কথা না বলা সপ্তম দিন মধ্যরাতে by আন্দালিব রাশদী
বিশ্বাস
না হয় জরিপ চালিয়ে দেখতে পারেন অধিকাংশ সুন্দরী পাত্রী পুরোপুরি আবদুল
টাইপের একটি পাত্রকে বিয়ে করে থাকে। আবদুল শুধু আচরণে নয়, নামেও। আমার নাম
আবদুল খালেক। আমার স্ত্রীর নাম তাথৈ।
আবদুল খালেকের স্ত্রী তাথৈ চৌধুরী। হোয়াট অ্যা কনট্রাস্ট! তাথৈর বড় বোন অথৈ চৌধুরীর স্বামী মহরম আলী মিঞা। এমনই হয়ে থাকে।
আমার নামটা তাথৈর পছন্দ নয়। কেউ জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে যায়। স্বামীর নাম আবদুল খালেক লিখতে হবে- এমন একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে একটি ফর্মে ম্যারিটাল স্ট্যাটাস লিখেছে আনম্যারেড। তাথৈ নিজেই হাসতে হাসতে কথাটি বলে ফেলেছে।
আমিও জিজ্ঞেস করি, তাথৈ মানে কি? এটা কেমন নাম?
তাথৈ বলে, শোনোনি, তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমি দ্রিমি দ্রাম দ্রাম?
আবার জিজ্ঞেস করি, এর মানে কি?
তাথৈ বলল, বাবা জানে। আমার নাম বাবা রেখেছে।
আমার নামও বাবা রেখেছে। সমস্যা কোথায়?
তোমার নাম ইশতিয়াক আহমেদ হলে আমার কোনো সমস্যা ছিল না।
ইশতিয়াক আহমেদ কেন? আদনান সামি কিংবা ওয়াহিদ মুরাদ কিংবা শাফকাত রানা নয় কেন? এগুলো তো আরও চমৎকার নাম।
আমাদের ঝগড়ার শুরুটা এভাবেই।
তাথৈ গলা ফাটিয়ে বলে, তোমার ওয়াইফের নাম হওয়া উচিত ছিল রূপবান কিংবা চন্দ্রবানু।
আমিও চেঁচিয়ে বলি, ইউ শাট আপ। হু ইজ ইশতিয়াক আহমেদ? কে তোমার ইশতিয়াক আহমেদ?
তাথৈ বলে, যদি চুপ না করি, যদি না বলি, তাহলে কী করবে? তুমি কি করবে? তোমার দৌড় আমার জানা আছে।
আমি আবারও চেঁচাই, ইউ শাট আপ!
সে রাতে আমাদের কারোই খাওয়া হয়নি। তাথৈ বলল, তোমার মতো অমানুষের সঙ্গে এক বিছানায় শুতে আমার বয়েই গেছে। তোমার জন্য উপযুক্ত এমন একজন চন্দ্র কি সূর্যবানু খুঁজে নাও।
আমি বলি, দরকার হলে তাই নেব। তোমার সাজেশনের প্রয়োজন নেই। তোমাকে আমার চেনা হয়ে গেছে।
এই এগার মাসেই? তাথৈ জিজ্ঞেস করে।
হ্যা, যথেষ্ট হয়েছে।
আমার বাবা তিন এগার ৩৩ বছরেও আমার মাকে চিনতে পারেনি। আর তুমি ১১ মাসেই। তাথৈ ফ্রিজ থেকে এক বোতল ঠাণ্ডা পানি বের করে ঢোক ঢোক করে, প্রায় অর্ধেকটা শেষ করে বোতলটা নিয়ে পাশের রুমে ঢুকে সজোরে দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমি ছিটকিনি লাগানোর শব্দ শুনলাম।
আমি যথারীতি বেডরুমে। সকালের ঝগড়াটা এড়াতে বেডরুমের দরজাটা খুলে রাখি। তাথৈর টুথব্রাশ আরও কী সব এই রুমের সংলগ্ন বাথরুমে।
ভেবেছিলাম ঘুম হবে না, কিন্তু টিভির রিমোট কন্ট্রোলের বাটন টিপতে টিপতে এক সময় জিনিসটা হাত থেকে পড়ে গেল, আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। টিভির সুইচ অফ করা হয়নি, সারারাতই চলেছে। আমাদের বিয়েতে উপহার পাওয়া এলইডি টেলিভিশন। অথৈ দিয়েছে, তাথৈর বড়বোন অথৈ। আমার পুরনো রঙিন টিভিটা পাশের ঘরে, এখনও বেশ চলে। সমস্যা সামান্যই। রিমোট কন্ট্রোলের ব্যাটারির শক্তি কমে এসেছে, পাল্টাতে হবে। ভোরের দিকে সম্ভবত অভুক্ত থাকার কারণে ঘুম ভেঙে যায়। আমি নিঃশব্দে উঠে পড়ি, ফ্রিজ খুলি। এক পেয়ালা ঠাণ্ডা পায়েস খেয়ে আবার বিছানায় ফিরি আমি এবং দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ি।
সাড়ে সাত কি আটটার দিকে ঘুম ভাঙে। দরজার বাইরে নিশ্চয়ই পড়ে আছে আজকের খবরের কাগজ। ঠিক শিয়রের কাছে ভাঁজ করা একটি কাগজ। বিয়ের পর এটাই আমাকে লিখা তাথৈর প্রথম চিঠি। তারপর প্রতিদিন একটি চিঠি। জবাব দিতে হয় আমাকেও। গত ১১ মাস এতটাই কাছাকাছি ছিলাম যে কারোই চিঠিপত্র লেখার প্রয়োজন হয়নি। আমরা এখন দূরে সরে যাচ্ছি। দূরের মানুষকে যে চিঠি লিখতে হয়।
তাথৈর প্রথম চিঠি
শোনো, আমি অনেক সহ্য করেছি। আর পারব না। তোমার মতো অমানুষের সঙ্গে আর সংসার করা সম্ভব নয়। তুমি সবদিক দিয়ে আবদুল টাইপের মানুষ। আমার বোন ও বান্ধবীরা আমাকে সতর্ক করেছিল, আমি গায়ে মাখিনি, এখন মনে হয় ভুল করেছি। তবুও ভালো, বিয়ের ১১ মাস পরে ভুলটা বুঝতে পেরেছি। ১১ বছর পর হলে কী করতাম, জানি না। আমি চাই, সাতদিনের মধ্যে তোমার সঙ্গে ডিভোর্সের সব ফর্মালিটিজ শেষ হোক।
তোমার সঙ্গে আর কথা বলতে চাই না। মুখেও না ফোনেও না। তুমি যদি কোনো ডিভোর্স লইয়ারের সঙ্গে কথা বলতে চাও, বলতে পার। দু’একদিনের মধ্যে সব হিসাব-নিকাশ করে ফেলবে। এটা-ওটার অজুহাতে ডিভোর্স যেন পিছিয়ে না যায়। তোমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিনা।
ইতি তাথৈ।
আমার প্রথম চিঠি
তাথৈ, তোমাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই। তুমি কাজটা অনেক সহজ করে দিলে। ভুলটা আমারই। চন্দ্র কিংবা সূর্যবানু টাইপের কোনো মেয়েকে বিয়ে না করে তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছি। ঠিক করিনি। অবশ্য তোমার আমার বিয়েতে আমার ভূমিকা ছিল সামান্যই। তুমিই আমাকে টেনে-হিঁচড়ে মগবাজার কাজী অফিসে নিয়ে এসেছে, এমনকি কাজী অফিসের কর্মচারীদের একশ’ টাকা করে টিপস তুমিই দিয়েছ। বিয়ের পর দুইজন সাক্ষী ও কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীকে নিয়ে আমরা যখন চাইনিজ খাবার খাচ্ছি, তোমার বান্ধবী নেহরিন শুনিয়ে দিল, তাথৈ বিয়ে না করলে এমন একজন আবদুল খালেককে ঢাকা শহরের আর কোনো মেয়ে পাত্তাই দিত না। হয়তো ঠিকই বলেছে। কিন্তু আমাকে পাঠানো নেহরিনের দুটি প্রেমপত্র তোমাকে দেখিয়ে বিব্রত করতে চাইনি। এখনও চাই না। ১১ মাসে আমার এগার বছরের শিক্ষা হয়েছে।
সাতদিন কেন লাগবে? আমি তার আগেই সব চূড়ান্ত করে ফেলতে চাই। সাতদিন পর আমি তালাকটা সেলিব্রেট করতে চাই। মুক্তির আনন্দে সেলিব্রেশন। তোমার কাছ থেকে মুক্তি।
ভালো থেকো।
ইতি আবদুল খালেক
(পাশের রুমের বন্ধ দরজার তলা দিয়ে চিঠিটি ঠেলে দিয়েছিলাম। তাথৈ যে চিঠি পেয়েছে এবং পড়েছে দ্বিতীয় চিঠিই তার প্রমাণ।)
তাথৈর দ্বিতীয় চিঠি
বেশ, তোমাকে মুক্তি দিচ্ছি। আর আগে জানতে চাই, নেহরিন কবে তোমাকে চিঠি দিল। আমাদের বিয়ের আগে না পরে? আগে হোক পরে হোক চিঠি দুটো হবে কেন? তুমি নিশ্চয়ই প্রথমটার জবাব দিয়েছিলে? কাগজে-কলমে না হলেও অন্তত ইশারায় ওকে আস্কারা দিয়েছ। তুমি কি ভুলে গিয়েছিলে তোমার ঘরে বিয়ে করা বউ আছে? আমি ওই হারামজাদিকে দেখে নেব। তোমার আমার ডিভোর্সের আগেই ওকে জনমের শিক্ষা দেব।
টিপস আমিই দিয়েছি, কারণ আমি তোমার মতো ছোটলোক নই। বিয়ের মতো এমন একটা আনন্দের ঘটনায় আমি হাত গুটিয়ে রাখার মতো মেয়ে নই। অবশ্য তখন বুঝিনি জন্মের পরিণতি যেমন মৃত্যু, বিয়ের পরিণতি ডিভোর্স।
ডিভোর্স লইয়ারের সঙ্গে কথা বলেছে? না বলে থাকলে দরকার নেই। দেনাপাওনা নিয়ে আমি কোনো ঝামেলা করব না। তোমার হাত থেকে তো মুক্তি পাব!
