ছেলেবেলার ঈদের স্মৃতি by এমাজউদ্দীন আহমদ
অতীতের স্মৃতি সব সময় অত্যন্ত মধুর। হাজারো অনিশ্চয়তায় ভরা বর্তমানের জন্য অনেক সময় মনটা ফিরে যেতে চায় অতীতে। অতীতের সব কিছু যেন আনন্দময়, সুখকর, কাক্সিত হয়ে ভেসে ওঠে স্মৃতিতে। সবটাই যেন নির্মল। সময়টাই আকর্ষণীয়। ছেলেবেলার সব কথা স্মৃতিতে আসে না। তখনো দুঃখবোধ ছিল চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রে অপূর্ণতা। গালমন্দ যে ছিল না তা নয়; কিন্তু দীর্ঘ দিন পরে অতীতের অন্ধকারও স্মৃতিতে ভেসে ওঠে এক ঝিলিক উজ্জ্বল আলো হয়ে। সাত-আট বছর বয়স থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এখনো আমার স্মৃতিতে প্রায় স্পষ্ট, কোনো কোনোটা কিছুটা ঝাপসা হলেও বেশির ভাগই মনে পড়ে, বিশেষ করে ঈদের দিনের ঘটনাবলি ভুলি কিভাবে? বাবা-মা এবং বেশ ক’জন ভাইবোনের সমন্বয়ে ছিল আমাদের বড় পরিবার। দাদি বেঁচে ছিলেন সবার মুরুব্বি হয়ে। কথা কম বলতেন; কিন্তু যা বলতেন তা হুকুম যেন, অবশ্য পালনীয়। কৈফিয়ত তিনি তলব করতেন। স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলে তার কাছেই জবাবদিহি করতে হতো। স্কুল থেকে ফিরে কে কী খেলো তা-ও তার দৃষ্টিতে থাকত।
একটা কথা আজকের তরুণ-তরুণীদের জন্য বলা প্রয়োজন এবং তা হলোÑ তখন জীবন ছিল খুব সহজ সরল। লোকজনের চাহিদা ছিল অত্যন্ত সীমিত। গ্রামে জন্মগ্রহণ করি। উচ্চ মাধ্যমিকপর্যায় পর্যন্ত লেখাপড়াও গ্রামীণ পরিবেশে সমাপ্ত হয়। উচ্চ মাধ্যমিকপর্যায়ের পরবর্তীপর্যায়ে রাজশাহী কলেজের ছাত্র হই। রাজশাহী কলেজের পরে সোজাসুজি ঢাকায়। রাজশাহী শহরেও তখন ছিল গ্রামীণ ছাপ। বিদ্যুৎ ছিল বটে; কিন্তু বিদ্যুৎচালিত কলকব্জা ছিল না বললেও চলে।
গ্রামের বাড়িতে সন্ধ্যায় দুটো তিনটে বারান্দায় হেরিকেন জ্বলে উঠত। পড়াশোনা, বাড়ির কাজ (home work) হেরিকেনের আলোয় করতে হতো। কোনো কোনো দিন হেরিকেন জ্বালাতে হতো আমাকে, কোনো দিন আমার বড় বোন জ্বালাত। ঈদের রাত্রিতে শুধু বারান্দায় নয়, ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠত। এই ঘটনা ঘটত ঈদের ক’দিন আগে থেকেই। ওই কয় দিন পড়াশোনা না করলেও কেউ খবরদারি করতেন না। ঈদের দিনের জন্য মোটামুটি একধরনের রুটিন অনুসরণ করা হতো। ছেলেদের জন্য নতুন পাজামা, পাঞ্জাবি অথবা শার্ট, একজোড়া জুতা বাবা কিনে আনতেন মালদহ শহর থেকে। মেয়েদের জন্য শাড়ি এবং স্যান্ডেল, কারো কারো দাবি অনুযায়ী একগোছা রঙিন চুড়ি, বিভিন্ন রঙের ফিতা এবং তখনকার দিনে পাওয়া যেত এমন কিছু আবদার করা জিনিস।
