্য স্বীকার করার সততা যদি থাকে, তাহলে নির্মম নিষ্ঠুরতার বহু চিত্রই বেরিয়ে আসবে, যা লক্ষ্য করে হৃদয়বান মানুষ হতবাক হয়ে যাবেন।
যুদ্ধাবস্থা অথবা শান্তির সময়েও আমরা জাতিসঙ্ঘকে পাই সঙ্কট নিরসনের সহায়ক হিসেবে। যেমনটি ঘটছে গাজা উপত্যকায়। জাতিসঙ্ঘের সহায়তায় এতিম শিশুদের জন্য আশ্রয় ও বড় হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে জাতিসঙ্ঘ। মিডল ইস্ট মনিটর থেকে জানা যায়, বিসান দাবের নামে আট বছরবয়সী শিশুটি জানে না তার অপরাধ কী। তবুও সে এক আক্রমণে সবাইকে হারায়। শিশুটি বলে, আমাদের কাছে রকেট ছিল না। তবু আমার মা-বাবা ও সব ভাইবোন বেহেশতে চলে গেছেন। ইসরাইলি হামলার পরে সে ছয় ঘণ্টা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়েছিল। হাসপাতালকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারি, এই শিশুটিও সবাইকে হারিয়েছে। ব্যাপারটা এমনভাবে ঘটেছে যে, শোকদীর্ণ শিশুরা কাঁদে না, চিৎকার করে না। নিরাসক্তভাবে ঘটনাটা শ্রোতাকে বর্ণনা করে। থেকে থেকে ভয়ে-আতঙ্কে তার ভেতরটা কেঁপে ওঠে। তার মতো কয়েক লাখ শিশু এখন গাজায়। মা-বাবা হারানো এই এতিমদের বোবা কান্নায় আকাশও যেন ভারী হয়ে আছে।
এসব শিশু যখন সময়ের নিয়মে বড় হয়ে উঠবে, তখন কি তার ভেতরে এক ভীত, আতঙ্কিত একজন মানুষ জন্ম নেবে না? কোনো দিন কি এই শিশুরা প্রতিশোধস্পৃহায় ফুঁসে উঠবে না? সে কি প্রশ্ন করবে না, স্বাধীন দেশের জন্য আশা আর স্বপ্ন তৈরি করা কি অপরাধ? আমার মনে পড়ে ছেলেবেলায় মহররমের মিছিলে শিয়া সম্প্রদায় বিশাল শোকমিছিল বের করত। দুই হাতের অস্ত্র দিয়ে নিজেদের গায়ে আঘাত করত। সাথে থাকত দুলদুল ঘোড়া, যার সারা গায়ে আঁকা হতো অসংখ্য তীর। ইমাম হাসান, ইমাম হোসেন রাসূলুল্লাহ সা:-এর দৌহিত্র। দুই শহীদ ভাইয়ের স্মরণে এই তাজিয়া মিছিলে লোকের মাতম উঠত। ইতিহাসের এক দূরপনেয় কলঙ্কিত বেদনাবিধূর কাহিনীর স্মরণে মানুষ আহাজারি তোলে আজো। মূল কথা হলো, ক্ষমতার লড়াইয়ে নিষ্পাপ দুই তরুণ ভাইয়ের মৃত্যু মানুষ চিরকাল স্মরণ করে। অমর করে রেখে আজো শোকার্ত স্মৃতির কাছে মানুষকে ফিরিয়ে আনে।
এই মুহূর্তে ইতিহাসকে উপেক্ষা করে গাজায় ঘটে চলেছে হত্যার উৎসব। আমাদের হৃদয় যত আঘাতে বিদীর্ণ হোক, হত্যাকারীর হৃদয় তাতে দ্বিধাগ্রস্ত হবে না। শিশু হত্যার বিক্ষোভে ফেটে পড়লেও ইতিহাসের তাতে ভ্রƒক্ষেপ নেই। ‘শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা’,বলে কবির কলম যতই ফুঁসে উঠুক, ফেলানীর মৃত্যুর মতোই তার সুবিচার পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘকাল।
আজ তাই বিশ্ববিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখতে হয়Ñ কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন? সোনার শিশুদের এতিম করে ‘রোখে মানুষের দাবি’ এর উত্তর খুঁজে পাই না। তবু শিশুদের অশ্রু লাঞ্ছিত অসহায় মৃত্যু, অসহায় আত্মসমর্পণ থেকে একদিন হয়তো গর্জে উঠবে প্রতিশোধের আগুনে পোড়া এক হিংস্র নবীন জনপদ। তারা মোকাবেলা করবে নিষ্ঠুরতার সাথে নিষ্ঠুরতার অস্ত্র নিয়ে। অথবা মার খেতে খেতে প্রতিরোধহীন অসহায় মানবিকবোধ থেকে জেগে উঠবে ঘৃণার অস্ত্র। মানুষ ও সভ্যতার নিত্যনতুন অহমিকার মুখোমুখি দাঁড়াবে সে। বলবে, ‘যদি আমার কবিতা পরিশ্রমী শ্রমিকের হাতে হাতুড়ি এবং মুজাহিদের মুঠোয় বোমা হয়ে যায়।’ (ফিলিস্তিনি কবি দারবিশের লেখা থেকে নেয়া)
পৃথিবীতে যুগে যুগে, হাজার হাজার বছর ধরে সভ্যতা এসেছে রক্তস্রোত ও অগ্নিদাহকে ক্ষমতার সঙ্গী করে। গাজার নির্মম ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই ইতিহাস, যা মুখে বলেÑ ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ আর অসহায় মানুষ তাদের হাতেই মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। তাই বলতে হয়, সারা বিশ্ব কি ক্ষমা করবে এই হন্তারকদের, যারা মানবসভ্যতার সবচেয়ে অসহায় প্রজাতিকে হাসতে হাসতে তুলে দেয় মৃত্যুর হাতে? এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবার পবিত্র অঙ্গীকারকে পরিহাস করে?
কামনা করি, জেগে উঠকু বিবেক, মানুষ যেন বলতে পারে, ‘আমরা চোখ মেলে আর শিশুহত্যার নারকীয়তা দেখতে চাই না। ওরা কেন ওদের অজান্তে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ভোগ করবে?
সারা বিশ্বের শিশুদের কথা আজ নতুন করে ভাবতে হবে।
শত্রুর হাতে জীবনধ্বংসী যে অভিশাপ এই নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করছে, সারা বিশ্বের শিশুদের কথা মনে রেখে কামনা করিÑ আর নয় হিরোশিমা, আর নয় নাগাসাকি, আর নয় হত্যার মহোৎসব। শিশুদের কথা মনে রেখে গড়ে তুলি নতুন বিশ্ব, যেখানে ওরা মানুষ হওয়ার জন্য জায়গা পাবে। আজ জেগে উঠুক বিশ্বমানবতা। প্রতিরোধ সৃষ্টি করুক অন্যায় নরধম যজ্ঞের বিরুদ্ধে।
No comments