ইতি তাথৈ
(দ্বিতীয় চিঠিটিও বিছানার ওপরই ছিল, ঘুম ভাঙার পর চোখে পড়ে। আমার দ্বিতীয় চিঠিটিও একইভাবে দরজার তলা দিয়ে ঠেলে দিয়েছি। পাছে নেহরিন অপদস্ত হয় এই আশঙ্কায় দ্বিতীয় চিঠিতে একটা মিথ্যে কথা লিখতেই হয়।)
আমার দ্বিতীয় চিঠি
তাথৈ,
উকিলের সঙ্গে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আইনকানুন আমার ভালো জানা আছে। টিপস নিয়ে তুমি আমাকে ছোটলোক বললে? এবার দেখবে তালাকটা হয়ে গেলে পিয়ন-চাপরাশিদের প্রত্যেককে পাঁচশ টাকা করে টিপস দেব। তুমি বিয়ে করে যত খুশি হয়েছে, ডিভোর্সে আমি তার পাঁচগুণ আনন্দ পাব, মনে রেখ।
আর একটা কথা- নেহরিনের ব্যাপারটা তোমাকে চটাবার জন্য বলেছি; চটাতে পেরেছি। তবে চিঠি সত্যিই পেয়েছি, অন্য কেউ লিখেছে। দেখতে সে নেহরিনের চেয়েও ভালো, তোমার চেয়েও। সেও তোমার অচেনা নয়।
আর একটা কথা, তোমার ক্লাস তো নটায়। এত সকাল সকাল বের হচ্ছ কেন? রাস্তাঘাটে কত ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। আমার টেনশন হয়।
অবশ্য তালাকের দিন যতই এগিয়ে আসছে, আমি ততই স্বস্তি পাচ্ছি।
ভালো থেকো।
ইতি আবদুল খালেক
তাথৈর তৃতীয় চিঠি
শোনো, আমার জন্য তোমার টেনশন হয়- এমন একটা ডাহা মিথ্যে কথা তুমি কেমন করে বললে? তুমি চাও খুব সকাল বেলা একটা দশটনি ট্রাক আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দ্রুত পালিয়ে যাক। তুমি তো কোনো না কোনোভাবে আমার হাত থেকে মুক্তি নিয়ে ওই বেশ্যাটাকে তোমার পাশে শোয়াতে চাচ্ছ। আমি নেহরিনের কথা বলছি না তুমি যার কথা ভাবছ আমি তার কথাই বলছি। তুমি ভেবেছ ডিভোর্সটা হয়ে গেলে আমি তোমার চেয়ে কম খুশি হব? তোমার ডাবল খুশি হব। পিয়ন-চাপরাশিদের এক হাজার টাকার একটা করে চকচকে নোট দেব। আমি দশ হাজার টাকা আলাদা করে রেখেছি।
আর একটা কথা শোনো, কাল সারারাত তোমার ঘরে লাইট জ্বলেছে। সারারাত কী করেছ? রাতজেগে অসুখবিসুখ বাধিয়ে আমাদের ডিভোর্সটা পিছিয়ে দিয়ো না যেন।
তুমিও ভালো থেকো।
ইতি তাথৈ
আমার তৃতীয় চিঠি
তাথৈ,
তোমার সঙ্গে ডিভোর্স হোক এটা চাই সত্যিই, কিন্তু তোমার মৃত্যু চাই না। মরে গেলে তো সব শেষ হয়েই গেল। আমি চাই তুমি বেঁচে থেকে শুনে যাও কে আমার পাশে তোমার জায়গাটিতে ঘুমায়। এটাই হবে তোমার বড় শাস্তি।
সারারাত লাইট জ্বেলে কী করেছি? তালিকা করেছি- ঘরের কোন জিনিসটা তোমার টাকায় কেনা, কোনটা আমার টাকায়। তোমারগুলো তুমি তো নেবেই, আমারগুলোও নিতে পার। ফ্রিজটা অবশ্য দুজনের টাকায় কেনা। ঠিক আছে, এটাও তোমার।
তুমি কি রাতে ঘুমোও না? নাকি আমার রুমের পাশে ঘুরঘুর করে গোয়েন্দাগিরি কর?
তোমার-আমার একটা জয়েন্ট ব্যাঙ্ক একাউন্ট আছে। ডিভোর্সের পর এটার কি হবে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ো। তোমার-আমার একটা যুগল পেইন্টিং আছে। আমার ছবিটা আমি রাখতে চাই, তোমারটা ক্যানভাসের মাঝ বরাবর কেটে দিয়ে দিতে পারি। তাতে আমারটার খানিকটা নষ্ট হয়ে যাবে, তোমারটাও। আমার সঙ্গে তোমার ছবি ভবিষ্যতে আমার সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করুক, এটা আমি চাই না।
দিনকাল খারাপ। সাবধানে চলাফেরা কর।
ইতি আবদুল খালেক
তাথৈর চতুর্থ চিঠি
আচ্ছা, তুমি নিজেকে কী ভাব? তোমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর তুমি জুলিয়া রবার্টসকে নিয়ে ঘুমোলে না সান্দ্রা বুলককে নিয়ে- তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। তোমার মতো আবদুল খালেকের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো বুয়ারও রাজি হবার কথা নয়।
কোনো প্রোট্রেটটা কাটাছেঁড়া করতে যেয়ো না। বরং ওটা আমি নিয়ে যাব। আমি চাই না আমার ছবিটা নষ্ট হোক।
আশ্চর্য! আজও দেখলাম তুমি বেডরুমের দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছ। কারণটা শুনতে পারি? তুমি ভেবেছ তাথৈ বেহায়ার মতো ঢুকে তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলবে, আই অ্যাম সো সরি। আই লাভ ইউ।
আমার বয়েই গেছে। দরজা ভালো করে বন্ধ করে ঘুমিয়ো। তোমার বেডরুমে যাবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। আমার টুথপেস্ট ব্রাশ, স্যানিটারি ন্যাপকিন, বডি স্প্রে, পারফিউম সবই এই রুমে নিয়ে এসেছি। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পার। আমি আপাতত মার সঙ্গে থাকব। কাল আমার রুমটা ঠিকঠাক করা হবে, বাথরুমটাও। তুমি তো আমাদের বিয়ের প্রথম দিকে কয়েকরাত ওখানেই ছিলে। রুমটা বেশ বড় তাই না?
ওই ছবিটা দেয়ালে টাঙিয়ে দেব। ফ্রিজটা দিতে পার, আমার রুমেই রাখব। তোমার প্রমোশনের কি হল? তোমাদের এমডি নাকি চাকরি হারাচ্ছেন?
রাতে মশারি টাঙাচ্ছো তো? এডিস মশা কিন্তু ড্যাঞ্জারাস। একবার হেমোরেজিক ডেঙ্গু হলে তোমাকে বাঁচানো যাবে না কিন্তু।
ভালো থেকো।
ইতি তাথৈ
আমার চতুর্থ চিঠি
তাথৈ,
তুমিই বা তোমার রুমের দরজায় ছিটকিনি লাগাও কেন? তোমার ধারণা দরজা খোলা রাখলে আমি বেহায়ার মতো ঢুকে পড়ে তোমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরব? অসম্ভব! সেদিন চলে গেছে। আবদুল খালেকের চোখ খুলেছে।
থাক আজ আর লিখতে চাচ্ছি না। একটু মাথা ধরেছে, সামান্য টেম্পারেচারও আছে।
ভালোয় ভালোয় ডিভোর্সটা হয়ে থাক।
তুমি ভালো থেকো।
ইতি আবদুল খালেক
(আমাদের রান্নাঘরে চুলো জ্বলে না। আমরা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলি না। আমিও হোটেলে খাই, ফেরার সময় এটা ওটা কিনে আনি, ফ্রিজে রাখি। আমাদের দু’সেট চাবি। সমস্যা হয় না। আমাদের তালাক আসন্ন। তাথৈ আমার সঙ্গে আর থাকবে না। না থাকুক।)
তাথৈর পঞ্চম চিঠি
শোনো খালেক
আমার রুমের দরজার ছিটকিনি লাগাব কি না সেটা আমার ব্যাপার। তুমি জিজ্ঞেস করার কে?