গ্রামে প্রাত্যহিক বাজার ছিল না। মাইল তিনেক দূরে শনি ও মঙ্গলবারে হাট বসত। সেই হাট থেকে সপ্তাহের জন্য মাছ এবং গোশত কেনা হতো। সবজি আমাদের Kitchen garden-এ প্রচুর হতো। আমাদের বাড়িটা ছিল ছয় বিঘা জমির ওপর। পেছনে সবজির ক্ষেত এবং তার পরেই আম ও লিচুর বাগান। বাড়ির পূর্ব দিকে ছিল ছোট্ট একটা পুকুর। আমাদের বৈঠকখানা ছিল দু’টি। একটি ছিল বাড়ি-লাগোয়া। আব্বা তার ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে বসতেন। আরেকটা ছিল রাস্তার পাশে অর্থাৎ বাড়ির উত্তরে। আব্বা শিক্ষকতা করতেন। এ সুবাদে স্থানীয়পর্যায়ে কোনো গোলমাল হলে মীমাংসার ভার পড়ত তার ওপর। এ জন্য সেই বৈঠকখানা ছিল বড় এবং বাড়ির শেষ প্রান্তে।
আমার মনে আছে, যেহেতু ঈদগাহ ছিল আমাদের বাড়ি থেকে মাইল দেড়-দুই দূরে, তাই গরুর গাড়িতে আমাদের যেতে হতো। আমি তো যেতামই, আমার ছোট ভাইও যেত। আগেভাগে গিয়ে জামায়াতে শামিল হতাম। নামাজের পরে বাবা-মা এবং দাদিকে কদমবুসি করে সালাম করতাম। ঈদের দিনে যেসব বন্ধু-বান্ধব আশপাশের, তারা ছুটে আসত। মা অতি আদরে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন।
ঈদের জন্য আব্বা যা কিনে এনেছেন, তা যে যার মতো লুকিয়ে রাখত এ জন্য যে, অন্যরা দেখে ওগুলোকে যেন পুরনো না করে দেয়। জুতা পায়ে ঠিকমতো লাগছে কি না তা পরখ করার জন্য বিছানায় এক-দু’বার হেঁটে দেখতাম।
আমাদের গ্রামের মধ্যখানে জুমা মসজিদ। কোরবানির ঈদের দিনে মসজিদের উঠানেই হতো খাসি এবং গরু জবাই। তখনকার দিনে এসব অনুষ্ঠানে গ্রামের সবাই মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করতেন। গোশত তৈরি হলে নিয়মমাফিক দরিদ্র-মিসকিনদের জন্য তিন ভাগের এক ভাগ সুনির্দিষ্ট করা হতো। গ্রামে ওই সময় দেখেছি (১৯৪০-৪২ সময়কালে) মিসকিনদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। ফলে প্রত্যেকের ভাগে পড়ত বেশ পরিমাণ গোশত। চামড়া বিক্রির অর্থ গরিবদের জন্য ব্যয় হতো। মাঝে মাঝে গ্রামে ধর্মসংক্রান্ত জলসা বসতো। গ্রামের সর্দার যিনি তিনি এসব দেখাশোনা করতেন। আমাদের গ্রামের শেষ প্রান্তে ছোট্ট এক পাড়ায় কিছুসংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাস করতেন।
মুসলমানের ঈদেও তাদের অনেকেই আমাদের বাড়িতে আসতেন। আব্বা-আম্মা যতেœর সাথে তাদের জন্য প্রস্তুত খাবার পরিবেশন করতেন। আমার কয়েকজন বন্ধু ছিল। তারাও আসত। সবাই মিলে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে আমরা উপভোগ করতাম। স্কুল কয়েক দিন বন্ধ থাকায় আরো সুবিধা হতো।
আমাদের গ্রামের পশ্চিম মাথায় ছিল একটা মাঠ। এখন তা নেই। ওই মাঠে ঈদের দিন বিকেলে কোনো কোনো সময় ফুটবল খেলার ব্যবস্থা হতো। গ্রামের লোকজনের ভিড় সেই খেলাকে জীবন্ত করে তুলত।
