সব দুর্ভোগ সড়কপথে
ঈদে ঘরমুখী মানুষের যাত্রার মূল স্রোত
শুরু হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের পর। ট্রেন, লঞ্চে ঝামেলা কম থাকায়
আনন্দ নিয়েই বাড়ি গেছেন যাত্রীরা। তবে গতকালও সব দুর্ভোগ ছিল সড়কপথে।
বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রীদের।
রাজধানীর বিভিন্ন টার্মিনালে এসব গন্তব্যের যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়ক এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মহাসড়কের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটকেন্দ্রিক দীর্ঘ যানজট চলছে টানা চার দিন ধরে। চলছে দুর্ভোগও।
আজ শুক্রবার থেকে পবিত্র ঈদুল আজহা ও শারদীয় দুর্গাপূজার সরকারি ছুটি শুরু হচ্ছে। ফলে আজ সব পথেই ঘরমুখী যাত্রীদের চাপ বাড়বে।
গতকাল শেষ কর্মদিবসে দুপুরের পর থেকেই রাজধানীর তিনটি আন্তজেলা বাস টার্মিনাল, লঞ্চ টার্মিনাল এবং রেলস্টেশনের দিকে মানুষের স্রোত শুরু হয়। সন্ধ্যার পর তা আরও বেড়ে যায়। এতে টার্মিনালগুলোর আশপাশে যানজটের সৃষ্টি হয়।
বিভিন্ন বাস টার্মিনালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), সিটি করপোরেশন, পুলিশ ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে পর্যবেক্ষণ দল বসানো হয়েছে। তারা সচেতনতামূলক প্রচারপত্র বিতরণ করে। মহাখালী টার্মিনালে এই দলের সদস্য ইমদাদুল হক বলেন, কোনো পরিবহনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দুপুরে মহাখালী টার্মিনাল পরিদর্শনে যান। তিনি যাত্রীদের কুশল জানতে গেলে অনেকেই বেহাল সড়ক নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মন্ত্রী তাঁদের আশ্বস্ত করেন, আগামী মার্চের মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে আর দুর্ভোগ থাকবে না। তিনি দাবি করেন, মহাসড়কের বেহাল দশা নয়, যানজটের মূল কারণ কোরবানির পশুবাহী ট্রাক বিকল হওয়া।
বাস সময়মতো আসে না: গাবতলী বাস টার্মিনালের উল্টো দিকেই হানিফ পরিবহনের নিজস্ব টার্মিনাল। বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের বসার জন্য শামিয়ানা টানিয়ে চেয়ার পাতা হয়েছে। দুপুর সাড়ে ১২টায় গিয়ে দেখা যায়, চেয়ার পূরণ হওয়ার পরও অনেক যাত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। গরমে ঘামছেন আর উদ্বেগ নিয়ে ছোটাছুটি করছেন অনেকে।
সেখানে দেখা হয় আলেয়া বেগম ও শহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তাঁরা যাবেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সঙ্গে দুই শিশুসন্তান। আলেয়া বেগম দুই ছেলেকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন। শহিদুল ইসলাম বলেন, ছেলেরা বাসা থেকে যে আনন্দ নিয়ে বের হয়েছিল, গরমে তা অনেকটাই চলে গেছে। অধৈর্য হয়ে বারবার বলছে, কখন বাসে উঠব।
শহিদুল জানান, তিনি হানিফ পরিবহনের যে বাসের টিকিট কেটেছেন, সেটি ছাড়ার কথা ছিল সকাল ১০টায়। কিন্তু এখনো বাস আসেনি।
কাউন্টারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, অপেক্ষমাণ যাত্রীদের অনেকেই বাসের খবর জানতে সেখানে ভিড় করেছেন। একেকজন একেক পথের। কাউন্টারের ভেতরে একজন মাইকে বিভিন্ন কথা বলছেন। কিন্তু কোন বাস কখন আসবে, সে কথা জানাচ্ছেন না। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রীদের সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, বাস কখন আসবে?