সত্যি করে বল জ্বর বেশি না কম? মাথাব্যথা খুব বেশি? আমি তো এটাই সন্দেহ করেছিলাম। একটা না একটা অসুখ বাধিয়ে ডিভোর্সের বারোটা বাজাবে। তুমি মরো। তুমি মরলেই আমার শান্তি। আমি তোমার সঙ্গে একদিনও থাকতে চাই না।
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুটা বরং নিরাপদ। কিন্তু তোমারটা যদি হেমোরেজিক ডেঙ্গু হয় তাহলে দ্রুত তোমার রক্তের প্ল্যাটিলেট ভাঙতে থাকবে। তারপর ব্যাপারটা কী ভয়ঙ্কর তোমার কোনো ধারণা আছে? আমি তোমার লাশ নিয়ে কোথায় যাব? তুমি যে কী! কেন আমাকে এত কষ্ট দাও? অসহ্য। আমি আর পারব না। তোমার যা হবার হোক। আমি কেন ভাবতে যাব?
ভালো থেকো।
ইতি তাথৈ
আমার পঞ্চম চিঠি
তাথৈ,
আমার লাশ নিয়ে তোমার বিপাকে পড়ার সম্ভাবনা আর নেই। প্রথমত আমার মাথাব্যথা ও জ্বর প্রায় সেরে গেছে। আর একটা দিন পার হলে পুরোপুরি সেরে যাবে। ডেঙ্গু বাধাবার সেই ঘাতক মশাটা আমাকে চিনতে পারেনি। এটা ঠিক আমি মশারি টাঙাইনি, একদিনও। আমি সবসময়ই ধরে নিয়েছি এটা স্ত্রীর কাজ। স্বামীরও কিছু কাজ আছে- যেমন বাল্ব বদলান।
দ্বিতীয়ত পরশুদিনই আমাদের ব্যাপারটা ঘটবে। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। অ্যাডভোকেট গোলাম রহমান আমার পক্ষে আর অ্যাডভোকেট মিথিলা পারভিন তোমার পক্ষে বলবেন। আজই কিছু ফি-ও অ্যাডভান্স দেয়া হয়েছে। আজকের পর মাঝখানে আর মাত্র একটি দিন।
আমরা দুজন একসঙ্গে যাব না আলাদা যাব তুমিই ঠিক কর। আমি মনে করি আলাদা যাওয়াই ভালো। একসঙ্গে গেলে হঠাৎ এটা-ওটা নিয়ে কথাবার্তা হয়ে যেতে পারে। তাতে আমার সঙ্গে কথা না বলার তোমার যে ব্রত তা ভেঙে যাবে।
বিয়ের আগে আমাকে লেখা তোমার ২২টা চিঠি আর বইচাপা দেয়া ১৩টা শুকনো গোলাপ কালরাতে খুঁজে পেয়েছি। নিরপেক্ষ বিচারকের মতো তোমার প্রথম তিনটি চিঠি আবার পড়বে, তা হলে বুঝতে পারবে চিঠিগুলোর সাহিত্যমূল্যও আছে। এগুলো তুমি ফিরিয়ে নিলে ভালো হতো। নিজের হাতে এগুলো নষ্ট করতেও ইচ্ছা করছে না। আবার যে তোমার স্থলাভিষিক্ত হবে সে যে খুশিমনে এগুলোকে গ্রহণ করবে তাও নয়।
ভালো থেকো।
ইতি আবদুল খালেক
(আমাদের চুলোতে আগুন না জ্বলার খবরটি কোনোভাবে তাথৈর বড়বোন অথৈর কাছে পৌঁছেছে। আমি জ্বরের দোহাই দিয়ে অফিসে যাইনি। তাথৈর চারটার আগে ফেরার কথা নয়। কিন্তু কেন দেড়টায় ফিরল সেই ভালো জানে। ফিরে দেখল প্রচুর খাবার নিয়ে আসা অথৈ টেবিলে খাবার সাজিয়েছে আর আমি হাভাতের মতো সে খাবারের দিকে তাকিয়ে আছি। বোনকে দেখে তাথৈ চেঁচিয়ে বলল, তোকে খাবার নিয়ে আসতে কে বলেছে? আমি তোর সব খাবার ফেলে দেব।
অথৈও মুখের ওপর বলল, তোর জন্য খাবার কে বলেছে? আমি যার জন্য এনেছি সে খাবে।
তাথৈ বলল, এত দরদ! বেশ, তুই থাক। আমি চললাম। তাথৈ সত্যিই গটগট করে বেরিয়ে গেল। চেঁচিয়ে বলল, তুই একটা বেশ্যা।
অথৈ বলল, আমি তোমাদের সমস্যাটাকে আরও জটিল করে ফেললাম না তো?
না আপু, পরশু আমরা ডিভোর্স করছি। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। তাথৈ ডিভোর্স চাইছে, আমিও।
অথৈ অবাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। জিজ্ঞেস করল, তারপর? মানে তারপর একা থাকবে?
আমি বললাম, তাথৈ আর আমার ওয়েভলেঙ্গথ ভিন্ন। একই ওয়েভলেঙ্গথের কেউ রাজি হলে তখন দেখা যাবে।
অথৈ আমার প্লেটে খাবার দেয়, সবচেয়ে বড় রোস্টটা আমার জন্য তুলে আনে। অনেকদিন কেউ আমাকে এভাবে খাওয়ায়নি। রোস্টে কামড় বসিয়ে আমিও তার দিকে তাকিয়ে থাকি। জিজ্ঞেস করি, মহরম ভাইর ড্রিঙ্কিং হ্যাবিট কিছুটা হয়েছে? বাইপাস সার্জারি পর তো অনেক রেসস্ট্রিকশন থাকার কথা।
অথৈ বলল, এখন আরও বেড়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে রাশনা মুকতাদির। ওদের প্রবেশনারি অফিসার। দু’জন এক সঙ্গে ম্যাকাও থেকে ঘুরে এসেছে। জায়গাটা কোথায় তুমি জানো?
চীনের কাছাকাছি কোথাও, নাম শুনেছি।
অথৈ বলল, ওয়েভলেঙ্গথ একই কিন্তু দুই বাচ্চার মা হলে তোমার কোনো সমস্যা আছে? অবশ্য মহরম বাচ্চাদের ব্যাপারে খুব সেয়ানা, বাচ্চা হাতছাড়া করবে না।
আমি শুধু বললাম, আপু, মহরম ভাইর রাশনা ঘোর কেটে যাবে।
অথৈ বলল, তুমিও এড়িয়ে যেতে চাচ্ছো!
তাথৈর ষষ্ঠ চিঠি
শোনো খালেক, আজ আমার কাছে স্পষ্ট হল তোমার সেই মানসী হচ্ছে অথৈ আপু। যেভাবে মোটা হচ্ছে অথৈর ওজন একশ কেজি হতে বেশি বাকি নেই। দুই বাচ্চাসহ অথৈকে পালতে পারবে তো? বাচ্চা দুটোই পেছনে হাতির খরচ। অবশ্য অথৈকে তো তুমি আর আমার চেয়ে বেশি চেন না। ও প্রেম করেছে কবি টাইপের ঝোলাওয়ালা নাদিম ভাইর সঙ্গে। তারপর হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বাবা যখন মহরম দুলাভাইর মতো মালদার পার্টি হাজির করে অথৈ খুশিতে গদগদ হয়ে কবুল বলে ফেলে। তুমি তাকে যতই ভালোবাস গাড়িবাড়ি, এয়ার কন্ডিশনড রুম আর দুহাতে ছড়ানোর মতো টাকার উৎস ফেল অথৈ তোমার কাছে আসবে না, লিখে রাখতে পার। মালদার পার্টি কি আমার জন্য ছিল না? আমি তোমার সঙ্গে প্রেম করেছি, তোমাকেই বিয়ে করেছি। অবশ্য এটাও ঠিক, তুমি নাদিম ভাইর মতো ঝোলাওয়ালা হলে আমাকে পেতে না। আমি কবি টাইপের ছেলেদের দুচোখে দেখতে পারি না। তার চেয়ে আবদুল টাইপের ছেলেরা অনেক ভালো। কিন্তু তুমি আবদুল খালেক যে বিয়ের ১১ মাসেই এতটা স্মার্ট হয়ে উঠবে ভাবিনি- তুমি আমার হাত থেকে মুক্তি চাইছো!