আমার ছেলেবেলার ঈদের স্মৃতি অত্যন্ত আনন্দঘন। সবাইকে ঈদ মোবারক বলা, সমবয়সীদের সাথে কোলাকুলি করা, বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগÑ সব কিছু মিলিয়ে ঈদ হয়ে উঠত মহা-আনন্দের উৎসব। কোনো কোনো সময় খেলাধুলার আয়োজন করে সবাই মিলে মেতে ওঠা ছিল খুবই সুখকর। আধুনিককালের টেলিভিশন বা রেডিওর মাতামাতি ছিল না বটে, ছিল না নতুন নতুন মোবাইল বা অন্যান্য চিত্তাকর্ষক আধুনিক সাজসরঞ্জাম; কিন্তু ছিল আদি অকৃত্রিম আনন্দের ঘন আস্তরণ, সমাজব্যাপী।
একটা কথা আজকের তরুণ-তরুণীদের জন্য বলা প্রয়োজন এবং তা হলোÑ তখন জীবন ছিল খুব সহজ সরল। লোকজনের চাহিদা ছিল অত্যন্ত সীমিত। গ্রামে জন্মগ্রহণ করি। উচ্চ মাধ্যমিকপর্যায় পর্যন্ত লেখাপড়াও গ্রামীণ পরিবেশে সমাপ্ত হয়। উচ্চ মাধ্যমিকপর্যায়ের পরবর্তীপর্যায়ে রাজশাহী কলেজের ছাত্র হই। রাজশাহী কলেজের পরে সোজাসুজি ঢাকায়। রাজশাহী শহরেও তখন ছিল গ্রামীণ ছাপ। বিদ্যুৎ ছিল বটে; কিন্তু বিদ্যুৎচালিত কলকব্জা ছিল না বললেও চলে।
গ্রামের বাড়িতে সন্ধ্যায় দুটো তিনটে বারান্দায় হেরিকেন জ্বলে উঠত। পড়াশোনা, বাড়ির কাজ (home work) হেরিকেনের আলোয় করতে হতো। কোনো কোনো দিন হেরিকেন জ্বালাতে হতো আমাকে, কোনো দিন আমার বড় বোন জ্বালাত। ঈদের রাত্রিতে শুধু বারান্দায় নয়, ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠত। এই ঘটনা ঘটত ঈদের ক’দিন আগে থেকেই। ওই কয় দিন পড়াশোনা না করলেও কেউ খবরদারি করতেন না। ঈদের দিনের জন্য মোটামুটি একধরনের রুটিন অনুসরণ করা হতো। ছেলেদের জন্য নতুন পাজামা, পাঞ্জাবি অথবা শার্ট, একজোড়া জুতা বাবা কিনে আনতেন মালদহ শহর থেকে। মেয়েদের জন্য শাড়ি এবং স্যান্ডেল, কারো কারো দাবি অনুযায়ী একগোছা রঙিন চুড়ি, বিভিন্ন রঙের ফিতা এবং তখনকার দিনে পাওয়া যেত এমন কিছু আবদার করা জিনিস।
গ্রামে প্রাত্যহিক বাজার ছিল না। মাইল তিনেক দূরে শনি ও মঙ্গলবারে হাট বসত। সেই হাট থেকে সপ্তাহের জন্য মাছ এবং গোশত কেনা হতো। সবজি আমাদের Kitchen garden-এ প্রচুর হতো। আমাদের বাড়িটা ছিল ছয় বিঘা জমির ওপর। পেছনে সবজির ক্ষেত এবং তার পরেই আম ও লিচুর বাগান। বাড়ির পূর্ব দিকে ছিল ছোট্ট একটা পুকুর। আমাদের বৈঠকখানা ছিল দু’টি। একটি ছিল বাড়ি-লাগোয়া। আব্বা তার ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে বসতেন। আরেকটা ছিল রাস্তার পাশে অর্থাৎ বাড়ির উত্তরে। আব্বা শিক্ষকতা করতেন। এ সুবাদে স্থানীয়পর্যায়ে কোনো গোলমাল হলে মীমাংসার ভার পড়ত তার ওপর। এ জন্য সেই বৈঠকখানা ছিল বড় এবং বাড়ির শেষ প্রান্তে।