এর মধ্যে রংপুরের একটি বাস এলে যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে উঠতে থাকেন। তাঁদের একজন সিরাজুল ইসলাম বলেন, মিরপুর থেকে সকাল সাতটায় এসেছেন। বাস ছাড়ার কথা ছিল আটটায়। সেই বাস এসেছে সাড়ে ১২টায়। ভাড়াও নিয়েছে বেশি।
হানিফ পরিবহনের চালক সাইফুল ইসলাম বলেন, তিনি সকালে যাত্রী নিয়ে রংপুর থেকে এসেছেন। বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে সাভারের নবীনগর পর্যন্ত যানজট ঠেলে ঠেলে আসতে হয়েছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গন্তব্যের একটি পরিবহনের কল্যাণপুর কাউন্টারেও অপেক্ষমাণ যাত্রীদের দেখা যায়। ওই কাউন্টারের কর্মকর্তা বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের দৌলতদিয়া প্রান্তে সাত-আট ঘণ্টার যানজটে পড়তে হচ্ছে। ঢাকায় থাকা কিছু বিকল্প বাস দিয়ে যাত্রীদের সামলানো হচ্ছে।
কল্যাণপুরে কেয়া পরিবহনের কাউন্টারের সামনেও ছিল যাত্রীদের ভিড়। গরমে-ক্লান্তিতে কাউকে কাউকে ঝিমুতে দেখা গেল। যাত্রী সায়েদা বেগম বলেন, বগুড়ায় যেতে সকাল সাড়ে ১০টার বাসের টিকিট কেটেছিলেন। কিন্তু বেলা একটায়ও বাস আসেনি। কখন আসবে তাও বলতে পারছে না কেউ।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সায়েদাবাদের পাশে মানিকনগরে স্টারলাইন পরিবহনের কাউন্টারে এবং সামনের সড়কে প্রচুর যাত্রীর ভিড় দেখা যায়। অধিকাংশেরই গন্তব্য ফেনী। তাঁদের অনেকে জানান, তাঁদের বাস বিকেল পাঁচটা থেকে সাতটার মধ্যে ছেড়ে যাওয়ার কথা। ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে যানজট এখন তেমন নেই বলে বাসগুলো সময়মতো ছাড়ছে। তবে বুধবার রাতেও ওই পথে যানজট ছিল।
একটু দূরে ইকোনো ও একুশে পরিবহনের কাউন্টারে বৃহত্তর নোয়াখালীর বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীদের ভিড় দেখা গেছে। বিকেল পাঁচটায় অফিস শেষ হওয়ার পর সায়েদবাদ টার্মিনালের দিকে মানুষের স্রোত আরও বাড়তে থাকে।
মহাখালী বাস টার্মিনালেও বিভিন্ন পথের যাত্রীদের টিকিটের দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে বাসের জন্য ক্লান্তিকর অপেক্ষার প্রহর গুনতে দেখা যায়। ময়মনসিংহ, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়াসহ বিভিন্ন পথের যাত্রীদের ছিল বাড়ি ফেরা নিয়ে উৎকণ্ঠা। তবে স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে তাঁরা এ কষ্ট মেনে নিচ্ছেন।
টিআর পরিবহনে নওগাঁয় যেতে বাসের জন্য অপেক্ষারত দীন ইসলাম বলেন, চারটায় বাস ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু পাঁচটায়ও সেই বাস আসেনি।
কমলাপুরে মানুষের স্রোত, পূর্বাঞ্চলে ট্রেনের সূচিতে টান: ভিড়ের কারণে দরজা দিয়ে উঠতে পারছিলেন না। আবার যেকোনো মুহূর্তে ছেড়ে দিতে পারে ট্রেন। শেষে উপায় না দেখে স্ত্রীকে কাঁধে তুলে জানালা দিয়ে ট্রেনে উঠিয়ে দিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন। নিজে উঠলেন এক কুলির কাঁধে চড়ে। এ দৃশ্য ছিল কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে রাজশাহীগামী সিল্কসিটি ট্রেনের। এটি কমলাপুর থেকে ছেড়ে যায় বেলা সাড়ে তিনটার দিকে। ট্রেনটির ইঞ্জিন, ছাদ ও দরজায় যাত্রীদের ঝুলে যেতে দেখা যায়। বিকেলের দিকে কমলাপুর স্টেশন থেকে নোয়াখালীর উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনেও উপচে পড়া ভিড় ছিল। উপকূলের কয়েকজন যাত্রী অভিযোগ করেন, ট্রেনে উঠে টিকিটে উল্লিখিত নম্বরের আসনই পাননি তাঁরা। রেলের কর্মকর্তাদের জানিয়েও লাভ হয়নি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুভ চৌধুরী বলেন, তাঁর মতো ২০ জন আসন পাননি। পরে তাঁরা ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের দরজায় বসে ভ্রমণ করছেন। সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া কালনী এক্সপ্রেসে তুলনামূলক ভিড় কম ছিল।
মিরসরাইয়ে একটি ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনটি নির্দিষ্ট সময়ের আড়াই ঘণ্টা পরে ছেড়ে যায়। চট্টগ্রাম পথের মহানগর গোধূলি ট্রেনটি রাত সাড়ে নয়টায়ও ছেড়ে যায়নি। এটি ছাড়ার কথা ছিল বিকেল সাড়ে চারটায়। বাকি ট্রেনগুলো গড়ে আধা ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে যায়।
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালেও ছিল যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। ভিড় ঠেলে আনন্দ নিয়েই লঞ্চে উঠেছেন তাঁরা। যাত্রী পূর্ণ করে লঞ্চগুলো ছেড়ে গেছে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন গন্তব্যে।
No comments