যাকগে, একটা ভালো খবর দিচ্ছি। আমার কমনওয়েলথ স্কলারশিপ হয়ে গেছে, ম্যানচেস্টারে। ডেভিড হিউম আমার সুপারভাইজার হবেন। আজই কনফার্মেশন পেয়েছি। সেপ্টেম্বরের লাস্ট উইকে ফ্লাইট। কালপরশু টিকিট পেয়ে যাব। মানে বড়জোর আর এক মাস। আমার জন্য ভেব না। আমি সব ম্যানেজ করতে পারব। পিএইচডি হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাসিন্ট্যান্ট প্রফেসর করে দেবে।
সব শিডিউল ঠিক আছে তো? ডিভোর্সের দিন আমি তোমার সঙ্গে যাব না, আলাদাই যাব। কিন্তু আমাকে এখানে যেন দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে না হয়, খেয়াল রেখো।
তুমিও ভালো থেকো
ইতি তাথৈ
আমার ষষ্ঠ চিঠি
প্রিয় তাথৈ,
তোমাকে অভিনন্দন। আর ক’বছর পরই তুমি ডক্টর তাথৈ। আমার আর পড়াশোনা হবে না। ব্যাংকিং ডিপ্লোমাটাই পাস করতে পারলাম না। আমারও একটা খবর আছে। একটা অফশোর ব্যাংকে ইন্টারভিউর জন্য শর্টলিস্টেড হয়েছি। লন্ডন অফিস থেকে ফোনে জানিয়েছে। কনফার্মেশন মেইল কাল পাব।
সব শিডিউল ঠিক আছে। তোমার আলাদা যাওয়াটাই ভালো দেখাবে। আমি আগেই পৌঁছব। আমার বিরুদ্ধে তোমার অভিযোগগুলো ঢাকঢোল পিটিয়ে বল না। আমিও বলব না। তালাকটা দুজন যখন মেনেই নিয়েছি, যত শান্তিপূর্ণভাবে হয় ততই মঙ্গল। আমার মাথাব্যথা ও জ্বর সেরে গেছে। ম্যানচেস্টারের এখন শীত পড়বে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও হতে পারে। ঠাণ্ডা লাগিয়ো না, শরীরের যত্ন নিয়ো।
ভালো থেকো।
ইতি আবদুল খালেক
লিফট অকেজো থাকায় ঠিক আগের রাতে দশটার দিকে তাথৈ দু’হাত ভর্তি খাবারের প্যাকেট নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে পাঁচতলায় আমাদের ফ্ল্যাটের খুব কাছাকাছি এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। তার চিৎকার আমার কানে পৌঁছেনি। পাশের ফ্লাটের মিসেস রব্বানী তাকে তুলে এনে কলিংবেল টিপেন, আমাকে ধমকের স্বরে বলেন, নিজে আরামে শুয়ে আছেন আর বউটাকে দিয়ে বোঝা টানাচ্ছেন- দেখুন হাত-পা ভাঙলো কি না।
এতদিনের নীরবতা আমিই ভাঙি। জিজ্ঞেস করি, এতসব খাবারের বোঝা কেন এনেছ?
তাথৈ মাথা নিচু করে বলল, ভাবলাম ডিভোর্সের আগে তোমাকে নিয়ে শেষ খাবারটা একসঙ্গে খাই। দ্য লাস্ট সাপার।
তাথৈ পা টেনে টেনে ফ্রিজের দিকে এগোলো। বরফ লাগবে। না পেলে অন্তত ঠাণ্ডা পানি। দরজা টেনে তাথৈ চেঁচিয়ে উঠল, ফ্রিজে এত খাবার জমিয়েছ কেন?
আমিও মাথা নিচু করে বললাম, প্রত্যেকদিনই তো তোমার জন্য খাবার এনেছি, ভেবেছি যদি খাও। কিন্তু তুমি তো ফ্রিজও খোলোনি। আজকের খাবারটা ডাইনিং টেবিলে আছে।
তাথৈ বলল, তুমি খুব অপচয় কর। খাবার এনে রেখেছ তা বলবে তো?
কেমন করে বলি, তোমার সঙ্গে না কথা বন্ধ।
তাথৈ বলল, চিঠি তো বন্ধ ছিল না।
ফ্রিজে আধ বোতল ঠাণ্ডা পানিও ছিল না। বোতলসহ তাথৈর ডান পায়ের গোঁড়ালিও চেপে ধরি। তাথৈ চিৎকার করে ওঠে, আস্তে লাগাও, ব্যথা পাচ্ছি। মনে হয় ফ্র্যাকচার আছে।
আইস কিউব বানাবার পাত্রে পানি ঢেলে ডিপফ্রিজে ঢুকিয়ে দিই। আমার শরীরে ভর দিয়ে তাথৈ তার রুমে ফিরে আসে। বলে, পায়ে নিচে বালিশ দিয়ে আমাকে শুইয়ে দাও। আর খাবারটা গরম থাকতে থাকতে আমাকে খাইয়ে দাও, তুমিও খাও।
ফ্রায়েড রাইস, বিফ চিলি, প্রন বল আরও কী সব এক প্লেটে নিয়ে তাথৈর সামনে রাখি। তাথৈ বলে, তোমাকে এখানে রাখতে কে বলেছে, খাইয়ে দাও। পা’টা রাতারাতি না সারলে কাল যাব কেমন করে?
বললাম, এমন কিছু হয়নি। তোমার জন্য একটা গাড়ি ম্যানেজ করতে পারব। চিন্তা কর না। ডিভোর্সের এমন সুযোগ হাতছাড়া করা আমাদের কারও জন্যই লাভজনক হবে না।
তাথৈর মুখে খাবার দিতে গিয়ে টের পাই ও ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি নিঃশব্দে মশারি ছেড়ে তোষকে নিচের দিকটা গুঁজে দিই। এডিস মশার বিশ্বাস নেই। তাথৈর ঘরের আলো নিভিয়ে আমি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি সস্তা আবেগের ঊর্ধ্বে
থেকে মনে-প্রাণে চাইছি কাল আমাদের ডিভোর্সটা হয়ে যাক। তাথৈ কি তাহলে সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেছে? সিঁড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়া, পায়ের গোঁড়ালিতে ফ্র্যাকচার কিংবা অন্যকিছু সবই কি সাজানো নাটক? হতভম্ব মানুষের মতো কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে নেই। তাথৈর ককানোর শব্দে সম্বিত ফেরে। তাথৈ কাঁদতে থাকে। আমি আলো জ্বালি।
তাথৈ বলে, ব্যথা। প্রচণ্ড ব্যথা।
আমি মশারি তুলি। বালিশের ওপর গোড়ালির দিকে বেশ ফুলে উঠেছে। স্পর্শ করে দেখি জায়গাটা বেশ গরম। আমি দ্রুত ডিপফ্রিজ থেকে জমাটবাঁধা আইসকিউব নিয়ে আসি। আমি তাথৈর পায়ে বরফ চৌকো ঘষতে থাকি। কিছুক্ষণ পর তাথৈ বলে, এখন আরাম লাগছে।
আমি নতুন আরেক টুকরা বরফ হাতে নিই। তাথৈর পা-টা আমার কোলে নিয়ে আবার ঘষতে থাকি। পা শীতল হয়ে আসে, আমার হাতও ঠাণ্ডায় অসার হয়ে পড়ছে।
তাথৈ উঠে বসে। আমি চোখ তুলে দেখি তার অশ্রু টলটল চোখ। এক ফোঁটা দু’ফোঁটা করে কান্না ঝরতে শুরু করে। তাথৈ আমার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দেয়। আমার এক হাতে তখনও আধেক গলা আইস কিউব।
(দুই)
পরের দৃশ্যগুলো আমাদের দুজনকে বদলে দিতে থাকে। বরফ যুগের একজোড়া শীতার্ত নরনারী পরস্পরের কাছ থেকে উষ্ণতা শুষে নিতে থাকে। সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে আসা দুই একটি শব্দ আমাকে আকুল করে তোলে। প্লিজ আবদুল খালেক, আহ! আবদুল খালেক, শোনো না।
অনেকদিন পর তাথৈর শীৎকার আর তার হাঁপানোর শব্দ একাকার হয়ে যায়।
বহুদিন পর আমাদের প্রচণ্ড আবেগময় ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ার পর দুটি রহস্যময় চোখ মেলে তাথৈ বলল, কাল আমাদের না গেলে হয় না? পরে যাব অন্য কোনোদিন।
আমি জিজ্ঞেস করি, কবে?
তাথৈ বলল, আমার তো এখন ডেঞ্জার পিরিয়ড চলছে। যদি বাবুটা লেগেই যায়!
বাবুটা?
হ্যাঁ, আমাদের একটা বাবু হবে না? বাবুটা একটু বড় হোক, তারপর যাব, তোমার সঙ্গেই যাব। বাবুটার নাম কি রাখব জান? নাম রাখব ইশতিয়াক আহমেদ।
তার মানে?
কোনো মানে নেই। আমাদের ডিভোর্সটা কী অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে গেল? তাথৈ বলল, আর শোনো আবদুল খালেক, এখন থেকে আমরা এই সিঙ্গেল খাটেই ঘুমোব।
আমি আবার বলি, তার মানে?
তাথৈ বলল, বাবু হওয়ার আগে ডাবল খাট না হলেও চলবে।
আমাদের কথা না বলা ৭ম দিন মধ্যরাতে তাথৈর ভেতরের বাবু তৈরির কারখানাটি সচল হয়ে উঠেছে। ততক্ষণে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তার ম্যানচেস্টার যাত্রা।
তাথৈ বলে, অনিশ্চিত হবে কেন? তুমিও আমার সঙ্গে ম্যানচেস্টার যাবে। স্কলারশিপের টাকায় তোমার খরচও চলে যাবে। আমাদের বাবুটাকে বড় করতে হবে না। আবদুল খালেক আমাদের বাবুটার জন্য তোমার চেয়ে ভালো বেবিসিটার কোথায় পাব?