আমার মনে আছে, যেহেতু ঈদগাহ ছিল আমাদের বাড়ি থেকে মাইল দেড়-দুই দূরে, তাই গরুর গাড়িতে আমাদের যেতে হতো। আমি তো যেতামই, আমার ছোট ভাইও যেত। আগেভাগে গিয়ে জামায়াতে শামিল হতাম। নামাজের পরে বাবা-মা এবং দাদিকে কদমবুসি করে সালাম করতাম। ঈদের দিনে যেসব বন্ধু-বান্ধব আশপাশের, তারা ছুটে আসত। মা অতি আদরে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন।
ঈদের জন্য আব্বা যা কিনে এনেছেন, তা যে যার মতো লুকিয়ে রাখত এ জন্য যে, অন্যরা দেখে ওগুলোকে যেন পুরনো না করে দেয়। জুতা পায়ে ঠিকমতো লাগছে কি না তা পরখ করার জন্য বিছানায় এক-দু’বার হেঁটে দেখতাম।
আমাদের গ্রামের মধ্যখানে জুমা মসজিদ। কোরবানির ঈদের দিনে মসজিদের উঠানেই হতো খাসি এবং গরু জবাই। তখনকার দিনে এসব অনুষ্ঠানে গ্রামের সবাই মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করতেন। গোশত তৈরি হলে নিয়মমাফিক দরিদ্র-মিসকিনদের জন্য তিন ভাগের এক ভাগ সুনির্দিষ্ট করা হতো। গ্রামে ওই সময় দেখেছি (১৯৪০-৪২ সময়কালে) মিসকিনদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। ফলে প্রত্যেকের ভাগে পড়ত বেশ পরিমাণ গোশত। চামড়া বিক্রির অর্থ গরিবদের জন্য ব্যয় হতো। মাঝে মাঝে গ্রামে ধর্মসংক্রান্ত জলসা বসতো। গ্রামের সর্দার যিনি তিনি এসব দেখাশোনা করতেন। আমাদের গ্রামের শেষ প্রান্তে ছোট্ট এক পাড়ায় কিছুসংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাস করতেন।
মুসলমানের ঈদেও তাদের অনেকেই আমাদের বাড়িতে আসতেন। আব্বা-আম্মা যতেœর সাথে তাদের জন্য প্রস্তুত খাবার পরিবেশন করতেন। আমার কয়েকজন বন্ধু ছিল। তারাও আসত। সবাই মিলে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে আমরা উপভোগ করতাম। স্কুল কয়েক দিন বন্ধ থাকায় আরো সুবিধা হতো।
আমাদের গ্রামের পশ্চিম মাথায় ছিল একটা মাঠ। এখন তা নেই। ওই মাঠে ঈদের দিন বিকেলে কোনো কোনো সময় ফুটবল খেলার ব্যবস্থা হতো। গ্রামের লোকজনের ভিড় সেই খেলাকে জীবন্ত করে তুলত।
আমার ছেলেবেলার ঈদের স্মৃতি অত্যন্ত আনন্দঘন। সবাইকে ঈদ মোবারক বলা, সমবয়সীদের সাথে কোলাকুলি করা, বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগÑ সব কিছু মিলিয়ে ঈদ হয়ে উঠত মহা-আনন্দের উৎসব। কোনো কোনো সময় খেলাধুলার আয়োজন করে সবাই মিলে মেতে ওঠা ছিল খুবই সুখকর। আধুনিককালের টেলিভিশন বা রেডিওর মাতামাতি ছিল না বটে, ছিল না নতুন নতুন মোবাইল বা অন্যান্য চিত্তাকর্ষক আধুনিক সাজসরঞ্জাম; কিন্তু ছিল আদি অকৃত্রিম আনন্দের ঘন আস্তরণ, সমাজব্যাপী।
No comments