সপ্তম রাতে আমাদের চিঠি লেখালেখি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।
আবদুল খালেকের স্ত্রী তাথৈ চৌধুরী। হোয়াট অ্যা কনট্রাস্ট! তাথৈর বড় বোন অথৈ চৌধুরীর স্বামী মহরম আলী মিঞা। এমনই হয়ে থাকে।
আমার নামটা তাথৈর পছন্দ নয়। কেউ জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে যায়। স্বামীর নাম আবদুল খালেক লিখতে হবে- এমন একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে একটি ফর্মে ম্যারিটাল স্ট্যাটাস লিখেছে আনম্যারেড। তাথৈ নিজেই হাসতে হাসতে কথাটি বলে ফেলেছে।
আমিও জিজ্ঞেস করি, তাথৈ মানে কি? এটা কেমন নাম?
তাথৈ বলে, শোনোনি, তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমি দ্রিমি দ্রাম দ্রাম?
আবার জিজ্ঞেস করি, এর মানে কি?
তাথৈ বলল, বাবা জানে। আমার নাম বাবা রেখেছে।
আমার নামও বাবা রেখেছে। সমস্যা কোথায়?
তোমার নাম ইশতিয়াক আহমেদ হলে আমার কোনো সমস্যা ছিল না।
ইশতিয়াক আহমেদ কেন? আদনান সামি কিংবা ওয়াহিদ মুরাদ কিংবা শাফকাত রানা নয় কেন? এগুলো তো আরও চমৎকার নাম।
আমাদের ঝগড়ার শুরুটা এভাবেই।
তাথৈ গলা ফাটিয়ে বলে, তোমার ওয়াইফের নাম হওয়া উচিত ছিল রূপবান কিংবা চন্দ্রবানু।
আমিও চেঁচিয়ে বলি, ইউ শাট আপ। হু ইজ ইশতিয়াক আহমেদ? কে তোমার ইশতিয়াক আহমেদ?
তাথৈ বলে, যদি চুপ না করি, যদি না বলি, তাহলে কী করবে? তুমি কি করবে? তোমার দৌড় আমার জানা আছে।
আমি আবারও চেঁচাই, ইউ শাট আপ!
সে রাতে আমাদের কারোই খাওয়া হয়নি। তাথৈ বলল, তোমার মতো অমানুষের সঙ্গে এক বিছানায় শুতে আমার বয়েই গেছে। তোমার জন্য উপযুক্ত এমন একজন চন্দ্র কি সূর্যবানু খুঁজে নাও।
আমি বলি, দরকার হলে তাই নেব। তোমার সাজেশনের প্রয়োজন নেই। তোমাকে আমার চেনা হয়ে গেছে।
এই এগার মাসেই? তাথৈ জিজ্ঞেস করে।
হ্যা, যথেষ্ট হয়েছে।
আমার বাবা তিন এগার ৩৩ বছরেও আমার মাকে চিনতে পারেনি। আর তুমি ১১ মাসেই। তাথৈ ফ্রিজ থেকে এক বোতল ঠাণ্ডা পানি বের করে ঢোক ঢোক করে, প্রায় অর্ধেকটা শেষ করে বোতলটা নিয়ে পাশের রুমে ঢুকে সজোরে দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমি ছিটকিনি লাগানোর শব্দ শুনলাম।
আমি যথারীতি বেডরুমে। সকালের ঝগড়াটা এড়াতে বেডরুমের দরজাটা খুলে রাখি। তাথৈর টুথব্রাশ আরও কী সব এই রুমের সংলগ্ন বাথরুমে।
ভেবেছিলাম ঘুম হবে না, কিন্তু টিভির রিমোট কন্ট্রোলের বাটন টিপতে টিপতে এক সময় জিনিসটা হাত থেকে পড়ে গেল, আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। টিভির সুইচ অফ করা হয়নি, সারারাতই চলেছে। আমাদের বিয়েতে উপহার পাওয়া এলইডি টেলিভিশন। অথৈ দিয়েছে, তাথৈর বড়বোন অথৈ। আমার পুরনো রঙিন টিভিটা পাশের ঘরে, এখনও বেশ চলে। সমস্যা সামান্যই। রিমোট কন্ট্রোলের ব্যাটারির শক্তি কমে এসেছে, পাল্টাতে হবে। ভোরের দিকে সম্ভবত অভুক্ত থাকার কারণে ঘুম ভেঙে যায়। আমি নিঃশব্দে উঠে পড়ি, ফ্রিজ খুলি। এক পেয়ালা ঠাণ্ডা পায়েস খেয়ে আবার বিছানায় ফিরি আমি এবং দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ি।
সাড়ে সাত কি আটটার দিকে ঘুম ভাঙে। দরজার বাইরে নিশ্চয়ই পড়ে আছে আজকের খবরের কাগজ। ঠিক শিয়রের কাছে ভাঁজ করা একটি কাগজ। বিয়ের পর এটাই আমাকে লিখা তাথৈর প্রথম চিঠি। তারপর প্রতিদিন একটি চিঠি। জবাব দিতে হয় আমাকেও। গত ১১ মাস এতটাই কাছাকাছি ছিলাম যে কারোই চিঠিপত্র লেখার প্রয়োজন হয়নি। আমরা এখন দূরে সরে যাচ্ছি। দূরের মানুষকে যে চিঠি লিখতে হয়।
তাথৈর প্রথম চিঠি
শোনো, আমি অনেক সহ্য করেছি। আর পারব না। তোমার মতো অমানুষের সঙ্গে আর সংসার করা সম্ভব নয়। তুমি সবদিক দিয়ে আবদুল টাইপের মানুষ। আমার বোন ও বান্ধবীরা আমাকে সতর্ক করেছিল, আমি গায়ে মাখিনি, এখন মনে হয় ভুল করেছি। তবুও ভালো, বিয়ের ১১ মাস পরে ভুলটা বুঝতে পেরেছি। ১১ বছর পর হলে কী করতাম, জানি না। আমি চাই, সাতদিনের মধ্যে তোমার সঙ্গে ডিভোর্সের সব ফর্মালিটিজ শেষ হোক।
তোমার সঙ্গে আর কথা বলতে চাই না। মুখেও না ফোনেও না। তুমি যদি কোনো ডিভোর্স লইয়ারের সঙ্গে কথা বলতে চাও, বলতে পার। দু’একদিনের মধ্যে সব হিসাব-নিকাশ করে ফেলবে। এটা-ওটার অজুহাতে ডিভোর্স যেন পিছিয়ে না যায়। তোমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিনা।
ইতি তাথৈ।
আমার প্রথম চিঠি
তাথৈ, তোমাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই। তুমি কাজটা অনেক সহজ করে দিলে। ভুলটা আমারই। চন্দ্র কিংবা সূর্যবানু টাইপের কোনো মেয়েকে বিয়ে না করে তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছি। ঠিক করিনি। অবশ্য তোমার আমার বিয়েতে আমার ভূমিকা ছিল সামান্যই। তুমিই আমাকে টেনে-হিঁচড়ে মগবাজার কাজী অফিসে নিয়ে এসেছে, এমনকি কাজী অফিসের কর্মচারীদের একশ’ টাকা করে টিপস তুমিই দিয়েছ। বিয়ের পর দুইজন সাক্ষী ও কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীকে নিয়ে আমরা যখন চাইনিজ খাবার খাচ্ছি, তোমার বান্ধবী নেহরিন শুনিয়ে দিল, তাথৈ বিয়ে না করলে এমন একজন আবদুল খালেককে ঢাকা শহরের আর কোনো মেয়ে পাত্তাই দিত না। হয়তো ঠিকই বলেছে। কিন্তু আমাকে পাঠানো নেহরিনের দুটি প্রেমপত্র তোমাকে দেখিয়ে বিব্রত করতে চাইনি। এখনও চাই না। ১১ মাসে আমার এগার বছরের শিক্ষা হয়েছে।
সাতদিন কেন লাগবে? আমি তার আগেই সব চূড়ান্ত করে ফেলতে চাই। সাতদিন পর আমি তালাকটা সেলিব্রেট করতে চাই। মুক্তির আনন্দে সেলিব্রেশন। তোমার কাছ থেকে মুক্তি।
ভালো থেকো।
ইতি আবদুল খালেক
(পাশের রুমের বন্ধ দরজার তলা দিয়ে চিঠিটি ঠেলে দিয়েছিলাম। তাথৈ যে চিঠি পেয়েছে এবং পড়েছে দ্বিতীয় চিঠিই তার প্রমাণ।)
তাথৈর দ্বিতীয় চিঠি
বেশ, তোমাকে মুক্তি দিচ্ছি। আর আগে জানতে চাই, নেহরিন কবে তোমাকে চিঠি দিল। আমাদের বিয়ের আগে না পরে? আগে হোক পরে হোক চিঠি দুটো হবে কেন? তুমি নিশ্চয়ই প্রথমটার জবাব দিয়েছিলে? কাগজে-কলমে না হলেও অন্তত ইশারায় ওকে আস্কারা দিয়েছ। তুমি কি ভুলে গিয়েছিলে তোমার ঘরে বিয়ে করা বউ আছে? আমি ওই হারামজাদিকে দেখে নেব। তোমার আমার ডিভোর্সের আগেই ওকে জনমের শিক্ষা দেব।
টিপস আমিই দিয়েছি, কারণ আমি তোমার মতো ছোটলোক নই। বিয়ের মতো এমন একটা আনন্দের ঘটনায় আমি হাত গুটিয়ে রাখার মতো মেয়ে নই। অবশ্য তখন বুঝিনি জন্মের পরিণতি যেমন মৃত্যু, বিয়ের পরিণতি ডিভোর্স।
ডিভোর্স লইয়ারের সঙ্গে কথা বলেছে? না বলে থাকলে দরকার নেই। দেনাপাওনা নিয়ে আমি কোনো ঝামেলা করব না। তোমার হাত থেকে তো মুক্তি পাব!
ইতি তাথৈ
(দ্বিতীয় চিঠিটিও বিছানার ওপরই ছিল, ঘুম ভাঙার পর চোখে পড়ে। আমার দ্বিতীয় চিঠিটিও একইভাবে দরজার তলা দিয়ে ঠেলে দিয়েছি। পাছে নেহরিন অপদস্ত হয় এই আশঙ্কায় দ্বিতীয় চিঠিতে একটা মিথ্যে কথা লিখতেই হয়।)
আমার দ্বিতীয় চিঠি
তাথৈ,
উকিলের সঙ্গে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আইনকানুন আমার ভালো জানা আছে। টিপস নিয়ে তুমি আমাকে ছোটলোক বললে? এবার দেখবে তালাকটা হয়ে গেলে পিয়ন-চাপরাশিদের প্রত্যেককে পাঁচশ টাকা করে টিপস দেব। তুমি বিয়ে করে যত খুশি হয়েছে, ডিভোর্সে আমি তার পাঁচগুণ আনন্দ পাব, মনে রেখ।
আর একটা কথা- নেহরিনের ব্যাপারটা তোমাকে চটাবার জন্য বলেছি; চটাতে পেরেছি। তবে চিঠি সত্যিই পেয়েছি, অন্য কেউ লিখেছে। দেখতে সে নেহরিনের চেয়েও ভালো, তোমার চেয়েও। সেও তোমার অচেনা নয়।
আর একটা কথা, তোমার ক্লাস তো নটায়। এত সকাল সকাল বের হচ্ছ কেন? রাস্তাঘাটে কত ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। আমার টেনশন হয়।
অবশ্য তালাকের দিন যতই এগিয়ে আসছে, আমি ততই স্বস্তি পাচ্ছি।
ভালো থেকো।
ইতি আবদুল খালেক
তাথৈর তৃতীয় চিঠি
শোনো, আমার জন্য তোমার টেনশন হয়- এমন একটা ডাহা মিথ্যে কথা তুমি কেমন করে বললে? তুমি চাও খুব সকাল বেলা একটা দশটনি ট্রাক আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দ্রুত পালিয়ে যাক। তুমি তো কোনো না কোনোভাবে আমার হাত থেকে মুক্তি নিয়ে ওই বেশ্যাটাকে তোমার পাশে শোয়াতে চাচ্ছ। আমি নেহরিনের কথা বলছি না তুমি যার কথা ভাবছ আমি তার কথাই বলছি। তুমি ভেবেছ ডিভোর্সটা হয়ে গেলে আমি তোমার চেয়ে কম খুশি হব? তোমার ডাবল খুশি হব। পিয়ন-চাপরাশিদের এক হাজার টাকার একটা করে চকচকে নোট দেব। আমি দশ হাজার টাকা আলাদা করে রেখেছি।
আর একটা কথা শোনো, কাল সারারাত তোমার ঘরে লাইট জ্বলেছে। সারারাত কী করেছ? রাতজেগে অসুখবিসুখ বাধিয়ে আমাদের ডিভোর্সটা পিছিয়ে দিয়ো না যেন।
তুমিও ভালো থেকো।
ইতি তাথৈ
আমার তৃতীয় চিঠি
তাথৈ,
তোমার সঙ্গে ডিভোর্স হোক এটা চাই সত্যিই, কিন্তু তোমার মৃত্যু চাই না। মরে গেলে তো সব শেষ হয়েই গেল। আমি চাই তুমি বেঁচে থেকে শুনে যাও কে আমার পাশে তোমার জায়গাটিতে ঘুমায়। এটাই হবে তোমার বড় শাস্তি।
সারারাত লাইট জ্বেলে কী করেছি? তালিকা করেছি- ঘরের কোন জিনিসটা তোমার টাকায় কেনা, কোনটা আমার টাকায়। তোমারগুলো তুমি তো নেবেই, আমারগুলোও নিতে পার। ফ্রিজটা অবশ্য দুজনের টাকায় কেনা। ঠিক আছে, এটাও তোমার।
তুমি কি রাতে ঘুমোও না? নাকি আমার রুমের পাশে ঘুরঘুর করে গোয়েন্দাগিরি কর?
তোমার-আমার একটা জয়েন্ট ব্যাঙ্ক একাউন্ট আছে। ডিভোর্সের পর এটার কি হবে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ো। তোমার-আমার একটা যুগল পেইন্টিং আছে। আমার ছবিটা আমি রাখতে চাই, তোমারটা ক্যানভাসের মাঝ বরাবর কেটে দিয়ে দিতে পারি। তাতে আমারটার খানিকটা নষ্ট হয়ে যাবে, তোমারটাও। আমার সঙ্গে তোমার ছবি ভবিষ্যতে আমার সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করুক, এটা আমি চাই না।
দিনকাল খারাপ। সাবধানে চলাফেরা কর।
ইতি আবদুল খালেক
তাথৈর চতুর্থ চিঠি
আচ্ছা, তুমি নিজেকে কী ভাব? তোমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর তুমি জুলিয়া রবার্টসকে নিয়ে ঘুমোলে না সান্দ্রা বুলককে নিয়ে- তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। তোমার মতো আবদুল খালেকের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো বুয়ারও রাজি হবার কথা নয়।
কোনো প্রোট্রেটটা কাটাছেঁড়া করতে যেয়ো না। বরং ওটা আমি নিয়ে যাব। আমি চাই না আমার ছবিটা নষ্ট হোক।
আশ্চর্য! আজও দেখলাম তুমি বেডরুমের দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছ। কারণটা শুনতে পারি? তুমি ভেবেছ তাথৈ বেহায়ার মতো ঢুকে তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলবে, আই অ্যাম সো সরি। আই লাভ ইউ।
আমার বয়েই গেছে। দরজা ভালো করে বন্ধ করে ঘুমিয়ো। তোমার বেডরুমে যাবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। আমার টুথপেস্ট ব্রাশ, স্যানিটারি ন্যাপকিন, বডি স্প্রে, পারফিউম সবই এই রুমে নিয়ে এসেছি। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পার। আমি আপাতত মার সঙ্গে থাকব। কাল আমার রুমটা ঠিকঠাক করা হবে, বাথরুমটাও। তুমি তো আমাদের বিয়ের প্রথম দিকে কয়েকরাত ওখানেই ছিলে। রুমটা বেশ বড় তাই না?
ওই ছবিটা দেয়ালে টাঙিয়ে দেব। ফ্রিজটা দিতে পার, আমার রুমেই রাখব। তোমার প্রমোশনের কি হল? তোমাদের এমডি নাকি চাকরি হারাচ্ছেন?
রাতে মশারি টাঙাচ্ছো তো? এডিস মশা কিন্তু ড্যাঞ্জারাস। একবার হেমোরেজিক ডেঙ্গু হলে তোমাকে বাঁচানো যাবে না কিন্তু।
ভালো থেকো।
ইতি তাথৈ
আমার চতুর্থ চিঠি
তাথৈ,
তুমিই বা তোমার রুমের দরজায় ছিটকিনি লাগাও কেন? তোমার ধারণা দরজা খোলা রাখলে আমি বেহায়ার মতো ঢুকে পড়ে তোমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরব? অসম্ভব! সেদিন চলে গেছে। আবদুল খালেকের চোখ খুলেছে।
থাক আজ আর লিখতে চাচ্ছি না। একটু মাথা ধরেছে, সামান্য টেম্পারেচারও আছে।
ভালোয় ভালোয় ডিভোর্সটা হয়ে থাক।
তুমি ভালো থেকো।
ইতি আবদুল খালেক
(আমাদের রান্নাঘরে চুলো জ্বলে না। আমরা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলি না। আমিও হোটেলে খাই, ফেরার সময় এটা ওটা কিনে আনি, ফ্রিজে রাখি। আমাদের দু’সেট চাবি। সমস্যা হয় না। আমাদের তালাক আসন্ন। তাথৈ আমার সঙ্গে আর থাকবে না। না থাকুক।)
তাথৈর পঞ্চম চিঠি
শোনো খালেক
আমার রুমের দরজার ছিটকিনি লাগাব কি না সেটা আমার ব্যাপার। তুমি জিজ্ঞেস করার কে?
সত্যি করে বল জ্বর বেশি না কম? মাথাব্যথা খুব বেশি? আমি তো এটাই সন্দেহ করেছিলাম। একটা না একটা অসুখ বাধিয়ে ডিভোর্সের বারোটা বাজাবে। তুমি মরো। তুমি মরলেই আমার শান্তি। আমি তোমার সঙ্গে একদিনও থাকতে চাই না।
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুটা বরং নিরাপদ। কিন্তু তোমারটা যদি হেমোরেজিক ডেঙ্গু হয় তাহলে দ্রুত তোমার রক্তের প্ল্যাটিলেট ভাঙতে থাকবে। তারপর ব্যাপারটা কী ভয়ঙ্কর তোমার কোনো ধারণা আছে? আমি তোমার লাশ নিয়ে কোথায় যাব? তুমি যে কী! কেন আমাকে এত কষ্ট দাও? অসহ্য। আমি আর পারব না। তোমার যা হবার হোক। আমি কেন ভাবতে যাব?
ভালো থেকো।
ইতি তাথৈ
আমার পঞ্চম চিঠি
তাথৈ,
আমার লাশ নিয়ে তোমার বিপাকে পড়ার সম্ভাবনা আর নেই। প্রথমত আমার মাথাব্যথা ও জ্বর প্রায় সেরে গেছে। আর একটা দিন পার হলে পুরোপুরি সেরে যাবে। ডেঙ্গু বাধাবার সেই ঘাতক মশাটা আমাকে চিনতে পারেনি। এটা ঠিক আমি মশারি টাঙাইনি, একদিনও। আমি সবসময়ই ধরে নিয়েছি এটা স্ত্রীর কাজ। স্বামীরও কিছু কাজ আছে- যেমন বাল্ব বদলান।
দ্বিতীয়ত পরশুদিনই আমাদের ব্যাপারটা ঘটবে। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। অ্যাডভোকেট গোলাম রহমান আমার পক্ষে আর অ্যাডভোকেট মিথিলা পারভিন তোমার পক্ষে বলবেন। আজই কিছু ফি-ও অ্যাডভান্স দেয়া হয়েছে। আজকের পর মাঝখানে আর মাত্র একটি দিন।
আমরা দুজন একসঙ্গে যাব না আলাদা যাব তুমিই ঠিক কর। আমি মনে করি আলাদা যাওয়াই ভালো। একসঙ্গে গেলে হঠাৎ এটা-ওটা নিয়ে কথাবার্তা হয়ে যেতে পারে। তাতে আমার সঙ্গে কথা না বলার তোমার যে ব্রত তা ভেঙে যাবে।
বিয়ের আগে আমাকে লেখা তোমার ২২টা চিঠি আর বইচাপা দেয়া ১৩টা শুকনো গোলাপ কালরাতে খুঁজে পেয়েছি। নিরপেক্ষ বিচারকের মতো তোমার প্রথম তিনটি চিঠি আবার পড়বে, তা হলে বুঝতে পারবে চিঠিগুলোর সাহিত্যমূল্যও আছে। এগুলো তুমি ফিরিয়ে নিলে ভালো হতো। নিজের হাতে এগুলো নষ্ট করতেও ইচ্ছা করছে না। আবার যে তোমার স্থলাভিষিক্ত হবে সে যে খুশিমনে এগুলোকে গ্রহণ করবে তাও নয়।
ভালো থেকো।
ইতি আবদুল খালেক
(আমাদের চুলোতে আগুন না জ্বলার খবরটি কোনোভাবে তাথৈর বড়বোন অথৈর কাছে পৌঁছেছে। আমি জ্বরের দোহাই দিয়ে অফিসে যাইনি। তাথৈর চারটার আগে ফেরার কথা নয়। কিন্তু কেন দেড়টায় ফিরল সেই ভালো জানে। ফিরে দেখল প্রচুর খাবার নিয়ে আসা অথৈ টেবিলে খাবার সাজিয়েছে আর আমি হাভাতের মতো সে খাবারের দিকে তাকিয়ে আছি। বোনকে দেখে তাথৈ চেঁচিয়ে বলল, তোকে খাবার নিয়ে আসতে কে বলেছে? আমি তোর সব খাবার ফেলে দেব।
অথৈও মুখের ওপর বলল, তোর জন্য খাবার কে বলেছে? আমি যার জন্য এনেছি সে খাবে।
তাথৈ বলল, এত দরদ! বেশ, তুই থাক। আমি চললাম। তাথৈ সত্যিই গটগট করে বেরিয়ে গেল। চেঁচিয়ে বলল, তুই একটা বেশ্যা।
অথৈ বলল, আমি তোমাদের সমস্যাটাকে আরও জটিল করে ফেললাম না তো?
না আপু, পরশু আমরা ডিভোর্স করছি। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। তাথৈ ডিভোর্স চাইছে, আমিও।
অথৈ অবাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। জিজ্ঞেস করল, তারপর? মানে তারপর একা থাকবে?
আমি বললাম, তাথৈ আর আমার ওয়েভলেঙ্গথ ভিন্ন। একই ওয়েভলেঙ্গথের কেউ রাজি হলে তখন দেখা যাবে।
অথৈ আমার প্লেটে খাবার দেয়, সবচেয়ে বড় রোস্টটা আমার জন্য তুলে আনে। অনেকদিন কেউ আমাকে এভাবে খাওয়ায়নি। রোস্টে কামড় বসিয়ে আমিও তার দিকে তাকিয়ে থাকি। জিজ্ঞেস করি, মহরম ভাইর ড্রিঙ্কিং হ্যাবিট কিছুটা হয়েছে? বাইপাস সার্জারি পর তো অনেক রেসস্ট্রিকশন থাকার কথা।
অথৈ বলল, এখন আরও বেড়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে রাশনা মুকতাদির। ওদের প্রবেশনারি অফিসার। দু’জন এক সঙ্গে ম্যাকাও থেকে ঘুরে এসেছে। জায়গাটা কোথায় তুমি জানো?
চীনের কাছাকাছি কোথাও, নাম শুনেছি।
অথৈ বলল, ওয়েভলেঙ্গথ একই কিন্তু দুই বাচ্চার মা হলে তোমার কোনো সমস্যা আছে? অবশ্য মহরম বাচ্চাদের ব্যাপারে খুব সেয়ানা, বাচ্চা হাতছাড়া করবে না।
আমি শুধু বললাম, আপু, মহরম ভাইর রাশনা ঘোর কেটে যাবে।
অথৈ বলল, তুমিও এড়িয়ে যেতে চাচ্ছো!
তাথৈর ষষ্ঠ চিঠি
শোনো খালেক, আজ আমার কাছে স্পষ্ট হল তোমার সেই মানসী হচ্ছে অথৈ আপু। যেভাবে মোটা হচ্ছে অথৈর ওজন একশ কেজি হতে বেশি বাকি নেই। দুই বাচ্চাসহ অথৈকে পালতে পারবে তো? বাচ্চা দুটোই পেছনে হাতির খরচ। অবশ্য অথৈকে তো তুমি আর আমার চেয়ে বেশি চেন না। ও প্রেম করেছে কবি টাইপের ঝোলাওয়ালা নাদিম ভাইর সঙ্গে। তারপর হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বাবা যখন মহরম দুলাভাইর মতো মালদার পার্টি হাজির করে অথৈ খুশিতে গদগদ হয়ে কবুল বলে ফেলে। তুমি তাকে যতই ভালোবাস গাড়িবাড়ি, এয়ার কন্ডিশনড রুম আর দুহাতে ছড়ানোর মতো টাকার উৎস ফেল অথৈ তোমার কাছে আসবে না, লিখে রাখতে পার। মালদার পার্টি কি আমার জন্য ছিল না? আমি তোমার সঙ্গে প্রেম করেছি, তোমাকেই বিয়ে করেছি। অবশ্য এটাও ঠিক, তুমি নাদিম ভাইর মতো ঝোলাওয়ালা হলে আমাকে পেতে না। আমি কবি টাইপের ছেলেদের দুচোখে দেখতে পারি না। তার চেয়ে আবদুল টাইপের ছেলেরা অনেক ভালো। কিন্তু তুমি আবদুল খালেক যে বিয়ের ১১ মাসেই এতটা স্মার্ট হয়ে উঠবে ভাবিনি- তুমি আমার হাত থেকে মুক্তি চাইছো!
যাকগে, একটা ভালো খবর দিচ্ছি। আমার কমনওয়েলথ স্কলারশিপ হয়ে গেছে, ম্যানচেস্টারে। ডেভিড হিউম আমার সুপারভাইজার হবেন। আজই কনফার্মেশন পেয়েছি। সেপ্টেম্বরের লাস্ট উইকে ফ্লাইট। কালপরশু টিকিট পেয়ে যাব। মানে বড়জোর আর এক মাস। আমার জন্য ভেব না। আমি সব ম্যানেজ করতে পারব। পিএইচডি হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাসিন্ট্যান্ট প্রফেসর করে দেবে।
সব শিডিউল ঠিক আছে তো? ডিভোর্সের দিন আমি তোমার সঙ্গে যাব না, আলাদাই যাব। কিন্তু আমাকে এখানে যেন দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে না হয়, খেয়াল রেখো।
তুমিও ভালো থেকো
ইতি তাথৈ
আমার ষষ্ঠ চিঠি
প্রিয় তাথৈ,
তোমাকে অভিনন্দন। আর ক’বছর পরই তুমি ডক্টর তাথৈ। আমার আর পড়াশোনা হবে না। ব্যাংকিং ডিপ্লোমাটাই পাস করতে পারলাম না। আমারও একটা খবর আছে। একটা অফশোর ব্যাংকে ইন্টারভিউর জন্য শর্টলিস্টেড হয়েছি। লন্ডন অফিস থেকে ফোনে জানিয়েছে। কনফার্মেশন মেইল কাল পাব।
সব শিডিউল ঠিক আছে। তোমার আলাদা যাওয়াটাই ভালো দেখাবে। আমি আগেই পৌঁছব। আমার বিরুদ্ধে তোমার অভিযোগগুলো ঢাকঢোল পিটিয়ে বল না। আমিও বলব না। তালাকটা দুজন যখন মেনেই নিয়েছি, যত শান্তিপূর্ণভাবে হয় ততই মঙ্গল। আমার মাথাব্যথা ও জ্বর সেরে গেছে। ম্যানচেস্টারের এখন শীত পড়বে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও হতে পারে। ঠাণ্ডা লাগিয়ো না, শরীরের যত্ন নিয়ো।
ভালো থেকো।
ইতি আবদুল খালেক
লিফট অকেজো থাকায় ঠিক আগের রাতে দশটার দিকে তাথৈ দু’হাত ভর্তি খাবারের প্যাকেট নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে পাঁচতলায় আমাদের ফ্ল্যাটের খুব কাছাকাছি এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। তার চিৎকার আমার কানে পৌঁছেনি। পাশের ফ্লাটের মিসেস রব্বানী তাকে তুলে এনে কলিংবেল টিপেন, আমাকে ধমকের স্বরে বলেন, নিজে আরামে শুয়ে আছেন আর বউটাকে দিয়ে বোঝা টানাচ্ছেন- দেখুন হাত-পা ভাঙলো কি না।
এতদিনের নীরবতা আমিই ভাঙি। জিজ্ঞেস করি, এতসব খাবারের বোঝা কেন এনেছ?
তাথৈ মাথা নিচু করে বলল, ভাবলাম ডিভোর্সের আগে তোমাকে নিয়ে শেষ খাবারটা একসঙ্গে খাই। দ্য লাস্ট সাপার।
তাথৈ পা টেনে টেনে ফ্রিজের দিকে এগোলো। বরফ লাগবে। না পেলে অন্তত ঠাণ্ডা পানি। দরজা টেনে তাথৈ চেঁচিয়ে উঠল, ফ্রিজে এত খাবার জমিয়েছ কেন?
আমিও মাথা নিচু করে বললাম, প্রত্যেকদিনই তো তোমার জন্য খাবার এনেছি, ভেবেছি যদি খাও। কিন্তু তুমি তো ফ্রিজও খোলোনি। আজকের খাবারটা ডাইনিং টেবিলে আছে।
তাথৈ বলল, তুমি খুব অপচয় কর। খাবার এনে রেখেছ তা বলবে তো?
কেমন করে বলি, তোমার সঙ্গে না কথা বন্ধ।
তাথৈ বলল, চিঠি তো বন্ধ ছিল না।
ফ্রিজে আধ বোতল ঠাণ্ডা পানিও ছিল না। বোতলসহ তাথৈর ডান পায়ের গোঁড়ালিও চেপে ধরি। তাথৈ চিৎকার করে ওঠে, আস্তে লাগাও, ব্যথা পাচ্ছি। মনে হয় ফ্র্যাকচার আছে।
আইস কিউব বানাবার পাত্রে পানি ঢেলে ডিপফ্রিজে ঢুকিয়ে দিই। আমার শরীরে ভর দিয়ে তাথৈ তার রুমে ফিরে আসে। বলে, পায়ে নিচে বালিশ দিয়ে আমাকে শুইয়ে দাও। আর খাবারটা গরম থাকতে থাকতে আমাকে খাইয়ে দাও, তুমিও খাও।
ফ্রায়েড রাইস, বিফ চিলি, প্রন বল আরও কী সব এক প্লেটে নিয়ে তাথৈর সামনে রাখি। তাথৈ বলে, তোমাকে এখানে রাখতে কে বলেছে, খাইয়ে দাও। পা’টা রাতারাতি না সারলে কাল যাব কেমন করে?
বললাম, এমন কিছু হয়নি। তোমার জন্য একটা গাড়ি ম্যানেজ করতে পারব। চিন্তা কর না। ডিভোর্সের এমন সুযোগ হাতছাড়া করা আমাদের কারও জন্যই লাভজনক হবে না।
তাথৈর মুখে খাবার দিতে গিয়ে টের পাই ও ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি নিঃশব্দে মশারি ছেড়ে তোষকে নিচের দিকটা গুঁজে দিই। এডিস মশার বিশ্বাস নেই। তাথৈর ঘরের আলো নিভিয়ে আমি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি সস্তা আবেগের ঊর্ধ্বে
থেকে মনে-প্রাণে চাইছি কাল আমাদের ডিভোর্সটা হয়ে যাক। তাথৈ কি তাহলে সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেছে? সিঁড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়া, পায়ের গোঁড়ালিতে ফ্র্যাকচার কিংবা অন্যকিছু সবই কি সাজানো নাটক? হতভম্ব মানুষের মতো কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে নেই। তাথৈর ককানোর শব্দে সম্বিত ফেরে। তাথৈ কাঁদতে থাকে। আমি আলো জ্বালি।
তাথৈ বলে, ব্যথা। প্রচণ্ড ব্যথা।
আমি মশারি তুলি। বালিশের ওপর গোড়ালির দিকে বেশ ফুলে উঠেছে। স্পর্শ করে দেখি জায়গাটা বেশ গরম। আমি দ্রুত ডিপফ্রিজ থেকে জমাটবাঁধা আইসকিউব নিয়ে আসি। আমি তাথৈর পায়ে বরফ চৌকো ঘষতে থাকি। কিছুক্ষণ পর তাথৈ বলে, এখন আরাম লাগছে।
আমি নতুন আরেক টুকরা বরফ হাতে নিই। তাথৈর পা-টা আমার কোলে নিয়ে আবার ঘষতে থাকি। পা শীতল হয়ে আসে, আমার হাতও ঠাণ্ডায় অসার হয়ে পড়ছে।
তাথৈ উঠে বসে। আমি চোখ তুলে দেখি তার অশ্রু টলটল চোখ। এক ফোঁটা দু’ফোঁটা করে কান্না ঝরতে শুরু করে। তাথৈ আমার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দেয়। আমার এক হাতে তখনও আধেক গলা আইস কিউব।
(দুই)
পরের দৃশ্যগুলো আমাদের দুজনকে বদলে দিতে থাকে। বরফ যুগের একজোড়া শীতার্ত নরনারী পরস্পরের কাছ থেকে উষ্ণতা শুষে নিতে থাকে। সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে আসা দুই একটি শব্দ আমাকে আকুল করে তোলে। প্লিজ আবদুল খালেক, আহ! আবদুল খালেক, শোনো না।
অনেকদিন পর তাথৈর শীৎকার আর তার হাঁপানোর শব্দ একাকার হয়ে যায়।
বহুদিন পর আমাদের প্রচণ্ড আবেগময় ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ার পর দুটি রহস্যময় চোখ মেলে তাথৈ বলল, কাল আমাদের না গেলে হয় না? পরে যাব অন্য কোনোদিন।
আমি জিজ্ঞেস করি, কবে?
তাথৈ বলল, আমার তো এখন ডেঞ্জার পিরিয়ড চলছে। যদি বাবুটা লেগেই যায়!
বাবুটা?
হ্যাঁ, আমাদের একটা বাবু হবে না? বাবুটা একটু বড় হোক, তারপর যাব, তোমার সঙ্গেই যাব। বাবুটার নাম কি রাখব জান? নাম রাখব ইশতিয়াক আহমেদ।
তার মানে?
কোনো মানে নেই। আমাদের ডিভোর্সটা কী অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে গেল? তাথৈ বলল, আর শোনো আবদুল খালেক, এখন থেকে আমরা এই সিঙ্গেল খাটেই ঘুমোব।
আমি আবার বলি, তার মানে?
তাথৈ বলল, বাবু হওয়ার আগে ডাবল খাট না হলেও চলবে।
আমাদের কথা না বলা ৭ম দিন মধ্যরাতে তাথৈর ভেতরের বাবু তৈরির কারখানাটি সচল হয়ে উঠেছে। ততক্ষণে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তার ম্যানচেস্টার যাত্রা।
তাথৈ বলে, অনিশ্চিত হবে কেন? তুমিও আমার সঙ্গে ম্যানচেস্টার যাবে। স্কলারশিপের টাকায় তোমার খরচও চলে যাবে। আমাদের বাবুটাকে বড় করতে হবে না। আবদুল খালেক আমাদের বাবুটার জন্য তোমার চেয়ে ভালো বেবিসিটার কোথায় পাব?
সপ্তম রাতে আমাদের চিঠি লেখালেখি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।
No comments